শঙ্কর রায়
লেখক প্রবীণ সাংবাদিক
গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষে ও ত্রিশের দশকে ইংরাজি সাহিত্যচর্চায় আলোড়নকারী অক্সফোর্ড পোয়েট্রি গোষ্ঠীর অন্যতম জ্যোতিষ্ক লুই ম্যাকিনসের অকালপ্রয়াণে (মধ্য ১৯৬০ দশকে) শোকার্ত উইস্টান হিউ অডেন তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন— ‘ডেথ ইজ নো ওকেশ্যন টু পোস্টমর্টেম দি ওয়ার্ক্স অফ ওয়ান’স লাইফটাইম।’ কিন্তু সদ্যোপ্রয়াত ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বেলায় আমার একদা অতিপ্রিয় কবি অডেনের নিদান মানতে পারছি না। কারণ আজীবন তিনি জনপ্রতিনিধির নৈতিকতা মেনে চলেছেন, এমন দৃষ্টান্ত প্রায় নেই। বরঞ্চ যে ব্যাপারে তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির চেয়েও বেশি অটল ও অচঞ্চল ছিলেন, তা হল আম্বানিদের সমর্থন ও আম্বানিদের (মুকেশ ও অনিল দুই ভাই এবং তাদের দুই গোষ্ঠী— রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও অনিল ধীরুভাই আম্বানি গ্রুপ বা এডিএজি ও তাদের সহযোগী/অধীন কোম্পানিগুলি) প্রতি আনুগত্যে। সেজন্য দেশের স্বার্থ (প্রধানত অর্থনৈতিক) বারবার খর্ব হয়েছে।
দ্বিতীয়বার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরে (২০০৯) প্রণববাবু আম্বানিদের স্বার্থসেবায় কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন তার দুটি নিদর্শন দিচ্ছি। এক, সেই দফায় তাঁর পেশ করা প্রথম বাজেট প্রস্তাবে আয়কর আইন ১৯৬১-তে ৩৫এ-ডি উপধারা জুড়ে দিলেন, যার সারমর্ম হল যদি কোনও সংস্থা পাইপলাইন (পণ্য সংবহন, যেমন খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস) স্থাপন প্রকল্পে ব্যয় করে, তা মূলধনী ব্যয়ের পরিবর্তে রাজস্ব ব্যয় হিসেবে গণ্য হবে, অর্থাৎ এর জন্য কর-ছাড় পাবে। তখন পাইপলাইন প্রকল্প রূপায়ণ করছিল কেবল একটি কোম্পানি— মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স গ্যাস ট্রান্সপোর্টেশ্যন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। এর দরুণ মুকেশ আম্বানি ২০,০০০ কোটি টাকা কর ছাড় পেয়েছিলেন। এর ফলে ডাহা লোকসানে চলা কোম্পানিটি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাওয়ার চেয়েও বিস্ময়করভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। আর সেই উপধারা কয়েক সপ্তাহ পরেই, অর্থাৎ মুকেশ আম্বানির কোম্পানি ফায়দা লোটার পরেই প্রত্যাহৃত হয়েছিল। পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, সুবীর ঘোষ ও জ্যোতির্ময় চৌধুরীর ‘গ্যাস ওয়ার্স: ক্রোনি ক্যাপিটালিজম অ্যান্ড দি আম্বানিজ’ গ্রন্থের পরিশিষ্টে এই সংবাদটির পূর্ণ বয়ান আছে।
দুই, ২০১১ সালে প্রণববাবু শেয়ারবাজার ও মূলধন বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়ার (সেবি) উপর চাপ সৃষ্টি করে আম্বানিদের উপর ১৫০০ কোটি টাকা জরিমানা মকুব করাতে চেষ্টা করেন। বেঁকে বসেন সেবি সদস্য কেএম আব্রাহাম (কেরল ক্যাডারের আইএএস), তখন সেবি-তে তাঁর মেয়াদ শেষ হতে কয়েক মাস বাকি। তিনি প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংকে (সেবি চেয়ারম্যান ইউকে সিনহাকে অনুলিপি দিয়ে) একটি কড়া চিঠি লেখেন যে অর্থমন্ত্রীর উপদেষ্টা ওমিতা প্যাটেল রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, এডিএজি, সাহারা, রাজস্থান ব্যাঙ্ক ও মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ-এর বেআইনি আর্থিক লেনদেনের জন্য আর্থিক জরিমানা মকুব/লাঘবের জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন ও তা ঘটছে অর্থমন্ত্রীর জ্ঞাতসারেই। এই কাজে হস্তক্ষেপ অবৈধ, কারণ আধা-আদালত সেবির কাজে হস্তক্ষেপ বেআইনি। ‘আমি মনে করি এই দুর্ভাগ্যজনক ও বিরক্তিকর ঘটনাবলি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আনা আমার নৈতিক ও সাংবিধানিক কর্তব্য।’ আরও লিখেছিলেন, শ্রী সিনহা মাত্র তিন মাস আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রায়ই নাক গলাচ্ছেন ওমিতা প্যাটেল, যাঁর অঙ্গুলিহেলনে চলেন বড়কর্তা, ‘দি বিগ ম্যান’, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী (সিনহা আব্রাহামকে যা বলেছিলেন) নিজেও চাপ দেন। কিন্তু মন্ত্রকে ছড়ি ঘোরান সেই মহিলা। এসব কথা এই চিঠিতে আছে। আব্রাহাম সাফ বলেছেন অর্থমন্ত্রকে এক ক্ষমতাশালী কায়েমি স্বার্থ সক্রিয়, আর পরিষ্কার অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন তদানীন্তন অর্থমন্ত্রীর দিকে।
মুকেশ-অনিলের কোন্দল একদা শত্রুতার পর্যায়ে পৌঁছেছিল। প্রয়াত মুরলি দেওরা (প্রাক্তন পেট্রোলিয়ম ও প্রাকৃতিক গ্যাস মন্ত্রী), বীরাপ্পা মইলি (দেওরার স্থলাভিষিক্ত) ও প্রণববাবু অতিশয় উদ্বিগ্ন ছিলেন। দুই ভাই অবশেষে সাময়িকভাবে হলেও সমঝোতায় এলেন। প্রণববাবু কি খুশি! পরঞ্জয়-সুবীর ঘোষ-জ্যোতির্ময় লিখেছেন: ধীরুভাইয়ের পুরনো দোস্ত প্রণববাবু উচ্ছ্বাসে বলে ফেললেন যে এই চুক্তি দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ‘অবৈরী প্রতিযোগিতা’ সূত্রপাত করবে না, ‘কর্পোরেট জগতে ভালো প্রভাব ফেলবে এবং অন্যান্য কোম্পানিরা এদের থেকে প্রেরণা পাবে। কারণ দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান হয়েছে।’ এই না হলে রিলায়েন্স মামা।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী (যাঁকে সিপিআই (এম)-এর প্রভাতী দৈনিকে মাঝে মাঝে বলা হয় ‘তৃণমূলেশ্বরী’) মমতা ব্যানার্জিও প্রণব মুখার্জির স্মৃতিচারণে লিখেছেন দিল্লিতে তাঁর বাড়িতে (কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে) একদিনের কথা। তখন মমতাদেবী কংগ্রেসে এবং সাংসদ নন। “তাঁর বাড়িতে দেখি, দোতলার ড্রয়িংরুমে এক ভদ্রলোক এসেছেন। মুখটা চেনা লাগছে। কোথাও কোনও ছবিতে যেন দেখেছি। প্রণবদাকে আড়ালে ডেকে বললাম, ‘উনি কি ধীরুভাই আম্বানি? যদি তা-ই হন, তা হলে একটু বলুন না, আমাদের ওখানে ‘স্যাপ’ কারখানাটি যাতে খুলে দেন। অনেক লোক বিপন্ন!’ প্রণবদা হেসে বলেছিলেন, ‘তুই তো সাঙ্ঘাতিক!’”
প্রণববাবুকে যাঁরা স্টেটসম্যান হিসেবে তুলে ধরছেন বা আবেগে তোল্লাই দিচ্ছেন (এদের মধ্যে সিপিআই (এম)-এর অর্থনৈতিক তাত্ত্বিক অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েকও আছেন। ৩১ আগস্ট টেলিগ্রাফ দৈনিকে প্রথম পৃষ্ঠার নিবন্ধ দ্রষ্টব্য), তাঁদের অনেকেই জানেন যে প্রয়াত একমাত্র ‘বাঙালি’ রাষ্ট্রপতির কাছে জাতীয় ও বঙ্গীয় স্বার্থের চেয়ে আম্বানিদের স্বার্থসেবা অনেক বড় ছিল। এক সুভদ্র ও মার্জিত রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁকে কুর্নিশ করলেও তাঁর সম্পর্কে কিছু কটু কথা বলতে হল। যা সত্য ‘তা বিদ্যুতের মত উদ্ভাসিত হয়’— বুদ্ধদেব বসুর এই কথাগুলি সতত স্মরণে আসে।
good article