সরসিজ দাশগুপ্ত
লেখক পেশায় আইনজীবী
When historians in future look back at the last 6 years to see how democracy has been destroyed in India even without a formal Emergency, they will particularly mark the role of the Supreme Court in this destruction, & more particularly the role of the last 4 CJIs.
–প্রশান্তভূষণ, বর্ষীয়ান আইনজীবী
CJI rides a 50 Lakh motorcycle belonging to a BJP leader at Raj Bhavan Nagpur, without a mask or helmet, at a time when he keeps the SC in Lockdown mode denying citizens their fundamental right to access Justice!
–প্রশান্তভূষণ, বর্ষীয়ান আইনজীবী
উপরোক্ত বক্তব্য দুটি সম্ভবত ভারতবর্ষের আইনের ইতিহাসের পাতায় চিরকালের জন্য জায়গা পেয়ে গেল। আমি এই বক্তব্যগুলির বঙ্গানুবাদ করতে পারতাম, কিন্তু, তাতে বোধহয় বক্তব্যগুলি অসম্পূর্ণ থেকে যেত— অন্তত প্রশান্তভূষণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এই বক্তব্যগুলির মাধ্যমে উনি ঠিক কী বলতে চেয়েছেন, সেটা এখানে আলোচ্য নয়। কারণ, তার ব্যাখ্যা উনি নিজেই মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে দিয়েছেন এফিডেভিট ফাইল করে। সেই নিয়ে নতুন কিছু আমার বলার নেই।
এই উপরোক্ত বক্তব্যের জন্যই, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, বক্তা বর্ষীয়ান আইনজীবী শ্রী প্রশান্তভূষণের বিরুদ্ধে কনটেম্পট অফ কোর্টের নোটিস ইস্যু করে, এবং তারপর সেটি মামলা হিসেবে গৃহীত হয়। উক্ত মামলায়, প্রশান্তভূষণ দোষী সাব্যস্ত হন, এবং, শাস্তি হিসেবে তাঁর সর্বমোট এক টাকার জরিমানা হয়।
বক্তব্যের পক্ষে বা বিপক্ষে তর্ক করা যায়, কিন্তু সেও আজ চর্বিতচর্বণ হবে। বহু বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষ গত বেশ কিছু দিন ধরে এই একই চর্চা করছেন, হয়তো পরেও করবেন। এই চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাতাতেই পড়েছি আইনজীবী অরুণাভ ঘোষবাবুর সুচিন্তিত মতামত, যেখানে তিনি কনটেম্পট অফ কোর্ট অ্যাক্ট আইনটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, এই একই কনটেক্সটে। কিন্তু, আলোচনা শুধু আইন নিয়ে নয়, আলোচনা বিচারব্যবস্থা নিয়েও হওয়ার কথা। প্রশান্তভূষণের ওই উপরোক্ত বক্তব্যে বিচারব্যবস্থাকেই প্রশ্ন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রশান্তভূষণের বিরুদ্ধে হওয়া এটি প্রথম মামলা নয়। এর আগে ২০০৯ সালেও তার বিরুদ্ধে আরও একটি কনটেম্প্ট মামলা হয়, যা এতদিন পেন্ডিং ছিল। হঠাৎ করে, এই নতুন কনটেম্পট মামলাটি শুরু হওয়ার পরে, আচমকাই, অনাহুত অতিথির মতন, ওই ২০০৯ সালের কনটেম্পট মামলাটিও হিয়ারিং-এ চলে আসে— একই দিনে, একই সময়, একই বেঞ্চে।
আগে এক জায়গায় লিখেছিলাম যে, ভারতের বিচারব্যবস্থা কিন্তু রমরমিয়েই চলছিল। প্যান্ডেমিক হঠাৎ এসে পড়ায় সবকিছু স্তদ্ধ হয়ে গেছিল কিছু মাসের জন্য। তারপর আবার আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করেছে। এমনিতে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট অব্দি সর্বত্র রয়েছে সাধারণের এবং অ-সাধারণের শর্তসাপেক্ষ এবং নিঃশর্ত যাতায়াত। শ্লথগতি এবং সামর্থের অভাবে, অনেক সময়েই বিচারব্যবস্থার প্রতি প্রশ্ন এসে যায় অনেকের মনে, এবং শুধু তা নয়, পাশাপাশি চলতে থাকে, মিডিয়ার মতন সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা। এমনই এক বিচারসভায়, মহামান্য অর্ণব গোস্বামীরা মিলে একদিন ঘোষণা করে দেন, “ডু নট আস্ক এবাউট জাজ লোয়া”— তারপর কী হয়, তা তো আমাদের সকলের জানা। তাঁরাই আবার ঠিক করে দেন, কোনটা খুন আর কোনটা সুইসাইড। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছয়, যে গত ১০ই সেপ্টেম্বর, শশী থারুরের উক্ত অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে করা একটি মানহানির মামলায়, মহামান্য দিল্লি হাইকোর্ট এই রায় দিতে বাধ্য হয় যে, মিডিয়ার বন্ধুদের ক্রিমিনাল রিপোর্টিং করবার আগে ক্রিমিনাল ল নিয়ে কোর্স করা দরকার! না, এই আলোচনা জাস্টিস লোয়ার মৃত্যু, বা, ভারতবর্ষের সংবাদমাধ্যমে চলা সমান্তরাল বিচারব্যবস্থা নিয়ে নয়, সেগুলো উপঢৌকন মাত্র। এই আলোচনার বিষয় হল প্রশান্তভূষণের সেই বক্তব্য, অর্থাৎ, ভারতের বিচারব্যবস্থার নাকি এখন খুব সঙ্কট।
কিন্তু, এই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, শুরুতেই বুঝতে হবে, আমাদের দেশের আইন প্রণয়নের পদ্ধতিকে।
আমাদের দেশে আইন দুইভাবে তৈরি হয়। পার্লামেন্টে নেতা-মন্ত্রীরা যে আইন পাশ করেন, সেই আইনের রূপকার মূলত ব্যুরোক্রেটসরা। আইনসভায় পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলে ও সরকারি গেজেটে পাবলিশ হলে, তবেই তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলে। আমার বা আপনার যদি সেই আইন নিয়ে কিছুমাত্র আপত্তি থাকে, তাহলে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হতেই পারি, এই যুক্তিতে যে, নতুন তৈরি আইনটি সংবিধানের কোনও বিশেষ ধারার পরিপন্থী। আমাদের যুক্তিতে সন্তুষ্ট হলে, আদালত সেই আইনটিকে আনকনস্টিটিউশনাল বা আলট্রা-ভাইরিস ঘোষণা করতে পারে, ঠিক যেমনটি হয়েছিল, সিঙ্গুর ল্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১১-র ক্ষেত্রে।
এটা গেল একটা পন্থা। কিন্তু, অন্যটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্ট যদি কোনও মামলার বিচার করবার সময়ে কোনও বিশেষ আইনের পরিধিকে আরও বিস্তৃত বা সঙ্কুচিত করে দেয়, বা, সেই বিষয়ে নিজের ব্যাখ্যা দেয়, তাহলে, সেই ব্যাখ্যা ও সেই বিস্তৃত বা সঙ্কুচিত পরিধিও সেই মুহূর্ত থেকেই দেশের আইন হিসেবে গণ্য হয়। পরবর্তী সময়ে, সেই বেঁধে দেওয়া ব্যাখ্যা ও পরিধির ভিত্তিতেই বিচার্য হয়, অনুরূপ আর সমস্ত মামলা। ঠিক যেমনটি হয়েছিল, আইপিসির সেকশন ৩৭৭-এর ক্ষেত্রে।
অর্থাৎ, এ কথা পরিষ্কার যে, ভারতবর্ষের আইনব্যবস্থায় আদালত, আইনসভা ও সরকারের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই আইন প্রণয়ন, বা, পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, সরকার সুপ্রিমের কোর্ট বা হাইকোর্টের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে।
এখন যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্ট এই অসীম ক্ষমতার অধিকারী, তাই অসীম ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর এসে পড়ে অসীম দায়িত্বভারও। দায়িত্ব কীসের? ভারতবর্ষের রাষ্ট্রকাঠামোকে অক্ষুণ্ণভাবে টিকিয়ে রাখবার দায়িত্ব। একথা তো সবাই জানি যে, আমাদের দেশের সংবিধানে যত কথাই বলা থাক না কেন, দলিতের অধিকারের কথা হোক বা ব্যক্তিস্বাধীনতা— সংবিধানের নানান ধারার নানান লঙ্ঘন ক্রমাগত এবং প্রত্যহ হয়েই চলেছে। বহু ক্ষেত্রেই এই সমস্ত লঙ্ঘন মূলত হচ্ছে সরকারের মদতেই, যে সূত্রে বিরোধীরা বলে থাকেন, “গণতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।” এখন, গণতন্ত্র বিপন্ন বা ক্ষুণ্ণ হলে, সাধারণ মানুষের মনে প্রথম আসে কোর্টের কথা, তারপর আসে, আন্দোলনের কথা। দীর্ঘ পঁচাত্তর বছরের স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রাপ্তি তো এটাই। এই প্রাপ্তি আমাদের মনে বিশ্বাস জাগায় যে, আদালত রয়েছে, সমস্ত বঞ্চনার হিসেব হবে। সে যতই, তারিখ পে তারিখ চিৎকার হোক না কেন, কিংবা, জলি এলএলবি সুপারহিট হোক না কেন। হাসিঠাট্টার পরেও, মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ এখনও আদালতের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকে। শুধু আমাদের দেশ নয়, সর্বত্রই এটা বাস্তব। আমেরিকার ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সময়েও শোনা গেছে শান্তির বাণী। আমাদের দেশের কোর্ট এই কদিন আগের শাহিনবাগ আন্দোলনের সময়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের শর্তে শুনানির নিদান দিয়েছিল। এগুলো অস্বাভাবিক নয়, বিচারব্যবস্থা সচল, দ্রুত এবং পক্ষপাতশূন্য হলে, সাধারণ মধ্যবিত্তের আস্থা অটুট থাকবে, এটা বুঝতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না।
একথা অনস্বীকার্য যে, এখনকার এই কনটেম্পট মামলা, এবং আগে সেই ২০০৯ সালের কনটেম্পট মামলা, আশ্চর্যজনকভাবে একসঙ্গে একই বেঞ্চে শুনানি হওয়া, প্যান্ডেমিকের মধ্যে যখন আর্জেন্ট, বা খুব গুরুত্বপূর্ণ মামলা ছাড়া আর কোনও মামলার লিস্টিং করাই সম্ভব হচ্ছে না আইনজীবীদের পক্ষে, তখন, ২০০৯ সালের কনটেম্পট মামলার হঠাৎ শুনানির জন্য লিস্টে চলে আসা, বা, সেই আপাত নিরীহ মামলা দুটোকে একসঙ্গে রেখে শুনানি করে, কার্যত ঝড়ের বেগে সেগুলোর নিষ্পত্তি করে ফেলা, এমন এক সময়ে, যখন সারা দেশের বিচারব্যবস্থা প্রায় স্তব্ধ, বিচার করার সময় প্রশান্তভূষণের পক্ষে থাকা পুরনো কোর্টের রুলিংগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে না রাখা, বা প্রশান্তভূষণের বক্তব্যের কোনও রেফারেন্স অব্দি না রাখা— ইত্যাদি সমস্ত কিছু জন্ম দেয় অজস্র প্রশ্নের। নীতির প্রশ্ন, নিয়মের প্রশ্ন, ভাবমূর্তির প্রশ্ন ইত্যাদি তো আছেই, তার সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে, অভিপ্রায়েরও প্রশ্ন। ওই অনেকটা ‘কী পেলাম, কী হারালাম’ আর কি।
আমার হিসেবে উপরোক্ত ওই কনটেম্পট কেসগুলোর থেকে আইনের ছাত্র হিসেবে প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য। এবং কী হারালাম? সম্ভবত, বিচারব্যবস্থার প্রতি মূলত মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের যে বিশ্বাস ছিল, তার বেশ কিছু অংশই হয়তো হারিয়ে ফেললাম। প্রশান্তভূষণের নিজের পক্ষের মতামত পড়লে বোঝা যায়, ভয় তিনি পাননি, অর্থাৎ, ভয় পেয়ে চুপ করে থাকবার লোক তিনি নন। তার পক্ষে মুখ খুলেছেন আরও অসংখ্য প্রাক্তন বিচারপতি, বর্ষীয়ান আইনজীবীরা। ভয়ের প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু, এই মামলাকে কেন্দ্র করে হয়ে চলা শহুরে ডিবেটগুলি থেকে একথা স্পষ্ট যে, প্রথাগত বিচারব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা যত কমছে, ততই সম্ভবত বাড়ছে, আন্দোলনের সম্ভাবনা। সেই নিয়ে না হয় অন্য কোনওদিন আলোচনা করা যাবে।