বিচারব্যবস্থাকে বিচার করার সময় এসেছে

সন্দীপ পাণ্ড্যে ও মোহিনী মল্লিক

 


সন্দীপ পাণ্ড্যে সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী। সোশালিস্ট পার্টি (ইন্ডিয়া)-র সহসভাপতি। মোহিনী মল্লিক আইআইটি (কানপুর)-এ হিউম্যানিটিজ-এর প্রাক্তন অধ্যাপক

 

 

 

 

 

একজন নিরপরাধকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেওয়ার কারণ হিসেবে যখন বলা হয় যে ‘এটি আইনের জন্য ভালো হচ্ছিল না’, এবং সেই ঘটনা যখন বেশ উল্লাস এবং স্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে, গণতন্ত্রের তখন অধোবদন হওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকে!

মুক্তির পর প্রিয়াঙ্কা গান্ধি ডাঃ কাফিল খানের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। আমাদেরও ইচ্ছে করছিল যে বিচারপতিরা এই রায়টা দিলেন, তাঁদের সঙ্গে একবার দেখা করতে। কেন? নিজেদের কর্তব্যপালনের জন্য? আইনের একটি মৌলিক নীতি— যতক্ষণ না একজন দোষী প্রমাণিত হচ্ছেন, ততক্ষণ তাঁকে অপরাধী বলা যায় না— মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য? এখানেই আসে অমোঘ প্রশ্নটা— আজকের ভারতবর্ষে কতজন বিচারপতি তাঁদের কর্তব্য পালন করছেন? যদি করতেন, তবে কি শার্জিল ইমাম, দেবাঙ্গনা কলিতা (তাঁকে অবশ্য অনেকগুলির মধ্যে একটা অভিযোগে জামিন দেওয়া হয়েছে)-দের মতো অসংখ্য মানুষ গরাদের পেছনে পড়ে থাকতেন? আমরা তো ভীমা কোরেগাঁও/এলগার পরিষদ মামলা নিয়ে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছি। সেই মামলায় বহু বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, অধ্যাপক এবং মানবাধিকার কর্মীদের যেসব ধারায় জেলের ঘানি টানানো হচ্ছে, তার মধ্যে বহু ধারা ডাঃ কাফিল খানের ওপরেও চাপানো হয়েছিল।

কাফিল খানের ঘটনা সাধারণ কোনও ঘটনা নয়। যে অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি তিনি আগুন-ঝরানো বক্তৃতা দিয়েছেন, সেটা মোটেও তাঁর গ্রেপ্তারির কারণ নয়। এটা সবাই জানে যে গোরখপুরের যে হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ৬০টি শিশুর মৃত্যু হয়, সেখানকার দুর্নীতি এবং অব্যবস্থার কথা কাফিল খানই প্রথম প্রকাশ্যে এনেছিলেন। তিনি তখন সেখানকার ইনচার্জ। তিনি বলেছিলেন, তিনি বারবার বলা সত্ত্বেও আগের সিলিন্ডারগুলির বিল মেটানো হয়নি, যার ফলে হাসপাতালে অক্সিজেনের হাহাকার তৈরি হয়। এর পরেও তাঁকে ক্ষমা করা হবে? শিকারী তার শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না? ২০১৭ সালে সরকারি কর্তব্যে অবহেলার জন্য এবং প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার অজুহাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

চিকিৎসকের কাজে কোনও অবহেলা দেখতে না পাওয়ায় আদালত ২০১৮ সালে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেয়। এরপর বিভাগীয় তদন্তেও তাঁকে সব অভিযোগ থেক্লে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেই যখন আবার নতুন করে তদন্ত শুরু হয়, তখনই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিষয়টির চালিকাশক্তি এমন কিছু, যাকে বাইরে থেকে সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে না। সরকার আবার সুযোগ পায় ২০১৯-এর ডিসেম্বরে। তখন সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকারীরা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভার আয়োজন করেন, এবং ডাঃ খান সেই সভায় বক্তব্য রাখেন। সরকারের দাবি কাফিল খানের বক্তব্যে নাকি সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এবং হিংসার ইন্ধন ছিল। যে ইউপি পুলিশ রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে নিজগুণে যথেষ্ট দুর্নামের অধিকারী হয়েছে, তারা এই ঘটনায় চূড়ান্ত তৎপরতা দেখিয়ে ডাঃ খানকে মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করে আলিগড়ে নিয়ে এল। সেখান থেকে পরে তাঁকে পাঠানো হল মথুরা জেলে। তাঁর বিরুদ্ধে আলিগড়ের শান্তিশৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হল। আলিগড়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের একটি অর্ডারের বলে তাঁর জামিন পাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হতেই প্রশাসন তাঁর ওপর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (এনএসএ)-এ অভিযোগ আনে এবং তাঁর কারাবাসের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়। স্টেট অ্যাডভাইসরি বোর্ডও এই আইনেই তাঁর জেলে থাকা দীর্ঘায়িত করে। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের দুজন বিচারপতির— প্রধান বিচারপতি গোভিন্দ মাথুর এবং বিচারপতি সৌমিত্র দয়াল সিং— ডিভিশন বেঞ্চ এই সমস্ত কাজকে আইনের চোখে মোটেও কোনও সুস্থিত কার্যকলাপ নয় আখ্যা দিয়ে ডাঃ কাফিল খানকে মুক্তি দিলেন। এই পুরো ঘটনায় পুলিশের কাজের নীতিহীনতা এবং হিংস্রতা বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট। আলিগড়ে ডাঃ খানের যে বক্তৃতাটিকে পুলিশ প্ররোচনামূলক বক্তব্য বলে এসেছে, বিচারপতিদের মতে সেই বক্তব্যটি হল ‘জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি রক্ষার আহ্বান’! এরপরে পেশাদারি নিরিখে পুলিশের আর কোনও আত্মমর্যাদা অবশিষ্ট থাকে কি? যাই হোক, ডাঃ কাফিল খান কিন্তু প্রমাণ করেছিলেন তিনি যথেষ্ট নিবেদিতপ্রাণ এবং বিবেকবান শিশু-চিকিৎসক। ভাগ্যের পরিহাস এমনই, এইরকম একটা অতিমারির সময়ে এরকম একজনকে চিকিৎসককে কাজে লাগানোর বদলে সরকার তাঁকে জেলে রেখে দিল!

আসলে সমস্ত বিচারপতিরাই বিচারপতি বিএইচ লোয়ার পরিণতি সম্পর্কে অবহিত। ২০১৪ সালে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। সে সময়ে তিনি সোহরাবুদ্দিন শেখ এনকাউন্টার (ফেক) মামলার বিচার করছিলেন এবং সেই মামলার এক অন্যতম অভিযুক্তের নাম ছিল অমিত শাহ। বা ধরুন বিচারপতি এস মুরলিধরের কথা। এ-বছর ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি হল, বিচারপতি মুরলিধর সেই ঘটনায় প্ররোচনামূলক বক্তব্য দেওয়ার পরেও কেন বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হল না দিল্লি পুলিশের কাছে সেই জবাবদিহি চেয়েছিলেন। যেদিন চেয়েছিলেন সেই রাতেই তাঁকে বদলি করা হয় পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাইকোর্টে। আর সাম্প্রতিক কালে আমরা যেমন প্রত্যক্ষ করছি— সারাজীবন অনুগত থাকার পুরস্কারস্বরূপ কর্মজীবনের শেষে কলাটা-মুলোটার ছায়া বেশ দীর্ঘতর হয়ে উঠছে। এতটাই দীর্ঘতর যে একজন দুষ্যন্ত দাভেকে একজন সদ্য-অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে এমনও বলার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হচ্ছে যে— “আমি মহাবালেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আপনাকে আত্মাবলোকনের শক্তি দেন এবং আপনার বিবেক জাগ্রত করেন” (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৩ সেপ্টেম্বর)। দুষ্যন্ত দাভে— সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েও যাঁকে বিচারপতি অরুণ মিশ্রের বিদায়ী সভায় বক্তব্য রাখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, বিচারপতির মিশ্রের অধীনস্থ ডিভিশন বেঞ্চে তার আগেই প্রশান্তভূষণের আদালত অবমাননার মামলার শুনানি চলছিল, যে মামলায় ভূষণের আইনজীবী ছিলেন দুষ্যন্ত দাভে।

আর ঠিক এইখানেই রাজনীতিক এবং জনগণের প্রতিনিধিদের এই প্রতিহিংসা এবং সঙ্কীর্ণতার রাজনীতির বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলা জরুরি। এবং সঙ্গে সঙ্গেই এই আইনি ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই যাঁরা ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে সত্যি কথাটা বলছে, যে-ধরনের বিচার আমাদের দেশের মানুষের প্রাপ্য তা দিচ্ছেন, তাঁদের সেলাম জানানোটাও জরুরি।

আমাদের এখন আরও কিছু নির্ভীক বিচারপতি লাগবে যাঁরা ডাঃ কাফিল খানকে শুধু যে সসম্মানে তাঁর চাকরিতে পুনর্বহাল করবেন তাই নয়, তাঁর ওপর চাপানো এনএসএ-র সমস্ত চার্জ থেকে তাঁকে মুক্তি দেবেন। যদি সেটা করা যায়, তবে তা একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হবে, এবং তার আশু ফল হিসেবে অন্যান্য নিরপরাধ জেলবন্দিদের মুক্তির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে।

আমরা বর্তমানে এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যখন বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে মানুষ গুরুতরভাবে সন্দিহান হয়ে উঠেছে। সেইরকম একটি সময়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের যে বিচারপতিরা একটি ব্যাপক অবিচারের প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করলেন, তাঁরা অবশ্যই আমাদের ধন্যবাদার্হ।

তাঁদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক!!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...