মুসাফির এ মন

নীলাঞ্জন হাজরা

 

মুসাফিরের গত এপিসোডে অরণ্যকথা ছিল তো। আবার?

…ঠিক আবার নয়, বলতে পারেন, আরও। মুসাফিরি তো শুধু বাহিরে হয় না, অন্তরেও হয়। আমি যে দুনিয়ার অজস্র অরণ্যে ঘুরেছি তা এক্কেবারেই নয়, যৎসামান্য কিছু। কিন্তু আমার মনের মুসাফিরিতে বিরাট অংশ জুড়ে আছে অরণ্য। তাই আমার অরণ্য মুসাফিরিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেছিলাম— অরণ্যের চেতনা, অরণ্যের সম্পর্ক, অরণ্যের সংঘাত এবং অরণ্যের মৃত্যু, মৃত্যুর অরণ্য। তা দীর্ঘ— গত এপিসোড থেকে উপচে এই এপিসোডেও চলে এল। যাঁরা গত এপিসোড পড়েননি তাঁরা এখানে সেটি পড়ে শুরু করতে পারেন।

এই সেই হাতি আমার প্রাচীন রুশি জেনিথ ক্যামেরায় তোলা ১৯৮০ দশকে কিন্তু পরিস্থিতিটা কিছুটা মালুম চলবে থেকে

 

অরণ্যের সংঘাত

বিষ্ণুপুরের কাছেই জয়পুর ‘বিট’-এর জঙ্গলে এক বনকর্মীর সঙ্গে ঢুকেছি বন্য হাতি স্বচক্ষে দেখব বলে৷ সহসা সে হাতি সোজা আমরা যেখানে লুকিয়েছিলাম, তার কাছাকাছি এসে, ফিরে যাওয়ার সরু পায়ে চলার পথটির ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল৷ আমাদের এক পাশে একটা পুকুর, পিছনে ও বাঁ দিকে গভীরতর জঙ্গল এবং ডান দিকে জঙ্গল ফুঁড়ে চলে যাওয়া কংসাবতী সেচ ক্যানালের পাড়ে ফিরে যাওয়ার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বিশালকায় এক বুনো হাতি৷ জঙ্গল অন্ধকার হয়েই গেছে, আকাশ থেকে শীতের সন্ধ্যার শেষ ম্যাড়মেড়ে আলোটাও প্রায় মিলিয়ে এসেছে৷

আমরা ডুবে আছি এক গলা ল্যান্টানা আর শিঁয়াকুল ঝোপের মধ্যে৷ এতক্ষণ হাতিটার পিঠের খানিকটা অংশ আর মাঝে মাঝে ওপরে উঠতে থাকা শুঁড়টা দেখতে পাচ্ছিলাম, হয়তো শ দুয়েক ফুট দূরে বড় জোর৷ এবার আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ শুধু শব্দ৷ চাপা সরসরে একটা শব্দ, হাতিটা নড়াচড়া করছে৷ ঝড়ঝড় ঝড়ঝড়৷ বোধহয় একটা ডাল ভাঙল৷ জীবনে সেই প্রথম অনুভব করলাম মানুষের, অন্তত আমার মতো মানুষদের, ইন্দ্রিয়গুলো কত ভোঁতা৷ কত ফালতু৷ যাকে বলে ‘কমপ্লিটলি ইউজলেস’৷ ভয়ঙ্কর ভয়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম, সে এক আশ্চর্য অসহায়তা৷ চোখ দুটো একেবারে বেকার হয়ে গিয়েছে— কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না৷ শুধু যে কিচ্ছু দেখছি না তাই নয়, মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে ভুলভাল দেখছি— একটা ছায়া এগিয়ে আসতে দেখলাম মনে হল না? বনকর্মীর হাতটা শিশুর মতো খামচে ধরেছি৷ হাতিটার ওপর নজর রাখতেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম৷ কতটা ঘুরেছি? ক ডিগ্রি? পুকুরটা কি এখন আমাদের ঠিক পিছনেই? নাকি খানিকটা বাঁ দিক ঘেঁষে? ফেরার পথটা, যেটা যখন পুকুরটার দিকে যখন মুখ করে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন ত্যারছাভাবে আমাদের ডান দিকে ছিল, এখন তা হলে বাঁ দিকে কি? কতটা বাঁ দিকে? হাতিটার শব্দটা একটু সরে গেছে মনে হচ্ছে কি? হঠাৎ বুকটা ধড়াস করে উঠল— ওদিকেও কী যেন একটা শব্দ পাচ্ছি না? ভুল শুনলাম কি?

গন্ধের কথা তো ছেড়েই দিলাম৷ গোদা গোদা কিছু গন্ধ ছাড়া আমরা কিছুই পাই না৷ ২০১৪-তে বিজ্ঞানীরা যে আবিষ্কার করেছেন মানুষ ১ লক্ষ কোটি রকমের গন্ধ শুঁকে আলাদাভাবে বুঝতে পারে, তাতে আহ্লাদিত হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই৷ কেন কারণ নেই সেটা দু-একটা ছোটখাটো উদাহরণ দিলেই দেখা যাবে৷ পরীক্ষায় দেখা গেছে— একটা সাধারণ মাপের কফির কাপে এক চামচ চিনি গুলে দিলে, মানুষ চিনি ছাড়া এক কাপ কফি আর চিনি দেওয়া এক কাপ কফির মধ্যে গন্ধের তফাৎ বুঝে ফেললেও ফেলতে পারে৷ অলিম্পিকের যে সুইমিং পুল হয় সাঁতার প্রতিযোগিতার, তেমন দুটি পুলে এক চামচ চিনি গোলা হলে কুকুর তা শুঁকেই বুঝে ফেলতে পারে৷ জীববিজ্ঞানীরা বার করেছেন মানুষের আছে মোটামুটি ৪০০ কেজো ‘ওলফ্যাকটরি রিসেপটর জিন’, কুকুরের আছে ৮০০টি৷ তার মানে কুকুর মানুষের চেয়ে যে দ্বিগুণ বেশি গন্ধ পায় তা কিন্তু নয়, কুকুর (ব্লাডহাউন্ড) মানুষের তুলনায় ১০ কোটি গুণ বেশি গন্ধ পায়৷ আফ্রিকার হাতির ক্ষেত্রে সেই বিশেষ জিন-এর সংখ্যা ১৯৪৮! হাতিবিজ্ঞানী লুসি বেট্‌স ও তাঁর সহকর্মীরা এক অসাধারণ পরীক্ষা চালিয়ে জেনেছেন আফ্রিকার হাতিরা মাসাই গোষ্ঠীর মানুষ এবং কামবা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে তিরিশ ফুট দূরে রাখা পোশাকের গন্ধ থেকে! গায়ের জোর বা দৌড়নোর ক্ষমতার কথা আর তুলছিই না৷

সে দিন সেই ভয়ঙ্কর সন্ধ্যায় অন্ধকার জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আর আর একটা জিনিসও হাড়ে হাড়ে টের পেলাম— আমাদের অতি দুর্বল দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক পরিবেশের একটু বাইরে গেলেই সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়, এবং তার ফলে আমাদের দিক ঠাহর করার ক্ষমতাটাও মাথার মধ্যে সম্পূর্ণ ঘেঁটে যায়৷ শীত বাড়ছে৷ আকাশ থেকে শেষ আলোটুকু চলে গেছে৷ শুরু হয়েছে মশার কামড়৷ কিন্তু জানি, সামান্য নড়লেই, মানে কোনও ক্রমে যদি শ খানেক ফুট দূরে দাঁড়ানো সেই হাতির মাথায় ঢোকে যে আমরা তার বা তার পালের কাছে বিপদ, তা হলে অবধারিত মৃত্যু৷ কারণ, আমরা দুজনেই জানি আমাদের এগজ্যাক্ট অবস্থান সে হাতি বিলক্ষণ জানে৷ সে শুধু আমরা কী করি দেখার অপেক্ষায় আছে৷ পাল্টা অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কাছে কোনও রাস্তা নেই৷ অপেক্ষা করতে থাকি৷ সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তিগুলো কানে কেন্দ্রীভূত করে লক্ষ রাখার চেষ্টা করতে থাকি, হাতিটা সরছে কিনা৷ না, সরছে না৷ এ আমি পরে বহুবার লক্ষ করেছি— জঙ্গলে হাতি সাধারণত একটা অলস গতিতে চলে আর খায়৷ কিন্তু কোনও কারণে বিপদের আশঙ্কা টের পেলে একটা হাতি ঘণ্টার পর ঘণ্টা— আট-দশ ঘণ্টা— সম্পূর্ণ নির্বিকারভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে৷ সেই সন্ধ্যায় তার মৃদু নমুনা পেয়েছিলাম প্রথমবার৷

সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি৷ আমি কোনওকালেই ঘড়ি পরি না৷ বনকর্মীটির হাতেও ঘড়ি নেই৷ কাজেই সময়ের বোধটাও ধীরে ধীরে গুলিয়ে গেল৷ কতক্ষণ? কে জানে৷ একসময় বুঝতে পারলাম, শীত, মশার কামড়, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তি সব মিলিয়ে একটা বোধ তৈরি হচ্ছে, যেটা সেই চরম মৃত্যুভয়কে ছাপিয়ে যাচ্ছে৷ থেকে থেকেই মনে হচ্ছে, যা থাকে কপালে, শালা, ক্যানাল পাড়টার দিকটা আন্দাজ করে একটা মরিয়া দৌড় লাগাই৷ পরমুহূর্তেই অবশ্য নিজেকে সামলাই৷ সেটা নিশ্চিত আত্মহত্যা হবে৷ খানিকক্ষণ পরে আবার সেই মরিয়া ভাবটা মাথা চাড়া দেয়৷ হয়তো আমার মনের কথাটা আন্দাজ করেই খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরেন বনকর্মী ভদ্রলোকটি৷ ফের দীর্ঘ অপেক্ষা৷ হাতি নির্বিকার৷ সেই সরসর আর ঝড়ঝড় শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই৷ আর মাঝে মাঝে দূরে জয়পুর-বিষ্ণুপুর হাইওয়ে থেকে ভেসে আসা গাড়ির হর্নের ক্ষীণ শব্দ৷ ওখানে সভ্যতা৷ এই আদিমতা থেকে মুক্তি৷ যদিও সেটা ঠিক কোন দিকে, তা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই৷ দাঁড়িয়ে আছি৷ মশাগুলোকে মারতেও পারছি না৷ পাছে শব্দ হয়৷ যতদূর সম্ভব কম নড়াচড়া করে পায়ে পা ঘষে আর হাত দিয়ে তাড়াচ্ছি৷

হঠাৎ ফের বুকটা ধড়াস করে ওঠে৷ একেবারে পাশ থেকে একটা তীক্ষ্ণ স্পষ্ট শব্দ— খচাৎ৷ তারপর সির্‌র্‌র্‌র্‌৷ সর্বনাশ৷ কী করছেন ভদ্রলোক? মৃদু আলোর ফুলকি৷ চকোলেট বোমার সলতেতে আগুন দিয়েছেন ভদ্রলোক৷ লাইটার দিয়ে৷ সেটা অবশ্য নিমেষে নিবিয়ে ফেলেছেন৷ সলতেটাও জ্বালিয়েছেন হাতের তালুর আড়ালে৷ কয়েক সেকেন্ড৷ তারপর আকাশ কাঁপিয়ে দড়াম! পটকাটা ফাটল পুকুরটার মাঝামাঝি৷ তৎক্ষণাৎ বুঝলাম হাতির দিকের শব্দটা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল৷ স্থির৷ ফের খচাৎ-সির্‌র্‌র্‌র্‌-দড়াম৷ তারপর আবার৷ পর পর৷ পকেট থেকে বার করছেন আর ফাটাচ্ছেন৷ একটাই জায়গায়, পুকুরটার মাঝামাঝি৷ আর এরই মাঝে আমাকে টেনে নিয়ে আমগাছটার পেল্লায় গুঁড়িতে একদম লেপটে দিলেন৷ নিজেও তাই৷ (গাছের গুঁড়িই একবার আমায় ও আমার বন্ধু দোলনদাকে হাতির হাতে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল৷ কীভাবে, বলব সে কাহিনিও)৷

কিন্তু, হাতিটা তখনও স্থির৷ পরে আন্দাজ করেছিলাম, কী হয়ে থাকতে পারে— হাতিটা স্রেফ কনফিউজ্‌ড হয়ে গিয়েছিল৷ কারণ তার শুঁড় তাকে যেখানে মানুষের গন্ধের হদিশ দিচ্ছে, পটকাগুলো ফাটছে তার চেয়ে অনেক দূরে, সম্পূর্ণ অন্য দিকে৷ আর সেই দিকেই আছে তার পরিবার— বর, মাসি, পিসি, বাচ্চা, ভাইপো, ভাগ্নের দঙ্গল৷ হঠাৎ জঙ্গলটা যেন দুলে ওঠে৷ হাল্কা একটা ঝরঝর ঝরঝর শব্দ৷ দ্রুত সরে যাচ্ছে৷ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে৷ ঠিক যে দিক দিয়ে এসেছিল, সেই দিক দিয়েই ফিরে চলেছে সে৷ মিনিট দুয়েকের মধ্যেই হাতে টান৷ তারপর পড়িমরি দৌড়৷ এটা স্রেফ কপাল আর সেই বনকর্মীর পথ চেনার ক্ষমতা যে, আমি ধাক্কা না-খেয়ে, আছাড় না-খেয়ে, হোঁচট না-খেয়েও ক্যানাল পাড়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম৷ ঠিক সেইখানটিতেই রয়েছে আমার স্কুটার৷ সিটে হাত রেখে দেখি সপসপ করছে৷ হিম৷

পরের দিন বিকেলে ফিরে এসেছিলাম ঠিক সেইখানেই৷ সেই পুকুরপারের বেগুনক্ষেতেই৷ এক মর্মন্তুদ ঘটনার পরে৷

সেই জঙ্গল ফুঁড়ে চলে যাওয়া কংসাবতী সেচ ক্যানাল৷ সেই ক্যানাল থেকে একটু দূরে একটা মজা-মজা পুকুর৷ পুকুরের এক পাড়ে এক বড় বেগুনক্ষেত৷ তার পর জঙ্গল কেটে ঢুকে যাওয়া ধানক্ষেত৷ আগের সন্ধ্যায় এই জঙ্গলেই আমাদের বন্দি করে ফেলেছিল এক প্রখর বুদ্ধিমান হাতি৷ সত্যি বলতে কী, সেই প্রাণ হাতে নিয়ে পালানোর পর থেকে ব্যাপারটা নিয়ে যত ভেবেছি, ততই অবাক হয়েছি৷ অবাক নয়, স্তম্ভিত হয়েছি৷ প্রশ্ন একটাই— হাতিটা কী করে বুঝল আমাদের ফিরে যাওয়ার পথ কোনটা হতে পারে? এ ঘটনা তিরিশ বছর আগের৷ আজ অবধি এ প্রশ্নের কোনও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর আমি পাইনি৷ মনকে বুঝিয়েছি, এটা একেবারেই কাকতালীয়৷ আবার ভেবেছি, সত্যিই কাকতালীয়? একটা হাতি প্রায় আধ কিলোমিটার দূরের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে, একটা পুকুরপাড় দিয়ে ঘুরে ঠিক আমরা যে পথ দিয়ে পালাতে পারি, তার ওপর এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে— এটা কাকতালীয় হতে পারে? আর একটাই ক্ষীণ সম্ভাবনা থেকে যায়— এই জঙ্গলেই দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে৷ এবং সে লক্ষ করেছে, এই এক চিলতে গন্ধের সুড়ঙ্গ বেয়েই মানুষের যাতায়াত৷ হাতি চোখে খুব ভাল দেখে না, যা সে পুষিয়ে নেয় নাক আর কানের ক্ষমতা দিয়ে, তবু হয়তো দেখেও থাকতে পারে— এই পথে হেঁটে, সাইকেল চড়ে মানুষের যাতায়াত সেই পুকুর পর্যন্ত৷ এবং সেই অব্যর্থ নিশানা বসে গিয়েছে তার মস্তিষ্কে৷ কথায় এমনি বলে না, হাতির স্মৃতি!

সে সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দিতে পারিনি, যত জেনেছি এই আশ্চর্য প্রাণীটির বিষয়ে, আমার কাছে যে জঙ্গলের অবিসংবাদিত রানি৷ বাঘ বা সিংহ তার ধারেকাছে আসে না৷ ‘রাজা’ কথাটার মধ্যে আমরা যে শ্রেষ্ঠত্বের গুণাবলি খুঁজি, হাতির মধ্যে তা যা আছে, অরণ্যের অন্য কোনও প্রাণীর মধ্যে তা নেই৷ অতি প্রশান্ত স্বভাবের সে৷ সম্পূর্ণ তৃণভোজী৷ অরণ্যের অন্য কোনও প্রাণীর সঙ্গে তার কোনও বৈরী নেই৷ ঋষির মতো স্বভাব৷ ক্রুদ্ধ হলে অবশ্য ক্রোধও ঋষির মতো৷ আর রানি বলছি এই কারণে যে, মদ্দা হাতি, ‘বুল এলিফ্যান্ট’, ঠিক এমন মোলায়েম স্বভাবের হয় না৷ মদ্দা হাতির কারও সঙ্গে খ্যাঁচাখেঁচি নেই৷ বাঘসিংহের সঙ্গেও নয়, যতক্ষণ না বাঘ বা সিংহ তার ওপর হামলা শানায়৷ সেটা অবিশ্যি তারা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছাড়া করে না৷ পঞ্চাশ বছরের অরণ্য-জীবনে জিম করবেট মাত্র একবার তেমন হামলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন৷ ‘প্যান্থেরা’ জিনাস-এর প্রাণী যতদূর সম্ভব হাতিকে এড়িয়ে চলে৷

অবিশ্যি এই প্রসঙ্গে জিম করবেট আমাদের জানিয়েছেন আরও একটি জরুরি কথাও— পঞ্চাশ বছর জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে তাঁর উপলব্ধি হয়েছে— মানুষই একমাত্র জানোয়ার যা আনন্দের জন্য, স্রেফ মজা লুটতে, অন্য প্রাণী হত্যা করে, যাকে ইংরেজিতে উনি বলেছেন— ‘Killing for sport’৷ উনি তাঁর কোনও একটা কাহিনিতে এটা স্রেফ উল্লেখ করে চলে গিয়েছেন প্রসঙ্গান্তরে এই বলে যে, তাঁর পঞ্চাশ বছরের জীবনে একবারই একটা সাপ আর বেজির লড়াই দেখে তাঁর মনে হয়েছিল বেজিটা মজা করতেই সাপটাকে মারছে৷ আর কখনও, কোথাও তিনি এমনটা দেখেননি৷ কিন্তু জিম করবেটের আরও অনেক অমোঘ উচ্চারণের মতোই এর মধ্যেও লুকিয়ে আছে এক অত্যন্ত জরুরি প্রশ্ন— তা হলে মানুষের মতো একটা জানোয়ারকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব প্রকৃতি নিতে যাবে কেন?

মনে মনে ভাবি— একটা পেল্লায় বৈঠকখানায় ঢুকলাম, এই সেদিন শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়ে— দারুণ দামি দামি আসবাব৷ দুর্মূল্য সব সামগ্রী দিয়ে সাজানো৷ আর তারই পাশাপাশি দেওয়ালে বাইসন, হরিণের মাথা টাঙানো৷ মেঝেতে বাঘের ছালটা অবশ্য ছিল না৷ কিন্তু যা ছিল, আর যা দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠেছিল, তা হল নখশুদ্ধ খানতিনেক হাতির কাটা-পা — বসবার জন্য৷ যে সহকর্মীর পরিচয়ে সে বাড়িতে ওঠা, এ সব দেখে তার মধ্যে ভারী সম্ভ্রমের ভাবও লক্ষ করলাম৷ বাড়ির মালিক ছিলেন না৷ কিন্তু থাকলে নির্ঘাৎ তাঁর ছাতি ফুলে ছাপ্পান্ন হত— হেঁ-হেঁ৷ এ সবই আমার বাপ-দাদার আমলের জিনিস, জানেন তো৷ আমার ঠাকুদ্দা দারুণ শিকারি ছিলেন৷ হেঁ-হেঁ৷ এটা অন্য কোনও প্রাণীর ক্ষেত্রে ভাবা যায়? কল্পনা করা যায়?

এমন একটি জানোয়ারকে রক্ষা কেন করবে প্রকৃতি? বরং প্রশ্নটাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলা যায়— মনুষ্য নামক প্রকৃতির এই ভয়ঙ্কর সৃষ্টিটি যত দ্রুত প্রকৃতি থেকে নির্মূল হয়ে যায়, প্রকৃতির অন্যান্যদের পক্ষে ততই মঙ্গল নয় কি? আনন্দের জন্য খুন করে যে জানোয়ার, তার টিকে থাকার কোনও যুক্তিই থাকতে পারে কি, নৈতিক কিংবা জৈবিক?

হাতি তেমনটা করতে শুরু করলে কী হত? করে না৷ প্রকৃত রানি অকারণে কখনও তার ক্ষমতার অপব্যাবহার করে না, আস্ফালন দেখায় না। হাতির বুদ্ধি এবং স্মৃতিশক্তি তো বিশ্বের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর কাছে কিংবদন্তির বিষয়৷ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় সবে তা কিছু কিছু প্রমাণ হচ্ছে৷ যেমন, এ কথা আজ প্রমাণিত, হাতি একবার কোনও মানুষকে দেখলে (এই দেখাটা কিন্তু শুধু চোখের দেখা নয়, হাতি তার প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে ‘দেখে’) সারা জীবনে আর কখনও ভোলে না৷ কিন্তু সেটা তার স্মৃতিশক্তির সামান্য উদাহরণ মাত্র৷ (আগ্রহীরা অবশ্যই বিশিষ্ট বিজ্ঞান-পত্রিকা, যাতে কিনা আইনস্টাইনও লিখতেন, Scientific American-এর হাতির স্মৃতি নিয়ে এই সহজ প্রবন্ধটি পড়ুন— https://www.scientificamerican.com/article/elephants-never-forget/)

আর সেই স্মৃতিই হয়তো সেই ভয়ঙ্কর সন্ধ্যায় সেই হাতিকে হাজির করেছিল আমাদের পালাবার পথের ঠিক ওপরে৷

কিন্তু তার পরেরদিন বিকেলেই দেখেছিলাম সে হাতি উত্যক্ত হলে, ক্ষুধার্ত হলে, বাসাহারা হলে, দলের শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কিত হলে কী করতে পারে! পুকুরের এক পাড়ে এক বড় বেগুনক্ষেত, আগেই বলেছি৷ তার পর জঙ্গল কেটে ঢুকে যাওয়া ধানক্ষেত৷ সকলকে অবাক করে সে দিন দুপুর সবে বিকেলে গড়িয়েছে, ক্যানাল টপকে নেমে পড়ল হাতি৷ ছোট্ট বছর বারোর মেয়েটিকে তখন তার মা পাঠিয়েছে সামনের বেগুনক্ষেত থেকে কটা বেগুন তুলে আনতে৷ হাতিটা নামতেই দুজনে সোজা মুখোমুখি৷ মেয়েটির লাশটা যখন পাওয়া গেল, তার বুকের এ পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া একটা লম্বা দাঁত চলে যাওয়ার ফুটো৷ মাথাটা ফেটে চৌচির৷ আন্দাজ — হাতিটা দাঁতে গেঁথে শিশুটিকে ওপরে তুলে, বাঁকুড়ার ভাষায় যাকে বলে ঝিঁকে দেওয়া, সেই ঝিঁকে দিয়েছে৷ সজোরে সে দেহ আছড়ে পড়েছে মাটিতে৷ মাথাটার আর কিছু বাকি নেই৷

কিন্তু তার চেয়েও ভয়াবহ রক্তস্নাত দৃশ্য দেখেছিলাম তার বেশ কয়েক বছর পরে৷ সম্ভবত ১৯৯২-এ৷ বিষ্ণুপুরে তিলবাড়ি বলে একটা পাড়া আছে৷ ১৯৯০-এর সেই দিনেকালে সেই পাড়া থেকেই বসতি ফিকে হতে হতে জঙ্গলের প্রথম ফিকে রেখায় গিয়ে মিশেছে৷ এরই মধ্যবর্তী জায়গায় ছিল বি-এড কলেজ৷ তার পরে জঙ্গলের দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে একটা ছোট্ট গ্রাম৷ তখনও সেখানে বিজলি যোগাযোগ নেই৷ হঠাৎ একদিন শুনলাম, এই গ্রামে হাতির হামলায় একটি বাচ্চা মারা গিয়েছে৷ সঙ্গে সঙ্গে আমার সেই প্রিয় স্কুটারে চেপে ছুটলাম৷ বি-এড কলেজ অবধি গাড়ি যাওয়ার মতো মোরাম ফেলা রাস্তা৷ তারপর ধানজমি৷ আল বেয়ে বেয়ে যেতে হয় সেই গ্রামে৷ স্কুটারটা কলেজের পাশে দাঁড়ানো একটা পুলিশ-জিপের কাছে রেখে হাঁটা লাগাই৷ হট্টগোলটা কানে এল গ্রামে পৌঁছনোর আগেই৷ ধানজমি শেষ হয়ে খানিকটা মাঠের মতো৷ সেখানে রীতিমতো ভিড়৷ প্রবল উত্তেজিত মারমুখী জনতা৷ অন্তত পাঁচশোজন৷ সকলেই এ গ্রামের হতে পারেন না৷ আশপাশ থেকেও জড়ো হয়েছেন বহু মানুষ৷ অনেকের হাতেই টাঙি, বল্লম৷ পুলিশকে ঘিরে ধরেছেন তাঁরা৷ দাবি পরিষ্কার— এক্ষুনি সবকটা হাতিকে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে কিংবা তাদের চিরকালের মতো সে জঙ্গল থেকে বিদায় করতে হবে৷ জঙ্গল যে পুলিশের আওতার মধ্যেই পড়ে না, সবকটা হাতি মেরে ফেলার কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না এবং হাতি তাড়ানোর ‘হুলা পার্টি’ আনার যে একটা সরকারি পদ্ধতি আছে— এ সব বকোয়াস শুনতে মানুষ রাজি নন তখন৷

আমি এই উত্তাপ দেখে একটু অবাক হই৷ গত চার-পাঁচ বছর হল দলমা পাহাড় থেকে শীতকালে নেমে আসা হাতির পালের ক্রমাগত মুখোমুখি হচ্ছেন স্থানীয় মানুষ৷ মারা গিয়েছেন কয়েকজন৷ পথচলতি মানুষ প্রাণে বাঁচলেও তাঁদের সাইকেল মোটরবাইক ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে আকছার৷ আর তার চেয়েও বড় কথা, সারা বছরের ফসল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে বহু ছোট চাষি, যাঁদের কথা মানুষ-হাতি সংঘাতের কিস্‌সা থেকে প্রায়শই বাদ পড়ে যায় বড়বড় ওয়াইল্ডলাইফ সংরক্ষণ সেমিনারে৷ হাতির আক্রমণে হতাহতের একটা হিসেব যদিবা মেলে, হাতির পালের দৌরাত্ম্যে ক্ষতি হওয়া ফসলের হিসেব আমি অন্তত কোথাও দেখিনি৷

এখানে একটি অতি জরুরি তথ্য মনে রাখতে হবে— ভূমি সংস্কারের ফলে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ কৃষিজমি ক্ষুদ্র ক্ষেত্রের, যাকে বলে ‘স্মল হোল্ডিং’৷ এবার কল্পনা করুন, আপনার পাঁচবিঘা জমিতে ধান প্রায় পাকার মুখে৷ সোনার ছোপ লেগে গিয়েছে৷ বহু পরিশ্রমে ও খরচে সে ফসল ফলানো৷ সহসা একরাত্রিতে, একটি মাত্র রাত্রিতে তার ওপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল কুড়ি, পঁচিশ, পঞ্চাশটি হাতির দল৷ বেশিটাই খেল, বাকিটা স্রেফ মাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল৷ কল্পনা করুন, পরের দিন সকালে উঠে কী দৃশ্য দেখবেন আপনি৷ একটু ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়৷ কলকাতার অর্ধেক মানুষের সারা বছরের মাইনে যদি সহসা কেটে নেওয়া হয়, কী চিত্র দাঁড়াবে এই শহরের? সেনা নামানো ছাড়া কি প্রশাসনের সামনে কোনও পথ খোলা থাকবে? বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়ার হাজারে হাজারে কৃষক এই আতঙ্কে রাত কাটান বছরের পর বছর৷ আর মনে রাখতে হবে, এ সব অঞ্চলের অধিকাংশ জমি সিঙ্গুরের মতো উর্বর বহুফসলা নয়৷ বড় জোর দু ফসলা৷

তবু আমি অবাক হয়ে দেখেছি, এক আশ্চর্য সহনশীলতায় তাঁরা হাতির আসা-যাওয়াটাকেও একটা বেশ পরব করে তুলেছেন৷ যদিও আমি জানি আগুন আছে ধিকিধিকি, ভেতরে ভেতরে৷ থাকতে বাধ্য৷ তবু তা সাধারণত দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে না৷ গ্রামের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে টানা নাড়ু আর ছোট গেলাসে কড়া চিনি দেওয়া চা খেতে খেতে হাতি নিয়ে ঠাট্টা-মশকরাই বেশি শোনা যেতে পারে, বা হঠাৎ মুখোমুখি হওয়ার উত্তেজিত গপ্পো৷ তা হলে আজ পরিস্থিতি এত উত্তপ্ত কেন? প্রশ্নটা দু-চারজনকে করতে একজন জানান— উখানটা যেয়ে দেখে লিন হাতিগুলান কী করেছে কাইল রাইতে৷ সেখানটায় গিয়ে দেখি একটা পাতলা ভিড়৷ বাচ্চা আর মেয়েরাই সে ভিড়ে বেশি৷ কিন্তু একটা মানুষের মুখে কোনও কথা নেই৷ কথা নেই, কারণ, যা দেখলাম, যা শুনলাম, তার পরে আর মুখ দিয়ে কথা সরতে পারে না৷ অসম্ভব৷

রাত্রি কটা তখন কেউ জানে না৷ সারা গ্রাম অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। সহসা শব্দ৷ চাপা অনেক নড়াচড়ার শব্দ আর তারস্বরে গ্রামের সবকটা কুকুরের সম্মিলিত চিৎকার৷ কেউ একজন প্রথম দরজা খোলে৷ উঠোনে, এখানে, ওখানে সর্বত্র পাহাড়ের মতো দলাপাকানো অন্ধকার নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে৷ দাওয়ার লাউমাচা থেকে শুঁড় দিয়ে টেনে টেনে লতা ছিঁড়ে মুখে চালান করছে৷ চলে যাওয়ার সময় হাল্কা পায়ে মাড়িয়ে গোটা মাচাটা পিষে দিয়ে যাচ্ছে৷ স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছে না৷ শুধু বোঝা যাচ্ছে গ্রামে ঢুকে পড়েছে একপাল হাতি৷ একটা মুদির দোকান দেশলাই বাক্সের মতো মচকে ভেঙে বার করে নিয়েছে ভেলিগুড়ের বস্তাটা৷ এই করতে করতেই একটি হাতি লাথ মেরে খুলে ফেলেছে এক কামরার একটা কুঁড়েঘরের দরজা৷ ভিতরে মা আর তার দুটি বাচ্চা৷ বাচ্চা দুটিকে কোলে ঠেসে সবচেয়ে দূরের কোণে দেওয়ালে লেপটে গেলেন মা৷ অর্ধেক ভাঙা দরজা দিয়ে আলকাতরা অন্ধকার সেই ঘরের মধ্যে শুঁড় বাড়িয়ে বোঁটকা গন্ধ ছড়িয়ে ফোঁস্ ফোঁস্ নিশ্বাস ফেলছে হাতি৷ খুঁজছে৷ হঠাৎ পেয়ে গেল একটা বাচ্চাকে৷ মা দেখছেন৷ আর একটি বাচ্চাকে আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে৷ আকাশ ফাটানো শিশুকণ্ঠের কান্নাটা বন্ধ হয়ে গেল নিমেষে৷ শুঁড় দিয়ে তুলে মাটির মেঝেতে আছড়ে ফেলেছে তাকে হাতিটা৷ আর একবার৷ আবার৷ কে জানে আরও কতবার৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ৷ আমি যখন পাতলা ভিড়ের পিছন থেকে উঁকি মেরে ঝলমলে রোদ্দুরে ভাঙা দরজা দিয়ে দেখি দুদিকের দেওয়ালে রক্তের ফোয়ারার দাগ জমে কালচে হয়ে গেছে৷ শিশুর রক্ত৷ যখন ফিরে চলেছি আল বেয়ে বি-এড কলেজের দিকে, মাথাটা দপদপ করছে৷ এখনও পুলিশ জিপটা অক্ষত আছে? এখনও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়নি গোটা জঙ্গলটায়? এখনও হাতিগুলোকে মেরে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়নি? আশ্চর্য!

আমার কাহিনির কথা ১৯৮০ শেষ, ১৯৯০এর দশকের গোড়ার আর এই হল ২০১৯এর ছবি ঠিক যেমন আশঙ্কা করেছিলাম সেদিন, আগুন জ্বলে উঠেছে শিশু হাতিটিকে দেখুন (ছবিটা পেলাম ইন্টারনেটে সৌজন্য বিপ্লব হাজরা / কোয়ার্ট্ ইন্ডিয়া https://allthatsinteresting.com/human-elephant-conflict-in-india#1)

 

অরণ্যের মৃত্যু, মৃত্যুর অরণ্য

‘অ্যাই কে আছিস? গাড়িটা বার কর তো,’ দুর্গাবাবু উত্তেজিত, ‘চলো, তোমায় দেখাচ্ছি৷’

বিরাশি বছরের বৃদ্ধ৷ দুধে আলতা গায়ের রং৷ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা৷ একটু বেঁটেই বলা যায়৷ পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, গেরুয়া ফতুয়া৷ কপালে শ্বেত চন্দনের টিকা৷ দুর্গাপ্রসাদ রায়৷ দুঁদে শিকারি৷ নাটোরের মানুষ৷ তারপর উত্তরবঙ্গে এসে প্ল্যান্টার সাহেবদের শিকারসঙ্গী— বাঘ, চিতাবাঘ, বাইসন, সম্বর হরিণ, বন শুয়োর কিচ্ছু বাকি নেই৷ মনে কোনও পরিতাপ নেই৷ আমি তখন বসুমতী নামক খবরের কাগজের অতি জুনিয়র রিপোর্টার৷ ঠিক মনে নেই তবে ১৯৯০-৯১-এর আশেপাশে৷ হঠাৎ খোঁজ পেলাম ভদ্রলোকের৷ বলা ভালো, তিনিই আমায় খুঁজে বার করলেন৷ আসলে বসুমতী-র রবিবারের পাতায় একবার একটা ‘কভার স্টোরি’ লিখেছিলাম, আমার সহকর্মী বন্ধু সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী ‘বাঘ’ শিরোনাম দিয়ে সেটা ছেপে দিল৷ সেই লেখা পড়ে খুশি হয়ে, আমাদের মালবাজার করেসপন্ডেন্টের মাধ্যমে আমাকে এত্তেলা৷ তারপর অফুরন্ত শিকারের গপ্পের ভূরিভোজ৷ দিনের পর দিন, ছুটি পেলেই৷ এখন কপাল চাপড়াই সে সব কিচ্ছু নোট রাখিনি৷ শুধু শুনে গেছি আর প্রশ্ন করেছি৷ তেমনি এক প্রশ্নের জবাবে ঊরু চাপড়ে বলেছিলেন, ‘শোনো, বম্বে ন্যাচেরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে আমার একবার সালেম আলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷ সেও তোমার মতো আমায় নিরীহ পশু শিকার-টিকার নিয়ে খোঁচা দিয়েছিল৷ আমি ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম— মিস্টার আলি, আপনি নিরীহ মুর্গির গলা কেটে কেটে খান না? আপনার বিবেকে লাগে না? চুপ করে গেল৷ He didn’t have a word to say৷’ বাংলায় কথা বলতে বলতে শেষ বাক্যটা প্রথমে বাংলা তার পর ইংরেজিতে বলা গোত্রের মানুষ ছিলেন দুর্গাবাবু৷

তবে জীবনের প্রথম শিকার তাঁর শখে নয়৷ সাংঘাতিক প্রয়োজনে৷ আর প্রথম শিকারই ছিল এক পেল্লায় চিতাবাঘ৷ ‘আমার জ্যাঠামশাইয়ের টিবি হয়েছিল, বুঝলে,’ শুনিয়েছিলেন দুর্গাবাবু৷ ‘ডাক্তার বদ্যি অনেক দেখানো হল৷ কেউ কিস্‌স্যু করতে পারল না৷ তখন আমরা নাটোরে থাকি৷ সেখানে যক্ষ্মাটক্ষ্মার কোনও চিকিৎসাই ছিল না সে সময়ে৷ আমার তখন ষোল বছর বয়েস, বুঝলে৷ I was just sixteen৷ শেষে নাটোরের রাজবাড়ির যিনি বৈদ্য, তাঁকে গিয়ে আমি ধরলুম৷ তাঁর নিজের বিরাট বাগান ছিল বনৌষধির৷ বিরাট ব্যাপার৷ তা তিনি তো আমার জ্যাঠামশাইয়ের নাম শুনেই রাজি হয়ে গেলেন৷ দেখে-টেখে জ্যাঠামশাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আমাকে ডাকলেন৷ বললেন— বাবা, এ রোগের চিকিৎসা আমার জানা আছে৷ এর জন্য যা-যা ওষুধ সব আমার বাগানেই আছে৷ কিন্তু বাবা, এ হল রাজরোগ৷ এর চিকিৎসা করতে হলে এমন একটা জিনিস লাগবে তা তো আমার কাছে নেই, আর তুমিও দিতে পারবে না৷ তা আমি বললাম, কী এমন জিনিস কবরেজ মশাই? আপনি বলুন না৷ ভগবানের আশীর্বাদে টাকাপয়সার অভাব হবে না৷ কবরেজ মশাই বললেন, টাকা দিয়ে তো সে জিনিস বাজারে পাবে না৷ তা হলে কি সে জিনিস? তখন তিনি আমাকে বললেন, লাগবে বাঘের চর্বি৷ আমি তো আকাশ থেকে পড়ি৷ সে কি, কবরেজ মশাই? সে এখন কোথায় পাব? অন্য কিচ্ছুতে হবে না? গরু-মোষ-শুয়োর-পাঁঠা? না৷ বাঘের চর্বি ছাড়া হবে না৷ মনটা খারাপ হয়ে গেল, বুঝলে ভাই৷ I was crestfallen৷

তা, এই বলে রাজকবিরাজ তো চলে গেলেন৷ মনটা খারাপ৷ কেবলই ভাবছি কী করা যায়? আমাদের পরিবারে বাবা-জ্যাঠামশাই সকলেই শিকার করেছেন এক সময়৷ কিন্তু জ্যাঠামশাইয়ের কথা তো ছেড়েই দিলাম, বাবারও তখন ষাটের ওপর বয়স৷ বন্দুক ধরার মতো হাত স্টেডি নয়৷ আর বাঘ শিকার কি মুখের কথা! এই সব ভাবছি৷ হঠাৎ পরের দিন আমাদের এক চাকর এসে খবর দিল, বাবু কাছেই অমুক গ্রামে চিতাবাঘে গরু মেরেছে৷ আমার রোখ চেপে গেল, বুঝলে৷ I was determined৷ চাকরটাকে বললাম— রাইফেলটা বের কর৷ তা বহুকাল ব্যবহার না হওয়া সেই বন্দুক, পরিষ্কার-টরিষ্কার করে আমি দুপুরের দিকে সেই গ্রামে গিয়ে হাজির হলাম৷ দেখি একটা বাছুরকে মেরেছে৷ চিতাবাঘ৷ গ্রামটার বাইরে একটা মাঠের মতো তার পাশেই একটা বিশাল নিমগাছ ছিল৷ আমি গ্রামের লোকজনকে বলে সেই মরা বাছুরটাকেই নিমগাছটার একটা উঁচু ডালে টাঙিয়ে দিলাম৷ মঠের আরেকপাশে একটা ঘন ঝোপ ছিল, তার মধ্যে লুকিয়ে বসে রইলাম৷ এর আগে বনমুরগি-টুরগি মেরেছি৷ কিন্তু বড় প্রাণী কখনও না৷ Big game, never৷ গ্রামের লোককে বলে দিয়েছি ধারেকাছে যেন কেউ না থাকে৷ ভয় ভয় করছে৷ কিন্তু এও জানি, ভগবান আমায় এ সুযোগ এনে দিয়েছেন৷ কাজেই দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছি৷ বিকেল চলে গেল৷ প্রায় সন্ধ্যার মুখে I heard a growl৷ দূরে গাছটার পিছনের একটা ঝোপ থেকে শব্দটা আসছে৷ আমি বুঝলাম, বাঘ এসে গেছে৷ এই বার দেখি সে এক-পা এক-পা করে গুঁড়ি মেরে মেরে গাছটার দিকে এগোচ্ছে৷ কিন্তু আমি তো মাটি ঘেঁষে গুলি করতে পারছি না৷ গাছটার কাছাকাছি এসে বাঘটা স্থির হয়ে গেল৷ এদিকে আলো কমে আসছে৷ গরম কাল ছিল৷ সেটাই ভাগ্য৷ সূর্য ডোবার পরেও অনেকক্ষণ আলো থাকে৷ আমি অপেক্ষা করে আছি, বাঘটা গাছে উঠলেই আমি গুলি করব৷ বহুক্ষণ পরে গাটাকে একটু তুলে দুটো লাফ মেরে সে সোজা গাছটার গুঁড়ি আঁকড়ে ওপরে উঠে গেল৷ In two bounds it was up on the tree৷ যা থাকে কপালে, আমি গুলি চালিয়ে দিলাম৷ অব্যর্থ নিশানা, বুঝলে৷ ধড়পড় করতে করতে পড়ে গেল৷ আমি উঠে দাঁড়িয়ে ফের একটা গুলি মারলাম৷ সেই আমার প্রথম শিকার৷ সেই বাঘের ছাল ছাড়িয়ে, চর্বি বার করে আমি তো কবরেজ মশাইয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে বললাম— চিতাবাঘের চর্বি হলে চলবে? তা উনি তো অবাক৷ বললেন, দেখা যাক৷ আমার মনে আছে, সেই চর্বি ফুটিয়ে অনেক কী-কী সব মিশিয়ে কবরেজ মশাই ১২টা না ১৫টা হরলিক্সের শিশির মতো শিশিতে করে ওষুধ পাঠিয়ে দিলেন৷ সেই ওষুধ খেয়ে জ্যাঠামশাই শুধু সেরেই উঠলেন না, আশি বছর পর্যন্ত দিব্যি বেঁচে ছিলেন৷ বুঝলে, He lived to be eighty৷’

এহেন দুর্গাবাবু উত্তরবঙ্গে এসে বহু জঙ্গল তো বটেই, ১৩টি আস্ত নদীও ইজারা নিয়েছিলেন৷ অরণ্যের স্পন্দন ছিল তাঁর নাড়িতে৷

যদ্দূর মনে আছে মালবাজার পেট্রল পাম্পের পিছনেই রায় পরিবারের পেল্লায় বাড়ি থেকেই একদিন সকালে চাকরকে দিয়ে গাড়ি বার করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে চললেন গরুমারা জঙ্গলে৷ ঠিক কোনখানটায় আজ আর মনে নেই, কিন্তু সম্ভবত খুনিয়ার মোড়ের কিছুটা আগে আমরা আলিপুরদুয়ারের হাইওয়ে ছেড়ে গভীর জঙ্গলের ঢুকে পড়লাম৷ তারপর এক জায়গায় গাড়ি রেখে, দুর্গাবাবু, তাঁর চাকর আর আমি হেঁটে জঙ্গলে চলতে লাগলাম৷ সেই প্রথম খেয়াল করলাম উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে লতা বাঁকুড়ার জঙ্গলের থেকে অনেক বেশি৷ আর জঙ্গলটা অনেক বেশি আর্দ্র, যদিও সেটা বোধহয় মার্চ-এপ্রিল মাস ছিল৷ হঠাৎ তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘দেখো৷ চারপাশে দেখো৷ কী দেখছ?’ আমি চুপ করে আছি৷ জানি উনিই উত্তর দেবেন৷ দিয়ে তার শেষটা ইংরেজিতে তরজমাও করে দেবেন৷ তাই হল, ‘দেখবে শুধু শাল আর সেগুন৷ হাতি কি শাল আর সেগুন পাতা খায়? খাবে কী? আমি বলেছি হাতিকে জঙ্গলে রাখতে গেলে অনেক রকমের গাছে জঙ্গল ভরে দিতে হবে৷ ক্যাঁদ, ডুমুর, মহুয়া, কাঁঠাল, জাম— এই সব গাছ চাই৷ ফলদায়ী গাছ৷ বুঝলে, Fruit bearing trees৷ চাই বড়বড় বাঁশঝাড়৷ হাতি কচি বাঁশের কোঁড় খেতে খুব ভালোবাসে৷ আর চাই প্রচুর বুনো এলাচ৷ ওয়াইল্ড কার্ডামম৷ আমি দেখেছি, হাতির অত্যন্ত প্রিয় খাবার৷ ওরা গাছটা উপড়ে ফেলে, গাছের গোড়াটা খায়৷ এখানে হয়তো আছে এখানে ওখানে৷ চলো দেখি৷ কচু পাতার মতো, তবে আর একটু লম্বা লম্বা পাতার ঝোপ৷ ভীষণ ভালোবাসে৷ They love it৷’

সেই ঝোপ খুঁজে বার করে, উপড়ে তার গোড়ায় গোল সাদা কন্দ ভেঙে এলাচের গন্ধ শুঁকিয়ে, দুর্গাবাবু সে দিন আমায় বুঝিয়ে ছিলেন শাল-সেগুনের মনোকালচারের জঙ্গল দেখে আমরা আহ্লাদিত হতে পারি, আসলে তা কোনও অরণ্যই নয়৷ দেশে রেলগাড়ি আসা ইস্তক, রেল লাইনের স্লিপার তৈরির হিড়িকে আসল জঙ্গল সাফ হয়েছে আর তৈরি হয়েছে শাল জঙ্গল৷ চুরমার হয়ে গেছে চিরকালের মতো ভারতের অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র৷ শুধু মানুষই নয়, ঔপনিবেশিক জাঁতাকল অভুক্ত ক্ষুধার্ত করে দিয়ে গেছে ভারতের অধিকাংশ জঙ্গলের প্রাণীকেও৷ সারা জীবন জিম করবেট বিহারের মোকামে ঘাটে থেকে সেই কাজটিই করতেন৷ আর তা করতে করতেই উপলব্ধি করেছিলেন এই ঔপনিবেশিক মহাযন্ত্রের ভয়ঙ্কর গ্রাস কী সর্বনাশ করতে পারে অরণ্যের৷

দুশো বছর ধরে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শোষণ এ দেশে শুধু মানুষের মধ্যেই মন্বন্তর এনে কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেনি, ভারতের জঙ্গলের মৌলিক চরিত্রটাই বদলে দিয়ে, আমার মনে হয়, চিরকালের মতো তাকে শেষ করে দিয়ে গেছে৷ ১৯৪৭-এ রাজনৈতিক হস্তান্তর হয়ে আমরা স্বাধীন হলাম বটে— এবং তার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা প্রতিটি আর্থসামাজিক পরিসংখ্যানেই প্রতিফলিত— কিন্তু আমার মনে হয়েছে সরকার বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের এমন একটা বৈরিতার সম্পর্ক তৈরি করে গেছে এই ঔপনিবেশিক শাসন যে, আমরা ভারতীয় নাগরিকরা যা-কিছু সরকারি তাকেই পরের দ্রব্য ভেবে থাকি৷

ছোটবেলায় হিন্দিতে একটা কথা শুনতাম— কোম্পানিকা মাল, দরিয়ামে ডাল৷ এ কোম্পানি নিশ্চয়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যাদের কাছ থেকে রানি শাসনক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার বহু বছর পরও ভারতীয়রা ব্রিটিশ সরকারকে কোম্পানির সরকার বলেই ডাকত৷ সে কোম্পানি আমাদের অনিষ্ট করে, আমাদের ওপর অত্যাচার করে, তার সম্পত্তি জাহান্নামে যাক, আমাদের কী৷ এই ধারণাটা যে আজও ঘোচেনি, তা সরকারি বাসগুলি দেখলেই বোঝা যায়৷ সরকারি অর্থভাণ্ডার মানেই অপচয়, এ কথাটা আমরা সবাই মানি৷ জঙ্গলের ক্ষেত্রেই বা তার অন্যথা হতে যাবে কেন? ঘুষ দাও বনদপ্তরের বাবুদের৷ কাটো গাছ৷ চালান করো কাঠচেরাই কলে৷ কামিয়ে নাও কোটি কোটি টাকা৷ এই কাঠ চোরাকারবারিদের ব্যবসা একটা গোটা লম্বা সুতো, যাতে টান পড়লে কাত হবে স্থানীয় অরণ্য সংলগ্ন গরিব-গুর্বো মানুষ, যাদের সাহায্য ছাড়া জঙ্গলে কোনও কিছু করাই অসম্ভব, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা যাকে হাতে না রাখলে স্থানীয় মানুষকে উশকিয়ে গোটা অপারেশনটাই তিনি পণ্ড করে দিতে পারেন, পুলিশের হরেক সাইজের কত্তা, যাঁরা বাধ সাধলে কাটা গাছ ট্রাকে করে পাচার করা অসম্ভব, কাঠ চেরাই কলের মালিক, যিনি বেআইনি গাছ দ্রুত চেরাই করে তার জন্য অল্প দাম দিয়ে উপরি টু পাইস কামিয়ে নেন, ফার্নিচার দোকানের মালিক যিনি চোরাই কাঠ সস্তায় কিনতে পারেন এবং আমি-আপনি যাঁরা সেগুনের পালিশ দেখে মুগ্ধ কিন্তু কদাচ ভাবি না সে সেগুন এল কোথা থেকে৷ গাছ মরলে সক্কলে খুশ৷

শুধু দু ধরনের প্রাণী ছাড়া৷ অরণ্যের পশু এবং অরণ্য-নির্ভর মানুষ৷ কিন্তু এর মধ্যে, আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল, অরণ্য-নির্ভর মানুষ আর দ্রুত অরণ্য-নির্ভর থাকছেন না৷ থাকতে পারছেন না৷ থাকতে চাইছেনও না৷ তাঁরা দ্রুত চাষাবাদের দিকে সরে গিয়েছেন৷ সরে যাচ্ছেন৷ যেতে বাধ্য হচ্ছেন৷ ‘সভ্য সমাজের’ যা কিছু উপাদান— মোটরবাইক, টেলিভিশন, সেলফোন তাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে৷ সেগুলির মজা তাঁরা বিলক্ষণ বুঝেছেন৷ আর বুঝেছেন সেগুলি কিনতে গেলে যে অর্থ দরকার তা অরণ্য-নির্ভর জীবিকায় সম্ভব নয়৷ কাজেই, শুনতে খুব খারাপ লাগলেও, এটাই আমার অভিজ্ঞতা যে, অরণ্যের প্রয়োজন তাঁদের ফুরিয়ে গিয়েছে৷ বরং চরিত্র বদলে যাওয়া খাদ্যহীন অরণ্যে ক্রুদ্ধ দিশাহারা হাতির মতো ভয়ঙ্কর জানোয়ার তাঁদের কাছে বিভীষিকা৷ কাজেই সংঘাত৷ এবং মৃত্যু৷

আর সে যে কী বিভীষিকা ১৯৯২-এর মার্চ-এপ্রিল মাস নাগাদ তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমি আর আমার বন্ধু দোলনদা, বিভাবসু মিত্র৷ তত দিনে বাঁকুড়ায় ‘হুলা পার্টি’ কথাটা সকলেই জেনে গিয়েছে৷ কী সেটা৷ এক মাহাতামাশা৷ ক্ষুধার্ত হাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামের মানুষ স্থানীয় রাজনীতিকদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকলেন— হাতি হটাও৷ তিনি স্থানীয় এমএলএ-কে বললেন— হাতি হটাও৷ এমএলএ বনদপ্তরকে বললেন— হাতি হটাও৷ ঠিক হল হাতি হটানো হবে৷ কীভাবে হবে? সেটা স্বচক্ষে দেখতেই এক সকালবেলা আমি আর দোলনদা হাজির হলাম জয়পুর বিট অফিসের কাছে কংসাবতী সেচ ক্যানালের ওপর একটা স্লুইস গেট লাগানো কালভার্টের কাছে৷ হাজির হয়েই দেখি পরব লেগে গেছে৷ আশপাশের গ্রাম থেকে ছেলে বুড়ো ছুঁড়ি বুড়ি সবাই জড়ো হয়েছে তামাশা দেখতে৷ পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ৷ তারা ঘিরে নিয়েছে গোটা এলাকা৷ সাজো সাজো রব৷ কী? না, হুলা পার্টি বেরোবে৷ ক্যানালের ওপারে যে খানচল্লিশ হাতির দল আছে তাদের খেদানো হবে৷ পুলিশ কাউকে ধারে কাছে আসতে দিচ্ছে না৷ কিন্তু আমার বাবা কিঞ্চিৎ স্থানীয় পরিচয় থাকায় ক্যামেরা-গলায় আমার ও দোলনদার কোনও অসুবিধা হল না৷

–তোমরা কোথায় যাবে ভাই?
–আমরা হুলা পার্টির সঙ্গে যাব৷
–অ৷ ভয়ঙ্কর বিপদ কিন্তু৷
–তাই জন্যই তো যাব৷
–অ৷ ওদিকে চলে যাও৷

ওদিকে গিয়ে দেখি হুলা পার্টির তোড়জোড় চলছে৷ জনা তিরিশেক আদিবাসী (সংখ্যাটা আজ আর সঠিক মনে নেই, তবে ওইরকমই হবে)৷ তাদের অনেকের হাতে একটা অদ্ভুত বর্শা, যার ডান্ডাটা যেখানে ধারালো ফলায় গিয়ে মিশেছে সেখানে একটা সরু লোহার জালের মতো করা৷ পরে দেখলাম আইডিয়াটা হল, সেই জালের মধ্যে কাপড় গুঁজে দিয়ে, কেরোসিন ঢেলে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়৷ সেই আগুনে বল্লমের ফলা গরম হয়ে থাকে৷ হাতি তেড়ে এলে সেই গরম ফলা ঢুকিয়ে দেওয়া হবে তার গায়ে৷ ব্যাটা অ্যাইসন সবক শিখবে যে আর কোনওদিন মানুষের ধারেকাছেও আসবে না৷ আর কয়েকজনের হাতে কেরোসিন ভর্তি জেরিক্যান আর লম্বা লম্বা মশাল৷ এবার এই জনা তিরিশেকের দল তিনভাগে ভাগ হয়ে দেল৷ আইডিয়া— তিনটে দল একে অপরের থেকে কিছুটা দূরে দূরে জঙ্গলে ঢুকে হাতির দলকে অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে ঘিরে ফেলবে৷ তারপর প্রবল হট্টগোল করে তাদের দিকে ধেয়ে যাবে৷ ভয় পেয়ে হাতির দল পালাবে৷ হুলা পার্টি পিছন পিছন ছুটে তাদের জঙ্গলের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আসবে৷

–কিন্তু এই বিপুল আয়োজনে সকাল-দুপুরে হাতিকে যে দূরত্বে তাড়ানো হবে, রাত্রে হাতি তো তা অবলীলাক্রমে পেরিয়ে ফের যেখানে পাকা ধান সেখানে চলে আসবে৷ কিংবা আশেপাশের অন্য কোনও গ্রামে হাজির হবে? তা হলে?
–অত জটিল প্রশ্ন করবেন না মশাই৷ পরের দিন সরকারি পয়সায় এ মোচ্ছব তখন আবার হবে৷ ওই যে কোম্পানি কা মাল…৷

হাতি খেদানো (ছবি সৌজন্য কেটার্স নিউজ https://allthatsinteresting.com/human-elephant-conflict-in-india#6)

 

যাই হোক সেই তিন দলের একটা দলের সঙ্গে আমি আর দোলনদা তো জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম৷ তখন বোধহয় বেলা এগারোটা-সাড়ে এগারোটা৷ ঢুকেই ঘন ঝোপে ডুবে গেলাম৷ পাঁচ-দশ ফুট দূরের ওপারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ আগে হাতির কাছে পৌঁছন তারপর তাড়া৷ সেটা কীভাবে হবে৷ হুলা পার্টির একজন একটা পেল্লায় গাছ বেছে তার মগডালে চড়ে পড়ল৷ সেখান থেকে সে হাতির পাল দেখতে পাচ্ছে এবং হুলা পার্টির তিনটি দলকেই, যারা একে অপরকে দেখতে পাচ্ছে না, ইশারায় হাতির দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিচ্ছে৷ হাতি অবশ্য তৎক্ষণাৎ গন্ধ পেয়ে সরে সরে যেতে শুরু করেছে৷ সেও এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা৷ অত বড় একটা হাতির দল চলে যাচ্ছে, নিঃশব্দে৷ ছায়ার মতো৷ অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্যি৷ জঙ্গলে দু পা চলে দেখুন শুকনো পাতা মাড়ানোর এত আওয়াজ হবে নিজেই চমকে উঠবেন৷ হাতির বেলা নয়৷ কেবল মচকানো ঝোপঝাড় আর সেই মগডাল থেকে দেওয়া ইশারায় আমরা বুঝতে পারছি হাতি চলে গেছে এইখান-এইখান দিয়ে৷

বহুক্ষণ এই লুকোচুরির পর কানে এল একটা অদ্ভুত শব্দ— গুড়গুড়গুড়গুড়গুড়গুড়৷ টানা৷ যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসা এনফিল্ড মোটরবাইক দ্রুত চলে যাওয়ার শব্দ৷ হঠাৎ দেখলাম হুলা পার্টির লোকজনের মধ্যে একটা টান-টান ভাব৷ তারা শঙ্কিত, কিংবা উত্তেজিত৷ এর মিনিট দশেক পরে, দেখি আমাদের দলের সামনের ভদ্রলোকটি, যার হাতে মশাল আর কেরোসিনের জেরিক্যান, আমায় চুপি চুপি ইশারায় ডাকছে৷ ক্যামেরাটা আঁকড়ে আমি এগিয়ে যাই৷ এবার তিনি সামনের দিকে আঙুল দিয়ে দেখান৷ কিছুই চোখে পড়ে না— গাছ-পালা ঝোপ-ঝাড়৷ চড়াই ডাকছে৷ তিনি আবার দেখান৷ খুব মন দিয়ে দেখি৷ বুকটা ধড়াস করে ওঠে৷ বেশ কিছুটা দূরে ঘন ঝোপের ওপরে একটা মাথা৷ শুধু মাথাটা৷ শরীরের আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না৷ স্থির৷ নিষ্কম্প৷ সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে, কারণ আমিই তখন দলের একেবারে সামনে৷ আমাদের দলটাও স্থির৷ ঘামছি৷ ধীরে ধীরে ক্যামেরাটা তুলে চোখে লাগাই৷ তাতে লাগানো একটা জার্মিন টেলিফটো লেন্স৷ যাতে ৪০ মিটার অবধি, মানে ১২০ ফুট অবধি শার্প ফোকাসে ধরা যায়৷ তার পরেই ‘ইনফিনিটি’ চিহ্ন৷ পরিষ্কার মনে আছে লেন্সের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে আমি ৪০ মিটারের দাগে ফোকাসটা পেয়েছি, আর উঠল প্রলয়ঙ্কর ঝড়৷ আমি শাটারটা টেপারও সময় পাইনি৷ একটা ধূসর বিপুল বল, হ্যাঁ গোল বল, ধেয়ে আসছে আমার দিকে৷ সঙ্গে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার৷ আর হুলা পার্টির চিৎকার৷ তারপর শুধু মনে আছে একটা বাজ পড়ার মতো শব্দ৷ তারপর ঝড় শেষ৷ আমার ক্যামেরাটা ঠকাং করে লাগল একটা বল্লমে৷ দোলনদা একটা বিশাল কুলঝোপ থেকে প্রায় ঝুলে আছে, সারা গা, বাঁকুড়ার ভাষায়, ঝুঁড়া গেছে৷

আমি জীবনে অনেকবারই ভয় পেয়েছি, কিন্তু মৃত্যুভয় কাকে বলে তা জেনেছিলাম সেই প্রথম৷ মনে আছে আমার ভীষণ বমি পাচ্ছিল, কিন্তু বমি হচ্ছিল না৷ বেঁচে ফিরব ভাবিনি৷ কিন্তু কী করে বাঁচলাম? দৈবাৎ৷ আমার আর হাতির মাঝখানে পড়ে গিয়েছিল একটা ফুট কুড়ি-তিরিশ লম্বা শালগাছ৷ কয়েক লহমায় ১২০ ফুট দূরত্ব পেরিয়ে, আমার থেকে দশ হাত দূরের সেই শালগাছটায় হাতিটা মেরেছে এক গুঁতো৷ সম্ভবত চোখে হাতি ভালো দেখে না বলেই৷ অত বড় গাছটা দেশলাই কাঠির মতো উপড়ে গেছে শিকড়শুদ্ধ৷ শালগাছের শিকড় মাটির বহু গভীরে চলে যায়৷ বাজ পড়ার শব্দটা আসলে শুকনো মাটি থেকে সেই শিকড় উপড়ানোর শব্দ৷ গুঁতো মেরেই হাতিটা ফিরে চলে গেছে৷ আজও ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়৷ আমি দেখেছি, হাতির সন্ত্রাস কী ভয়ঙ্কর জিনিস৷ এই সন্ত্রাসে, বাঁকুড়ার, পশ্চিম মেদিনীপুরে, পুরুলিয়ার জঙ্গলে আজ পদে পদে মৃত্যুর নাচ৷ দিনে-রাতে, দুপুরে-সন্ধ্যায়৷ এ তামাশা নয়৷

 

চলবে

 

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5006 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. 20Bet Asia brings you the ultimate slot experience with a vast selection of thrilling games. Whether you prefer classic fruit machines or innovative video slots, you’ll find everything you need for non-stop entertainment. With providers like NetEnt, Play’n GO, and Pragmatic Play, the slot collection at 20bet is nothing short of impressive. These games offer stunning visuals, immersive soundtracks, and exciting bonus features like free spins and multipliers. Some slots even have massive progressive jackpots waiting to be claimed!

আপনার মতামত...