লুলা দ্য সিলভা ও সেলসো আমোরিম
ভাষান্তর: মিলন কিবরিয়া
কোভিড ১৯ মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী বিপুল প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র স্পষ্ট। একই সঙ্গে মহামারির প্রভাব পড়েছে বিশ্বের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছে, শক্তির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের লক্ষণ ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। অস্থিতিশীলতা ও যুদ্ধের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন বিশ্বের শান্তিকামী জনগণ। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের বামপন্থী রাজনীতিবিদরা কী ভাবছেন তারই একটি প্রতিফলন ব্রাজিলের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি (২০০৩-২০১০) এবং ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য লুলা দ্যা সিলভা এবং ব্রাজিলের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৯৩-৯৪, ২০০৩-২০১০) সেলসো আমোরিম-এর এই নিবন্ধ। প্রকাশিত হয়েছে ইন্ডিয়া-চায়না ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে।
এই বিশ্ব ব্যবস্থা আর নয়।
এই বছরের শুরু থেকে এবং মার্চ মাসে তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯কে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ (অতিমারি) ঘোষণার পর থেকে সরকার ও সুশীল সমাজ এক অভূতপূর্ব সঙ্কট মোকাবেলা করছে। সারা পৃথিবী জুড়েই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে/পড়ছে। গত দশকের আর্থিক সঙ্কট কোনওরকমে কাটিয়ে ওঠার প্রাক্কালে বিশ্ব অর্থনীতি এখন ১৯৩০-এর মহামন্দা-পরবর্তী সবচেয়ে মারাত্মক ধ্বসের কবলে পড়েছে।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন ঝুঁকির মুখে; কেননা মহামারির ফলে জনমনে সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতার বোধ ব্যবহার করে জনতুষ্টিবাদী ও কর্তৃত্বপরায়ণ নেতারা তাদের নিজস্ব ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। ফলে ইতোমধ্যে ভঙ্গুর গণতন্ত্র আরও নাজুক হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে সঙ্কটকে অস্বীকারের মনোভাব গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে জাইর বলসোনারো এবং আরও অনেকে।
পরিস্থিতির এমন ভয়াবহতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছে। কোনও কোনও নেতার আত্মম্ভরী আচরণের কারণে মহামারি মোকাবেলার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও ঔষধ পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালীরা নির্লজ্জভাবে সরাসরি দস্যুতায় লিপ্ত। একই সময়ে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের মিথ্যা অভিযোগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র মতো বহুজাতিক সংস্থাকে সম্পদ ও তার পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমন দুঃখজনক পরিস্থিতিতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক কাঠামো রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ কোনও সিদ্ধান্ত এমনকি ন্যূনতম কার্যকরী সুপারিশ গ্রহণেও ব্যর্থ হয়েছে। জি২০ তার সদস্যদের মধ্যকার মতপার্থক্য নিরসন করতে ও সঙ্কট মোকাবেলায় কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে।
ইরান, কিউবা ও ভেনিজুয়েলার মতো রাষ্ট্রের উপর আরোপিত একতরফা অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব, রাষ্ট্রপুঞ্জ মানবাধিকার হাইকমিশনার এবং পোপ ফ্রান্সিস সহ আরও অনেকের অনুরোধ স্রেফ উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে তাদের অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয় ও মানবিক সাহায্য পাওয়ার পথ রুদ্ধই রয়েছে। বহুমুখী সহযোগিতার পথ নির্লজ্জভাবে পরিত্যক্ত হয়েছে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে অপরিমেয় প্রাণ ও জীবনযাপনের ক্ষতির বিনিময়ে একদিন এই চলমান দুঃস্বপ্নের সমাপ্তি হবে। তবে সাধারণত এই কথাই শুনতে পাই, ‘ভবিষ্যতের পৃথিবী আর কখনওই আগের মতো হবে না।’ এবং অবশ্যই আশা করা যায়, মানবজাতি এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত হামলা থেকে শিক্ষা নেবে, যে হামলা বয়ে এনেছে মৃত্যু ও দুঃখ বিশেষত দরিদ্র এবং নিম্নবর্গের মানুষের জন্য।
এই মহামারি আমাদের প্রচলিত জীবনযাত্রার খুঁটি নাড়িয়ে দিয়েছে, আর একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থারও। মনে হচ্ছে, বিশ্বব্যবস্থার একান্ত মৌলিক পুনর্গঠনের বিষয়ে প্রায় সার্বজনীন ঐকমত্য আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে?
অনেক বিশ্লেষকের মতে, বিশ্ব “নতুন ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ” কিংবা তার চেয়েও নিকৃষ্টতর কোনও কিছুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর কারণ হিসাবে মার্কিন কূটনীতিক গ্রাহাম অ্যালিসনের ‘থুসিডিডসের ফাঁদ’ তত্ত্বের উল্লেখ করা হচ্ছে। এই তত্ত্বানুসারে বিদ্যমান পরাশক্তিকে অগ্রাহ্য করে নতুন পরাশক্তি উত্থান সংঘর্ষ ও যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করে।
এই মতানুসারে, যুক্তরাষ্ট্রকে চিনের ‘ওভারটেক’ যা এই মহামারির আগে থেকেই অবশ্যম্ভাবী মনে হচ্ছিল তা আরও গতি লাভ করবে এবং বিশাল অস্থিতিশীলতার জন্ম দেবে। একই সময়ে বিভিন্ন সরকার ও জনগণ মূলত আর্থিক পুঁজির দ্বারা নগ্ন মুনাফা বৃত্তির ভিত্তিতে অবারিত বিশ্বায়নের বিষয়ে শঙ্কিত। তারা একধরনের বিচ্ছিন্নতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করছে।
নিরাপত্তাহীনতা ও অনুন্নয়নের অপরিমেয় ঝুঁকি নিয়ে মানবজাতি “সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ” যুগে প্রবেশ করতে পারে। ফলে বিদ্যমান চরম অসাম্যের বিশ্বে সকল প্রকার সংঘর্ষ ও সামাজিক অস্থিরতা সহ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। এই প্রেক্ষাপটে একতরফা সামরিক শক্তি প্রয়োগের হার বাড়তে পারে, তাতে সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ সহযোগিতা আরও ব্যাহত হবে।
আবার এমনটি নাও হতে পারে। জাতি ও ব্যক্তি পর্যায়ে আত্মম্ভরিতার অধিপত্য কমতে পারে— এবং মানুষ, প্রকৃতি ও নিজেদের কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বৃহত্তর সংহতি ও নমনীয়তার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারে।
এটা অসম্ভব নয়, বরং অপরিহার্য যে নির্দিষ্ট সংখ্যক রাষ্ট্র ও বহুজাতিক সংস্থাকে— যেমন পুনর্গঠিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সংস্থাসমূহ (অবশ্যই পুনর্গঠন ও শক্তিশালীকরণ সহ)— জোট গঠন ও এমন অংশীদারিত্বে যুক্ত হতে হবে যা এককেন্দ্রিক আধিপত্য ও দ্বিমুখী লড়াই থেকে মুক্ত একটি বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব সৃষ্টিতে অবদান রাখবে।
“ভ্যারিয়েবল জিওমেট্রি”র ভিত্তিতে গঠিত এই ধরনের জোট বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার সত্যিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে। ফলে প্রকৃত বহুকেন্দ্রিকতার নীতির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার যথাযথ বিকাশ হবে। এই ধরনের দৃশ্যপটে চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া হয়তো উপলব্ধি করতে পারবে যে যুদ্ধের (স্নায়ু বা অন্যতর) চেয়ে সংলাপ ও সহযোগিতা বেশি লাভজনক।
এটা তখনই সম্ভব হবে যখন প্রত্যেকটি রাষ্ট্র— বিশেষত যেখানে অধিপত্যবাদ বিরোধী নেতৃত্ব প্রদানের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিদ্যমান— নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণের পথ খুঁজে নেবে, জনগণের চাহিদা পূরণে অধিক সচেষ্ট হবে, বিশেষত তাদের ঝুঁকিপূর্ণ খাতসমূহে। সামাজিক ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক সরকারকে হাতে হাত রেখেই চলতে হবে।
ইতিহাসের এই বিবর্ণ সময়ে যখন সভ্যতা নিজেই বিপদাপন্ন প্রতীয়মান হচ্ছে তখন এই ধরনের চিন্তাভাবনা ইউটোপিয়ান মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা যারা সকল প্রকার অনভিপ্রেত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মানবজাতির সৃজনশীল সক্ষমতায় বিশ্বাস করি তারা ইউটোপিয়ান শোনালেও আমাদের কর্মপ্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে পারি না। হতাশায় নিমজ্জিত হওয়াও আমাদের মানায় না।
*”ভ্যারিয়েবল জিওমেট্রি” ধারণাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যেখানে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের প্রবল মতপার্থক্য সত্ত্বেও অচলাবস্থা নিরসণের সম্ভাবনাকে স্বীকার করা হয়।