চার্বাক মিত্র
লেখক সমাজ-রাজনৈতিক প্রবন্ধকার
রোজ টিভিতে প্রাইমটাইম শো দেখেন? এই শোগুলিতে উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ বিশ্বাস করেন? ওই শোগুলিকেই খবরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সোর্স মনে করেন?
ত্রিভেন্দ্র কুমার গৌতমকে চেনেন?
প্রথম তিনটে প্রশ্নের উত্তরই যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে চতুর্থ প্রশ্নটির উত্তর ‘না’ হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। প্রাইমটাইমের ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলিই যদি আপনার কাছে খবর হয়, তাহলে অবশ্যই ত্রিভেন্দ্র কুমার গৌতমের নাম আপনি শোনেননি।
আপনাকে দোষই বা দেব কী করে? আপনার দিনে খবরের কতটুকু প্রয়োজন? আপনি যেচে খবরের কাছে যাবেন, নাকি খবর আপনার কাছে গুটি গুটি পায়ে আসবে? খবরের কাগজ আসবে মাসকাবারি নিয়মে, কাগজবাহক এসে দিয়ে যাবে দোরগোড়ায় বা বারান্দায়। টিভি চলবে রিমোটের বোতাম টিপলে। ফেসবুক স্ক্রল করলে কিছু টুকরো সমাচার, লিঙ্ক ভেসে উঠবে। এখন, এর বাইরে গিয়ে অকারণ খোঁজাখুঁজি আপনি কেনই বা করবেন? সত্যিই তো! আর না খুঁজলে আর যাই হোক, ত্রিভেন্দ্র কুমার গৌতমের নাম এসে আপনার প্রাতরাশের পাতে পড়বে না।
কে ত্রিভেন্দ্র কুমার গৌতম? পরে বলছি।
আপনারা যাঁদের চেনেন, তাঁদের কথায় আসা যাক। শ্রীযুক্ত সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার খবর যেদিন প্রকাশ্যে এসেছিল, সেদিন প্রাথমিকভাবে মিডিয়া খবর দিয়েছিল, অবসাদে আত্মহত্যা। সুশান্তের কেরিয়ারের শ্রেষ্ঠতম ছবিটি বোধহয় ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’। ছবিটা হলে পড়ে পড়ে মার খেয়েছিল। ব্যোমকেশ নিজেকে যদিও ‘সত্যান্বেষী’ বলতেন, তবে চারচৌকো বাক্সে এই খবর দেখার পর অনেকেরই বাসনা জাগল ডিটেকটিভ হয়ে ওঠার, সত্যান্বেষী নয় কিন্তু, ডিটেকটিভ! কেমন ডিটেকটিভ? অনেকটা স্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জির মতো, বা পাঁচকড়ি দে-র আমলের সেই কালো কোটপরা ডিটেকটিভের মতো, যার এক হাতে জ্বলে টর্চ, আরেক হাতে উদ্যত পিস্তল, অন্য হাত এগিয়ে গিয়ে টুঁটি চিপে ধরে। এই অদৃশ্য অন্য হাতের উদয় হল কোথা থেকে? সোশ্যাল মিডিয়া নামক একটি টাট্টু ঘোড়া, যে ঘোড়ায় সওয়ার হয়েই দেশের মানুষ মনে করে সে-ই রচনা করবে বিশ্বের যাবতীয় ওপিনিয়ন পিস, লাইভে এসে সে দেবে জ্বালাময়ী মতামত, যে মতামত তার থেকে কেউ শুনতে চায়নি আদৌ, সেই ঘোড়ার কক্সিস থেকেই এই তৃতীয় হাতটির উদয়। মোদ্দা কথা, সকলেই ঠিক করল, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!’ আর যেই না ভাবা, অমনি মন্ত্রীমশাইও রাজকন্যার গুলিসুতো খেয়ে নিয়েছে। মিডিয়াও দেখল ‘অবসাদ’, ‘ডিপ্রেশন’ এসব বড্ড বেশি অ্যাডাল্ট হয়ে যাচ্ছে। বড়দের গল্প। শিশু-কিশোর সাহিত্য চাই। ডিপ্রেশনের গল্প ঘুরে গেল নেপোটিজমের গল্পে। এ দেশের জনগণ নাহয় মন্টেসরিতে পড়ে, এ দেশের ক্লাসটিচার মিডিয়াও রূপনারাণের কুলে হঠাৎ বিস্ময়ে জেগে উঠল— ‘ওমা! বলিউডে নেপোটিজম! কী অশৈলী কী অশৈলী!’ তারাও দিব্য সেই গোয়েন্দাগল্পে ধুনো দিতে শুরু করল। সস্তার চটি পাল্প ফিকশন লেখা হয়েও যেত, কিন্তু সত্যি সত্যি নেপোটিজম নিয়ে গল্প লেখা শুরু হলে সেটা মোটেই খুব ছোটদের গল্প থাকবে না। বলিউডের অনেক তাসের ঘর ভেঙে পড়তে পারে। তার চেয়ে যা সহজ, তা হল আলিয়া ভাটকে ট্রোল করা, মহেশ ভাটের যৌনজীবন নিয়ে টিপ্পনি কাটা। কারণ, এসব করতে মোটেই সাহস লাগে না। মহেশ ভাট ইলেকট্রা কমপ্লেক্সে ভুগতেই পারেন, তিনি তো সরকারকে মাঝেমধ্যেই গালমন্দ করতে ছাড়েন না। অতএব, তাকে গালাগাল দেওয়া সোজা। কোথা থেকে একটি ভিডিওতে ভেসে এল ‘বাড়িওয়ালি’-র সময় রীতা কয়রালকে অনুপম খেরের হুমকি দেওয়ার কাহিনি। মিডিয়া সযত্নে গল্পের এই অংশটা ছোটদের থেকে উহ্য রাখতে উঠেপড়ে লাগল। অনুপম খের এখন সরকারি লোক বলে কথা! তারপর ভারতীয় পিতৃতন্ত্র তার শেষতম চালটা চালল। রিয়া চক্রবর্তী হয়ে উঠল ভিলেন। ধোকা দেওয়া প্রেমিকা অনেক বেশি সহজ ভিলেন, অবসাদ বা বলিউডের ক্ষমতাচক্রের থেকে।
এখন এই যা যা ঘটল, তার মধ্যে মিডিয়ার দুষ্টুমি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে জনাবেগের বিস্ফোরণকে সসম্মানে প্রাইমটাইম বা ফ্রন্টপেজে বা ওয়েব পোর্টালের ক্লিকবেট নিউজে জায়গা দেওয়ার আশ্চর্য অভ্যাস! যেন দেশের বাচ্চা জনগণ বায়না করছে বলেই তাদের মুখে লালিপপ ধরিয়ে দিতে হবে! তারা যখন যেমনটা চাইবে, গল্প তেমনটাই এগবে। রিয়ার কালাজাদু নিয়ে হারাকিরি, ড্রাগচক্র ধরতে গিয়ে বলিউডি কায়দায় উজবুক রিপোর্টারের মার খাওয়া, রিয়ার ছবি টাঙিয়ে ‘ভাই গাঁজা ভেজ’ লিখে স্লাটশেম করার ছ্যাবলা চেষ্টা এবং মিডিয়ার শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া রিয়ার ওপর— এসবই আদতে জনগণকে সেরেল্যাক খাইয়ে শান্ত রাখার চেষ্টামাত্র! অর্থাৎ, দেশের লোক যদি বলে কাল থেকে কাক দেখলেই মারব, কারণ কাকেরা বদের আঁটি— তাহলে মিডিয়াও বলবে নিশ্চয়, কাকেরা খুবই খারাপ। তাই আপাদমস্তক ছাব্বিশ ইঞ্চিতেই বিশ্বাস করছে মিডিয়া। কোনও নড়চড় নেই। এর মধ্যে কোনও একটি চ্যানেল এই নিত্য ক্যাকাফোনি থেকে ব্যতিক্রমী হওয়ার জন্য দেখিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর পূর্বজন্মে তিনি নাকি কট্টর মুসলমান ছিলেন, এ জন্মে তারই প্রায়শ্চিত্ত করছেন মসজিদ ভেঙে। এই অবিশ্বাস্য গাঁজা লোকে খেয়ে চলেছে, আর গাঁজা খাওয়ার জন্য রিয়া চক্রবর্তীর মুণ্ডপাত করছে। অর্ণব গোঁসাই ওই যে ‘মুঝে ড্রাগ দো, মুঝে ড্রাগ দো’ করে আর্তনাদ করছিলেন, তা কিন্তু নেহাতই আলঙ্কারিক নয়। এই প্রবল হ্যালিউসিনেশনের চাহিদাই এখন গণ-র চাহিদা, তারা বোকা ছেলের মতো পুচুপুচু কোকাকোলা খাবে, আর বোকাড্যাশ মিডিয়াও তাদের বাবা সেজে পয়সা জুগিয়ে যাবে।
এবার আসা যাক, ত্রিভেন্দ্র কুমার গৌতমের প্রসঙ্গে।
উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্মীপুরে এই ভিলেজ ডেভলপমেন্ট অফিসারের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। সরকারি অফিসার। আত্মহত্যা করেছেন। কারণ? সহকর্মীদের খোঁচা দিনরাত সহ্য করতে না পেরে। কেন সহকর্মীরা খোঁচা দিচ্ছিল?
ত্রিভেন্দ্র কুমার গৌতম, সরকারি পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়া অফিসার, একজন দলিত।
না। এই খবর নিয়ে কোনও মিডিয়া নিজেদের এবং আপনার সময় নষ্ট করবে না। সুশান্ত তারকা, তার মৃত্যুর সূত্র ধরেই নাহয় অবসাদ নিয়ে খানিক কথা হতে পারত নতুন করে। কিন্তু তা হল না। সুইসাইড প্রিভেনশন ডে-তে তাঁর ছবির সামনে বিবেকানন্দের ছবি ও বাণী রেখে যে মিডিয়া কর্তব্য সারছে, তারা আদতে উঠেপড়ে লেগে রয়েছে বিগত মাসখানেক ধরে, এই আত্মহত্যাটিকে পরিকল্পিত খুন প্রমাণ করে ছবি হিট করাতে। রিপাবলিক টিভির যে সাংবাদিক ইস্তফা দিলেন, তাঁর টুইটগুলো পারলে মন দিয়ে পড়ে দেখুন। ঠিক কতটা দেউলিয়া হলে একটা দেশের মিডিয়া এইভাবে গল্প বানানোর অ্যাজেন্ডা নিতে পারে। রোহিত ভেমুলা কিন্তু অবসাদেই আত্মহত্যা করেন। কারণ, ‘মেধার ভিত্তিতে সংরক্ষণ’, ‘কোটার চাকরি’-র কর্পোরেট গণকোলাহলের মধ্যে থেকে আচমকা কাস্ট অপ্রেশনের বড়দের গল্প বেরিয়ে আসতে পারে। রোহিত ভেমুলা অবসাদে আত্মহত্যা করেন, অথচ সুশান্তকে বশীকরণ করে খুন করা হয়। ত্রিভেন্দ্র কুমার গৌতমের আত্মহত্যা আদতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক খুন— একথাও বোধহয় ভারী হয়ে যাবে এদেশের নাবালক পাবলিকের জন্য। তাই মিডিয়াকে এসব এড়িয়ে যেতে হয়। নিটের প্রস্তুতি ভাল নেই বলে তামিলনাড়ুর যে মেয়েটি আত্মহত্যা করল, তার গল্প কেউ বুঝবে না। ঝিনচ্যাক ছাড়া কিছু থাকবে না।
যখন লাইন দিয়ে কৃষক আত্মহত্যা ঘটছিল, এবং সরকারি নথিতে সেই মৃত্যু হয়ে যাচ্ছিল পেটখারাপে মৃত্যু, তখন একজন সাংবাদিক সেই ঘটনা প্রকাশ্যে এনেছিলেন, তার নাম পি সাইনাথ। তিনি বারবার বলেন, ‘জয় জওয়ান জয় কিসান’ আওয়াজ তোলা এই দেশে সাংবাদিকরা তখন বড্ড বেশি ব্যস্ত ছিলেন কৃষক-আত্মহত্যা কভার করার চেয়েও জরুরি কোনও কাজে। কী সেই কাজ? ল্যাকমে ফ্যাশন উইক কভার করা।
বিস্ময়ের কী আছে? মিডিয়া পাঠকের মর্জির ওপরেই নির্ভর করবে। তাই গৌরী লঙ্কেশরা, যাঁরা এই ভাবের বেলুন ফুটিয়ে দিতে চান, তাঁরা খুন হয়ে যাবেন এমনিই। আমরা আমাদের অক্ষম আঙুল চালিয়ে যাব কিবোর্ডে, কারণ, সেই আঙুল ট্রিগারে রাখা নেই!