শিশুশিক্ষাকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে

মানবী মজুমদার

 


লেখক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস, কলকাতা-র সঙ্গে যুক্ত। বর্তমান নিবন্ধটি গত ২৫ জানুয়ারি ২০২০-তে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি-তে ইংরাজিতে প্রকাশিত হয়। লেখকের অনুমতিক্রমে কিছুটা সম্পাদিত আকারে আমরা লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করছি। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে লেখক লেখাটিতে একটি ভূমিকা সংযোজন করে দিয়েছেন।

 

 

 

 

শিশুশিক্ষা নিয়ে অনেক আলোচনা ও গবেষণা হয়ে চলেছে, এদেশে ও বিদেশে। অনেক মতামতের মধ্যে ক্রমশ জোরালো হচ্ছে এই ভাবনা যে শিশুমনের বিকাশের প্রস্তুতি শুরু হোক তাড়াতাড়ি (an early start)। কিন্তু আমাদের দেশে শৈশবও যে জাতপাত, লিঙ্গ ও শ্রেণিবৈষম্যের বন্ধনে বন্দি— তাই শুরুর প্রশ্ন জুড়ে যায় ন্যায্যতার দাবির সঙ্গে (a fair start)। আরও কথা ওঠে শিশুশিক্ষার প্রার্থিত রূপটি কী হবে তা নিয়ে (a fitting start)। সম্প্রতি ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতি (২০২০)-তে শিশুশিক্ষা নিয়ে কিছু প্রস্তাব আছে। বিষয়টি নিয়ে চর্চার সত্যিই প্রয়োজন— কিন্তু তা কি হবে শুধু শিক্ষাবিদদের মধ্যে বা অভিভাবকদের গৃহকোণে? না কি জরুরি দরকার গণ-আলোচনার, যাতে শিশুর অধিকারের প্রতি এযাবৎ উদাসীন গণতান্ত্রিক রাজনীতি খানিকটা নজর দিতে পারে? এসবের মূলে প্রোথিত রয়েছে একটি বুনিয়াদী প্রশ্ন— শিশুশিক্ষার উদ্দেশ্য কী হবে— আসন্ন শিক্ষার ঘোড়দৌড়ের জন্য প্রস্তুতি, যাতে মানবসম্পদ বাহ্যিক সম্পদের পথ সুগম করে, নাকি যাতে মুক্ত শিশুমনের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়? এই বিষয়ে অল্প কিছু কথা রাখলাম, যাতে তর্কবিতর্কের পালে খোলা হাওয়া লাগে।

 

শুরুর কথা

কিছু শিক্ষাবিদ বলছেন, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অর্থনৈতিক পুঁজির পাশাপাশি মানবসম্পদকেও ‘একুশ শতকীয় সম্পদের একটি রূপ’ হিসেবেই দেখা উচিত। যেহেতু সমাজে সম্পদজনিত এক বিকট বৈষম্য বিদ্যমান, ফলত, এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, শিক্ষার বিস্তার প্রকৃত প্রস্তাবে সেই বৈষম্য দূরীকরণের একটি অস্ত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়। ফলে শিশুশিক্ষা তাড়াতাড়ি শুরু করলে— তাকে মানবসম্পদ বা মানব-সক্ষমতার সারবস্তু যাই ভাবা হোক না কেন— তা শিক্ষা এবং নীতি নির্ধারণ, এই দুই ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আবার সন্তানদের শিক্ষা তাড়াতাড়ি শুরু করার ব্যাপারে বাবা-মায়ের যে আগ্রহ নেই, এমনটাও ভাবার কারণ নেই।

তবুও, এত কিছু আপাত-সঙ্গতির পরেও, অনেক জরুরি বিষয় থেকেই যায়। সেগুলি আবার অনুল্লেখিত এবং অপরীক্ষিতও বটে। যেমন, তাড়াতাড়ি শিক্ষা শুরু কি সমাজের সমস্ত স্তরের শিশুদের জন্যই ন্যায্য হবে? আরও যে বিষয়টি আগ্রহোদ্দীপক সেটি হল— বাচ্চাদের এই তাড়াতাড়ি শুরু করা শিক্ষার রূপটি কেমন হবে? সেটি কি আগামী স্কুলজীবনের একটি আনন্দদায়ক প্রস্তুতি হবে? নাকি, সামনে শিক্ষার যে ইঁদুর-দৌড় শুরু হবে তার উপযোগী হয়ে ওঠার জন্য কিছু যান্ত্রিক প্রস্তুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? আরও একটি প্রশ্ন— শিশুদের স্কুলের জন্য কে তৈরি করবে?

 

স্কুলের জন্য প্রস্তুতি এবং স্কুলের প্রস্তুতি

প্রথমেই স্পষ্ট বলে দেওয়া ভালো— বাজার বা বাণিজ্যের ওপর শিশুদের শিক্ষিত করে তোলার দায়ভার কেউ অর্পণ করেনি। বরং শিশুদের উচ্চমানের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিরই দায়িত্ব। সারা পৃথিবীতেই এই ব্যবস্থা প্রচলিত, এবং এটি যথেষ্ট কার্যকরী ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিতও বটে। আর আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে, যেখানে তীব্র সামাজিক বৈষম্য একটি জ্বলন্ত সত্য, সেখানে তো শিশুদের নিরাপত্তা এবং বিকাশের বিষয়গুলিতে সরকারের দায়িত্ব অস্বীকার করার পরিসরই বিশেষ থাকে না।

আমাদের একদিকে রয়েছে ভারতের শহরাঞ্চলগুলি— যেখানে এখন প্রি-স্কুল এডুকেশনের ক্ষেত্রে ‘অপরিপক্ব বেসরকারিকরণ’-এর একটা জয়যাত্রা চলছে। অন্যদিকে রয়েছে ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস (আইসিডিএস)-এর মতো সামাজিক প্রকল্পগুলি। দেখা যাচ্ছে, সমতার প্রেক্ষিতেই প্রথমটির বিরুদ্ধে দ্বিতীয়টি নিয়ে লড়ে যাওয়ার জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু সরকার-পরিচালিত প্রাক-স্কুল কেন্দ্রগুলির পক্ষে কথা বলার অর্থ এই নয় যে, তাদের যে ব্যাপক উন্নতির প্রয়োজন আছে সেটাকে অস্বীকার করা। দুটোই দরকার আইসিডিএস কেন্দ্রগুলির। তাদের পক্ষে দাঁড়াতেও হবে এবং তাদের উন্নতও করতে হবে। ভারতের দুটি বাছাই করা শহরে আইসিডিএস কেন্দ্রগুলিতে চালানো একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, বাচ্চারা প্রায় প্রতিদিনই তীব্র কেরোসিন শিখার পাশে বসেই ক্লাস করতে বাধ্য হয়। কারণ, আলাদা ঠিকঠাক কোনও রান্নাঘর নেই— রান্নাটা ক্লাসরুমেই হয়। এখানেই শেষ নয়। অনেক আইসিডিএস সেন্টারই স্থানীয় কোনও ক্লাবের একটা ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে তৈরি হয়েছে। ফলে সেখানে কোনও শৌচালয়ের ব্যবস্থা নেই, এবং বাচ্চাদের খোলা জায়গায় মলত্যাগে অভ্যাস করানো হয়। একবিংশ শতাব্দীর ভারতের শহরের কথা হচ্ছে, এবং আমরা শহুরে অপসারণ এবং অধিকারচ্যুতির এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি, কারণ আমরা ‘শহরে মানুষের অধিকার’ (হার্ভে এবং ওয়াকস্মুদ ২০১২)-এর ধারণায় বিশ্বাস করি, চেষ্টা করি “স্মার্ট সিটি” বানানোর— সেইরকম একটা পটভূমিতে দাঁড়িয়ে শিশুদের পড়াশোনার জন্য একটু ঠিকঠাক জায়গা দিতে এই যে প্রগাঢ় অবহেলা, এ পরিষ্কার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বিশেষত দরিদ্র শিশুদের জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলি কী অপরিসীম কৃপণ। বাচ্চাদের জন্য স্কুলগুলিকে প্রস্তুত করার চেয়ে আমরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করাতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছি।

 

যখন প্রি-স্কুলই পূর্ণাঙ্গ স্কুল

আইসিডিএস সেন্টারগুলি এক গুণগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন আমরা দেখলাম। তাদের সংস্থানের অভাবের চিরকালীন সঙ্কট, এবং বেসরকারি প্রি-স্কুলগুলির সমকক্ষ হয়ে ওঠার দাবি— এই হল তাদের চ্যালেঞ্জের স্বরূপ। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রি-স্কুলগুলিও— উচ্চ এবং নিম্ন উভয় মানেরই— এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের গুণগত চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়েছে। মজার বিষয় হল, এই চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তারা আদৌ ওয়াকিবহাল কিনা, বা ওয়াকিবহাল হলেও সচেতন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আসলে এই ধরনের বেশিরভাগ স্কুলগুলিই অপ্রকৃত ধরনের। তাদের দৈনন্দিন পড়াশোনার কুচকাওয়াজ, এমন পাঠ্যসূচি যা বয়সের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়, মানোপযোগী করে তোলার মাত্রাতিরিক্ত প্রয়াস এবং তাদের পরীক্ষাপদ্ধতি— কোনও কিছুই না শিশুদের সৃজনশীল বিকাশের স্বাভাবিক স্ফূরণ ঘটতে সাহায্য করে, না তাদের মধ্যে জ্ঞানের বৈচিত্র্য সন্ধান করে। তারা কোনওরকমে বাচ্চাদের আগেভাগেই ঠেলেঠুলে সেই “ফার্স্ট বয় সিনড্রোম” (সেন ২০১৫)-এর শিক্ষাপদ্ধতির জন্য তৈরি করে দিতে চায়। শিশুদের কৌতূহল, কল্পনা এবং গভীর চিন্তাভাবনার ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলতে তারা একদমই ব্যর্থ। এটিও অবশ্যই একটি বড়সড় গুণগত সঙ্কট। এবং আমরা— যারা বেসরকারি যে কোনও কিছুকেই উচ্চগুণসম্পন্ন বলে মনে করি, তারা এই দিকটি সম্পর্কে খেয়ালই করি না।

যে সমীক্ষাটির কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে সেটি শহর, মফস্বল এবং গ্রামীণ এলাকায় অনেকগুলি সরকারি এবং বেসরকারি প্রিস্কুল সেন্টারে ক্লাসরুমে কীভাবে পড়ানো এবং শেখানো হয় তা অধ্যয়ন করেছে, যে-সমস্ত বইপত্র এবং শেখানোর জিনিস ব্যবহৃত হয় সে-সবের নমুনা সংগ্রহ করেছে, এবং যে-সব পদ্ধতিতে এই সেন্টারগুলি বাচ্চাদের অগ্রগতি পরিমাপ করে সেগুলিও পরীক্ষা করে দেখেছে। তাতে দেখা গেছে পরিকাঠামোগত অনেক অসুবিধার মধ্যেও অনেক অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রই নানারকম উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাচ্চাদের শেখায়। ফলে বাচ্চারাও অনেক চাপমুক্ত এবং আনন্দদায়ক পদ্ধতিতে প্রাক-অক্ষর এবং প্রাক-সংখ্যা পর্যায়ের শিক্ষাগুলি গ্রহণ করতে পারে। উল্টোদিকে গড়পড়তা বেসরকারি প্রিস্কুলগুলি— বিশেষ করে যেগুলিতে ফি তুলনামূলকভাবে কম— খুবই একঘেয়ে। মূলধারার স্কুলশিক্ষার যাবতীয় ক্লান্তিকর বিষয়গুলি এই সব জায়গায় ইতিমধ্যেই শুরু করিয়ে দেওয়া হয়। মুখস্থ, পুনরাবৃত্তি এবং গোঁড়ামিপূর্ণ ভোঁতা শিক্ষণ পদ্ধতিই ফুটফুটে বাচ্চাদের ওপর প্রয়োগ করা হতে থাকে।

শিশুদের প্রাক-স্কুল শিক্ষার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল কী পদ্ধতিতে তাদের অগ্রগতি পরিমাপ করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিগুলির অবশ্যই যথেষ্ট সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন, যাতে সেগুলি দিয়ে জ্ঞানের বৈচিত্র এবং “বহুমুখী বুদ্ধিমত্তা” দুয়েরই আভাস পাওয়া যায় এবং একটি শিশুর মধ্যে সাধারণ এবং বিশেষ দুই-ই আমরা খুঁজে নিতে পারি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশিরভাগ প্রি-স্কুলেই এই অগ্রগতি পরিমাপের জন্য “সবার-জন্য-একই-রকম” পদ্ধতি অনুসৃত হয়। এবং সেগুলি শিশুদের অগ্রগতিকে প্রাক-অক্ষর এবং প্রাক-সংখ্যা পরিচয়ের পর্যায় অনুসারে না মেপে পুরোদস্তুর আক্ষরিক এবং সাংখ্যিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের উপযুক্ত পরীক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। কোনও অভিজাত এমনকি ‘ব্র্যান্ড’ প্রিস্কুলের রিপোর্ট কার্ড দেখলে আপনার রীতিমতো ভয় লেগে যাবে। বাচ্চাদের অঙ্কে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে যা যা শেখানো হয়েছে সেগুলি হল— গোলক, ঘনক, শঙ্কু, আয়তঘন, চোঙ, স্থানীয় মান, বার লেখচিত্র, ইত্যাদি ইত্যাদি। কারও যদি দেখে মনে হয় যে কোনদিন না ক্যালকুলাসও ঢুকে পড়ে এর মধ্যে, তাকে মোটেই দোষ দেওয়া যাবে না। সমীক্ষাটিতে আরও দেখা গেছে, সরকারি বা বেসরকারি যে প্রি-স্কুলেরই হোক না কেন, একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু এই বয়সেই প্রাইভেট টিউশন নেওয়া শুরু করছে। আমাদের স্কুলশিক্ষার পূর্ব স্তরের এই যে উপরিউক্ত চিত্রটি আমরা দেখলাম, এই প্রবণতার ব্যাখ্যা সম্ভবত তার মধ্যেই নিহিত আছে। তাড়াতাড়ি শিক্ষা শুরু করাটা অতএব দেখা যাচ্ছে একই সঙ্গে প্রি-স্কুলিং এবং প্রি-টিউটরিং-এর রূপ ধারণ করছে। যা হওয়ার কথা ছিল এক আনন্দময় নবজাত শিক্ষা সফর, তা কোনওরকম কালক্ষেপ না করে এক ভয়ঙ্কর ইঁদুর দৌড়ে পরিণত হচ্ছে।

আমাদের চোখের সামনেই শিক্ষাক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তার কোনও ছাপ এখনও লক্ষ করা যাচ্ছে না।

 

রাজনীতিতে ফেরা

শিশুদের ভোটাধিকার নেই। ফলে আমাদের ভোটবাক্স-কেন্দ্রিক গণতন্ত্রে শিশুদের বিষয়গুলি কোনও গুরুত্ব পায় না। আমাদের দেশের এক বিপুল সংখ্যক শিশু যে ভয়াবহ বঞ্চনার শিকার তাকে ভাষা দিতে পারত একটা ধৈর্যহীনতা এবং প্রতিবাদের রাজনীতি। সেটাই আমরা কোথাও দেখতে পাই না।

সাম্প্রতিক বাজেটবরাদ্দ হ্রাসের (পরে যদিও কিছুটা বাড়ানো হয়েছে) ফলে আইসিডিএস কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দ্রেজ (২০১৭) এই বিষয়টিই উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘কুঠার’টা কেন এত কঠোরভাবে আর মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে শিশুদের ওপরেই পড়ে? অর্থমন্ত্রকের একজন সিনিয়র অফিসারের কথা থেকেও আমরা এ বিষয়ে একটা সম্যক ধারণা পাই। তিনি বলছেন, তিনি এ-ধরনের কোনও প্রবণতা সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহালই নন। তাঁরা তাড়াহুড়ো করে এই বাজেট কাটছাঁটটি করেছেন, এবং সে-সম্পর্কে কোনও বিস্তারিত ভাবনাচিন্তা করেননি! এই ধরনের অমনোযোগের সঙ্গে শিশু-সম্পর্কিত স্কিমগুলির বরাদ্দ হ্রাসের ঘটনা যে শুধু আমাদের অসংবেদনশীলতাকেই চিহ্নিত করে তাই নয়, আমাদের দেশ সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে শিশুদের প্রতি কতটা নির্মমভাবে উদাসীন, তা-ও এর মধ্যে দিয়ে পরিস্ফুট হয়।

আমাদের একটা প্রবণতা হল আমরা সামাজিক পলিসিগুলিকে তাদের অন্তর্নিহিত রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেগুলিকে স্রেফ কিছু টেকনিকাল বিষয় হিসেবে দেখে থাকি। এবং এই প্রবণতাই উল্লিখিত ‘গণতান্ত্রিক ঘাটতি’কে আড়াল করে রাখে। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, যেকোনও পলিসি রূপায়ণের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন হয়, এবং সেই পরিকল্পনা সুষ্ঠভাবে বাস্তবায়িত করতে প্রয়োজন হয় বাস্তব পরিচালন দক্ষতার। এখানে পরিষ্কার স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন কিছু অগ্রগণ্য প্রশাসনিক এবং শিক্ষাকর্মীদের কাছে আমরা ঋণী। তাঁদের দায়বদ্ধতা এবং দক্ষতা দেশের কিছু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে প্রাক-স্কুল শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্থানীয় করে তুলেছে। কিন্তু সমস্যাটা হল পেশাদার কর্মশক্তি হিসেবে তাঁদের স্বীকৃতিই বলুন, বা তাঁদের পরবর্তী ধাপে উন্নীত করা এবং একটি যথাবিহিত সাম্মানিকের ব্যবস্থা করাই বলুন, কোনও কিছুই আমাদের নীতি নির্ধারণকারী চর্চায় বা নির্বাচনী বিতর্কে স্থান পায় না। এই শিশু-সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ঝড়ঝাপটা থেকে আলাদা করে স্রেফ কিছু স্কিম হিসেবে দেখার সংস্কৃতি অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। সে জায়গায় ফিরে আসুক রাজনীতি। যদি সে রাজনীতি বিতর্কিত, কোলাহলমুখর, বিশৃঙ্খল হয় তাও স্বাগত।

সাম্প্রতিক ‘বাজেট’ প্রসারণের প্রসঙ্গে বেসরকারি প্রি-স্কুলগুলি সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে তারা তথাকথিত ‘স্বল্পক্ষমতাসম্পন্ন’ বাবা-মার অনেক অপূর্ণ চাহিদা পূর্ণ করেছে। এখন এইভাবে বাবা-মার পছন্দের শক্তির কথা উদযাপন করতে গিয়ে কত যে হাজার রকম উপায়ে স্কুলগুলিতে ব্যবসা আসে সেই প্রশ্নটা প্রায়শই আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চার পরিসরের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বেসরকারি প্রি-স্কুলগুলির মধ্যে কিছু রয়েছে একক ক্ষুদ্র উদ্যোগ জাতীয়। এদের অত আনুষ্ঠানিকতা বা আড়ম্বর নেই। আর কিছু রয়েছে যেগুলি একদমই অভিজাতদের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কোনও ট্রান্সন্যাশনাল বিজনেস নেটওয়ার্কের অংশ। যেটা হওয়ার কথা ছিল বা হওয়া উচিত ছিল প্রি-স্কুলিং-এর সামগ্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে একটি সমষ্টিগত পছন্দের বিষয়, বাজারীকরণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তাকে বানিয়ে তোলা হল একটি বিচ্ছিন্ন, একাকী, ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। সাধারণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আলোচনায় কথা (ভয়েস)-কে একজন নাগরিকের অস্ত্র এবং পছন্দ (চয়েস)-কে একজন ক্রেতার কৌশল হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু যখন সামাজিক পছন্দ হিসেবে কোনও বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার জন্ম হয়, তখন তার শিক্ষাগত উদ্দেশ্যের সাপেক্ষে গণতান্ত্রিক পরিসরগুলিতে যে সমষ্টিগত ভয়েস থাকে, তাকে এগিয়ে এসে সমষ্টিগত চয়েসটিকে আকার দিতে হয়। সুতরাং বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রয়োজন শিশুদের ক্ষমতায়নের ধারণাটিকে আত্মস্থ করার, তার অনুশীলনে সহায়তা করার।

একটি সমাজকাঠামো, যেখানে ক্ষমতার অসাম্য একটি জ্বলন্ত সত্য, জাত-ধর্ম-শ্রেণি ইত্যাদি নানা কারণ যার পেছনে ক্রিয়াশীল— সেরকম একটি সমাজে সমস্ত সামাজিক কর্মসূচির মতো দ্রুত শিশুশিক্ষার বিষয়টিও রাজনৈতিক বিষয় হতে বাধ্য। এরকম একটি জটিল বিষয়কে সরল করে দেখতে চাইলে তা কোনওভাবেই সব স্তরের শিশুদের জন্য ন্যায্য (fair) এবং উপযুক্ত (fitting) হতে পারে না। একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। কোনও শহরে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের জন্য একটা ঠিকঠাক জায়গার ব্যবস্থা করা কি স্রেফ একটা টেকনিকাল কাজ? একদমই নয়। বরং এটি নগরায়নের সামগ্রিক রাজনৈতিক-আর্থনীতিক শক্তিগুলির সঙ্গে যুক্ত— তার হ্রাসকরণ, রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতা, ‘স্থানিক ন্যায়বিচার’-এর পালটা চাহিদা জাতীয় সমস্ত উপাদানগুলিই এখানে ক্রিয়াশীল হবে। ফলত, এটা স্পষ্ট যে, প্রাক-স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা এবং তৎসংক্রান্ত বিতর্ককে অবশ্যই সামগ্রিক অসাম্যের কাঠামোগত নির্মাণের চর্চার সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে। অন্য একটি প্রসঙ্গে পিকেটি ঠিক এই বিষয়টিতেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

এর ফলশ্রুতিতে ভারতে শিশুদের জীবনের রাষ্ট্রের ভূমিকার বিষয়টিও পরখ করে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। হতে পারে, রাষ্ট্র তার অধিকাংশ শিশু-সম্পর্কিত সামাজিক কর্মসূচিগুলিতে আরও সদর্থক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এল। আবার উল্টোটাও হতে পারে— অর্থাৎ রাষ্ট্র বেসরকারি প্রিস্কুলগুলিকে একদম উন্মুক্ত জায়গা ছেড়ে দিল, বেসরকারি পুঁজির জয়যাত্রার পথ সুগম করতে গিয়ে জলাঞ্জলি দিল আমাদের শিশুদের সুস্থ বিকাশের বিষয়টিই। যাই হোক, আমরা আমাদের কথা বলতে পারি, যে আমরা ভারতেকে একটি ভিন্নতর উন্নত এবং ভিন্নতর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চাই, যেখানে অন্তত কিছু জায়গায় শিশুরা একটা ন্যায্য এবং উপযুক্ত শিক্ষারম্ভের সুযোগ পায়। বাকি ভারত গণতন্ত্রের সেই স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নেবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...