বিপুল চক্রবর্তী
লেখক এই সময়ের একজন অগ্রগণ্য কবি। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্মানে ভূষিত। লেখকের সুর করা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তিনটি গান (কবিতা)-এর ইউটিউব লিঙ্ক লেখার নীচে দেওয়া হল
বীরেনদার সঙ্গে ১৯৭৪ সালে আমার যখন দেখা হয় তখন আমি উনিশ। দেখা হয়েছিল একটি কবিতা পাঠের আসরে, যেখানে একদিকে অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মণিভূষণ ভট্টাচার্য এমন সব দিকপাল কবিরা, আর অন্যদিকে অর্বাচীন আমি! কবিতা-টবিতা পড়া হলে বীরেনদা সভাশেষে আমাকে বললেন, “শ্রীমান, তুমি আমার বাড়ি আইস।”
আমরা দু’জনেই ঢাকুরিয়ার। এরপর একদিন গুটিগুটি পায়ে বীরেনদার বাড়িতে ঢুকেই পড়লাম। গিয়ে দেখি উনি বলছেন, “রানু, দেখো দেখো, কে আইসে।” তখন বুঝলাম বীরেনদা রানু, মানে ওঁর স্ত্রী অর্থাৎ বৌদির সঙ্গেও আমাকে নিয়ে কথা বলেছেন। এইটে আমার কাছে ছিল রিকগনিশন। খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম সেইদিন।
বীরেনদার সঙ্গে সেই যে জুটলাম, সেই জোটের ছাড়ান হল ওঁর মৃত্যুতে। ১৯৮৫ সালে। এর মধ্যে মনে রাখার মত মুহূর্ত এসেছে অসংখ্য, যার সামান্য কিছু ভাগ করে নিই আপনাদের সঙ্গে।
একবার, বন্দিমুক্তির মিছিলে হাঁটছি আমি ও বন্ধুরা। সকলে মিলে জোর স্লোগান দিচ্ছি, “কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট”। হঠাৎ দেখি বীরেনদা পেছন থেকে এসে আমাকে খামচে ধরে বললেন, “তোমারে আর বিপ্লব করতে হইব না!” আমার ব্যাপারটা একটু সম্মানেই লাগল। আমি ঝট্ করে ওঁর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার স্লোগান দিতে লাগলাম। কিছুটা অগ্রাহ্যই করে ফেললাম। এদিকে, পরে সম্বিত ফিরতে এক রাশ লজ্জা। আর ওঁর কাছে যেতে পারছি না। মনে অপরাধবোধ কাজ করছে। ও মা, একদিন উনি নিজেই আমাদের বাড়িতে এসে হাজির! শুনি মাকে বলছেন, “কই, শ্রীমান কই?” আমার কাঁধে হাত দিয়ে সেদিন জোর করে ওঁর বাড়িতে নিয়ে গেছিলেন। পথে যেতে যেতে বারবার বলছেন, “তোর মনে আছে এই যে প্রবীর দত্ত মারা গেল ৭৪-এ! আমরা কী করতে পারসি? কয়ডা কবিতা লিখসি মাত্র! এখন যদি এইরম একটা ঘটনা ঘটে, আমি কি তোকে বাঁচাতে পারব? তোর অনেক কাজ আছে।” বীরেনদা ছিলেন এমনই একজন মরমিয়া মানুষ।
আরেকটি মনে-রাখা ঘটনার কথা বলি। একদিন আমি আর বীরেনদা কলেজ স্ট্রিট থেকে ফিরছি। কলেজ স্ট্রিট থেকে শেয়ালদা। শেয়ালদা থেকে ঢাকুরিয়া। হঠাৎ বীরেনদা বলে উঠলেন, “তোর কাছে দুটো টাকা হবে রে?” ছিল, কিন্তু একটু আশ্চর্যই হলাম। এদিকে তখন আমারই জন্য উনি এখানে-ওখানে চাকরি খুঁজছেন। আবার সেই আমার কাছেই কী না টাকা চাইছেন! যাই হোক, আমার কাছ থেকে দুটো টাকা নিয়ে আরেকজনের পকেটে দেখি জোর করে গুঁজে দিলেন। উনিও আমাদের সঙ্গেই শিয়ালদার দিকে যাচ্ছিলেন, বারাসতের ট্রেন ধরবেন বলে। একটু পরে, আমরা যখন শিয়ালদা সাউথ স্টেশন থেকে ঢাকুরিয়া আসছি, বীরেনদা বললেন, “ও যে বারাসত অবধি যাবে, ওর তো খাওয়াও হয়নি বোধহয় সারাদিন। চেহারাটা দেখছস, কী অবস্থা!”
এমন ঘটনা, যাকে আপনি ‘অ্যানেকডোটস’ বলে হয়তো অল্প একটু হাসবেন, আছে তো অনেকই, তবু সে-সব সরিয়ে রেখে কবি বীরেন্দ্রের মধ্যেই থাকতে চেষ্টা করি, আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর পরিক্রমাকে কিছুটা ছুঁয়ে যাবার চেষ্টা করি।
বীরেনদার প্রথম বই, তার নাম ‘গ্রহচ্যুত’। এর প্রায় সব কবিতাই মনে হবে একটু রবীন্দ্র-অনুসারী, জীবনানন্দ-অনুসারী, নজরুল-অনুসারী। মনে হবে, এ তো বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নয়! এখানে দুটি কবিতার কথা বলব। তার একটি হচ্ছে প্রেমের কবিতা। একদম প্রথম যৌবনের যে প্রেম, সেই প্রেমের কবিতা। কবিতাটির শিরোনাম ‘তোমার মুখ’—
আমার হাতের ওপর তোমার মুখটি
তুলে ধরলাম –
দেখলাম, আবেগে বোজা তোমার চোখ। ..
দেখা হ’লো না।
কতবার বললাম তোমার কানে,
কানে কানে –
দেখলাম, রক্তলাজে ফিরিয়ে নেওয়া তোমার চোখ!..
দেখা হ’লো না।
এরপরে কতখানি বাঁক নিয়ে এই বইয়েরই আরেকখানি কবিতা, যার মধ্যে কী গভীর বিষণ্ণতা ছুঁয়ে আছে—
মাঝে মাঝে মালটানা গাড়ির শব্দ,
কুকুরের কান্না!
তোমার গভীর ঘুমের পাশে আমার রাত্রিজাগরণ।
অদ্ভুত, এই পৃথিবীতে জীবনধারণ।
এই দুটো কবিতাকেই বীরেনদা তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতায় স্থান দিয়েছেন। এই কবিতা দুটো পড়ে মনে হয় একটি অন্য ভাষ্য— যা পড়ে রবীন্দ্রনাথ মনে হবে না, জীবনানন্দ মনে হবে না, নজরুল মনে হবে না— তেমন একটি অন্য স্বর উঠে আসছে। বইটির নামকরণও এ-ক্ষেত্রে লক্ষণীয়— গ্রহচ্যুত। কেন মনে হয়েছিল সেই সময়ে সেই তরুণ বয়সে একজন কবির, যে তিনি গ্রহচ্যুত? এইটা জানার জন্য আপনাকে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে— যেখানে গিয়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজের সব পাঁপড়িগুলো মেলে দিয়েছেন, সেই সত্তরের দশক পর্যন্ত।
‘গ্রহচ্যুত’, তারপর ‘পেট্রোল ও অন্যান্য কবিতা’, বাংলা সন ১৩৫১-তে। তারপর ‘নতুন মাস’ ১৩৫৩, ‘২৬শে জানুয়ারি’ ১৩৫৩, তারপর পাঁচ নম্বর বই ‘রানুর জন্য’। এই ‘রানুর জন্য’ বইটি আমার কাছে খুব মূল্যবান। রানু তাঁর স্ত্রীর নাম, প্রেমিকার নাম। সেই প্রেমিকার জন্য রচিত এই কাব্যে আমরা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-নামক সূর্যের প্রথম আলোটি দেখতে পাচ্ছি।
যাই হোক, এই বইয়ের থেকে ‘দোল ও পূর্ণিমা’ কবিতার কিছু অংশ—
সর্বত্রই এক মুখ, রঙে রঙে একাকার কিশোর মিছিল
যেন একঝাঁক চিল
দ্বিপ্রহরে শ্রান্ত হয়ে দিঘির ভেতরে
সূর্যের বলের মতো রঙের চেতনা নিয়ে ক্লান্ত খেলা করে।সর্বত্রই এক ক্লান্তি! শোলোক ফুরুলে
চুলের আবির নিয়ে ঘুমায় স্বপ্নের শিশু ঠাকুমার কোলে
আকাঙ্ক্ষায় পুড়ে যায় রূপকথার নক্ষত্রের অদৃশ্য কপাল
একাকী যুবতী চাঁদ মাঝরাতে ফাঁকা ট্রেনে চুরি করে দুর্ভিক্ষের চাল!
এই আমরা বীরেনদাকে পেয়ে গেলাম! এর আগের বই ’২৬শে জানুয়ারি’-তে নিজের জায়গা যে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন, তার একটা আভাস পেয়েছি মাত্র। আর এই বইয়ে, এই প্রেমের কবিতাগুলিতে, আমরা প্রথমবারের জন্য বুঝতে পারলাম কোন পথে ধুলো-উড়িয়ে ছুটে যাবে তাঁর কবিতা।
এরপর আমি ‘প্রভাস’-এর কথা বলব। তার আগে এর একটি অংশ এখানে তুলে দিই—
…তোমরা ফিরে যাও। কোথায় দ্বারকায়
নারীর দেহমদে পশুরা লুব্ধ;
কোথায় শিশুকেও জ্যান্ত ছিঁড়ে খায়
আহত নেকড়েরা; এমনি যুদ্ধ!
কী হবে ঘুম থেকে সে-দেশে হেঁটে গেলে?
সুদর্শন আমি দিয়েছি ছুঁড়ে ফেলে।
এখানে এই ঘাসে হৃদয় ঢেকে নিয়ে
ঘুচাবো দ্বন্দ্বের জয়ের ক্লান্তি –
ব’লো না কথা পাখি, আস্তে ঝরো ফুল;
ঘুমের রাত আসে। শান্তি, শান্তি!
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং তার যে অর্থমানতা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সে সবের কিছু কিছু আমরা জানি। কিন্তু তার অর্থহীনতার কথা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তুলে ধরছেন এই কবিতায়। ‘সুদর্শন আমি দিয়েছি ছুঁড়ে ফেলে’… এরকম একটা পংক্তি, ক্লান্ত শরীরের দীপ্তি ঝরে পড়ে— এরকম একটা অনুভবের উচ্চারণ!
আমাকে বীরেনদা বহুবার বলেছেন— তোরা তো অভিশপ্ত! লিখতে এলি আর সারা শরীরে রক্ত ছিটিয়ে দিল সময়টা। আমরা যখন লিখতে এসেছি তখন তো আমাদের পোশাকে-আশাকে বন্ধুর রক্ত লেগে আছে। সেই রক্তাক্ত সত্তরে, যখন সকলে প্রায় ভীত, আমরা তখন সবে কবিতা লিখতে শুরু করেছি। তখন আমাদের চারপাশে যেসব পত্রপত্রিকা— অনীক, স্পন্দন, অনুষ্টুপ— সব বন্ধ হয়ে গেল জরুরি অবস্থায়। সেইখানে, বীরেনদা লিখছেন সরোজ দত্তকে নিয়ে—
যারা এই শতাব্দীর রক্ত আর ক্লেদ নিয়ে খেলা করে/ সেই সব কালের জল্লাদ/ তোমাকে পশুর মতো বধ করে আহ্লাদিত?/ নাকি স্বদেশের নিরাপত্তা চায় কবির হৃৎপিণ্ড?
আমার সন্তান যাক প্রত্যহ নরকে— এই ঘোষণা তো অমোঘ হয়ে গেছে বহু আগেই। এই কবিতাতেই লিখছেন—
যে-আমি তোমারি দাস; কানাকড়ি দিয়ে
কিনেছ আমাকে রাণী, বেঁধেছ শৃঙ্খলে
আমার বিবেক, লজ্জা; যে-আমি বাংলার
নেতা, কবি, সাংবাদিক, রাত গভীর হ’লে
গোপনে নিজের সন্তানের ছিন্ন শির
ভেট দিই দিল্লীকে; গঙ্গাজলে হাত ধুয়ে
ভোরবেলা বুক চাপড়ে কেঁদে উঠি, “হায়,
আত্মঘাতী শিশুগুলি রক্তে আছে শুয়ে!”
একদল বলেন— বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হচ্ছেন প্রতিবাদের কবি। যেন তাঁর কোনও প্রেম নেই, কোনও ব্যথা নেই, অন্য অনুভব নেই। এঁদের আলোচনা শুনলে আমার জীবনানন্দের সেই ‘যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই— প্রীতি নেই— করুণার আলোড়ন নেই’ মনে পড়ে যায়! অর্থাৎ বীরেনদা ছিলেন একবগ্গা মানুষ, এবং তাঁর কবিতাও ছিল তাঁরই মতন— একবগ্গা। বলাই বাহুল্য, এমন কথা যাঁরা বলেন তাঁরা পড়ে বলেন না, এবং দৈবাৎ পড়ে থাকলেও বুঝে বলেন না। খুব কেঠো জায়গা থেকে লাল সেলাম, অমর রহে এইসব বলেন আর কী।
যাই হোক, তবু আমাদের কাজ তো একজন কবিকে জানা। সর্বদিক দিয়ে তাঁর আগা, পাশ, তলা সবটাই জানা। একটু খুঁজলেই আমরা দেখতে পাই বাংলার পাঁচালি আর ছড়াগানের উত্তরসূরি বীরেন্দ্র কখনও বলছেন “ভোট দিও না হাতিকে/ভোট দাও তার নাতিকে”, “ভোট দিও না গাধাকে/ভোট দাও তার দাদাকে”, বা “নেড়েচেড়ে দেখি বুড়ো মরে গিয়েছে/মন্ত্রী হবার সাধে বুড়ো জেগে উঠেছে”। এই শ্লেষ যেমন লিখছেন, তার সঙ্গে লিখছেন “চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও লিখে দিলেন পৃথিবী ঘুরছে না/পৃথিবী তবু ঘুরছে, ঘুরবেও/যতই তাকে চোখ রাঙাও না”। এই গভীর সত্য, অথচ অসীম সাহসের এই কথাকে কী অনায়াসে আপনার সামনে রাখছেন, আপনাকে তার স্বাদগ্রহণে বাধ্য করছেন! কথাটি আপনারই হয়ে উঠছে। আবার ধরা যাক ‘মাতলামো’ কবিতার এই পংক্তি—
উত্তেজনা ছড়াই না। বরং এ শ্মশানের শান্তি থেকে পরিত্রাণ কী আছে,
কোথায়,
খুঁজি উন্মাদের মত; ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলি দু’হাতে সরাতে চাই,…
এই পংক্তিতে বরং সেই ঋষির কথাই মনে পড়ে, কল্যাণময়তায় যাঁর অবিশ্বাস নেই, তবু চারিদিকের হিংস্র সভ্যতার মধ্যে ‘শেষ পুণ্যবাণী’-টিকে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। সুন্দর তাঁর কাছে কাম্য, তা বলে কুৎসিতকে অস্বীকার করে ভাবের ঘরে চৌর্যবৃত্তি তিনি করেন না।
এইবারে আমরা এইভাবে গড়াতে-গড়াতে দেখছি, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কখনও আগুনের মতো, কখনও চাবুকের মতো, কখনও ব্যথাতুর, ক্রন্দনরত। নানান পরতে আমরা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে আবিষ্কার করতে পারি।
অবিশ্বাসে, দ্বন্দ্বে ধ্বস্ত হতে হতেও এই মনোভাবের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে কবিকে দেখি শেষ পর্যন্ত মানুষে আসক্ত, বিশ্বস্ত—
এ দিনে মানুষ নাম
মনে হয় অশ্লীল তামাশা! আমাদের সন্তানেরা আমাদের চোখের সামনে
রক্ত মাংস কর্দম, অথবা আততায়ী… কাপুরুষ! আমরা গলিত নখদন্ত সিংহ
নিরাপদ, সার্কাসের খাঁচায়, ঘোলাটে চোখের মণি…
বিস্ফারিত… ক্রমে অন্ধকার হ’য়ে আসে…তবু মাথা উঁচু রাখতে হয় নরকেও। আমাদের চোখের আড়ালে
ক্রমাগত রক্তক্ষরণের
পিচ্ছিল নৈপথ্যে আজও রয়েছে মানুষ – একা – নরক দর্শন করে,
তবু অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়;
রক্ত মাংস কর্দমের পাহাড় ডিঙিয়ে, নদী সাঁতরিয়ে
নরক উত্তীর্ণ হ’তে ক্লান্তিহীন যাত্রা তার;মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম।
সুতরাং, একটা রঙের পোঁচ লাগিয়ে বীরেনদার কবিতাভুবনকে ‘ক্লাসিফাই’ করে দেবার চেষ্টাটা অবিমৃষ্যকারিতা ছাড়া কিছুই আমার মনে হয় না।
প্রয়াত কবি আলোক সরকারের একটি সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম (প্যারাফ্রেজ করে লিখছি), আলোক বলছেন, ‘বুদ্ধদেব বসুর কাছে গিয়েছি, বুদ্ধদেব বসু জিজ্ঞেস করলেন আমাদের যে তোমাদের বন্ধুদের মধ্যে যারা কবিতা লিখছেন তাদের মধ্যে কার কবিতা ভালো লাগে? আমি এবং দীপঙ্কর দাশগুপ্ত দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব বসু বললেন– হ্যাঁ হ্যাঁ লাগবেই। ওর কবিতা ভীষণ জেগে ওঠা কবিতা। উচ্চকিত কবিতা।’ এর মধ্যে দুটো ইঙ্গিত আছে বলে আমার মনে হয়েছে। একদিকে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে ভালো কবিতা লিখছেন বা লেখেন সেই মর্মে স্বীকারোক্তি। আবার অন্যদিকে যেন একটা দ্বিধা, বা হয়তো বর্জনের ভাব, যে এটা উচ্চকিত কবিতা।
বীরেনদার কাব্যবিশ্ব নিয়ে এতাবৎকালে যা-যা লেখালিখি আমি পড়েছি তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠটি শঙ্খ ঘোষের— ‘আগুন হাতে প্রেমের গান’। এই লেখাটি পড়তে-পড়তে দেখছি, শঙ্খ লিখছেন (আবারও আমি নিজের ভাষায় বলছি), বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে অনেকে ধরতে পারছে না। কেননা যে পথে, যে ভাবনায়, আমাদের অ্যাকাডেমিক ভাবনায়— কতকগুলো ফর্ম্যাট আছে, সেই ফর্ম্যাটে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ধরা যাচ্ছে না। তার জন্য নতুন ফর্ম্যাট লাগে। কেননা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই ফর্মগুলোকে তোয়াক্কা করেননি।
এখানে আমি একটু থমকে যাই। আমার একটা ভাবনা আসে।
নতুন ফর্ম্যাট-এর কথা শুনতে তো ভালোই লাগে। বেশ একটা পথিকৃৎ ভাব আসে। সেটা তো মন্দ নয়! কিন্তু ভাল-মন্দেরও অধিক যে কথা বিচার্য বলে আমি মনে করি, তা হল এই অভিধা— বিশেষ করে যেদিক থেকে বিচার করে তা দেওয়া হল— তা কতটা ন্যায্য। আমি যদি বলি, এটাই আমার বাংলা কবিতার চিরদিনের ফর্ম্যাট? আর সেই ফর্ম্যাট আধুনিক বাংলা কবিতার কঙ্কাল বিলিতি ফর্ম্যাটের থেকে আলাদা। আগে বলা—
চোখরাঙালে না হয় গ্যালিলিও
লিখে দিলেন, ‘পৃথিবী ঘুরছে না।’
পৃথিবী তবু ঘুরছে, ঘুরবেও;
যতই তাকে চোখ রাঙাও না।
এর সঙ্গে—
দুঃখ কর অবধান দুঃখ কর অবধান।
জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ।।
-এর কোনও যোগাযোগ পাওয়া যায় না? আবার দেখুন—
জলে ভাসছে ওফেলিয়া
জলে ভাসছে লখিন্দর,
গাজন যেন ডাকাতদের বিলে!
জলে ভাসছে ওফেলিয়া
জলে ভাসছে অবাক লখিন্দর;
কন্যা! তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
এই অবাক শব্দটার মধ্যে কোনও বিস্ময়ের ব্যাপার নেই। বাকহীন, রুদ্ধবাক, বাক নেই যার। প্রথম যখন এ কবিতাটা পড়ি দুটো-তিনটে চমক তৈরি হয় ভেতরে। একটা হচ্ছে কীভাবে এই যে কন্যাকে অ্যাড্রেস করছেন— এ কবিতাটার নাম হচ্ছে বেহুলা— তাহলে বেহুলাকে অ্যাড্রেস করছেন, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে ওফেলিয়া। সেও জলে ডুবে মরেছিল। কিন্তু দুটোর কারণ অন্য। এখানে লখিন্দর মৃত, ওখানে ওফেলিয়া মৃত। ওফেলিয়ার প্রেমিক ওফেলিয়ার বাবাকে মেরে ফেলেছে ভুলবশত। সেই গ্লানি থেকেই ওফেলিয়া আত্মহননের দিকে গেছে। আর এইদিকে আবার পতিব্রতা বেহুলা মৃত স্বামী লখিন্দরকে নিয়ে ভেলায় ভেসে চলেছে। এই দুটো জায়গাতেই কন্যা ডাকটা অদ্ভুত চাবুকের মত উঠে আসছে। একদিকে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথাটা উঠে আসছে, আর একদিকে দেবতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এই লোকায়ত আঙ্গিকে ভর করে গড়ে ওঠা আমার আরও একটি প্রিয় কবিতা—
একদা মা-কে দিয়েছিলাম দোষ,
‘তুমি কেন অর্ধেক-ভিখারী।
না-হয় আমরা ঘরে করবো উপোস;
তাই ব’লে কি যাবে রাজার বাড়ি?’‘ছেলে, আমার ছেলে।
ঘুঁটে কুঁড়িয়ে পেট তো ভরে না!
দোষ যদি হয় রাজার বাড়ি গেলে,
ছেলের উপোস দেখবে-কি তার মা?’
এর মধ্যে রাজনীতি আছে, ক্রোধ আছে— কিন্তু সেইসবের মধ্যে দিয়েও যে স্রোতটা বেরিয়ে আসছে কবিতার, সদ্যচ্ছিন্ন বটপাতার দুধের মত, সেইটা দেখার।
তাই আমি এই প্রশ্নটি রাখতে চাই, যে এটি কি সত্যিই একটা নতুন ফর্ম্যাট, নাকি আমাদেরই যে চিরায়ত বাংলা ভাষা-বাংলা কবিতা, তারই একটি উন্নীত ব্যবহার?
কতবার আমার কত লেখায় এমন হল আমি একটু বেশি রাজনীতি-ঘেঁষা লেখা লিখেছি আর বীরেনদা আমাকে বলছেন, “না, এটা কবির কাজ না। তোমার মধ্যে কোনও বায়াস থাকবে না। তোর অনেক বড় কাজ। তুই তোর ইঙ্গিত ইশারা খুঁজে বেড়া। ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে ইঙ্গিত আছে। প্রত্যেকটি ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে মেসেজ আছে। সেগুলোকে খুঁজে বার কর। সেগুলোর কথা বল।”
বীরেনদার চলার যে পথ, তা যেন পুষ্পকরথে চেপে সীতার লঙ্কাগমনের পথের মত। বীরেনদা এক-এক করে অলঙ্কার ফেলতে-ফেলতে চলে গেছেন, আর আমরা সে-সব কুড়িয়ে নিয়ে ওই উচ্চতার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। কবি যখন লিখছেন—
মাটি তো আগুনের মত হবেই
যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।
তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।
আমাদের মনে হয় এ এক মহর্ষির ঋকবেদী মন্ত্রোচ্চারণ। তাতে ভাষার অলঙ্কার নেই, জ্ঞানের অহঙ্কার নেই, আছে গভীর এক জীবনবোধের দৈব উচ্চারণ, গ্রীক দার্শনিকের মত।
সামনেই মাও সে তুং-এর জন্মদিন আসছে। তাঁকে এবং বীরেনদাকে প্রণাম জানিয়ে কমরেড মাও-এর উদ্দেশ্যে লেখা বীরেনদার একটি কবিতা দিয়ে শেষ করতে চাই।
তাঁর জীবন, তাঁর কবিতা
(মাও সে-তুং-এর স্মৃতিতে নিবেদিত)সমস্ত জীবন
মাথায় রোদ নিয়ে
তিনি
পাহাড়ের পর পাহাড়
হেঁটে পার হয়েছিলেন।লংমার্চের
দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার পরেও
তাঁর
পায়ে-হাঁটার রাস্তা
ফুরিয়ে যায়নি।একজন সত্যিকারের মহৎ জীবনশিল্পী
তিনি জেনেছিলেন
যুদ্ধে জয়লাভ করলেই
মানুষের বিশ্রাম নিতে নেই;
আহ্লাদে নেচে-ওঠার মতো
কোনও রাজসূয় উৎসব নেই মানুষের।
একটি ধর্মযুদ্ধের পুরস্কার
কোনও ব্যক্তির সিংহাসনে আরোহণ নয়;
বরং
এখনি সুযোগ নিজেকে নতুন করে নির্মাণ করার
বন্ধুদের কুশলকামনায়,
প্রেমে,
এবং অপরিসীম ধৈর্যে।সমস্ত জীবন
মাথায় রোদ নিয়ে
তিনি চেয়েছিলেন
মহাপৃথিবীর জন্য একটি অমল কবিতা
রচনা করতে…
খুবই ভালো লাগলো আলোচনাটি। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ভালো করে পড়বার বা বোঝবার আগেই উচ্চকিত বলে দেগে দেবার একটা প্রবণতা গোড়া থেকেই আছে। ভালো লাগলো আপনি সেটা স্বল্প পরিসরেই নস্যাৎ করতে পেরেছেন।
ধন্যবাদ, বন্ধু Swapan Bhattacharyya!
খুব ভালো লাগলো, সংগ্রহে রাখার মতো। শেষটাও অসাধারণ। কবি যে বার্তা দিতে চেয়েছেন, লেখকও আমাদের সকলের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দিলেন।কবির সঙ্গে তিনিও আমাদের সতর্ক করে দিলেনঃ ‘.. নইলে মোড়ের মাথায় একটা কানাকড়ি পড়ে থাকতে দেখলে/ আমাদের শপথগুলি কুঁজো হয়ে তা কুড়িয়ে নিতে পারে’
অশেষ ধন্যবাদ, বন্ধু Mrinmoy Sengupta!
মফস্বলে ছেলেবেলা কাটিয়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর কবিতা ভালবেসে যখন বিবাহসূত্রে এসে পড়লাম কলকাতায় আর কর্মজগতে প্রবেশ করে সহশিক্ষিকা আর সহকর্মী হিসেবে পেলাম বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেজোবোন রমলাদিকে, মনে হয়েছিল রূপকথার জগতে প্রবেশ করলাম। কবির অনেক ব্যক্তিগত পরিসর জানা হল। আজ আপনার এই অনন্যসাধারণ লেখাটিও তেমনি এক অজানা ব্যক্তিগত পরিসরে নিয়ে গেল। খুব ভালো লাগল।
Bidisha Chakrabarti ???
এক প্রিয় কবিকে নিয়ে আর এক প্রিয় কবির চমৎকার একটি স্মৃতিকাতর লেখা। এমন লেখা পড়লে সমৃদ্ধ হতেই হয়। ?
অশেষ ধন্যবাদ, ভাই Raju Mondal!