সৌগত ভট্টাচার্য
ঘন্টা বাজবে এখন। পুজো শেষ। বিপ্লবকৃষ্ণের হাত নাড়ানো দেখলেই বুবি উলু দিতে শুরু করে। উলুর শব্দ ঘন্টাকে ছাপিয়ে যায় ছোট্ট মন্দিরের চারপাশে। বিপ্লবকৃষ্ণ পুজো শেষ করে ধুতি সামলে উঠতে উঠতে বুবিকে ইশারা করে পুজোর ফুল পাতাগুলো পরিষ্কার করে দিতে। বুবি হ্যাঁ না কিছু বলে না, মাথা নেড়ে হি হি করে হাসে শুধু। বিপ্লবকৃষ্ণ কয়েকটি ফল হাতে বুবির সামনে এসে বলে, “এই নে…!” বুবি দু-একটা ফল একসঙ্গে মুখে ঢুকিয়ে হাত ধুতে যায়। এই ফলগুলো সকালবেলায় বুবিই কেটে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে ঠাকুরের সমানে। সকালে বিপ্লবকৃষ্ণ আসার আগে মন্দিরে বুবি চলে আসে। মন্দির লাগোয়া ‘মা তারা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ থেকে মন্দিরের গেটের চাবি নিয়ে বুবি তালা খুলে মন্দির ধুয়ে মুছে ফল কেটে ফুল সাজিয়ে রেখে বিপ্লবকৃষ্ণের আসার অপেক্ষা করে।
পুজো শেষ হলেই বিপ্লবকৃষ্ণ মন্দিরের পেছনে ভোগ রান্নার ঘরে গিয়ে ধুতি ছেড়ে পাঞ্জাবির নীচে প্যান্ট পরে নেয়। সে সময় বুবি ফল প্রসাদের থালাটা নিয়ে মন্দিরের সামনে বসা বাজারের সবজিওয়ালা, দোকানদারদের হাতে হাতে ফল প্রসাদ দেয়। প্রসাদ দেওয়া শেষ হলে মন্দির ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে সন্ধ্যা আরতির জন্য তৈরি করে। চৌকো মন্দির প্রাঙ্গনের পাশেই একটা অনেক পুরনো বটগাছে অনেকে মানত করে লাল সুতো বাঁধে। বুবিও মানত করে একটা সুতো বেঁধেছে বটগাছের গায়ে। বুবি মন্দিরের কাজ শেষে হাজার হাজার সুতোর দিকে তাকিয়ে থাকলেও নিজের বাঁধা সুতোটা চিনতে পারে না। কোন ভাষায় যে মানত করেছে বুবি!
“ওকে বলে কোনও লাভ নেই, কতবার বলেছি জল পালটে মোছ, সেই কালো হয়ে যাওয়া জল দিয়েই মুছবে…” পিয়ালিবৌদি চিৎকার করলেও বুবি শুনতে পায় না। “শুনতে পায় না ছাই!” পিয়ালি আবার মুখ ঝামটা দিয়ে বলে। পিয়ালি জানে যে বুবি শুনতে পায় না, বলতেও পারে না, শুধু হাসতে পারে। বুবি পিয়ালির দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হি হি করে হাসে। বুবির হাসি দেখে পিয়ালির মাথায় রাগে রক্ত উঠে যায়! বুবি ফ্রিজের কোণায় বসে এককাপ চা সামনে নিয়ে স্টিলের বাটি থেকে মুড়ি চিবোয়। এখান থেকে আরও দুটো বাসাবাড়িতে কাজ করে বুবি বাড়ি ফিরবে।
“এত চিৎকার কেন? মাছ বাজার বসেছে নাকি?” ক্যানক্যানে গলায় বলতে বলতে টিউশনে ঢোকে বছর বিয়াল্লিশের বিপ্লবকৃষ্ণ চক্রবর্তী। মন্দিরের কাছেই একটি বাড়িতে সেভেন এইটের কয়েকটি ছেলেমেয়েকে ‘টিউশন পড়ায়’ বিপ্লবকৃষ্ণ। সকাল বিকেল মন্দিরের পুজো সেরে দুটি ব্যাচে ফাইভ থেকে টেন আর্টস গ্রুপ পড়ায়। ছাত্ররা তার গলার আওয়াজে চুপ করে যায়। বিপ্লবকৃষ্ণ ঘরে ঢুকে কিছু বলার আগেই মানিক বলে, “স্যার, বাবা বলছে মালিক পেমেন্ট করলে আপনাকে দুই মাসের টাকা একবারে দেবে!” বিপ্লবকৃষ্ণ কম টাকার প্রাইভেট মাস্টার। সেই পেমেন্টও ঠিকমত পায় না। সারামাস ধরে টুকটাক করে পেমেন্ট করে ছাত্ররা। বিপ্লবকৃষ্ণ পাঞ্জাবির পকেট থেকে খুচরো বের করে সামনের টেবিলের ওপর এক দুই পাঁচ ও দশ টাকার কয়েনগুলোকে একটার উপর একটা রেখে সাজায়। বিপ্লবকৃষ্ণ কালেকশনের খুচরো গুনতে গুনতে সমানে একটা নোট খাতা খুলে বলতে থাকে, “ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আচার ও নিয়মসর্বস্বতা… সংস্কৃত ভাষার দুর্বোধ্যতা…. ব্রাহ্মণদের সীমাহীন অত্যাচার থেকে বাঁচতে নিম্নবর্ণের মানুষ দলে দলে অন্য ধর্মে গ্রহণ করে চলে যায়!”
“স্যার, কী বললেন? আর একবার বলেন না!” রবি সূত্রধর বলে।
বিপ্লব বলে, “বৈদিক যুগে কয়টা বর্ণের কথা জানতে পারি বল?” রবি চুপ করে থাকে।
রকেট মণ্ডল বলে, “চারটা বর্ণ— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র!”
“ভেরি গুড, সে সময়ে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় ছাড়া অন্যরা নিচু বর্ণের মানুষ ছিল….”
“স্যার, বর্ণ মনে কী?” সন্তু বলে।
“চুপ কর, যা বলছি শোন….”
বিপ্লবকৃষ্ণ বলতে থাকে “ব্রাহ্মণরা নিচু বর্ণের মানুষের ওপর অত্যাচার করত, সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষাদান, মন্ত্র উচ্চারণ বা মন্ত্রপাঠের অধিকার নিচু শ্রেণির মানুষের ছিল না। ব্রাহ্মণরা বলত এগুলো ঈশ্বরের নির্দেশ, নিম্নবর্ণের মানুষকে পালন করতে হবে। জন্মগতভাবে এই অধিকার ছিল ব্রাহ্মণদের। প্রশ্ন করার অধিকার তাদের ছিল না। এই নির্দেশ যখন অত্যাচারে পরিণত হল তখন কিছু মানুষ সেগুলোর প্রতিবাদ করে অন্য ধর্মে চলে যায়! যেখানে জাতিভেদ বা উঁচু নিচু শ্রেণি, বর্ণ কিছুই ছিল না। সকলেই সমান। সবচেয়ে বড় কথা, সেখানে সরল কথ্য ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। কথ্য ভাষায় ঈশ্বরকে ডাকা যায়… এমনকি সরল ভাষায় ধর্মগ্রন্থ রচনা হয়, অনুবাদ হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর এই ঘটনাকে বলে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন!”
“কী বলে?”
“প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন!” বাচ্চারা সবাই বলে। এই কথাগুলো বলতে বলতে সকালের মোট মন্দিরের কালেকশন হিসেব করে ফেলেছে বিপ্লবকৃষ্ণ!
“বাংলা খাতা বের কর, আজকে বাংলা পরীক্ষা না!” বিপ্লবকৃষ্ণ বলে। সকালের দিকে মন্দিরে কালেকশন তেমন হয় না। মর্নিংওয়াকে আসা মানুষজন প্রণামীর বাক্সেই টাকা ফেলে। তাছাড়া যে যেমন ছুড়ে দেয় মায়ের পায়ে সেটাই বিপ্লবকৃষ্ণর কামাই। দক্ষিণা বিপ্লবকৃষ্ণর, প্রণামীর বাক্সের কালেকশন ডোনেশন মন্দির কমিটির। সেটা দিয়ে মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ বাৎসরিক পুজো ভোগদান ইত্যাদি হয়। বিপ্লবকৃষ্ণ মন্দির কমিটির মাইনে-করা পুরোহিত। কিন্তু সে মাইনেতে বউ ছেলেকে নিয়ে এই বাজারে সংসার চলে না তার। তাই, পাশাপাশি টিউশন করতে হয় বিপ্লবকৃষ্ণকে।
আলো ফোটার আগেই বুবির ঘুম ভাঙে। শীত গ্রীষ্ম ঘুম থেকে উঠেই স্নান করা বুবির অভ্যেস। বুবির “আউ আউ…” করা তীব্র গোঙানি মেশানো শব্দে পাড়ার অনেকের ঘুম ভেঙে যায়। সবাই বোঝে বুবি ফুল চুরি করতে বেরিয়েছে। “মেয়েটিকে শুধু দুবেলা খেতে দিবেন… যাতে প্রাণে বেঁচে থাকে!” জামবাড়ির সুকুমার অলোকেশ বসুকে বলেছিল। “ছেলেগুলোকে তাও অন্যের জমিতে কাজে পাঠাতে পারব। কিন্তু বোবা মেয়েটাকে…” অলোকেশকে কথাগুলো বলতে চোখ জলে ভিজে গেছিল সুকুমারের। একটা ছিটের ফ্রক পরে খালি পায়ে বুবি সেই যে শহরে অলোকেশের বাড়ি এসেছিল, সেই থেকে বুবি চল্লিশ বছর ধরে এখানেই থেকে গেছে। অলোকেশ ছিল জামবাড়ি হাইস্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই, বেশ কিছু জমিজায়গাও করেছিল। তার বিরাট বাড়ির বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো রান্নাঘরের পাশে একটা ছোট্ট ঘরে বুবির ঠাঁয় হয়েছিল। অলোকেশ মারা গেছে অনেকদিন হল। এখন বুবি মোট চারটি বাসাবাড়িতে কাজ করে। এখনও অলোকেশদের বাড়িতেই রাতে থাকে বুবি। অলোকেশের ছেলে বাপ্পা বুবিকে রাতের ভাত দেয়, থাকার ঘর দেয়। তাই অলোকেশদের বাড়ি থেকে কোনও টাকা বুবি পায় না। “হারামজাদি নচ্ছার আবার দরজা খুলে ফুল তুলতে এসেছিস!” পাড়ার সাধন বুবিকে বাসি মুখে গালি দেয়। বুবি হো হো করে হাসতে হাসতে “আউ আউ…” করে দৌড়ে গলির মোড়ের দিকে চলে যায়। মন্দির ধোয়ামোছার সময় হয়ে যায়।
বিধুভূষণ রায় তাঁর জোতের মালপত্র বেচার জন্য প্রতি বুধবার সরলপুরে হাট বসানোর ব্যবস্থা করেন। এখন এই হাটই সরলপুরের সবচেয়ে বড় বাজার। এই বাজারে ঢুকতেই ডান হাতে প্রাচীন বটগাছ তলায় কালীমন্দির। মন্দিরটি বিধুভূষণের তৈরি করেছিলেন তাঁর মা চারুবালা দেবীর স্মৃতিতে। বিধুভূষণ তাঁদের ময়নাডাঙ্গা জোতের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বিনয়কৃষ্ণকে এই মায়ের মন্দিরের পুরোহিত করে সরলপুরে নিয়ে আসেন। বিপ্লবকৃষ্ণ বিনয়েরই কনিষ্ঠ সন্তান।
মন্দিরের ঘণ্টার সঙ্গে একটা নাইলনের দড়ি বাঁধা। দড়ি পুরনো হয়ে গেলে নতুন দড়ির রংটা মাঝে মাঝে পালটে যায়, কখনও লাল কখনও সবুজ কখনও আকাশি… ঘন্টার দড়ির রং পালটালে বুবি বিরক্ত বোধ করে। কেন বিরক্ত হয় বুবি, সে কথা বিপ্লবকৃষ্ণ ঠাহর করতে পারে না। বুবি রোজ ঘন্টার দড়ি ধরে টানে, বিপ্লবকৃষ্ণ আরতি করে আর কিছু লোক বসে সন্ধ্যা আরতি দেখে। ধুপধোঁয়ার গন্ধে চারপাশ ভরে যায়। বুবির চোখ মাঝেমাঝে ধূপের ধোঁয়ায় জ্বালা করে, কিন্তু ধূপের গন্ধ ভালোও লাগে। সকালের মতোই বিকেলের রুটিন বিপ্লবকৃষ্ণর। সন্ধ্যা আরতি শেষ করে বিপ্লবকৃষ্ণ সোজা টিউশন পড়াতে চলে যায়। বুবি মন্দির পরিষ্কার করে বন্ধ করে চাবিটা মিষ্টির দোকানে রেখে দেয়।
“মানুষকে বোঝতে হবে, আরও জনসংযোগ বাড়াতে হবে…” গৌতম মিত্র যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, ঠিক সেই সময় বিপ্লবকৃষ্ণ পার্টি অফিসে এসে ঢোকে। বিপ্লবকৃষ্ণকে দেখেই গৌতম মিত্র সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলেন, “বিশুর দোকানে পাঁচটাকে সাতটা লাল চা বলে বোস, দরকারি কথা আছে!” মন্দিরে আরতি, টিউশনি সেরে রোজ সন্ধ্যা পার্টি অফিসে আসে বিপ্লবকৃষ্ণ। “দুনিয়ার চারপাশের যা অবস্থা, যে ভয়ানক আগ্রাসন…!” এক সময়ের সরলপুরের নামজাদা শিক্ষক নেতা গৌতম বলে যান। শিক্ষক সমিতির আন্দোলন দিয়ে জীবন শুরু করলেও গৌতম দীর্ঘদিনের পার্টিসদস্য। অবসর জীবনে আরও যেন পার্টিকে জড়িয়ে ধরেছেন তিনি। পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে নানা বিষয়ে নানা সময় তীব্র মতবিরোধ থাকলেও তা নিয়ে প্রকাশ্যে কখনওই রা করেননি। রাজ্যে পালা পরিবর্তনের পর, যখন পার্টির অনেকেই এদিক ওদিক চলে যেতে শুরু করে বা নানা অজুহাতে ঘরে বসে যায়, সেই সময় গৌতম একাই সন্ধ্যাবেলায় পার্টি অফিস খুলে এক কাপ চা নিয়ে বসে কিছুক্ষণ খবরের কাগজ পড়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিতেন। তাঁর কাছেও অন্য দলের লোভনীয় অফার ছিল। গৌতম নাক টেনে বলেছিল, “আমরা সবাই তো সরলপুরের মানুষের জন্য রাজনীতি করব, মানুষের কল্যাণ হলেই হল, আমার পথ না হয় এটাই থাক!”
কথার মাঝে মাঝে নাক টানা গৌতমের স্বভাব। চায়ে চুমুক দিয়ে গৌতম বলেন, “পুরসভার ভোট কোন মাসে হবে এখন দেখা যাক। রাজ্যকমিটির নির্দেশ না এলে আমরা প্রচার শুরু করতে পারব না….!” পার্টি অফিসে বাকি চারজন বসে ঘাড় গুঁজে মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রোল করতে করতে হুঁ হ্যাঁ করে উত্তর দিচ্ছিল। গৌতম মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না। মেয়ে সোহিনীর চাপে ইদানীং একটা বেসিক ফোন ব্যবহার করেন। সারাদিনে ক্লান্ত বিপ্লবকৃষ্ণ লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে মাথা পেছনে ঝুলিয়ে ঝিমোচ্ছিল। “এই বিপ্লব, বাড়ি গিয়ে ঘুমো!” গৌতম বলেন। বিপ্লব চোখ বুজেই বলে, “আপনি বলুন, আমি শুনেছি!”
“তোর শরীর কি ক্লান্ত লাগছে?” গৌতম বলেন।
“নাহ, কাল সকালে একটা গৃহপ্রবেশের নারায়ণপুজো আছে, মন্দির আছে, পড়ানো আছে, সব কীভাবে ম্যানেজ করব সেটাই ভাবছি। বলুন বলুন…” চেয়ার থেকে শরীর তুলতে তুলতে পার্টি অফিসের দেওয়ালে পরপর টাঙানো সাদাকালো ছবিগুলোর দিকে বিপ্লবকৃষ্ণর নজর যায়। কবে থেকে এই ছবিগুলো দেখে আসছে বিপ্লবকৃষ্ণ। এঁদের নিয়ে কত গল্প শুনেছে পার্টির সিনিয়রদের থেকে। ঠিক যেমন বিপ্লবের বাবা বিনয়কৃষ্ণ তাঁদের শোয়ার ঘরের ধারের বেড়ায় টাঙানো ঠাকুরদেবতার ছবি দেখিয়ে ছোটবেলায় বিপ্লবকে নানা গল্প শোনাতেন। বেহুলা লখিন্দরের গল্প বিপ্লবকৃষ্ণের খুব প্রিয় ছিল। বিপ্লবকৃষ্ণের মন্দিরের দেওয়ালে টাঙানো শিবের ছবিটার কথা মনে পড়ে। ছবিটায় শিবের জটার দিকটায় অনেক দিন হল নোনা ধরেছে। ছবিটা নতুন করে বাঁধাতে দিতে হবে। টেবিলের ওপর রাখা পার্টির মুখপত্রটি হাতে নেয় বিপ্লবকৃষ্ণ। ভেতরের পাতায় হেডিং, “পুর নির্বাচনের জন্য বুথ ভিত্তিক প্রস্তুতি নিচ্ছে পার্টি!” বিপ্লবকৃষ্ণ মনে মনে ভাবে আজ বাড়ি গিয়ে পঞ্জিকা দেখতে হবে, কাল পূর্ণিমা কখন লাগবে। পূর্ণিমা না লাগলে পুজো শুরু করা যাবে না…. পঞ্জিকা কী বলে!
“একদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারো না! কতবার বলি!”
“সামনে ইলেকশন। গৌতমদা তাই একটু সময় দিতে বলেছে!”
“আচ্ছা, কাল তোমার বাইরে পুজো আছে না?”
“আছে!”
“সেই তো সাতসকালে ওঠো, তাড়াতাড়ি ফিরলে সন্ধ্যায় একটু রেস্ট হয়..”
“পার্টি অফিসটাই তো আমার একমাত্র আড্ডা…”
“কী আড্ডা মারো বলো তো?”
“কেন? কী আড্ডা মানে? আড্ডার কথা ওভাবে বলা যায় নাকি!”
“না, আড্ডা মানে তো ওই কঠিন কঠিন কথা আলোচনা… জিজ্ঞেস করব ভাবি, আবার ভুলেও যাই। আচ্ছা, তুমি তোমার গৌতমদার কথা বোঝো?”
“কেন বলো তো?”
“না উনি কীরকম সব কঠিন কঠিন কথা কেটে কেটে বলেন!”
“সে একটু বলে ঠিকই। শুদ্ধ বাংলা আর কী! মাস্টারমশাই ছিল, তাই হয়তো!”
“সে তো তুমিও মাস্টার!”
“আরে সোমা, বোঝো একটা কথা, আমি আর গৌতমদা কি এক হলাম? গৌতমদা কত জ্ঞানী পণ্ডিত মানুষ, কত পড়াশোনা জানো! আর আমি কোথায়…”
“যাই বলো, হতে পারে পণ্ডিত মানুষ, কিন্তু আগে উনি যখন বক্তৃতা দিতেন কিছুই বুঝতাম না! সে কথা আমরা মেয়েবউরা বলাবলি করতাম। তোমাদের পার্টির লোকজনের বক্তৃতার সব কথা বোঝা যায় না কেন গো? বাইরে থেকে যাঁরা আসতেন সরলপুরে তাঁরা কী সব কঠিন কঠিন বক্তৃতা দিয়ে চলে যেতেন, বাবা রে বাবা।”
“তুমি আর জীবনে কয়টা বক্তৃতা শুনেছ সোমা, মাঠের ভাষায় কত মানুষ বক্তৃতা দেয় জানো?”
“টিভিতে এত বছরেও তো কাউকে দেখলাম না মাঠের ভাষায় কথা বলতে! আমি আমারটুকু বললাম! কে বোঝে জানি না বাবা! আমি মুখ্যসুখ্য মানুষ, আমি বুঝি না!”
এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে মন্দিরের সামান্য পুরোহিত বিপ্লবকৃষ্ণ, বুঝে পায় না। বিপ্লবকৃষ্ণ বলে,
“পুরোহিত দর্পণটা কোথায় রেখেছ, কাল লাগবে!”
রাতে খাওয়ার শেষে ঘরে পরপর টাঙানো ঠাকুরের ছবিতে প্রণাম করতে গিয়ে মাঝে মাঝে পার্টি অফিসের দেওয়ালের সাদাকালো ছবিগুলোর কথা মনে পড়ে বিপ্লবকৃষ্ণর। দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলোকে প্রণাম করে শুয়ে পড়ে সে। মার্চ মাসেও ফ্যান চালিয়ে গায়ে একটা হালকা চাদর দিলে আরাম হয়।
পুরোহিত দর্পণের প্রতিটা পাতায় বাবার হাতের স্পর্শ টের পায় বিপ্লবকৃষ্ণ। পার্টি যে বছর ক্ষমতায় এল সেই বছর বিপ্লবকৃষ্ণের জন্ম। বিপ্লবের মামা শ্যামল শিকদার ছিলেন শহরে পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী। শ্যামল সাধ করে ভাগ্নের নাম রেখেছিলেন বিপ্লব। কৃষ্ণ তো বিপ্লবের পারিবারিক উপাধি। কিন্তু নরানাং মাতুলক্রম হবে কে জানত!
“নমঃ শ্রী বিষ্ণু নমঃ শ্রী বিষ্ণু নমঃ শ্রী বিষ্ণু…. তিনবার জল এখানে দিন!” বিপ্লবকৃষ্ণ পার্টির লিফলেটগুলোকে ভাঁজ করে “গৃহপ্রবেশ”, “অন্নপ্রাশন”, “বিবাহ” ইত্যাদি লিখে লিখে মোটাসোটা “পুরোহিত দর্পণ” এর পেজ মার্ক বানিয়েছে। আজ “গৃহপ্রবেশ” লেখা পেজ মার্ক খুলে “পুরোহিত দর্পণ” থেকে বলতে থাকে। মাঝে মাঝেই বাংলায় লেখা সংস্কৃত শব্দে হোঁচট খায়। “উমমম… নমঃ গঙ্গা অং…” বিপ্লবের মন্তর পড়তে পড়তে মনে মনে বলে, “শালা কী কঠিন কঠিন শব্দ লিখে গেছে মাইরি। যাঁরা লিখেছে নিজেরা বুঝত কি না সন্দেহ! এক্কেরে পার্টির বইগুলোর মত!” পার্টির বইগুলো পড়তে গিয়ে অনেকবার হোঁচটও খেয়েছে, পড়ার উৎসাহ পায়নি— কোন দেশের শব্দ যে সেগুলো! ঈশ্বরের কাছে বা মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য কেন যে সহজ করে লেখা হয় না বইপত্তরগুলো— বিপ্লবকৃষ্ণ মনে মনে ভাবে!
পার্টি অফিসে ঢোকার সাথে সাথেই গৌতম মিত্র একটি লিফলেট বিপ্লবকৃষ্ণের হাতে ধরিয়ে দেন। “কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান”। বিপ্লবকৃষ্ণ পড়তে পড়তে বলে “কবে থেকে প্রচার?” গৌতম বলেন, ”আমাদের পুরনো ঘরে বসে যাওয়া পার্টির মেম্বারদের আবার বোঝাতে হবে, একত্রিত করতে হবে! তারপর একটা মিটিং করে মার্চের মাঝে থেকে প্রচারের নির্দেশ এসেছে কেন্দ্রীয় কমিটির থেকে!” এপ্রিলের সতেরোয় ভোট। বিপ্লবকৃষ্ণ বলে, “পনেরোতে পয়লা বৈশাখ, সেদিন আমার মন্দিরে ব্যস্ততা থাকবে, এখনই বলে দিলাম!” একসময় মন্দির কমিটি থেকে বাজার কমিটি সবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পার্টির অঙ্গুলিহেলনে চলত। গৌতম মিত্রর কথাই অনুচ্চারিত শেষ কথা ছিল সরলপুর অঞ্চলে। এখন পরিবর্তিত দিনকাল।
লিফলেট আর দক্ষিণার খুচরোগুলো টেবিলে রাখে বিপ্লবকৃষ্ণ। সোমা চা এনে দেয়। আজ বিপ্লবকৃষ্ণ বাড়ি ফিরতে বেশি রাত করেনি। বিপ্লবকৃষ্ণর শোয়ার ঘরের টেবিলের পাশে একটা বইয়ের তাক আছে। সেখানে পার্টি থেকে পাওয়া কিছু বইপত্র রাখা তার পাশেই “পুরোহিত দর্পণ” “নিত্য পূজা পদ্ধতি” আর কিছু পাঁচালি। এগুলোর নীচের তাকে কিছু স্কুলপাঠ্য সহায়িকা, যা বিপ্লবের ছাত্র পড়ানোর কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। টিউশনের বাচ্চাগুলোর বাংলা পরীক্ষার খাতা রাতের মধ্যেই দেখতে হবে বিপ্লবকৃষ্ণকে।
“এই যদি বানানের অবস্থা হয়!.. বাংলাটা কি খুব কঠিন ভাষা সোমা?”
সোমা কোনও উত্তর করে না, আর্যকে তখন পড়াচ্ছিল। বিপ্লবকৃষ্ণ বলে যায়,
“একটা কথা বুঝেছি, যাঁদের হাতে যত বেশি দাপট থাকে তাঁদের কথা বলার কায়দা কানুন ভাষা সব অন্যরকম হয়, তাঁদের কথা সবাই মানে। বাকি আমাদের মত হেজিপেজি মানুষের ভাষা অন্যরকম, আমাদের কথা কেউ শোনে না!”
“বুবি তো কথাই বলতে পারে না, তাহলে কি ওর কিছু বলার নেই!” সোমা বলে।
“বুবির ইশারা আমি বুঝি, কিন্তু সবাই তো আর বোঝে না! ইশারাটাই তো ওর ভাষা! আমরা সবাই ওকে বোবা বলি! ও ইশারা দিয়ে ও কী বলতে চায় বোঝায়! কিন্তু যারা বোবা না, কথা বলতে পারে, তারা বাংলায় কথা বললেও তাদের কথা অনেক মানুষ বোঝেই না কী যে বলতে চায়!”
“সে তো প্রতিবার মঙ্গলচণ্ডীর সময় মন্দিরে তুমি যখন মন্ত্র বলো আমি তো কিছু না বুঝেই বুবির মত ঠোঁট নাড়ি! আমার নিজের যেন কোনও ভাষাই নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের মত করে কিছু একটা বলে ঠাকুরের পায়ে ফুল দিই! কিন্তু হয় আর কই…”
বিপ্লবকৃষ্ণ খাতা দেখতে দেখতে বলে,
“আমি কি ছাই সব বুঝি নাকি। মাঝেমাঝে মন্ত্র পড়তে গিয়ে ভাবি সহজ সরল ভাষায় মন্ত্রগুলো লেখা হলে ভালো হত!”
“তুমি তো পুজোটাই করবে সারাজীবন, সংস্কৃতটা শিখে নিলেই পারো!”
“সে তো শেখাই যায়, কত স্কুল নাকি হয়েছে সংস্কৃত মন্ত্র সংস্কৃত ভাষা শেখানোর, তাতে কী আর হবে। আমি নয় সংস্কৃত শিখলাম বুঝলাম জানলাম, কিন্তু যাঁরা সেই মন্ত্র শুনবে বলবে তারা কী বুঝবে? তারা তো আর সংস্কৃত জানে না! তার চেয়ে সহজ সরল ভাষায় বইগুলো, মন্ত্রগুলো লিখলেই ভালো হত!”
“এত কথা আমি বুঝি না! কাল কিন্তু মুদি বাজারটা এনে দিও, কাল তোমার ব্যস্ততায় ভুলে যেও না আবার!”
“মনে আছে। দেব… আমি যখন মন্দিরে পুরোহিত হয়ে মন্ত্র পড়ি সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেয়, কিছু না বুঝেই শুধু বুবির মত ঠোঁট নাড়ায়। আবার পার্টির কেউ যখন বেদিতে মালা দেয় বা বক্তৃতা দেয় আমিই অনেক কথাই অনেক সময় কিছু বুঝি না, মুখ নাড়াই! মাঝে মাঝে তো সংস্কৃত মন্ত্রও বলে বেদিতে ফুল দিয়ে দিই…!”
“সত্যি বলতে কী, এই যে তুমি কী সব লিফলেট বইপত্র নিয়ে আসো, এগুলোও তো বাংলায়ই লেখা, আমি অনেকবার পড়ার চেষ্টা করে দেখেছি, কিছুই বোঝা যায় না তা না, দুই নম্বর লাইন পড়লে প্রথম লাইনটা ভুলে যাই। কেমন যেন কঠিন কঠিন শুকনো লেখা, পড়তে উৎসাহ লাগে না!”
“পণ্ডিত মানুষদের ভাষা মনে হয় কঠিনই হয়। সে পার্টির পণ্ডিতই হোক বা মন্ত্র লেখার পণ্ডিত! মন্ত্রই বলো আর পার্টির বইই বলো সব মানুষের ভালোর জন্যই তো লেখা হয়। কিন্তু যাঁদের ভালোর জন্য লেখা হয় তাঁরা এগুলো কী সত্যিই বোঝে! বুঝলেও কী বোঝে! ভগবানই জানে !”
“এত কঠিন কঠিন ভাষায় লিখে যে কী লাভ এগুলো? যাক ছাড়ো, অনেক হল পার্টি-টার্টি! কাল মুদি বাজারের কথাটা মনে রেখো, মুদি দোকানের লিস্ট এখানে রাখলাম! আর ছেলের স্কুলের ভ্যানের টাকা রেখে যেও! “
অনেক রাত হল, বিপ্লবকৃষ্ণের চোখ ঘুমে লেগে আসে, ক্লান্ত শরীর বিছানার আরাম চায়।
আজ সরলপুরে মহামিছিলের ডাক দিয়েছে পার্টি। বুবি সাজগোজ করে একটা লাল ছাপের শাড়ি পড়ে মিছিলে এসেছে। বিকেলে পার্টি অফিসের উল্টোদিকের হাইস্কুলের মাঠে দুটো চৌকি জোড়া লাগিয়ে মঞ্চ তৈরি হয়েছে। মঞ্চের পাশে একটা রিকশায় চোঙ বাঁধা। একটু পরেই মিছিল বেরোবে। বুবি একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে নমিতাদের সঙ্গে হাত নাড়িয়ে ইশারায় “হি হি…” করে গল্প করছে। কাঁটায় কাঁটায় চারটায় ঘড়ি ধরে মিছিল শুরু হয়। সকলের হাতে দলের পতাকা দেওয়া হয়েছে। বুবির হাতেও একটা বাঁশের ডাঁটির মধ্যে পতাকা লাগানো। রিকশার পেছনে লাগানো চোঙা থেকে স্লোগান দিচ্ছে চার পাঁচজন কর্মী। বিপ্লবকৃষ্ণ দেখছে, মিছিলের সবার মুখে নাড়া দেখে কিছু না শুনেই বুবিও “আউ আউ…” করে সজোরে কিছু বলার চেষ্টা করছে, উলু দেওয়ার মত, বা অঞ্জলির দেওয়ার মত করেই! স্লোগানের সঙ্গে বুবির হাত নাড়া, যেন মনে হচ্ছে সে অভ্যাসবশত মন্দিরে ঘন্টার দড়ি টানছে, টেনেই যাচ্ছে। কিন্তু বুবির ভাষাহীন শব্দ মিছিলের কেউ শুনতে পাচ্ছে না। রিকশার পেছন থেকে ওঠা মিছিলের স্লোগানের শব্দে বুবির গোঙানির ভাষা হারিয়ে যায়, শোনা যায় না। যেমন ঘন্টার আওয়াজে শোনা যায় না মন্দির দর্শনে আসা মানুষের নিজেদের মধ্যে বলা কথাবার্তা।
মিছিল বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর এবার ফেরার পালা। ফেরতা মিছিলটি কালিতলা মোড়ের সমানে আসলে, গৌতম মিত্র আর কিছু মানুষ যাঁরা রিকশার পেছনে মাইকে স্লোগান দিতে দিতে নেতৃত্ব দিচ্ছিল তাঁরা পুরনো রংচটা, দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়া সরলপুর পার্টি অফিসের দিকে যাওয়ার জন্য বাঁ ঘুরে যায়। বিপ্লবকৃষ্ণ ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে যেন দেখতে পায়, বাকি মিছিলটা ডান দিক না বাঁ দিক না সোজা নতুন এক রাস্তা ধরে হাঁটতেই থাকে… মিছিল যেন চলতে থাকে বাঁধ পেরিয়ে নদীর দিকে পাহাড়ের দিকে, গড়ে ওঠা নতুন রাস্তা দিয়ে নতুন জনপদের দিকে… যে নতুন জনপদের নাম স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে লেখা আছে… মিছিলটি চলছে যেন খ্রিস্টজন্মের অনেক শতাব্দীতে আগে কোনও এক ভারতবর্ষের বুকে নতুন গজিয়ে ওঠা জনপদ অভিমুখে… সেখানে পণ্ডিত-মূর্খ সবাই সাধারণ মানুষের বোঝার মত সরল সোজা ভাষায় কথা বলে… বদলে যাওয়া সময়ের নতুন ভাষায় কথা বলে… দলে দলে মানুষ সেই মিছিলে যোগ দিতে থাকে, বুবি নামিতা বুবির বাবা সুকুমার সবজি বিক্রেতা পরিতোষ পার্টি অফিসে চা দেওয়া বিশু বিধুভূষণের ক্ষেতের চাষিরা … হাঁটতে থাকে… বিল্টু সূত্রধরের ছেঁড়া ইতিহাস বইটির তৃতীয় অধ্যায় থেকে কালো কালো অক্ষরগুলো যেন মানুষের ছায়া হয়ে মিছিলটিতে যোগ দেয়… মিছিল ক্রমশ লম্বা হয়ে যায়… মিছিল দীর্ঘ হয়ে যায়…