অরুণাভ ঘোষ
লেখক আইনজ্ঞ, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা
বরিষ্ঠ আইনজীবী প্রশান্তভূষণকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক মামলাটির প্রসঙ্গে আমি শুধুমাত্র আইনি বাধ্যবাধকতার কথাগুলোই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
ভারতের সংবিধানের ১২৯ নং অনুচ্ছেদ এবং ২১৫ নং অনুচ্ছেদে যথাক্রমে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের ক্ষমতার কথা বলা আছে। এই অনুচ্ছেদগুলিতে বলা আছে আদালত অবমাননার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কোর্ট অবশ্যই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারে। অন্য কোনও নিম্ন আদালত আদালত অবমাননার শাস্তি দিতে চাইলে সেই মামলাটি তাকে হাইকোর্টে পাঠাতে হয়। এছাড়াও সংবিধানে ২২৬ ধারা বা ৩২ ধারা রয়েছে যা বিভিন্ন সাংবিধানিক অধিকারের কথা বলছে। পাশাপাশি আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার, যে মুহূর্তে সাংবিধানিক ধারা কোনও নির্দিষ্ট আইন হিসেবে পাশ হয়ে যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে ধারাটিকে ইন্টারপ্রেট করার জায়গাটা কিছুটা হলেও সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ কোনও সঙ্কটকে আইনি দিক থেকে দেখতে গেলে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট আইনে সে প্রসঙ্গে কী বলা আছে, সেটুকুই অনুসরণ করতে হবে৷
এখন কনটেম্পটস অফ কোর্ট অ্যাক্ট-এ সেকশন টু সি-তে ক্রিমিনাল কনটেম্পট-এর কথা বলা আছে। এখানে ‘scandalize, or tend to, scandalize and lower or tend to lower the authority of any court’ এই বাক্যবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে আদালতের অবমাননার কথা বলা আছে, কোনও ব্যক্তিবিশেষের প্রসঙ্গে কিছু উল্লেখ নেই। আমি যদি বিচারপতি থাকাকালীন কোর্টের বাইরে কোনও অন্যায় করি, তাহলে তা আমারই ভুল, কোর্টের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। একটা উদাহরণ দিই, যদি কোনও বিধায়ক বিধানসভার কোনও আইন বা প্রথা ভঙ্গ করেন, বিধানসভার ক্ষমতা আছে তাকে শাস্তি দেওয়ার। ২০০৩ সালে সৌগত রায়ের নামে একটি খবরের কাগজ আজেবাজে কথা লিখেছিল। তার ওপর ভিত্তি করে বোলপুরের এক বিধায়ক সেই কাগজের বিরুদ্ধে প্রিভিলেজ মোশন আনে। হাসিম আবদুল হালিম তখন বিধানসভার স্পিকার। আমি বিধানসভায় প্রশ্ন তুললাম, আচ্ছা, আমি যদি কাগজে লিখি যে কোনও এক মাননীয় বিচারপতিকে রেডলাইট এলাকায় দেখা যায়, সেটা সত্যি হোক বা না হোক, সেটা কি আদালত অবমাননা হবে নাকি মানহানি হবে? হালিম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এটা মানহানির বিষয় হবে। আমি কী বলতে চাইছি বুঝতে পেরে হালিম সাহেব তৎক্ষণাৎ সেই কাগজের বিরুদ্ধে আনা প্রিভিলেজ মোশনটা খারিজ করে দিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হার্লে ডেভিডসনে চড়ছেন না কীসে চড়ছেন এবং তা নিয়ে কে কী বলল, তার সঙ্গে আদালতের কোনও সম্পর্কই নেই। অতএব, এখানেও সেকশন টু সি প্রযোজ্য হচ্ছে না। এখানে কোর্ট কি কোনওভাবে অপমানিত হচ্ছে? হচ্ছে না৷ এবার ধরা যাক, তা সত্ত্বেও প্রশান্তভূষণকে সুপ্রিম কোর্ট শাস্তি দিল। কিন্তু, কনটেম্পট অফ কোর্ট আইনে যেমন শাস্তি দেওয়ার নিদান আছে, তেমনি এরই ১৯ নং ধারায় অভিযুক্তের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করারও ববন্দোবস্ত আছে। হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ যদি অপরাধীকে আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি দেয়, তাহলে উচ্চতর আদালতে এই শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করা যেতে পারে। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ শাস্তি বহাল রাখলে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যাবেন— এইরকম নানা পর্যায়ক্রমিক ধাপ আছে। কিন্তু প্রশান্তভূষণের ক্ষেত্রে যেহেতু অবমাননার মামলাটি স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেছেন, এক্ষেত্রে প্রশান্তভূষণের আর আপিল করার অধিকার রইল না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টেরই উচিত ছিল, তিন বিচারপতির বেঞ্চ যেহেতু নিজেদের রায় শুনিয়েছে, মামলাটি পাঁচ সদস্যের উচ্চতর বেঞ্চে পুনর্বিচারের জন্য পাঠানো। তা করা হল না। কেন হল না? সুপ্রিম কোর্টের একজন সদ্য-প্রাক্তন বিচারপতি, কুরিয়েন জোসেফ, সম্প্রতি এই প্রশ্নটি তুলেছেন। সব মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকক্ষকে এত কলঙ্কিত এর আগে কখনও হতে হয়নি।
শুধু সুপ্রিম কোর্ট নয়, সারা দেশেই ছোট বড় সমস্ত আদালতে বিচারপতিদের অবস্থান আর সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্রের বিদেশে গিয়ে চিকিৎসার খরচ নিয়ে একটা গুরুতর অভিযোগ হাওয়ায় ভাসছিল। সেটা গুজবও হতে পারে। আমি আরটিআই থেকে জানতে চাইলাম, এই অভিযোগ সত্য কি মিথ্যা। আজ পর্যন্ত তার কোনও উত্তর পাইনি। পরে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে বিচারপতিদের ব্যাপারে আরটিআই করা যাবে না। এরপরেও বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠলে আর কবে উঠবে৷
প্রশান্তভূষণ মামলায় ফিরে আসি। সুপ্রিম কোর্টের দশজন প্রাক্তন বিচারপতি এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের প্রবল সমালোচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে প্রাক্তন বিচারপতি মাননীয়া রুমা পালও আছেন। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিরাও এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, প্রধান বিচারপতির নিয়োগকর্তা যিনি, অর্থাৎ স্বয়ং ভারতের রাষ্ট্রপতি, আমরা যদি তাঁর সমালোচনা করতে পারি, তাহলে প্রধান বিচারপতির কাজের সমালোচনা করতে পারব না কেন?
আদালত অবমাননার শাস্তি হিসেবে প্রশান্তভূষণের সর্বোচ্চ ছ মাসের জেল হতে পারে, সঙ্গে হয়তো হাজার দুয়েক টাকার জরিমানা। প্রশান্তভূষণ জেলে খেটে বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু এই রায়ের ফলে সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তির যা চরম ক্ষতি হল, তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
ভারতীয় বিচারব্যবস্থা আজ একধরনের রক্তশূন্যতার শিকার একথা বললে ভুল হবে না। এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়ার বিচারপতিদের ট্র্যাক রেকর্ড যদি দেখা যায়, আমরা দেখব, এঁদের মধ্যে দু-চারজন ছাড়া (যেমন বিচারপতি নরিম্যান বা বিচারপতি চন্দ্রচূড় ইত্যাদি) কেউই সর্বোচ্চ মানের আইনজীবী ছিলেন না। তাই আজ নিজেদের অযোগ্যতা শাসকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দিয়ে ঢাকতে হচ্ছে৷ বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দলের সমর্থক না হলে বিচারপতি হিসেবে কলেজিয়াম তার নাম সুপারিশ করবে না— এটাই আজ অলিখিত নিয়ম। বিজেপি সরকারের এই নীতির জন্য এই মুহূর্তে দেশে চল্লিশ শতাংশ বিচারকের আসন খালি। দিল্লি দাঙ্গায় মানুষ মরছে, সুপ্রিম কোর্ট শীতের ছুটি ভেঙে ফিরে এসে জরুরি ভিত্তিতে কোনও রায় দিতে পারেন না। কাশ্মিরে ৮০০০ মানুষ গ্রেফতার হয়ে আটকে আছেন, সুপ্রিম কোর্টের কোনও হেলদোল নেই। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি নিয়ে প্রধান বিচারপতি গগইয়ের বেঞ্চ যে রায় দিল পাঁচজনের মধ্যে একজনেরও তা ওপেন কোর্টে পড়ে শোনানোর সাহস হল না। এমনই ‘সর্বসম্মত’ ছিল সেই রায়। এরকম আরও উদাহরণ দেওয়া যায় যা থেকে স্পষ্ট হবে যে ভারতের বিচারব্যবস্থা দেশের সংবিধানের প্রতি যথার্থ দায়বদ্ধতা দেখাতে পারছে না।
শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্ট বা অন্যান্য আদালত নয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের পদ থেকে শুরু করে আমাদের রাজ্যে বিশ্বভারতীর উপাচার্য নিয়োগ পর্যন্ত, প্রত্যেক জাতীয় গুরুত্বের প্রতিষ্ঠানে স্বজনপোষণের মাধ্যমে বিজেপি নিজেদের পছন্দের লোক বসাচ্ছে ও প্রতিষ্ঠানটির সর্বনাশ করে দিচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণা সংস্থাগুলিকে আগে অনুদান দেওয়া হত, এখন ধার দেওয়া হয়, অর্থাৎ পরে সে টাকা সরকারকে ফেরত দিতে হবে৷ একটি ব্যবসাবুদ্ধি-সর্বস্ব, সঙ্কীর্ণ, নীতিহীন সরকার আমাদের দেশের সর্বনাশ করে চলেছে৷ এদের ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারলে এই সমস্যার কোনও সমাধান সম্ভব নয়।
বরঞ্চ এই সমস্যার শিকড় যে কতখানি গভীরে, প্রশান্তভূষণের ঘটনা আমাদের সকলকে তা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল৷
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত
খুবই জরুরি লেখা। এমন লেখা আরও আসুক।