সায়ন্তন ভট্টাচার্য
১
“কী এমন বয়েস তোমার? কতটুকু চিনেছ জীবন? এখন এমন একটা সময় যখন তুমি বুঝতে শিখছ যে তোমার রোলমডেল বাবা-মা একেবারেই আদর্শ ভালোমানুষ নয়, এটাও জেনে যাচ্ছ যে সুপারহিরো বলে আদতে কিছু হয় না। তোমার অভিজ্ঞতা শূন্য, অনুপ্রেরণা নেই। তুমি ভাবছ ব্যতিক্রমী হবে, পালটে দেবে সবকিছু, কিন্তু সত্যি বলতে জানো না তুমি যে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই? তবে? জীবন একটা সুন্দর জিনিস এটা তোমাকে ভাবতে শেখানো হয়েছে, পাখিপড়ার মতো তোমার প্রতিবর্ততে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে টিঁকে থাকার জিন। কিন্তু কেন? জীবন তোমার, জীবনের ভালো লাগা-মন্দ লাগা তোমার, মৃত্যু তোমার কেন নয়? যন্ত্রণার জন্যে কেন তোমাকে নিয়তির অপেক্ষা করতে হবে? হাতে পঞ্চাশ দিন সময় নাও আর শেষ করে দাও নিজেকে, বুঝিয়ে দাও তুমি যে তোমারই। মরে যাও, স্রেফ মরে যাও আরেকটা বন্ধ্যা দিনের মতো।”
ক্যান্সার হাসপাতালে সপ্তাহে কম করে তিন-চারজন মারা যায়, এমন পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও আউটডোরের সিঁড়িতে যে পরিমাণ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা মা, মেয়ে, ভাইকে দেখেছি যে হিসেবটা কষে ফেলাই যায়। মানুষগুলো শেষের দিকে যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না, অপারেশনের জ্বালা শুকোতে না শুকোতেই কেমোথেরাপিতে মাথার চুল উঠতে শুরু করে, শরীর গাছের মতো শান্ত হয়ে যায়, কষ্ট কমানোর জন্যে মরফিন আসে। যেভাবে সার্কাসের দুরন্ত বাঘ-সিংহকে অবশ করে রাখে রিং মাস্টার! আসলে মুশকিল কোথায় হয়েছে জানেন মশাই? আমরা নিজেরাই রোম্যান্টিসাইজ করতে গিয়ে নিজেদের অজান্তে মৃত্যুকে একটা রূপকথা বানিয়ে ফেলেছি, গল্প ফেঁদেছি মৃত্যুপরবর্তী জীবনের, স্বর্গের, নরকের, কিন্তু কোনওদিন মৃত্যুর মুহূর্তদের নিয়ে গভীরে ভাবিনি। ভাবিনি পাঁচতলা ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়া ছেলেটার মাটিতে মাথা ঠুকে যাওয়ার মুহূর্তে কী পরিমাণ আঘাত লেগেছিল, অ্যাসিড খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটার শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুড়ে যাওয়ার চিটচিটে অনুভুতি কেমন হতে পারে, গল্প লিখিনি গায়ে আগুন লাগানো মানুষটার চোখ পুড়ে যাওয়ার গন্ধ নিয়ে। মৃত্যু তাই বরাবর তার ভয়াবহতাকে আড়াল করে শিল্প-সংস্কৃতি এমনকি নিত্যজীবনে ঘাঁটি গেড়ে বসে থেকেছে। পাঠক বলেছে, “আহা, মৃত্যুর ঘ্রাণ”, মা বলেছে, “তুই মরলে হাড় জুড়োয়!”
২
প্রত্যেক বছর প্রায় দু’হাজার করে নীলতিমি, ডলফিন ইত্যাদি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রতীরে হাজির হয়ে ডিহাইড্রেশনে মারা যায় যাকে চলতি ভাষায় “বিচিং” বলে। অর্থাৎ পৃথিবীর বৃহত্তম স্তন্যপায়ীরাই প্রত্যেক বছর কোনও অজানা কারণে আত্মহত্যা করে– “ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ” নামের উৎপত্তি এখান থেকেই যার নাম জানে না আজ এমন কেউ নেই। কিন্তু কী এমন ছিল এই খেলায় যে রাশিয়াতে প্রায় একশো ত্রিশ জন টিনেজার স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করল স্রেফ খেলার ছলে? মনোবিদরা এর উত্তর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ২০১৬’র মে মাসে কিছু উদ্ভট তথ্য পেলেন– পৃথিবীতে টিনেজার আত্মহত্যায় নিউজিল্যান্ডের পরে বরাবরই দ্বিতীয় স্থানে ছিল রাশিয়া। পরিসংখ্যান বলছে রাশিয়ার অধিকাংশ টিনেজারই বড় হয় নিজের বাবা-মা’র কদাকার দ্বন্দ্ব এবং দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। পরিসংখ্যান বলছে রাশিয়ার ফেসবুকের থেকেও বেশি খ্যাত সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট “ভিকোন্ট্যাক্টে”তে আঠারো বছরের নিচের সমস্ত বাচ্চারা অনায়াসে পর্নোগ্রাফি থেকে শুরু করে গ্রাফিক ভায়োলেন্সযুক্ত ভিডিও দেখতে পারে কোনওরকম বাধানিষেধ ছাড়াই, পরিসংখ্যান বলছে “ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ” গেমের অনেক আগে থেকেই রাশিয়ার বিভিন্ন নেটওর্কিং সাইটে একাধিক সুইসাইড বা সেল্ফ হার্ম গ্রুপ রয়েছে যারা সরকারের নাকের ডগা দিয়ে দিনের পর দিন খোলাখুলি আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিতে থাকে টিনেজারদের। মনোবিদরা বলছেন, “ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ” রাশিয়াতে ব্যতিক্রমী কিছু নয়, বরং আত্মহত্যাকামীদের হাতে তুলে দেওয়া ধারালো ছুরি, ব্যাস।
কিন্তু ভারতে? আমাদের দেশ তো রাশিয়া নয়! শুধু ভারত কেন, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, চিলি, আমেরিকা, ইতালি, আরব সর্বত্র “ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জের” শিকার রয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত দেশের কিশোর-কিশোরীরাই অন্তত একবার করে স্বাদ পেতে চেয়েছে আলাদা হওয়ার, হাত কেটে নীলতিমির উল্কি বানিয়েছে, রাত জেগে একা একা ভুতের সিনেমা দেখেছে, গায়ে সুচ ফুটিয়ে বসে থেকেছে সারা রাত, চ্যালেঞ্জের শেষদিন পিছপা হয়নি ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে। কেন? এই দেশে এই নিয়ে একটি সফল এবং দুটি অসফল আত্মহত্যার খবর মিলেছে যাদের সকলেই ওই মারণ খেলার সাথে জড়িত ছিল। ব্লু হোয়েল খেলার চক্করে একজন মহারাষ্ট্রের কিশোর বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে, ইন্দোরের এক টিনেজার স্কুলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়ে ধরা পড়েছে সিনিয়রদের হাতে। কেন?
৩
আসল উত্তর সেই শুরুতেই– মৃত্যুর রোম্যান্টিসিজম। কৈশোর খুব নকল করে জানেন তো! আমার বাবা-কাকাদের আমলে টিভি ছিল না, ফলে ভিস্যুয়াল রূপকথারাও ছিল না। স্বপ্ন বলতে ছিল “লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে”, তাই এসেছিল সাইকেলের টায়ারে পাটকাঠির বাড়ি মেরে চাকা ঘোরানোর খেলা। আমাদের কৈশোরের শুরু হয়েছিল আলিফ লায়লা দিয়ে, চন্দ্রকান্তা দিয়ে, রামায়ণ-মহাভারত দিয়ে। আমাদের কৈশোর তাই পাটকাঠিদের কখনও তীর-ধনুক বানিয়েছে, কখনও তলোয়ার বানিয়েছে। তার পরের কৈশোর পেয়েছে অ্যাকশন ফিগার, হটউইলস। আর তার পরের জেনারেশন পেয়েছে… সবকিছু। হ্যাঁ, আমি-আপনি স্বপ্নেও যা কোনওদিন চাওয়ার কথা ভাবতে পারিনি, এই টিনেজারেরা না চাইতেই তাদের পেয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, গুগলে, পর্ন সাইটে বা অনলাইন গেমে। আর সেইজন্যেই ফুরিয়ে গেছে তারা। তারা ফুটবল মাঠের “প্লান্টিক” কী জিনিস জানে না, প্রথম প্রেম নিবেদন সামলানোর হেঁচকি জানে না, পাড়ার পিকনিক জানে না, সরস্বতী পুজোর চাঁদা জানে না, বাবার মানিব্যাগ থেকে খুচরো চুরি জানে না। কারণ তারা সব পেয়ে গেছে, তারপর খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে হাত বাড়িয়েছে একমাত্র না পাওয়ায়– ‘মৃত্যু’। বাবা-মা সব্বার লড়াই করে, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট সব্বাই করে, ভালোবেসে আঘাত সব্বাই পায়, কিন্তু আমরা কেউ এতটাও অপদার্থ ছিলাম না যে মৃত্যুতে রোম্যান্টিসিজম খুঁজব। উলটে বরাবর ভেবে এসেছি যে মরে গেলে এসব ছাইপাঁশও আর ভাবতে পারব না আগামীকাল থেকে, মরে গেলে পরেরদিন বিকেলের ক্রিকেট ম্যাচ মিস হয়ে যাবে, কার্টুন দেখা হবে না, ফুচকা খাওয়া ফুরিয়ে যাবে জীবনের মতো।
মবি ডিক হোয়াইট হোয়েল ছিল, গল্পের ক্যাপ্টেন নিজের পা খুইয়েও জীবনের শেষ মু্হূর্ত অবধি ব্যয় করে দিয়েছিল দানবীয় জন্তুটাকে হারানোর লড়াইতে। আমরাও তাই করছি, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভারত সর্বত্র। জীবন শেষ করে দিচ্ছি জীবনকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্যে– এতকিছু বলার পরেও আমাকে যদি আজ সেই ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়া কিশোরের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় আমি কিছু বলতে পারব না। তাকে এত কিছু বোঝাতেই পারব না! কারণ আমার কৈশোরে খেলার মাঠ ছিল, সব পেয়েছির ফেসবুক নয়। সরি…
এ সমস্যা খুব গুরুতর এবং আরও বহু সমস্যার সাথে যুক্ত… পরে এ নিয়ে বিস্তারিত কোনও বিশ্লেষণ লিখুন, অনুরোধ রইল…