বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
The Duck and the Kangaroo
১
ঘুম থেকে উঠতে বেলা হয়েছিল হীরকের। ঘুম ভাঙল জিনির ধাক্কায়। ওঠো ওঠো, আর ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই ওরা এসে যাবে।
হীরক লাফ দিয়ে উঠে বসেছিল। মেয়েদের ভেজা চুলের একটা গন্ধ থাকে। শ্যাম্পুর না। বোধহয় জলের সঙ্গে দীর্ঘ চুলের মিতালিতে একটা মোহময়তা তৈরি হয়। অনেক আগে এরকম স্নান করে এসে হীরককে তুলতে হলে জিনি তার উপরে নিজের মাথার চুল ঝাঁকাত। বিছানায় শুয়ে সেই বৃষ্টির জন্য হঠাৎ মন কেমন করে উঠল হীরকের।
–এমন ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছ কেন? জিনির সুন্দর করে আঁকা ভুরু অনেকটা উপরে উঠল। পারোও বটে। জাগো! ওঠো!
–হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি তো। বুদ্ধ আর মণীশরা আসছে। তোমাদের প্যাকিং হয়ে গেছে?
–সেটাই তো করছি। আমার স্যুটকেসে আর জায়গা হবে না, তুমি আলাদা করে নাও।
–আমি কালকেই করে রেখেছিলাম।
–সেলফিশ! তখন আমাদেরটাও তো দেখতে পারতে, অন্তত মেয়েরটা। তাহলে আর আমাকে এখন এত দৌড়ঝাঁপ করতে হত না। জিনির কথাটা উচ্চগ্রামে শুরু হয়ে খাঁড়িতে নেবে গেল। তাড়ার সময়ে জন্মানো রাগ বুকের ভিতর অবধি পৌঁছায় না। জিনির উষ্মাটা এখন সেই পর্যায়ের। যেতে যেতে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ব তো? আমি কিন্তু বাড়িতে কোনও খাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট রাখিনি।
–ওরা তো বাড়িতে আসছে না, আমরা তো এয়ারপোর্ট থেকেই তুলে নেব।
এই স্বস্তিটা সঙ্গে নিয়ে জিনি চলে যাবার পরেও হীরক বিছানায় বালিশ আঁকড়ে রইল কিছুক্ষণ। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে কাল। ছোটবেলায় তার একটা পিতলের থালা ছিল, অন্নপ্রাশনের। তাতে লেখা ছিল সুখে থাকো, পাশে কিছু লতাপাতা আঁকা। স্টিলের থালার চল হতে মা ওটা লোহার তোরঙ্গে পুরোন বাসন কোসনের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছিল। হীরকের দুর্গাপুরের বাড়িতে ছোটবেলার শোওয়ার ঘরের একটা দেওয়াল জুড়ে চওড়া তাক ছিল জানালার ঠিক উপর থেকে, সামনে পর্দা ঝুলত। পিছনে থাকত এইরকম মেলা জিনিস যা কোনওদিন কাজে লাগবে কিনা কেউ জানে না, কিন্তু লাগতে পারে সেই ভাবনায় রেখে দেওয়া। ওটাই ছিল তাদের স্টোরেজ রুম। স্বপ্নে দেখল সে আর শানু সেই তোরঙ্গ থেকে থালাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। হীরক সেই তাকের উপর উঠে তোরঙ্গের ঢাকা তুলে হাঁটকাচ্ছে। শানু নিচে দাঁড়িয়ে তাড়া দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি কর হীরক, ওরা এসে যাবে। আমাকে নিয়ে চলে যাবে। হীরক প্রাণপণে ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে থালাটা খুঁজছিল। ওই থালাটা পেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, ওটাই শানুর জিয়নকাঠি। অন্তত স্বপ্নের মধ্যে সেটাই মনে হচ্ছিল।
স্বপ্নটা ভাবনা থেকে সরতে মাথা ঝাঁকাল জোরে জোরে। মুড়ির টিনে ঝাঁকি মেরে জায়গা করার মত। বুদ্ধ আর মণীশরা আসছে। সবাই মিলে যাবে স্লিপিং বেয়ার ডিউন, ট্র্যাভার্স সিটিতে। বালির পাহাড় আর মিশিগান হ্রদের পাশে কাটিয়ে আসবে ক দিন। হীরকের অ্যান আরবারের বাড়ির থেকে কয়েক ঘণ্টা দূরে। এয়ারপোর্ট যাওয়ার আগে রেন্টাল কারটা তুলতে হবে, সিক্সটিন সিটার। অন্তত আধঘণ্টা লাগবে। এইসব ফিরিস্তিগুলো মনের মধ্যে আউড়ে নিয়ে হীরক তাড়াতাড়ি নিজেকে বিছানা থেকে উজিয়ে তুলল। আর দেরি করলে চলবে না।
বুদ্ধ-মৌমি, বিজু-মণীশ আর অবশ্যই ওদের ছানারা। ফোর্থ অব জুলাইয়ের উইকেন্ডে ফি বছর সপরিবারে একত্র হয়। এটা ওদের অ্যামেরিকা বসবাসের ট্র্যাডিশন। অন্তত গত চার পাঁচ বছর তাদের বেছে নেওয়া স্বদেশের স্বাধীনতা উৎসব।
কলেজে বুদ্ধ, বিজু, মণীশ ওরা একসঙ্গে ছিল। যাদবপুরের একব্যাচ, টান তো থাকবেই। মণীশ আর হীরক হস্টেলে পাশাপাশি, এক ঘরে। তাছাড়া হীরকের মত মণীশও দুর্গাপুরের ছেলে, একসঙ্গে স্কুল। বুদ্ধ হস্টেলে থাকত না, ডে স্কলার। কিন্তু হীরকের সঙ্গে বুদ্ধর জমাট সেই কাউন্সেলিং-এর দিন থেকে। আর বিজুর সঙ্গে তো মিশিগান ইউনিভার্সিটিতেও কয়েক মাস। এখন এক থেকে দুই, তিন, চারের ফ্যামিলি হয়ে গেছে সবার। বন্ধুত্বটা এখনও আঁটোসাঁটো। পুরনো জামার মত। উত্তর অ্যামেরিকার তিন প্রান্তে থাকলেও, এদেশের জন্য হাতের পাঁচ। কদিনের হইচই ভালই লাগবে!
এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে মণীশকে একা দেখে একটু চমকে গেল যদিও।
জিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, একি মণীশদা? বিজু, তিয়াস এরা কোথায়?
ট্রলি ব্যাগ হাতে মণীশ চোখে মুখে একটা ছদ্মরাগ ফুটিয়ে তুলে ব্যাপারটা হালকা করতে চাইল। দেখেছ? আমি এসেছি তার জন্য কোনও আনন্দ নেই। এই যে আমাকে মণীশদা বলো আর আমারই ব্যাচমেট বিজুকে নাম ধরে ডাকো ওখানেই একটা বিভাজনের রেখা টেনে দিয়েছ সেটা আমি বরাবর বলেছি।
–সিরিয়াসলি মণীশ, বিজুরা কোথায়? এল না কেন?
–তুই তো জানিস বিজু কীরকম কাজপাগল। ওর প্ল্যান্টে কমিশনিং-এর কিছু কাজ ল্যাগ করছে। ছেড়ে আসতে পারল না। বিজু আর তার কাজ সিয়ামিজ টুইন, তার ব্যাবচ্ছেদ করা আমার কর্ম নয়। কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের অপারগতা বোঝানোর চেষ্টা করল মণীশ।
–একথাটা একবার ফোনে জানাল না পর্যন্ত! বিজুটাকে না… তুইও তো আগে থেকে বলতে পারতিস।
–সত্যি মণীশদা, আমরা সবাই মিলে বললে নিশ্চয় বিজু আরেকবার ভাবত।
ততক্ষণে বুদ্ধ আর মৌমিকে দেখা গেল ট্রলি ব্যাগ নিয়ে এস্ক্যালেটার দিয়ে নাবছে। ওরা আসছে সান ফ্র্যান্সিস্কো থেকে। সঙ্গে দোলন আর বিট্টু। তিস্তা এতক্ষণ বড়দের কথার মাঝখানে মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়েছিল। দোলন আর বিট্টুকে দেখে দ্বিগুণ উৎসাহে ওদের দিকে ছুটল। সেদিকে তাকিয়ে জিনি বলল, অন্তত তিয়াসকে নিয়ে আসতে পারতে মণীশদা। বছরে একবার মোলাকাতেও দেখো কীরকম বন্ড তৈরি হচ্ছে ওদের মধ্যে।
মৌমি আসা মানে হইচইয়ের পারদটা হুহু করে বেড়ে যাওয়া। থ্রি কোয়ার্টার টাইটসের উপরে বড় বড় জংলা প্রিন্টের দেশি কুর্তিতে ঝলমল করতে করতে এক মিনিটে কতগুলো শব্দ ভরে দেওয়া যায় সেই তাড়া নিয়ে বলল, একি হীরুদা তুমি এমন অফিসে যাওয়ার পোষাক পরে আছ কেন? পৌঁছেই আমাদের ডিউনে চড়ার কথা না? জিনি তোমার বরকে বেড়ানোর দিনে এমন বর্বরোচিত ড্রেসে সাজিয়ে এনেছ কেন? বিজু কোথায় মণীশদা? তিয়াস?
–একসঙ্গে সবার টিকি ধরে নেড়ে দেওয়া হয়ে গেছে তো? খাকি শর্টসের পকেটে দু হাত গুঁজে হাসতে হাসতে বলল বুদ্ধ। জানিস তো বেশি কথা বলার জন্য মৌমির দাঁতগুলো সব সময়েই বেরিয়ে থাকে, কিন্তু আজকে একেবারে মূলোর দোকান।
–দেখেছ তোমরা? আমার বড় বড় দাঁত নিয়ে কিরকম সকাল সকাল ঠুকে দিল!
কাউকেই মৌমির কথার উত্তর দিয়ে উঠতে হয়নি। কিন্তু গাড়িতে বসে মৌমি আবার মণীশকে চেপে ধরল। বিজু কেন এল না মণীশদা?
হীরক স্টিয়ারিং-এ। পাশে মণীশ। দ্বিতীয় সারিতে জিনি, মৌমি আর বুদ্ধ। একদম পিছনে তিস্তা, দোলন আর বিট্টু।
মণীশ একা এসেছে এই ব্যাপারটা হীরকও ঠিক বুঝতে পারছে না। একেবারে শেষ মুহূর্তে না করে দিল, অন্তত ফোন করে জানাতে পারত। এমনকি তিয়াসও এল না। যদিও বিজুর অফিসের কাজের অজুহাত দিয়েছে, তিয়াস এল না কেন তবে? ঘাড় ঘুরিয়ে মণীশের মুখের রেখাগুলোকে মাপার চেষ্টা করছিল হীরক।
–আচ্ছা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস না করে ওকেই সোজাসুজি প্রশ্ন করো না তোমরা। পকেট থেকে ওয়্যারলেস বের করে বাড়িয়ে দিল মণীশ।
–কবে কিনলি? অফিস থেকে দিল? জিজ্ঞেস করল বুদ্ধ, নিজে অনেকদিন কিনবে কিনবে করেও কেনেনি। মৌমি বলেছে আগে একটু টাকা জমুক, এখুনি এত ফ্রিভোলাস হবার দরকার নেই। নাহলে সিলিকন ভ্যালিতে এখন সবার হাতেই ওয়্যারলেস।
–না, নিজের। পার্টি লাইনে আর পোষাচ্ছিল না বস।
পার্টি লাইনটা সত্যিই বিরক্তিকর। মিশিগানে আর নেই। কিন্তু যখন ছিল বেশ ভোগান্তি ছিল হীরকদের। একটা লাইন তিন-চারজনে শেয়ার করলে যা হয়। দরকারি ফোন পাওয়াই দুষ্কর। তার ওপর লাইনে বসে অন্য কেউ কথা শুনতে পারে। কিন্তু পার্টি লাইন বজায় থাকলেও ঝট করে কি ওয়্যারলেস নিত হীরক? এখানে এখনও বেশি লোক নেয়নি।
মণীশ বাড়ির লাইন লাগিয়ে দিল। রিং হলেও কেউ তুলল না। বললাম না, বিজু বাড়িতে বসে থাকার মেয়ে নাকি? ছুটির দিনেও অফিসে গিয়ে বসে আছে আজ, খুব নাকি জরুরি কাজ।
–রাত্রে আর একবার ট্রাই করব মণীশদা, বিজু আমাদের এইভাবে ডিচ করল কেন জানতে চাই।
হইচই একবার জমে যেতে বিজুর কথা ওঠেনি আর। উঠল পরের দিন স্লিপিং বেয়ার ডিউনে বালির পাহাড় ভেঙে মিশিগান লেকে নাবার সময়।
ওরা তখন বালির পাহাড়ে দাঁড়িয়ে নাববে কি নাববে না ভাবছিল।
–কেন, এমন কি উঁচু? মোটে তো সাড়ে চারশো ফিট। জিনির মধ্যে একটা কুছ পরোয়া ভাব।
–এখানে কি লেখা আছে দেখোনি? বিচের দিকে নেবে যদি উঠতে না পারো, রেস্কিউ টিম এসে তোলার জন্য পাঁচ হাজার ডলার নেবে।
শুনেই আঁতকে উঠল মৌমি। এমা এত? সে তো সাঙ্ঘাতিক বেশি টাকা! গলাকাটাদের দেশে এসে পড়লাম নাকি!
–আমার মনে হয় ভয় দেখানোর জন্যে লিখেছে। আসলে ওরা চায় না এদিক দিয়ে লোকে জলের কাছে বেশি যাক। দেখছিস না, কত বালির বস্তা দিয়ে রেখেছে জেটির নীচে। নিশ্চয় বালি আস্তে আস্তে ধ্বসে যাচ্ছে, সংরক্ষণ করতে চাইছে।
–বুদ্ধর কথাই ঠিক। এমন কিছু নয় এটা। আমরা কত পাহাড়ে উঠে এলাম, এটা তো নস্যি! দরকার হলে মেয়েরা বাচ্চাদের নিয়ে থেকে যাক, আমরা নাবি।
মণীশের এই কথায় জিনির সজোরে প্রতিবাদ, কেন আমরা কম কিসে?
–আরে বাবা এরকম যুদ্ধং দেহি হোয়ো না, নাবতে চাইলে সবাই নাবো। আমি জানিয়ে রাখলাম, আমার পাঁচ, তোমাদের পনেরো আর বুদ্ধর কুড়ি হাজার ডলারের হিসেব নিজে নিজে উঠতে না পারলে।
জিনি এসবের তোয়াক্কা না করে তড়তড় করে নেবে যাচ্ছিল। সঙ্গে মৌমি আর বাচ্চারা। কারোরই তেমন অসুবিধা হতে দেখা গেল না।
বরং হীরকরা কিছুটা নেবে দাঁড়িয়ে জল দেখছিল। আকাশ আর জলে ছড়িয়ে আছে নীলের সুষমা। নীলের মধ্যেও বৈচিত্র্য কম নয়।
–কী নীল দেখেছিস এখানকার জল?
–মিশিগান হ্রদের সমুদ্রনীল নীল মিশে গেছে আকাশের আকাশীনীল নীলের সঙ্গে।
–উরেব্বাবা, তুই কবি হয়ে যাচ্ছিস নাকি?
মণীশের কথার ঠেসটা উপেক্ষা করে হীরক বলল, কথাটা আমার নয়, শানুর লেখা একটা চিঠি থেকে বললাম। এমন সুন্দর করে নীল রঙের কথা লিখেছিল শানু যে আমার মনে গেঁথে গেছে।
মণীশ শানুকে তেমন পছন্দ করেনি কোনওদিন। অপছন্দ শব্দটা বেশী কড়া হয়ে যাবে— নির্লিপ্তি। সেইভাবেই বলল, ও শানু পাগলা! তোকে এখনও জ্বালায়?
শানু হীরকের স্কুলজীবনের একটা অংশ। বন্ধুত্বের ভিতরঘর। আজ তাদের সঙ্গে এখানে শানুরও থাকা সম্ভব ছিল। মৃদু প্রতিবাদ করল, ওভাবে কেন বলছিস? প্রতিটা মানুষের একটা আত্মসম্মান আছে। সামনে থাকুক বা দূরে।
বুদ্ধ চট করে কথা ঘোরাল। তার মানে তোদের শানু হয়তো একজন বড় কবি হতে পারত।
–আর হীরক এক বড় চিত্রকর। জিনির মুখে শুনলাম তুই নাকি আজকাল ছবি আঁকা ধরেছিস?
–অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। আমরা কে কী চেয়েছিলাম, এখন কী করব, ভবিষ্যতে কোথায় যাব সেই গন্তব্য কি কেউ জানি?
–আমাদের গন্তব্য কে ঠিক করে দিয়েছিল রে? মণীশের গলায় একটা চ্যালেঞ্জের সুর।
–বুলস আই বানানো ছিল আমাদের সকলের জন্য। বলতে বলতেই হীরক ভাবছিল। কে বানিয়েছিল এই বুলস আই? কেউ কি ঠিক করে দিয়েছিল আর তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বন্দুক হাতে? কিংবা চোখে ঠুলি লাগিয়ে কোন দৌড়ের দাগটানা মাঠে?
–আসলে গন্তব্য বলে কিছু হয় না রে, যাওয়াটাই আসল। সেটা এখন বেশ বুঝি।
তখনই বিজুর কথা তুলল মণীশ।
বিজুকে এটাই বুঝিয়ে উঠতে পারিনি কোনওদিন। এখনও সেই দৌড়, শৃঙ্গ জয়ের অভিযান। পুরনো অভ্যাসে। কথাগুলো গলায় নিয়ে মণীশ পা হড়কে অনেকটা নীচে নেবে গেছিল।
–কেন কী বলেছে বিজু? বিজুর নাম শুনেই অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে গেছিল হীরকের।
নিজের পায়ে ভালো করে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কথা ঘোরাল মণীশ। আমাদের জীবনটা বড্ড একটেরে হয়ে গেছে রে, হাওয়া বাতাস খেলানো চাই।
–তার মানে? সেটা আবার কী?
–তোদের মনে হয় না যে আমরা বর্তমান ভুলে অতীত আর ভবিষ্যতে ঠাঁই নিয়েছি? কী হয়নি সেটা নিয়ে হাহুতাশ আর আর কী হওয়াতে হবে ভবিষ্যতে তাই নিয়ে ফন্দিফিকির?
ওরা যে ভবিষ্যৎ চেয়েছিল এখন তো সেই ভবিষ্যৎ, সযত্নে গড়ে তোলা ক্যারিয়ার হাতের মুঠোয়। স্বপ্নের দেশে এই জীবন, সেটা তো জলজ্যান্ত বর্তমান। তবু বর্তমান নিয়ে কোথাও একটা অসন্তোষ দানা বাঁধছে, তাই কি মণীশের এই অতীত-ভবিষ্যৎ নিয়ে কাটাছেঁড়া? হীরক মণীশের চোখের ভিতরটা পড়ার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ বিজুকে এই কথায় টানলই বা কেন?
মাঝামাঝি পৌঁছে মৌমি ততক্ষণে চেঁচাচ্ছে। কী ব্যাপার তোমাদের? দাঁড়িয়ে গেলে কেন?
ওরা তিনজন মাঝামাঝি। জিনি তরতর করে নেবে এখন জলে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে। দুই হাত মুখের সামনে জড়ো করে চেঁচাল— নেবে আসাটা এমন কিছু কঠিন নয়, তোমরা আসতে থাকো।
হীরক, বুদ্ধ আর মণীশ তবু বালিতে পা ছড়িয়ে বসল একটু। হীরকের জুতোয় একগাদা বালি ঢুকে গেছে। জুতো খুলে উল্টাতেই হড়হড় করে একগাদা বালি।
–এই বালিগুলো কী মিহি দেখেছিস? কী করে উড়ে না গিয়ে জমা হল এখানে? মণীশ আঙুল চালিয়ে বালি তুলে ধরছিল, আর বালি উড়ে উড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল হাওয়ার টানে।
–কিছু ওড়ে, কিছু রয়ে যায়। উপরে লেখা ছিল দেখিসনি মারিয়াম ঘাস আটকে ধরেছে উড়ে যাওয়া বালি, তবেই না ডিউনের জন্ম। তবু যাচ্ছে আসছে। এই যে কাঠের এই স্ট্রাকচারের তলায় এত বালির বস্তা ফেলে রেখেছে, সেও তো বালির উড়ে যাওয়া আটকানোর জন্য। নাহলে এই কাঠের ডেক থাকত নাকি?
বুদ্ধ তখনও মণীশের কথার অন্তর্নিহিত মানে খুঁজছে। সেই ভাবনা থেকেই বলল, বর্তমানে অতীত থাকে। থাকবেই। অতীত ছাড়া বর্তমান হয় নাকি আবার? তাহলে হয়ে যাবে এই ঝুরো বালির মত, কোথায় উড়ে যাবে থই পাবি না।
–আর ভবিষ্যৎ? সারাটা জীবন কি ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে, কোথায় পৌঁছাতে হবে সেই চিন্তায় বেঁচে থাকতেই ভুলে যাব?
ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে হাই পাওয়ার চশমার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া চোখে কৌতুক ঝকঝকিয়ে উঠল বুদ্ধর। বর্তমান বেঁচেই থাকে ভবিষ্যতের জন্য, দেখিসনি ইতিহাস লেখার সময় কেমন বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যৎকে গুঁজে দেওয়া থাকে।
বুদ্ধকে থামিয়ে দিল মণীশ, প্রফেসর বুদ্ধদেব সরকার, আপনি একটু হালকা করে বলবেন কি? এক্সাম্পল দিয়ে। আপনার ছাত্ররা পুরো হাওয়া হয়ে গেছে।
–বুদ্বুদ! ডোবার জলে বুড়বুড়ি কাটছে।
লেকের জলে কায়াক ভাসানো আমেরিকানদের দিকে তাকিয়ে বুদ্ধ বলল, আমরা যখন ছোটবেলায় শনি রবিবারে কেসি নাগের অঙ্ক রটে ফেলতাম, এরা তখন বাবা মায়ের সঙ্গে নৌকা চালানোর তালিম নিচ্ছে। আমাকে দ্যাখ, আমি তো সাঁতারটাও জানি না। আমরা চাইলেও আমাদের সেই অতীতটাকে অগ্রাহ্য করতে পারি না।
–তোর গোঁজাগুঁজির ফান্ডাটা একটু খোলসা কর আগে— তোর ভবিষ্যতের পোঁদে বর্তমান গুঁজে দেওয়াটা?
বুদ্ধর চোখে হাসি চলকে পড়ল। তুই তো পুরো আমাদের কলেজ জীবনের ভাষায় চলে গেলি মণীশ। তাহলে সেই জীবন থেকেই একটা এগজাম্পল দিই। মনে কর তুই যখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে কাকলির সঙ্গে প্রেম করছিলি। তোর জীবন নিয়ে লেখার সময় একজন হিস্টোরিয়ান কী লিখবে বল?
–কী লিখবে? হঠাৎ এরকম কথায় একটু অবাক হয়ে তাকাল মণীশ।
–লিখবে, সত্যেনদার ক্যান্টিনে বসে মণীশ কাকলির হাত ধরে ঠিক সেইভাবেই আমি তোকে ভালবাসি বলেছিল যেভাবে এই জীবনে আরও বহুবার বলবে অন্য অনেক মেয়েকে, অন্য কোনওখানে। হল না অতীত নিয়ে লেখার সময় বর্তমানকে ভবিষ্যতের ইয়েতে গুঁজে দেওয়া?
এই কথার সঙ্গে বুদ্ধর খ্যাঁক খ্যাঁক হাসিকে অগ্রাহ্য করে মণীশ বলল, আর তোদের নিয়ে কোনও হিস্টোরিয়ান কখনও ইন্টারেস্টেড হলে কী লিখবে? মিছিলে আকাশে হাত মুঠো করে স্লোগান ছুঁড়তে ছুঁড়তে হেঁটে চলা বুদ্ধ আর হীরক কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝে যাবে এই নিষ্ফল আবেগের চেয়ে ক্যাপিটালিজমের পুজো করায় আখেরে জনগণের বেশি লাভ। অন্তত নিজেদের লাভ তো বটেই।
এমন একটা হাজির জবাব দিতে পেরে মণীশের খুশি হবার কথা। কিন্তু ওর মুখচোখ দেখে মনে হল বুদ্ধর কথায় আসলে রেগে রয়েছে। ওর উত্তরটা বেশ খোঁচা দেওয়ার মত ছিল। হীরক জানে বুদ্ধ নেহাতই আড্ডার ছলে কাকলির কথাটা বলেছিল, কিন্তু মণীশ ভালোভাবে নেয়নি। বিজু আসেনি সেটাও মাথার মধ্যে কিট কিট করছিল। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার জন্য ভিতরে ভিতরে ছটফট করছিল অনেকক্ষণ। বউয়েরা এখন একটু দূরে। তাই প্রশ্নটা করেই ফেলল, সত্যিকারের কেসটা কী বল তো মণীশ? বিজুর সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছিস?
মণীশ কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু শব্দগুলো ওর কণ্ঠনালীতে ঢেউ তুলেই থমকে যাচ্ছিল। গলা দিয়ে শব্দ না বেরোলেও একটা অপেক্ষা তৈরি হচ্ছিল। আকাশে মেঘ করার মত। বাষ্প হয়ে জল উবে গিয়ে মেঘের উপর মেঘ জমেছে। গুমোট।
আবার আগামী সংখ্যায়
বেশ লাগছে পড়তে। এ পর্বে শানুর দেখা পেলাম– তার জন্য ভাবনা রয়ে গেল।