বাসু আচার্য
অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি (শেল্টার) থেকে যে রাতে সরোজ দত্তকে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ, সে রাতে আকাশে দলা পাকানো মেঘ ছিল। ছিল পরদিনের বৃষ্টির ইঙ্গিত। আমরা অবশ্য তখনও মাতৃজঠর চিনে উঠতে পারিনি। আর তাই ভ্রূণ হওয়ার অবকাশটুকুও ছিল না। কিন্তু প্রায় পাঁচ দশক সময় অতিক্রমণের দোরগোড়ায় এসে মনে হয়— ছিলাম তো ওখানেই, তোমার পাশে, কমরেড; মুখর ইতিহাসের মূক সাক্ষী হয়ে…।
‘৭১-এর চৌঠা অগস্ট, রাত সাড়ে-এগারোটা নাগাদ, রীতিমতো তৈরি হয়েই এসেছিল রুণু-দেবী-তারাপদরা। এসেছিল বাহিনী সাজিয়ে, মানবিক সত্তাগুলোকে বালিচাপা দিয়ে। পরদিন ভোররাতে লোকটাকে আরিয়ানস্ ময়দানে গুলি করে মাথাটা কেটে নিয়ে প্রমাণ লোপের চেষ্টাও করেছিল ওরা। কিন্তু, ওই যে! পাপ কি কখনও ছাই চাপা থাকে? যাকে ভাবো বোবা, বধির… তার অবিনশ্বর আত্মা চিৎকার করে ওঠে : আমাকে খুন করেছে, প্রতিশোধ চাই…। কিছু বছর পর বেলুড় বাজারে পড়ে থাকতে দেখা যায় গুলিবিদ্ধ ‘টর্পেডো’-কে। পাশে সস্তা কাগজে ছাপা লিফলেট, প্রেরক— ‘দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি পরিচালিত সিপিআই (এম-এল)’।
সরকারি খাতায় অবশ্য সরোজ দত্ত আজও ফেরার। ‘৭৭-এ দেওয়া তদন্তের প্রতিশ্রুতি বাম আমলে কেন, এই পরিবর্তনের সপ্তম বছরেও পালন হ’ল না। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। যে খুন করবে, সেই আবার খুনের তদন্ত করবে, এটা দেখতেও বেশ অশ্লীল লাগে, না কি! তবে যদ্দুর জানি সরোজ দত্তর অনুগামীরা চানও না ‘অ্যাবস্কন্ডেড’ নেতার ফাইলে তাঁর শাহাদতের সরকারি শিলমোহর। সরকার এবং রাষ্ট্র, এই অত্যাচার যন্ত্রের বিরুদ্ধে যাঁর আজন্ম লড়াই, তাঁকে সরকারি কেতাবে ‘মর্যাদা’ প্রদান করা হবে ভাবলেই তাদের বিবমিষা জাগে। অবশ্য এমন লোকও আছে যারা ‘বিপ্লব’, ‘নকশালবাড়ি’ ইত্যাদি নাম ব্যবহার করতে কসুর করে না, আবার ‘মানবাধিকার কমিশন’-এর দ্বারস্থ হতেও ছাড়ে না। বলিহারি ট্যাকটিকস! সংশোধনবাদীদের উদ্দেশে সরোজ দত্ত একবার লিখেছিলেন, ইচ্ছে করে ‘মেরে শুয়োরের বাচ্চাদের দাঁতের পাটি খসিয়ে দিই’। জানি না, তার অনুগামীদেরও এসব নৌটঙ্কি দেখে একই সাধ জাগে কিনা!
এইসব নৌটঙ্কিবাজরা নাকি বুঝতে পারে না কখনও সামরিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা কবি-ইন্টেলেকচুয়াল-সাংবাদিক সরোজ দত্তকে পুলিশ কেন খুন করল। মুক্তির দশকের সেই উত্তাল দিনগুলোতে কানু সান্যাল, অসীম চ্যাটার্জী, সন্তোষ রাণারা প্রত্যক্ষ যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন, পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। রীতিমতো আগুনখোরও ছিলেন। কিন্তু তার পরেও তো তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছিল রাষ্ট্র। কিন্তু সরোজ দত্তর বেলায় কেন…? উত্তরটা মধ্যবিত্ত বিপ্লববিলাসীরা কিভাবে দেবেন জানি না, তবে আমার মনে হয়, শত্রু কখনও শত্রু চিনতে ভুল করে না। চারু মজুমদার সরোজ দত্তের নিহত হওয়ার দৃষ্টান্ত দেখুন, সাথে মিলিয়ে নিন বেঁচে ফেরা নেতৃবর্গের পরবর্তী জীবনটা।
সরোজ দত্তকে সেই কারণেই হত্যা করা হয়েছিল, যে কারণে হত্যা করা হয় চারু মজুমদারকে। সরোজ দত্ত শিরদাঁড়ার বিনিময়ে, আদর্শের বিনিময়ে মুক্তি অথবা জীবন খরিদ করতে চাননি। কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এসবই তো উপরিকাঠামোর পরিচিতি। আসল পরিচয় মানুষের শ্রেণিপরিচয়। রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্রকে তুমি যদি চ্যালেঞ্জ করো, তাহলে তুমি বাঁচবে না, সে তুমি যেই হও না কেন!
সরোজ দত্ত পাতি বুর্জোয়ার দার্শনিক ইমারতটা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, মধ্যবিত্তের বিপ্লব বিলাস হল “বৈশাখের মধ্যদিনে অগ্নিদাহে মূর্চ্ছাতুর আমি/চাহি মেঘ, চাহি জল, চাহি বৃষ্টিধারা।/সকলি আনিবে যবে মহামেঘ কালবৈশাখীর/পাতার কুটিরে আমি উৎকণ্ঠায় হব দিশেহারা।” কারণ তিনি জানতেন, বিপ্লব একটা প্যারাডাইম শিফ্ট, এবং চূড়ান্ত পর্বে সেটা মননে। সমাজতান্ত্রিক মানুষ ছাড়া সমাজতন্ত্র টেকে না। তাই সহস্র বছরের সামন্ততান্ত্রিক সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে ভেঙে নতুন প্রলেতারীয় আধিপত্য গড়ার পথেই এগোচ্ছিলেন তিনি। আর সেজন্যই তো তাঁর চলার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হ’ল।
সরোজ দত্ত শহীদ হওয়ার পর চারু মজুমদার বলেছিলেন: ‘কমরেড সরোজ দত্ত পার্টির নেতা ছিলেন এবং নেতার মতোই তিনি বীরের মৃত্যুবরণ করেছেন।’ হ্যাঁ, সরোজ দত্ত নেতা ছিলেন, এমন একজন নেতা যিনি স্ত্রীর মুখে সাবধানে থাকার পরামর্শ শুনে উত্তর দিয়েছিলেন: ‘এইডা কি কইলা বেলা! যুদ্ধে কি শুধু বাহিনী মরব! আরে দুই একডা সেনাপতিরও তো জ়ান যাইব!’ নির্মম ভবিষ্যৎদ্রষ্টা!
শহীদ স্মরণে লিখতে গিয়ে চারু মজুমদারের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল: ‘শ্রমিক এবং দরিদ্র ভূমিহীন কৃষকের সাথে একাত্ম হয়ে এই হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে হবে।’ পাঁচ দশকের পারে পৌঁছে দেখছি সেদিনের অধিকাংশ হত্যাকারীরা আজও হায়না হয়ে তাজা রক্তের সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘু্রে বেড়াচ্ছে। আমাদের হেলদোল নেই। কিছু লোক নিরীহ কৃষকের গলা কেটে বিপ্লব করছে, শ্রেণির প্রশ্ন গুলিয়ে দিয়ে পার্টিকে শত্রু বানাচ্ছে! আর একদল নির্বাচনী গড্ডালিকায় নাম লিখিয়ে, চারু মজুমদার-সরোজ দত্তকে ভাঙিয়ে আখের গুছিয়ে নিচ্ছে।
কিন্তু এগুলোই তো শেষ কথা নয়! চারু মজুমদার থেকে সরোজ দত্ত, শ্রেণির ওপর জোর দিতে বলেছিলেন, বলেছিলেন– শ্রমিক, কৃষক, গতর খাটিয়েরাই আসল বাহিনী। সেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এখনও নিশ্চয়ই আছে কিছু বোকাবুড়ো, যারা নিরক্ত শরীরে শুধু হাড় সম্বল করেও লড়তে রাজি! তাই আশা ছাড়ছি না। হ্যাঁ, আজ তাঁরা দুর্বল, তাঁদের গণবাহিনী নেই। কিন্তু একদিন হবে, কারণ চারু মজুমদারের রাজনীতিটা মরেনি। রাজনীতিতে যদি সমস্যা থাকে তাহলে মুক্তাঞ্চল থাকলেও মুক্তাঞ্চল ধরে রাখা যাবে না, গণবাহিনী থাকলেও তা ক্রমশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।
কবি, বুদ্ধিজীবী নয়, বিপ্লবী, আদর্শবোধে উন্নতশির এবং সর্বার্থেই চারু মজুমদারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবেই সরোজ দত্তকে মনে রাখবে ভাবীকাল। উনিও যে তাই চেয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।
গণবাহিনী, মুক্তাঞ্চল… এসব সম্ভব এখনও?