দীপসিতা ধর
লেখক জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত, ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ও নেতা
ওরা বড় হবে চড়বে গাড়ি
আর আমি কাটব ঘাস
জনপ্রিয় গানের লাইন। অনুপম রায়ের কলমে। গানের কথাগুলো বাস্তবসম্মত এবং যুক্তিযুক্ত। সব মানুষ তো আমাদের দেশে গাড়ি চড়েন না। কেউ কেউ বাসে, ট্রেনে, পায়ে হেঁটে বা সাইকেলেও দেশান্তরী হন। লকডাউন পরবর্তী সময়ে ভারতের বেশিরভাগ অভিবাসী শ্রমিকরাই এইভাবে পুরনো বাসায় ফিরতে চেয়েছেন। ক্লান্ত হয়ে রেললাইনে শুয়ে প্রাণ খুইয়েছেন। তবু তাঁদের অভিযান থামেনি। আসলে তাঁদের জন্য চলার কোনও বিকল্প নেই। তাই কিছু মানুষকে গাড়ি ছাড়াই চলার প্রস্তুতি রাখতে হয়। সেই প্রস্তুতি যদি হয় ছোটবেলা থেকেই, তবে অসুবিধা কোথায়?
৩৪ বছর পর নয়া শিক্ষানীতির আগমন— আগের দুটি শিক্ষানীতির ঠিক-ভুলের পর্যালোচনা, এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নীতি প্রণয়ন— এই দুটি মূল বিষয় ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি বা নেপ (২০২০)-র বিচার্য হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হিসেবনিকেশ মেলাবার বদলে নয়া শিক্ষানীতি কিছু বৈপ্লবিক পট পরিবর্তন এবং সেই পরিবর্তন আশু করার লক্ষ্যে যে পরিকাঠামো প্রয়োজন তার কোনওরকম হদিশ না দিয়েই সাঙ্গ হয়েছেন। পার্লামেন্টে পাশ না করেই মন্ত্রীসভা সিলমোহর দিয়েছেন। এখন গৌরচন্দ্রিকা না বাড়িয়ে দেখে নেওয়া যাক সমস্যা কোথায়।
স্কুলের রদবদল, তবে দায়ভার কার?
প্রাথমিক শিক্ষার শুরু এবার অঙ্গনওয়াড়ি থেকে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, সহায়িকা এবং সুপারভাইজার এবার পুরোদস্তুর দিদিমণি। কিন্তু মোদি সরকারের হিসেব বলছে, বিগত বছরের বাজেটে নিউট্রিশন স্কিম— যার আওতায় আসে আইসিডিএস-এর মতো সংস্থা— তার ব্যয়বরাদ্দ কমেছে প্রায় উনিশ শতাংশ। শূন্যপদের সংখ্যা মোট পদের ৫-৬ শতাংশ, সহায়িকাদের ক্ষেত্রে ৭-৮ শতাংশ এবং সুপারভাইজার ও অন্যান্য উঁচু পদে ৩০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। অর্থাৎ যাদের কাঁধে এই গুরুভার জুটতে চলেছে, তাদের ভিতই বেশ নড়বড়ে। আপনার শিশুর ভিত মজবুত হবে কী করে?
সরকারি স্কুলে শিক্ষকের কমতি, ছাত্র কমে যাওয়া স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। নেপ (২০২০) শূন্যপদ পূরণার ব্যাপারে উদাসীন। বরং তারা জোর দিচ্ছেন ‘কমিউনিটি ইন্টারভেনশন’-এ। এখন কমিউনিটি মানে কে? ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে কমিউনিটি মানে গ্রাম পঞ্চায়েত। আপনার পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। এ পঞ্চায়েতে আপনার জাত আপনার অধিকারের পাসওয়ার্ড। যে ব্রাহ্মণ, ভূমিহার বা রাজপুতরা আজও কিছু জাতের ছায়া মাড়ায় না, তারা স্কুলছুট দলিত, অন্ত্যজ পরিবারের সন্তানদের স্কুলমুখো করবে— এই ভাবনা এবং ব্যাঙ্কে ১৫ লাখ টাকা পাওয়া একই রকম কথা। তাই কমিউনিটির কাঁধে বন্দুক রেখে আসলে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলছে। যে দেশে এসসি-এসটি-ওবিসিদের মধ্যে স্কুলছুট ৩০ শতাংশের কাছাকাছি, সেই দেশের সরকারের এমন ঔদাসীন্য আসলে মনুযুগের প্রতিধ্বনি।
রদবদল স্নাতক স্তরেও
স্নাতক এখন চার বছরের— এফওয়াইইউপি (ফোর ইয়ার্স আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম)। এখানে অঙ্কটা সহজ আর উত্তরটা জানা। আগে যে ডিগ্রি পড়তে তিন বছরের খরচা জোটালেই হত, এখন সেখানে লাগবে অতিরিক্ত আর একটা বছর। তাই গরীব মা-বাবার কপালের ভাঁজে আরও একটা রেখার সংযোজন। এক বছরে সার্টিফিকেট, দু বছরে ডিপ্লোমা, তিন বছরে ডিগ্রির গল্প থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য চার বছরের ডিগ্রি আবশ্যিক। তাই আপনার ট্যাঁকের জোর না থাকলে যা পাচ্ছেন তাই নিয়ে মানে মানে কেটে পড়ুন। আসলে শিক্ষা তো আর আপনার অধিকার নয়, এটা একটা প্রিভিলেজ— সকলে পাবে না।
নেপ (২০২০)-তে ‘চয়েসে’র ছড়াছড়ি। ফিজিক্স থেকে হোম সায়েন্স— সব পড়া যাবে একসঙ্গে! বাংলার সঙ্গে জীববিজ্ঞান পড়ানো যাবে না এ-কথা তো আচার্য জগদীশ বোস বলে যাননি। সুতরাং ছাত্রছাত্রীরা ‘যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে’। তবে শিক্ষক পদের কী হবে? ধরা যাক, জুলজির সঙ্গে কেমিস্ট্রি আর কেউ ‘চুজ’ করছে না। তবে আমি সর্বক্ষণের কেমিস্ট্রি মাস্টার রেখে কী করব? আমার ভ্যারাইটি চাই। একই ডিজাইনে অনেকগুলো কালার। তাই আমি আপনার সঙ্গে চুক্তি করব। কন্ট্রাকচুয়াল টিচার, অ্যাড-হক ইত্যাদি নামে ডেকে স্থায়ী চাকরির ধারণাকেই তুলে দেব। কম দামে ভাড়ার শ্রমিক পেয়ে গেলে কেউ কি আর বেশি টাকা দিয়ে হাতি পুষবে? এমনিতেই আনন্দ তেলতুম্বড়ে হোন বা সাইবাবা, প্রফেসররা বড্ড বেশি কথা বলে ফেলছেন, একবার পকেটে টান পড়লেই গরীবের অধিকার রক্ষা নিয়ে কথা বলা বেরিয়ে যাবে! অন্তত নয়া শিক্ষানীতি সে কথাই বিশ্বাস করছেন দেখা যাচ্ছে। চাকরির অনিশ্চয়তা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ইউনিভার্সিটি পাশ তাজা মাথাগুলোকে মাথা নোয়ানো শ্রমিকে পরিণত করবে, এ-কথা সরকার অস্পষ্ট কিন্তু দৃঢ়ভাবে নয়া শিক্ষানীতির দু লাইনের মাঝখানে লিখেছেন।
উচ্চশিক্ষা— গরীবের প্রবেশ নিষেধ
স্কুলে তিনটি বোর্ড-পরীক্ষা, ভোকেশনাল ট্রেনিং, কলেজে ‘ইজি-এক্সিট’ বা ‘ইনস্টিটিউশনালাইজড ড্রপ-আউট’-এর পরেও যদি কিছু গরীবগুর্বো চাষামজুরের ব্যাটাবেটিরা কলেজ টপকে উচ্চশিক্ষায় পৌঁছে যায়, একটা বড় চেকপোস্ট লাগাতে হবে তাদের আটকাতে। তাই মুশকিল আসান ‘কমন এনট্রান্স টেস্ট’। হতে পারে আপনার গবেষণার বিষয় সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ, কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশের জন্য আপনার ওয়ালারস্টাইনের ওয়ার্ল্ড সিস্টেম থিওরির সম্যক ধারণা থাকতে হবে। এসব সূক্ষ্ম এবং শিক্ষার গুণমান সংক্রান্ত ‘অ-গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়গুলো যদি ছেড়েও দেওয়া যায়, তবে এই এন্ট্রান্স টেস্ট যে আসলে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে চলা কোচিঙের রমরমা ব্যবসায় চার চাঁদ লাগাবে সে নিয়ে কোনও ধন্দ থাকা উচিত নয়। বৃত্তি পেয়ে, টিউশনি পড়িয়ে, গয়না বেচে কলেজ টপকানো গেলেও এই কোচিং গেরো পেরোতে পারবেন না অনেকেই। অনেকে মানে যারা প্রথম প্রজন্মের সাক্ষর, গ্রামের প্রথম মেয়ে যে গবেষণা করার স্বপ্ন দেখেছিল তাদের গুড়ে পুরোটাই বালি।
এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। আনতে হবে ফরেন ইউনিভার্সিটি বিল। বিদেশের যদু-মধুদের ব্যবসা করতে দিতে হবে এ-দেশে। কারণ হলদিয়াতে হার্ভার্ড বা কাশীতে কেমব্রিজ হওয়ার সুযোগ নেই। ওনারা এমন ফ্র্যাঞ্চাইজি বা ক্যাম্পাস খোলায় বিশ্বাসী নন। তাই অ্যামিটি, অশোকা-র ধাঁচেই বেসরকারি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হবে। সেখানে পড়বেন রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো উচ্চবর্ণের, উচ্চশ্রেণির বাবুবিবিরা। কেউ কেউ অবশ্যই তাও বিদেশে যাবেন। কারণ স্টাডিইং অ্যাব্রড ইজ স্টিল আ কুল থিং। তাই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম খরচায় গুণগত শিক্ষা না, বরং শিক্ষাকে আরও বেশি অর্থের সমানুপাতিক করে তুলতে বদ্ধপরিকর নেপ (২০২০)।
৬০ পাতার খসড়া অনেক গালভরা কথায় ভরা। মাল্টিডিসিপ্লিনারি পড়াশোনায় জোরের কথা বলা হয়েছে। অথচ সেই মাল্টিডিসিপ্লিনারি উইমেন স্টাইজ-এর ফান্ড মোদি জমানায় কমেছে ইনস্টিটিউশনের ভিত্তিতে গড়ে প্রায় ৩০ লাখ। দলিত স্টাডিজ, এক্সক্লুশন স্টাডিজ-এর মতো ডিসিপ্লিন বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে টাকার অভাবে। মূর্তি বানানো সরকারের হাতে ছাত্র পড়ানোর টাকা নেই। অটোনমির নামে তুলে দেওয়া হচ্ছে সরকারি অনুদান। সরকার এখন ব্যবসা করবে— লোন দেওয়া হবে কলেজকে, কলেজকে ছাত্রদের পিষে সেই টাকা এনে দিতে হবে সরকারকে, তবেই আবার মিলবে পরবর্তী কিস্তি। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় বসবে বোর্ড অফ গভর্নরস, তাদের প্রেরণ করবে স্বয়ং কেন্দ্র সরকার। তোমার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল এক্সিকিউটিভ কমিটি-র জন্য বুড়ো আঙুল। গবেষণার বিষয় ঠিক করবে ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন— গোমূত্রে সোনা না কম দামে জ্বালানি, দেশের স্বার্থে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ ঠিক করে দেবে তারাই। হ্যাঁ বলে রাখি, ভারতবর্ষ গবেষণার পেছনে খরচ করে জিডিপি-র ০.৬৮ শতাংশ। না, সেটা বাড়ানোর কোনও লক্ষ্যমাত্রা নয়া শিক্ষানীতিতে নেই।
শেষ কথা
হামবোল্ট শিক্ষাকে নাগরিক তৈরির হাতিয়ার ভেবেছিলেন। আম্বেদকর-ফুলে-রোকেয়ারা শিক্ষাকে পিছিয়ে পড়া মানুষের অগ্রগতির সোপান হিসেবে দেখেছিলেন। আর মনু শিক্ষাকে দেখেছিলেন পুঁজি বা সম্পদ রূপে— যার বণ্টন গোহত্যার মতনই পাপ। এত শতাব্দী যাদের আঙুল কেটে, জিভ কেটে, অথবা কানে গরম সিসা ঢেলে দিয়ে ব্রহ্মার পা থেকেই তোমার সৃষ্টি বোঝানো হয়েছিল, আজ তাদের বংশধররাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার এমনকি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটিয়েছে। খালি প্রশ্ন আর প্রশ্ন। সব অসুর কালো কেন? রাম শম্বুকের গলা কাটল কেন? দলিতরা মন্দিরে ঢুকতে পারে না কেন? উচ্চবর্ণ ১৩ শতাংশ হয়েও সরকারি চাকরিতে ৮০ শতাংশ কেন? ভারতীয় সামন্তবাদী সমাজের একদম গোড়ায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আর তাই এদের আটকাতে এইসব নানা ফন্দিফিকির। ইউজিসি গাইডলাইনসের পরবর্তী সংযোজন এই নয়া শিক্ষানীতি।
এই শিক্ষানীতি গবেষক তো দূরের কথা, নাগরিকই বানাতে চায় না। চায় অর্ধদক্ষ শ্রমিক বানাতে। যার হাতেকলমে কাজ জানা থাকবে, কিন্তু মেধা থাকলেও উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি থাকবে না। শিক্ষা কম থাকলে সমস্যা কম— দরকষাকষির ক্ষমতা কম, মালিকের সঙ্গে ট্যাঁ ফোঁ করলেই সিধে ছাঁটাই, তার জায়গায় কাজ পেতে আরও অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে। এতে মালিকের সুবিধা, পুঁজির সুবিধা, সুবিধা পুঁজিপতি মালিকের বন্ধু সরকারের। A pool of desperate young labour at the disposal of the market— তার হাত-পা-পাকস্থলি সব এই বাজারের হাতে বাঁধা। পালাবার পথ নাই।