শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক শিল্প-সমালোচক, চলচ্চিত্রবেত্তা, প্রাবন্ধিক
ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ-এর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাঁর মৃত্যুর আগের বেশ কয়েকটা বছর ধরে শিথিল হয়ে গেছিল। ওঁর কাজকর্মেরও হদিশ পেতাম না। অথচ মধ্য-ষাটের দশক থেকে শুরু করে গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত যে-প্রয়াসে আমার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব জড়িয়ে গেছিল, তার মুখ্য লক্ষ্য ছিল, কলকাতা ও মফসসল বাংলায় একটা চলচ্চিত্রসংস্কৃতির মননলালিত ভিত তৈরি করা যাতে বুদ্ধিঋদ্ধ ও বিবেকবান এক সম্প্রদায় তাঁদের আঁতের টানেই নতুন বাংলা চলচ্চিত্রকে পোষণ করে যাবেন। আমি আমার সৌভাগ্য বিবেচনা করি যে ১৯৫৫ সালে, যে-বছর আমি স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠেছি, সেই বছরই বসুশ্রী প্রেক্ষাগৃহে প্রথম প্রদর্শনীতে আমি পথের পাঁচালি দেখেছি। রোবের্জও তাঁর সৌভাগ্য বিবেচনা করতেন যে, কলকাতায়— দারিদ্র ও দুর্দশার শহর, দুঃস্বপ্নের নগরী কলকাতায়— মানুষের পীড়ামোচনের সঙ্কল্পে খ্রিস্টান সন্ন্যাসীর সেবাব্রতীর দায় নিয়ে আসবার পথে নিউ ইয়র্কে পথের পাঁচালি দেখবার সুযোগ পান। চলচ্চিত্রবিদ্যায় তাঁর দীক্ষাকে তাঁর সেবাব্রতের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার চিন্তা ওই পথের পাঁচালি দেখা থেকেই। কলকাতায় এসেও কয়েক বছর তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আলাপ করতে সঙ্কোচ বোধ করেছেন। তারপর একবার আলাপ হতেই রোবের্জ কলকাতায় তাঁর চলচ্চিত্রানুরাগ ও চলচ্চিত্রবিদ্যা প্রচারের প্রতিটি উদ্যোগে সত্যজিৎ রায়কে অভিভাবকত্বে বরণ করে নিয়ে তাঁর পরামর্শ তথা নির্দেশনার উপর নির্ভর করেছেন।
ধর্মব্রতীদের দায়ধর্ম বা দানধ্যানের দাক্ষিণ্যে দুঃস্থ, দুঃখী মানুষের ক্লেশ লাঘবের পথ বেছে না নিয়ে রোবের্জ চেয়েছিলেন বঞ্চিত মানুষের স্বাধিকারের দাবি উচ্চারণে তাঁদের বলীয়ান করতে। আর সেই বলবত্তার উন্মোচনে চলচ্চিত্রকে তিনি এক অমোঘ অস্ত্র বিবেচনা করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি জানতেন, জন্মসূত্রেই চলচ্চিত্র এমনভাবেই বিত্ত ও পুঁজির ঘনিষ্ঠ যে সেই চক্রজালে আপাদমস্তক জড়িত চলচ্চিত্রের একটি বিকল্প স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র জোগাতেই চলচ্চিত্রবিদ্যাচর্চার গুরুত্ব। চলচ্চিত্রচেতনার সেই উন্মেষের লক্ষ্যেই চিত্রবাণী নামে সজীব, স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রোবের্জ কতভাবে সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকের তরুণসমাজকে কৃতার্থ করেছেন কলকাতায় চলচ্চিত্র ও সংযোগবাহনের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগার পত্তন করে, ব্যাখ্যা ও দিগদর্শন সহযোগে ছবি দেখিয়ে, চলচ্চিত্র আস্বাদন পাঠক্রমের আয়োজন করে, উৎসাহীদের জন্য বিশেষ ব্যক্তিগত পাঠক্রমের আয়োজন করে, আলোকচিত্রগ্রহণে সমাজবোধসম্পন্ন দৃষ্টিনির্মাণের দীর্ঘ পরীক্ষাকর্মে। এইসবেরই যেন অবশ্যম্ভাবী উত্তরণ ঘটেছিল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অ্যাকাডেমির স্তরে চলচ্চিত্রবিদ্যা শিক্ষাদানে, টিভি-র মাধ্যমে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থায়।
এই নতুন শতকে রাষ্ট্রীয় ও রাজ্য স্তরেও প্রশাসনিক ও মিডিয়াবাহিত অতিকায় প্রচারে চলচ্চিত্রের সভ্যঅধর্মী সম্ভাবনাকে নির্মূল ও অসম্ভব করে দেওয়ার বীভৎস আবহের মধ্যেই রোবের্জ-এর তিরোধান একটা বিপন্নভাবনা বা স্বপ্নের সঙ্কটকেও যেন চিহ্নিত করে দিল। মৃত্যুতেও রোবের্জ তাই প্রাসঙ্গিক।
*ভেতরের ছবি দুটি চিত্রবাণী-র ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া