সন্দীপ পাণ্ড্যে
লেখক ২০০২ সালে ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী
বিজয়বার্তা দিয়ে আড়ম্বরে অযোধ্যার রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের উত্তরপ্রদেশ সরকার কেন যে লখনউ-এ আম আদমি পার্টির অফিস তালাবন্ধ করে নিজেদের এত নীচে নামাল, তা ভেবে অনেকেই থই পাচ্ছেন না। কেন সরকার অসুরক্ষিত বোধ করছে? যতই হোক, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে আম আদমি পার্টি বহিরাগত। উত্তরপ্রদেশ সরকার সম্ভবত আম আদমি পার্টির রাজ্যসভার সদস্য সঞ্জয় সিং-এর মন্তব্যে ঘাবড়ে যেতে পারে। দেশের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠান থেকে বাদ দেওয়াটাকে উনি বিজেপি-র দলিত-বিরোধী চরিত্রের অনুসারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সেই কারণে দলিত ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিবর্গের নেতারা ওঁর তারিফ করেছেন।
ওবিসি-র অন্তর্ভুক্ত রাজভর গোষ্ঠীর প্রতিনিধি সুহেলদেব-এর ভারতীয় সমাজ পার্টির নেতৃত্ব নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম পাঁচ বছর বিজেপি-র সহযোগী ছিল। এমনকি, ওমপ্রকাশ রাজভর ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন পরবর্তীকালে আম আদমি পার্টির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবেন। সঞ্জয় সিংও বলেছিলেন রাজ্যে অরাজকতা চলছে। অপরাধীদের উপর পুলিশের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই এবং পুলিসকেও বাগে আনতে পারছে না রাজ্য সরকার। উত্তরপ্রদেশ সরকারকে বর্ণনা করতে গিয়ে সঞ্জয় সিং বলেছেন এই সরকার উচ্চ-জাতির ঠাকুরদের সরকার। এই মন্তব্যটি সরকারকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। ঘটনাচক্রে, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং সঞ্জয় সিং এই ঠাকুর জাতিরই মানুষ।
সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির দিকে যদি তাকাই, বিশেষ করে প্রায় একশোজন অপরাধীকে মেরে ফেলে যোগী সরকারের মহান ঘোষণার পরে যে রাজ্যে সব অপরাধী হয় মৃত না হলে জেলে বন্দি, তাহলে দেখব, কানপুরে ২২শে জুন সঞ্জিত যাদবকে অপহরণ করা হল এবং পুলিশের উপস্থিতিতে ওঁর আত্মীয়স্বজনরা অপহরণকারীদের তিরিশ লাখ টাকার ফিরৌতি দিলেন। কিন্তু টাকা হাতবদলের আগেই সঞ্জিত যাদবকে হত্যা করা হয় এবং তাঁর মৃতদেহ পাণ্ডু নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ৩রা জুলাই কুখ্যাত বিকাশ যাদব আটজন পুলিশকে মেরে ফেলে এবং ১১ই জুলাই বিকাশ যাদব এবং ছয়জন অনুচর পুলিশ এনকাউন্টারে মারা যায়। ৬ই আগস্ট হাপুরে অপহরণ এবং ধর্ষণের পর একটি ছয় বছরের মেয়েকে মীরাটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে শিশুটি এখন চিকিৎসাধীন। ৭ই আগস্ট ষোল বছরের এক কিশোরীকে বাড়িওলির ভ্রাতুষ্পুত্র অনুপ যাদব শারীরিকভাবে নিগ্রহ করে এবং কিশোরীটি যখন কানপুরে গোবিন্দ নগর থানায় অভিযোগ জানাতে যায় তখন ইন্সপেক্টর অনুরাগ মিশ্র মেয়েটিকে জানায় যে তার সামনে নেচে দেখানোর পরেই অভিযোগ দায়ের করা হবে। মুখতার আনসারিকে গুলি মেরেছিল যে রাকেশ পাণ্ডে, তাকে লখনউতে গুলি করে মারা হল বিজেপি বিধায়ক কৃষ্ণানন্দ রাইকে হত্যার অপরাধে, যে মামলায় আদালত আগেই তাকে নির্দোষ বলে ছেড়ে দিয়েছে। বুলন্দশহরে লকডাউনের সময় ১০ই আগস্ট নিগ্রহের অভিযোগ দায়ের করবার পর গ্রেটার নয়ডায় মোটোরবাইক থেকে পড়ে মারা যায় আমেরিকা-ফেরত সুদীক্ষা ভাটি। বাগপতের প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক সঞ্জয় খোখর প্রাতঃভ্রমণের সময় খুন হন। আলিগড়ের গোন্ডা থানায় ঢুকে বিজেপি বিধায়ক রাজকুমার সহযোগি এবং তাঁর সহকর্মীরা এলাকার এসএইচও-র সঙ্গে বাগবিতণ্ডা করে চড় মারেন এবং সেই এসএইচও-কে সাসপেন্ড করা হয় আর এসপি (রুরাল)কে বিজেপি সাংসদ সতীশ গৌতমের চাপে বদলি করে দেওয়া হয়। ১৩ই আগস্ট শাম্লি জেলার উমরপুরে বারো বছরের কার্তিক খুন হয় এবং তাঁর নগ্ন দেহটি মাঠে পাওয়া যায়। ১৪ই আগস্ট লখিমপুর খিরি অঞ্চলে পাকারিয়া গ্রামে তেরো বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়। একই দিনে গোরখপুরে সতেরো বছরের এক কিশোরীকে দুই ব্যক্তি অপহরণ করে এবং ধর্ষণের পর গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে ছেড়ে দেয়। ১৪ই আগস্ট আজমগড়ের বাসগাও গ্রামের দলিত গ্রামপ্রধান পাপ্পু রামকে গ্রামের উচ্চবর্ণের মানুষরা মেরে ফেলে এবং পরে গণ্ডগোলের সময়ে একটি আট বছরের ছেলে পুলিশ জিপের চাকায় পিষে মারা যায়। জমি সংক্রান্ত বিবাদে ১৬ই আগস্ট গোরখপুরের গ্রামীণ এলাকায় অ্যাডভোকেট রাজেশ্বর পাণ্ডে তাঁর আত্মীয়ের আক্রমণে মারা যান। সেই দিনে প্রতাপগড়ের গ্রামীণ এলাকায় উকিলদের উপস্থিতিতে জমি সংক্রান্ত বিবাদ নিস্পত্তির সময় প্রতিবেশীদের গণপিটুনিতে প্রাণ হারান দয়াশঙ্কর মিশ্র এবং তাঁর ছেলে আনন্দ। উত্তরপ্রদেশের আইনশৃঙ্খলা যে বিপর্যস্ত, তা উল্লিখিত এই ঘটনাগুলি থেকে স্পষ্ট।
আইনশৃঙ্খলা বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ হল রাজ্য সরকার এখন বেছে বেছে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের মিথ্যা কেসে ফাঁসাতে ব্যস্ত। সোশ্যালিস্ট পার্টি (ইন্ডিয়া)-র উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সভাপতি অ্যাডভোকেট মহম্মদ সোয়েব, অল ইণ্ডিয়া পিপলস ফ্রন্ট-এর মুখপাত্র এবং অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার এস আর দারাপুরি, কংগ্রেস কর্মী সাদাফ জাফর এবং বেশ শতাধিক সমাজকর্মী এবং সাধারণ নাগরিকদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে বন্দি করা হয়েছে শুধু এই কারণে যে তাঁরা নাগরিক সংশোধনী আইন এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এছাড়াও আন্দোলনের সময়ে সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি নষ্ট করবার অভিযোগে এঁদেরকে রিকভারি নোটিস পাঠানো হয়েছে, আদালতে অভিযোগ প্রমাণের আগেই। ইউপি কংগ্রেস সভাপতি অজয় কুমার লাল্লুকে জেলে পাঠানো হয়েছে এই অপরাধে যে তিনি কয়েকটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত কাগজ জাল করে পার্টির তরফ থেকে রাজ্য সরকারকে দিয়েছিলেন লকডাউনের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য। ইউপি কংগ্রেসের মাইনরিটি সেল-এর সভাপতি শাহনওয়াজ আলমকে পরে জেলবন্দি করা হয়েছে অ্যান্টি-সিএএ এবং এনআরসি আন্দোলনে প্রতিবাদে অংশগ্রহণের অপরাধে। ‘ওয়্যার’ সংবাদ পোর্টালের সম্পাদক সিদ্ধার্থ বরদারাজনকে নোটিস দিতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ অযোধ্যা থেকে দিল্লিতে পৌঁছেছে এই জন্য যে উনি লকডাউনের মধ্যে অযোধ্যাতে রামনবমী উপলক্ষে মেলার জন্য সরকারি অনুমতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সঞ্জয় সিং-এর বিরুদ্ধে কেসগুলি সাজানো হচ্ছে এই বলে উনি বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নাকি প্ররোচনা দিচ্ছেন। লখনউ-এ আম আদমি পার্টির অফিসের দরজা যে তালাবন্ধ করা হয়েছে, তা দিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকার যে কোন কাজকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তা আর চাপা থাকছে না।
বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে এখন এই প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত মৌলিক অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য পুলিশকে সক্রিয় করে রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে অতি অল্প প্ররোচনার অপরাধে ভয় দেখানো হচ্ছে। যোগী আদিত্যনাথকে বুঝতে হবে যে অযোধ্যায় একটি মন্দির বানিয়ে রামরাজ্য নামক বহু-উচ্চারিত কল্পনাটি বাস্তব হবে না। ওনার ‘ঠোক দো’ নীতি (পুলিশ দিয়ে অপরাধীদের এনকাউন্টারে মেরে ফেলা) যেহেতু স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে, তাই ওঁকে সত্যিই এমন কোনও উপায়ের কথা ভাবতে হবে যাতে উত্তরপ্রদেশে তাঁর সরকার আইন ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় সাযুজ্য এনে বর্তমানের এই অরাজকতা বন্ধ করতে পারে।