ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
কোভিড অতিমারিতে, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোশিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ইতিমধ্যে প্রায় দুশো চিকিৎসক প্রাণ দিয়েছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা ধরলে অঙ্কটা আরও বাড়বে বলেই মনে হয়। একদিকে এই নব্য ভাইরাসে আক্রান্ত রুগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে শুশ্রূষাকারী নিজেই তার শিকার হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা, অন্যদিকে সেই চিকিৎসা মনঃপূত না হলে রুগীর পরিজনের হাতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা। তাদের হাত থেকে বেঁচে ফিরলে হয়তো বা বাড়িওয়ালার চোখরাঙানি, নতুবা পাড়ার মাতব্বরের। এছাড়া, নানা কারণে সংক্ষুব্ধ জনতাকে ডাক্তারনিধনে উদ্বুদ্ধ করতে মাঝে মাঝে রংমেলানো বিদ্বজ্জনের সরস প্ররোচনা। এতসব অতিবৌদ্ধিক মারপ্যাঁচে অতিষ্ঠ হতে-হতে পড়ে ফেলা গেল অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের নাতিদীর্ঘ উপন্যাস— ‘অবিরাম জ্বরের রূপকথা’।
কাহিনি চার প্রজন্মের তিন চিকিৎসক দ্বারিকানাথ, কৃতীন্দ্রনাথ ও দ্বিজোত্তম ঘোষালকে নিয়ে। এই তিন চরিত্রকে নিয়েই কাহিনি এগোয় এবং পরিশেষে পূর্ণতা লাভ করে। একই পরিবারের, কিন্তু ভিন্ন প্রজন্মের এই তিন চিকিৎসকের প্রত্যেকেই তাঁদের চিকিৎসাজীবনে ভিন্ন-ভিন্ন মহামারির চিকিৎসায় ব্রতী হন। কলেরার প্রকোপ প্রজন্মান্তরে ফিরে-ফিরে আসে, তবে তার সঙ্গে কখনও আসে টাইফয়েড, কখনও বা ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, স্প্যানিশ ফ্লু, কখনও বা প্লেগ। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, এই উপন্যাসের সময়কালে মহামারির আকার নিয়ে কলেরার প্রাদুর্ভাব হয় অন্তত বার ছয়েক। আসে টিবি, যার তখনকার ডাক্তারি নাম ‘কনসাম্পশন’। এ যেন কৃতান্তের সঙ্গে এক দারুণ সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া। মহামারি, অর্থাৎ এমন রোগের প্রকোপ যার আশু কোনও চিকিৎসা নেই, এবং যতদিন না কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি কার্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে, ততদিন রোগের লক্ষণ দেখে প্রচলিত পথে চিকিৎসা করে রুগীকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনার সাহসী চেষ্টা করা ছাড়া গত্যন্তরও নেই। এমন স্বল্পায়ুধে বিক্রম দেখানো চিকিৎসকদের গল্প পড়েই গৌরচন্দ্রিকার কথাগুলি মনে পড়ল। তবে বলে রাখা ভালো, যে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে।
দ্বারিকানাথ শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক। সমস্ত কুসংস্কার ও গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে তিনি এক অসাধারণ চরিত্র। ডাক্তারি শেখার প্রয়োজনে শবব্যবচ্ছেদকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণসন্তান দ্বারিকানাথ তাঁর বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে কুণ্ঠিত হন না। নিজের জ্ঞানান্বেষণের প্রয়োজনে ক্রিশ্চিয়ান হয়ে যেতে তাঁকে কোনও দ্বিধায় পড়তে হয় না। তেমনই আমোদিনীকে নিজের জীবনসঙ্গিনীর মর্যাদা দিতেও তাঁকে ভাবতে হয় না— সেই আমোদিনী, যিনি বিধবা, পরবর্তীতে বারবণিতা। আমোদিনী নিজের মনে যখন গান করেন, তখন উচ্চাঙ্গ থেকে বেশ্যাসঙ্গীত, সব ধরনের গানেই আমরা তাঁর পারদর্শিতা দেখতে পাই। আমোদিনীর মৃত্যুর পরও শাস্ত্রের প্রতি দ্বারিকার অটল নিষ্ঠা আমরা দেখতে পাই, যখন তিনি আমোদিনীর শবব্যবচ্ছেদে এতটুকু দ্বিধা দেখান না। দ্বারিকার পুত্র কৃতীন্দ্রনাথ বাড়ি থেকে পালিয়ে মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর-র যোগ দেন, যার উদ্যোক্তা ছিলেন স্বনামধন্য চিকিৎসক সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী। কৃতীন্দ্রের পুত্র পুণ্যেন্দ্র চিকিৎসক না হয়ে হলেন রসায়নবিদ। তাঁর পুত্র দ্বিজোত্তম আবার হাতে তুলে নিলেন তাঁর পিতামহ ও প্রপিতামহের রোগহরণ আয়ুধ। আমরা পাচ্ছি মধুমাধবীর মত চরিত্র, যিনি পেশায় চিকিৎসক হলেও অ্যালোপ্যাথি নয়, কবিরাজি মতে চিকিৎসা করেন।
বস্তুত, এই উপন্যাসে আরও একটি প্রধান চরিত্র আছে বলে আমার মনে হয়েছে। তাঁর নাম নেই। তিনি হলেন— সময়। তিনি ইতিহাস। এই উপন্যাসের সময়কাল ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিংশ শতকের প্রথমার্ধ।
এই উপন্যাসে জন্মমৃত্যু আছে, প্রেম-অপ্রেম আছে, আছে পারিবারিক টানাপোড়েনের খুঁটিনাটি ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ধরার চেষ্টা। আর এই সব প্রকরণকে এক সুতোয় গেঁথেছে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিবর্তন। যেন সঙ্গীতে তালযন্ত্রের স্থান নিয়েছে কোনও স্ট্রিং ইন্সট্রুমেন্ট! তবে চিকিৎসা যদি বহিরঙ্গের সূত্ররক্ষক হয়, তবে অন্তরঙ্গের অদৃশ্য সুতোটি জ্ঞানান্বেষণের উদগ্র বাসনা, যে বাসনা ঠিকরে পড়ে আমাদের মূল চরিত্রদের চালচলন থেকে।
ইতিহাসপ্রবাহের অল্পবিস্তর খোঁজ রাখেন যাঁরা, বা যাঁরা আমার মত আন্তর্জালিক পল্লবগ্রাহী, তাঁরা জানবেন যে ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল চালু হয়ে যাওয়ার পর বিলেত থেকে এ-দেশে আসা মানুষের সংখ্যা— শুধু মানুষ কেন, তাদের রকমারি জিনিসও— এক লাফে অনেকটা বেড়ে গেল। যে পথ পাড়ি দিতে আগে লাগত তিন মাসাধিক কাল, সেই পথ এখন তিন হপ্তাতেই পেরোনো সম্ভব হল। ফলে, ১৭৫৭ সালের পর থেকে বাংলার কর্তৃত্বকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেবার বৃটিশ প্রচেষ্টায়— ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের পর যে প্রচেষ্টা মহারানির শিলমোহর পেল— জোয়ার এল। ভারতকে এক যথার্থ উপনিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টার পার্শ্বফল হয়ে এ-দেশে আসতে লাগল সমুদ্রপারের সংবাদ— রাজনীতির, সমাজনীতির, বিজ্ঞানের। পাস্তুর ও কখের বীজাণুতত্ত্ব, গুটিবসন্তের প্রতিষেধক, অনুভূতিনাশকের ব্যবহার, কলেরা ইত্যাদি মারণরোগের চিকিৎসা ও প্রতিষেধক— আরও বহু উদ্ভাবন-আবিষ্কারের সংবাদ যখন এই দেশে এসে পৌঁছতে আরম্ভ করল, তখন ভারতীয় তরুণ-তরুণীর একটি দল— যাঁরা বিলাতি প্রথায়, এ-দেশে হোক কী বিদেশে নিজেদের শিক্ষিত করেছেন— তার প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আমাদের কাহিনি শুরু হচ্ছে এই দলের এমনই এক চরিত্র, যদিও কাল্পনিক, দ্বারিকানাথ ঘোষালকে নিয়ে।
তবে দ্বারিকানাথের আশেপাশে আমরা কিংবদন্তিপ্রতিম কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রকে দেখতে পাচ্ছি। তাঁদের মধ্যে আছেন রাধাগোবিন্দ কর, সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী। সুরেশের একটি পরিচয় আমরা আগে দিয়েছি। আছেন বাঘের আক্রমণে আহত হয়ে সুরেশের কাছে চিকিৎসার্থে আসা যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়— আমাদের বাঘা যতীন। মূল কাহিনির বুননের সঙ্গে এই ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি এমনভাবে মিলিত হতে পেরেছে, যে কাল্পনিক চরিত্রেরা বাস্তবের জমিতে নেমে আসতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। হয়তো সেই কারণেই, গ্রন্থের পরিশিষ্টে ঘোষালবাড়ির যে বংশতালিকা দেওয়া হয়েছে তা যে কাল্পনিক, সেটা আলাদা করে ঠাহর করতে হয়।
এই কাহিনির আখ্যানের ভঙ্গিটি আমাদের চেনা। তবে যা চেনা নয়, তা সম্ভবত তথ্যনিষ্ঠা। একটি কাহিনিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে যে বিপুল পরিমাণ তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে তা দেখলে অবাক হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। তথ্য অর্থে কেবল সন-তারিখ নয়। চিকিৎসাপদ্ধতির বর্ণনা, অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ এবং কবিরাজি পথ্যের বর্ণনা— এ সব যতটা গভীরে গিয়ে আলোচিত হয়েছে, তার থেকে লেখকের এ-বাবদ পড়াশোনা সম্বন্ধে স্থিরনিশ্চিত হওয়া যায়। বইয়ের শেষে লেখকপ্রদত্ত সহায়ক গ্রন্থের একটি দীর্ঘ তালিকা আমাদের এই ধারণাকে পোক্ত করে। এই বিবরণ মধ্যে মধ্যে এতটাই যথাযথ, যে মানুষের শরীরের ভিতরের ছবিটা আমরা দেখতে পেয়ে শিউরে উঠি। তবে পরক্ষণেই এই ভেবে আমাদের সম্বিত ফেরে, যে কাহিনির মূল চরিত্রগুলির কাছে সে-সব নেহাতই হাত-পা-মাথার মত স্বাভাবিক। বরং, একটি মানবশরীরকে ভিতর ও বাহির— এই দুই দিক থেকেই তাঁরা সমভাবে দেখে থাকেন। ফলে এই সূক্ষ্মচিত্রণ তাঁদের চরিত্রের একটি দিক উন্মোচিত করছে মাত্র।
পরিশেষে বলতে হয়, এই রূপকথা আমাদের একাধারে বিমর্ষ ও উৎফুল্ল করে। কারণ মানুষই একমাত্র প্রাণী যে তার ধ্বংসের কথা লিখে রাখে, আবার সম্পূর্ণ ধ্বংসের থেকে ঘুরে-দাঁড়াবার স্পর্ধাও কেবল সে-ই দেখাতে জানে।
অবিরাম জ্বরের রূপকথা
প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং
মূল্য: ৩৫০ টাকা