কলকাতা, নয়…

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

 

এই স্মৃতিকথাটির কয়েকটি পর্ব ‘আরেকরকম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সমগ্র রচনাটি ধারাবাহিকভাবে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হবে।

সকালের গল্প

খোল-করতাল বাজিয়ে ভগবানের নাম করতে-করতে, ছাদখোলা ঘোড়ার গাড়ি চেপে গঙ্গা নাইতে যেতেন মিশ্রজি। হরেকৃষ্ণ নামের সঙ্গে মিশে যেত ঘোড়ার কপকপ-খপখপ। তখনও আকাশ ফর্সা হতে ঘন্টা দেড়েক দেরি আছে। পুরো কথাটা কীযে ছাই বলতেন বোঝা যেত না, তা উচ্চারণের দোষেও হতে পারে অথবা ঘুম জড়ানো কানের দোষেও হওয়া অসম্ভব নয়। তবে, সারারাত ঠেলায় আলু-পেঁয়াজ-বেগুন-পটল-মুলো চলবার হাঁপানি-হেঁইওতে যে ঘুমের আঠা পাতলা হয়নি, ওই করতালের হইচইতে তা হালকা। আবার যেই একটু চোখের পাতা লাগতে শুরু করেছে, নিখুঁত ভৈরবীতে বেজে উঠত জাহাজের ভোঁ। ভোরের স্বপ্নের নেপথ্য সঙ্গীত! তবে, থিয়েটারের থার্ড বেল বাজাত রাস্তা ধোওয়ার হিসহিস। ঘুমভাঙা রাস্তায় হাইড্রেন্টের গঙ্গার জল পড়তেই নিচের জানালার খড়খড়িকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ত জলের ভাপ। তখনই বোঝা যেত গঙ্গার জলের গন্ধ আলাদা। শুধু গন্ধ নয়, উৎসাহী জলের ছিটেও ঢুকে পড়ত কখনও। করপোরেশনের লোকটিকে খুব একচোট বকে দিতে যেই জানালা খোলা, এক পাল শিশু রোদ কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বেই। কোল থেকে হড়কে ঘরের মেঝেতে নেমে হামাগুড়ি দেবে! দক্ষিণে লেডি ডাফরিন হাসপাতালের উপরের কার্নিসে টলমল করছে নরমচামড়ার রোদ্দুর। বকা ভুলে ওইদিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। কার্নিসের প্রান্তে সারিবদ্ধ কাকবাহিনী— ছত্রী সৈন্য ভূতলে অবতরণের আগে জরুরি শলাপরামর্শ সেরে নিচ্ছে। আকাশছোঁয়া চিলের দল এঁকে চলেছে নিজস্ব নিয়মের বৃত্ত।

এইভাবেই আমাদের স্কট লেন পাড়ায়, যাকে চাঁপাতলা বলা যায় আবার মুচিপাড়াও, সকাল হত। সকাল মানেই স্কুলে যাওয়ার তাড়া। দুধ-পাউরুটি খেয়ে, টিফিন বাক্স পিঠের ব্যাগে ভরে স্কুলের উদ্দেশে হাঁটা শুরু। ছটা পঁয়তাল্লিশের মধ্যে পৌঁছতে হবে। পিঠের ব্যাগটি কাপড়ের। আগের রাতেই তাতে রুটিন দেখে খাতা-বই গুছিয়ে রাখা। সঙ্গে বাবা। অতএব, পা-চালিয়ে যাওয়া। অতএব তা ১৯৬০, ১৯৬১। এবং ১৯৬২-ও। হেয়ার স্কুল। স্কুল তখন দু-তলা। পরে যারা স্কুলে ঢুকেছে তাদের এ-কথা বললে বিশ্বাসই করত না! পঞ্চম অবধি সকালবেলার ক্লাস। ষষ্ঠ থেকে একাদশ এগারোটায়। ১৯৬২-তে, যখন সদ্য তৃতীয় শ্রেণি, বড় হয়ে যাই। স্কুল ছুটির পর আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই বাবা অফিস দৌড়তেন। সেদিন অন্য কোনও চিন্তায় সোজা অফিস। এদিকে স্কুল ছুটির পর দেখি কেউ নেই। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ কেউ নেই। হয়তো আসতে দেরি হচ্ছে। ঠিক আছে। ঘন্টা পিটিয়ে ক্লাসের সূচনা-সমাপ্তি ঘোষণা করে যে রামধনি, মূল ফটকের লাগোয়া যার এক চিলতে ঘর, তার সামনেই বসে রইলাম। একে-একে চলে গেল সকালের সবাই। ডে-সেকশন শুরু হয়ে গেল। রামধনির দেওয়া কাঠের টুলের ওপর বসে আছি তখনও।

‘কিরে তোকে কেউ নিতে আসেনি?’ ডে-সেকশনের হেডমাস্টারমশাই গৌরগোপাল রায়। রামধনি ধরে এনেছে! দেখলেই ভয় করে। তবে মোহনবাগান সাপোর্টার। ক্লাবের কথা শুনলেই, নরম। তা জেনে, মোহনবাগান জুনিয়র সেকশনে খেলত এমন কত যে খেলোয়াড় হেয়ার স্কুলে ঢুকে পড়েছিল তখন! আমরা অবশ্য ওই নীল জার্সি পরা ছেলেদের দেখে খুবই হইচই করতাম। প্রিয় ক্লাবের ছেলে বলে কথা! ওদের পরেই আমাদের আর এক গর্বের ছেলেরা যুগের যাত্রী-র। সাদা জার্সি। নীল-সাদায় ভালোই ভাব। তবে যুগের যাত্রী মহড়া দিত আমহার্স্ট স্ট্রিট লাহাবাড়ির উলটো দিকের হৃষীকেশ পার্কে।

‘কেউ আসেনি?…’

দু-দিকে মাথা নাড়ালাম। এবং সত্যের খাতিরে এইটাও বলা দরকার— চোখ দিয়ে টুপটাপ, টুপটাপ..।

‘দাঁড়া… দাঁড়া… ভয় পাস নে… দেখছি’ বলতে-বলতে স্যার চলে গেলেন স্কুলের ভেতরে। একটু পরেই ফিরে এলেন গণেশকে নিয়ে। ওঁর খাস পিওন। রংচটা ধুতি, আকাশি শার্ট।

‘রাস্তা চিনে যেতে পারবি তো?’

মাথা নাড়ালাম, ‘হ্যাঁ স্যার… এই তো রাস্তা পেরিয়ে গোলদিঘি, মির্জাপুর স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিট, স্কট লেন… আট—’

রাস্তা মুখস্থ দেখে হেডস্যার খুশি, ‘আচ্ছা যা—’

গণেশের কাছে নিশ্চয়ই বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল। কারণ, কুড়ি ফুট এগোয় আর বুকপকেট থেকে কাগজ বের করে রাস্তা মেলায়। এমন ব্রেক জার্নি করতে-করতে যতক্ষণে বাড়ি পৌঁছলাম, দেরি দেখে মা বেরিয়ে স্কুলে গেছেন আমাকে খুঁজতে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন। গম্ভীর। হেডমাস্টারমশাই প্রচুর উত্তম-মধ্যম বাক্য নিক্ষেপ করেছেন। সন্ধেবেলায় বাবা ফিরতেই মার হইহই। সব শুনে বাবা আমার দিকে। গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বাহ্‌ তুই তো বড় হয়ে গেছিস… কাল থেকে একাই যাওয়া-আসা করবি।’ বাবার রায় বরাবরই এমন আশ্চর্যের, সুপ্রিম কোর্টের জাজমেন্ট (কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় প্রিন্সিপাল মশাই কিছু ট্যারাব্যাঁকা বলেছিলেন। তাঁর প্রথম শ্রেণিতে পাশ করা ছেলেকে হেনস্থা হতে দেখে, বাবা প্রিন্সিপালকে একবার দেখে নিয়ে কড়া গলায় ছেলেকে বললেন, এমন কলেজে পড়বার দরকার নেই, যা আলুর চাষ কর। ধুতি-পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের নাজেহাল অবস্থা)। এর ওপরে আপিল চলে না। সেই থেকে আমি বড় হয়ে গেলাম। দায়িত্ব বাড়ল। ছোটভাই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলে, তাকে সঙ্গে নিয়ে গুটিগুটি রাস্তা পেরিয়ে স্কুলের দিকে। আমহার্স্ট স্ট্রিট পার হতে তেমন কিছু অসুবিধে হত না। একটাই তো বাস চলে— থ্রি বি। আর কখনও ময়লা নেওয়ার লরি। বোধহয় বেডফোর্ড কোম্পানির। কলেজ স্ট্রিট পেরোতে দু-দিক ভালো করে দেখে নিতে হত। বাস এবং ট্রাম। ট্যাক্সি নজরে পড়ত না ওই সকালে।

হেয়ার স্কুলের ক্লাসে বসেই গোলদিঘি দেখা যেত তখন। সেনেট হল ভাঙার গুমগুম শব্দই বা ভুলি কী করে! চোখের সামনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বাড়ি তৈরি হল। উঁচু ক্লাসে ওঠবার পর ডে-সেকশনের ইংরেজি শিক্ষক হিমাংশুবাবুকে বলতে শুনেছি, ‘কী বায়োস্কোপ হলের মতো বাড়ি বানিয়েছে!’

এক সকালে বিছানায় শুয়েই গানের আওয়াজ ভেসে এল— ‘ওরে নূতন যুগের ভোরে…।’ জানালা খুলতেই দেখি বিনয়কাকু, আশুকাকু, পঙ্কজদি সবাই। সারি দিয়ে চলেছে। আমরা স্কুলে সকালবেলায় ক্লাস শুরু হওয়ার সময় এমনই সারি দিয়ে গাই ‘আনন্দলোকে, মঙ্গলালোকে, বিরাজ সত্যসুন্দর…’ কিন্তু বিনয়কাকু-আশুকাকু এরা তো স্কুলে পড়ে না, চাকরি করে। তবে?

‘বাবা, এরা গান করছে কেন?’
‘জানো না, আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একশো বছর হল, তাই প্রভাতফেরি বেরিয়েছে, উইলিয়ামস লেন হয়ে স্কট লেন–’

উইলিয়ামস লেন উত্তরে গিয়ে স্কট লেনে মিশেছে। একটি চার্চ ছিল সেখানে। এখনও আছে নিশ্চয়। হয়ত বন্ধ, তবু থাকার তো কথা। প্রতি রবিবার চার্চে প্রার্থনা। গোরা সাহেব-মেম অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ভিড় জমে যায়। চার্চটির শুরু ১৮৬৩। আমি ইতিহাসে অত কিছু ভালো নই। সাল-তারিখ গুলিয়ে যায় কখনও। তবে ওই চার্চটি যে ১৮৬৩-র সন্দেহ নেই। এত নিশ্চিত হবার কারণ আছে।

এক সকালে বাবার হাত ধরে হাঁটছিলাম উইলিয়ামস লেন ধরে। দেখি চার্চ চত্বরে বিশাল একটা এরোপ্লেনের মত কিছু দাঁড় করানো। তার গায়ে লেখা, ১৮৬৩-১৯৬৩।

‘এই এরোপ্লেনটা এমন কেন?’
‘ওটা প্লেন নয় রে… স্পুটনিকের মডেল…’

বাবা ভালো করে বোঝালেন— চার্চটার বয়স একশো হল সেইজন্য উৎসব হবে। এই অনুষ্ঠানের জন্যই স্পুটনিক।

‘স্পুটনিক জানিস তো?’ বাবা হাসলেন।

‘হ্যাঁ’ বলে মাথা নাড়ালাম। ক্লাস থ্রি-র ছেলে স্পুটনিক জানবে না! ইউরি গাগারিন আর তার মহাকাশযান ভস্তক-এর নাম শোনেনি হয় নাকি! মুখে নিশ্চয় লায়েক-লায়েক ভাব ফুটে উঠেছিল।

কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না। ‘এ-ক-শো বছর!’

‘হ্যাঁ একশো… রবীন্দ্রনাথের জন্মের মাত্র দু-বছর পরেই এই চার্চ…’
‘বাবা তুমি কবে জন্মেছ?’
‘ঊনিশশো সতেরো…’
‘তার মানে তোমার এখন ছেচল্লিশ বছর?’
‘বাহ্‌, ভালো বিয়োগ শিখেছিস…’

আমার ঘোর-লাগা কাটতেই চায় না। ১৮৬৩ যদি ক্রমশ ১৯৬৩ হয়ে যায়, তাহলে ১৯৬৩ নিশ্চয় একদিন ২০০০ সাল হবে।

বাবা বলল, ‘হ্যাঁ হবে…’
আমি আরও অবাক— ‘আমি দু হাজার সাল দেখতে পাব?’
‘হ্যাঁ নিশ্চয় পাবি, বল তো ক বছর পরে দু হাজার হবে?’

মানসাঙ্কতে খুব খারাপ নয়। তবু সাবধানের মার নেই। দু-হাজার থেকে ঊনিশশো তেষট্টি বাদ দিলাম। বিয়োগফলটা আবার ঊনিশশো তেষট্টির সঙ্গে যোগ করেও দেখে নিলাম দু-হাজার হচ্ছে কিনা।

‘সাঁইত্রিশ বছর পরে…’
‘বাহ্‌, তুই তো যোগেও ভালো রে! দ্যাখ, তাহলে আর মাত্র সাঁইত্রিশ বছর পরেই দু-হাজার সাল..’

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা দু হাজার সাল দেখতে পাব?’
‘হ্যাঁ তুই মানে তোরা দু ভাই পাবি, আমি পাব না।’

বাবার কথা ফলেছে।

 

(ক্রমশ)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...