জয়তী ঘোষ
লেখক জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক
বিষয়টি তাহলে আর গোপন রইল না। কোভিড-১৯ মহামারিতে দৈনিক নতুন আক্রান্তের সংখ্যা এবং এই মহামারিকালে বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলির মধ্যে সবথেকে খারাপ ফল প্রদর্শন, এই দুই হিসাবে ভারত ‘জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন’ লাভ করেছে। কীভাবে এই দ্বিমুখী কৃতিত্ব অর্জন করা সম্ভব হল? ‘ভগবানের মার’ নয়, এর জন্য দায়ী আমাদের বর্তমান দেশনায়কদের ঔদাসীন্য ও অযোগ্যতা।
অধোগতির হিসাবনিকাশ
গত বছরের হিসাবে এই বছরের এপ্রিল–জুন পর্যায়ে জাতীয় আয়ের আনুমানিক ২৪ শতাংশ সঙ্কোচন জি২০ দেশগুলির মধ্যে, এমনকি আমাদের দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের মধ্যেও, সবচেয়ে খারাপ ফল। তবে এই পরিসংখ্যান সম্ভবত বাস্তবচিত্রের বেশ কিছুটা রক্ষণশীল প্রতিফলন, কারণ এই অনুমানের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে কেবলমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্র থেকে, এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের হিসাবটা কষা হয়েছে এই তথ্যের নিরিখেই। জাতীয় আয়ের প্রকৃত সঙ্কোচন সম্ভবত এর চেয়ে আরও ভয়ানক। ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশনের (কেবলমাত্র পঞ্জীকৃত কারখানাগুলির হিসাব যেখানে ধরা হয়ে থাকে) সূচকের মত গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবভিত্তিক সূচকে দেখা যাচ্ছে ২০ শতাংশের বেশি পতন। অন্যদিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদনে সঙ্কোচনের হার, কিছু সমীক্ষার মতে, আরও অনেক বেশি। বহু অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ আজও হয় বন্ধ, নয় তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। মজুরিজাত মোট আয়ের অধোগতিও স্পষ্ট, এবং তার পতনের হার জাতীয় আয়ের পতনের হারের থেকে বেশি। এর অর্থ, একদিকে কর্মসংস্থান যেমন কমছে, তেমন কমছে মজুরিও।
জাতীয় আয়ের হিসাবনিকাশের মধ্যে আরও একটি সিঁদুরে মেঘের রেখা দেখা যাচ্ছে। কৃষি ছাড়া অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে— বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি— সঙ্কোচন অত্যন্ত স্পষ্ট। রবিশস্যের আশানুরূপ উৎপাদন ও যথেষ্ট বৃষ্টিপাত কৃষিকে রক্ষা করেছে ঠিকই, তবু ব্যাপক আয়সঙ্কোচনের ফলে কৃষিমূল্য কৃষকের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় হবে কি না, বা কৃষিকাজ তাঁর কাছে যথেষ্ট লাভজনক থাকবে কি না, তা একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ব্যষ্টিক প্রয়োজনপূরণে পণ্য ও পরিষেবাখাতে সরকারি খরচ, বা সরকারি ভোগ ব্যয় (গভর্নমেন্ট কনসাম্পশন এক্সপেন্ডিচার), গত বছরের এপ্রিল-জুন পর্যায়ে ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু যেহেতু মোট বিনিয়োগ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে, সরকারি বিনিয়োগও যে সঙ্কুচিত হয়েছে তা ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্রশাসনিক ও সুরক্ষাখাতে এবং অন্যান্য পরিষেবার ক্ষেত্রে স্থূল মূল্য সংযোজন (গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড)-এর পতন হয়েছে ১০ শতাংশ। এর ৯০ শতাংশ বেতন। কেন্দ্রীয় সরকারের বেতনে যেহেতু কোনও কাটছাঁট হয়নি, এই সঙ্কোচনের ঝড় মূলত রাজ্য সরকারগুলির উপর দিয়ে গেছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। এঁদের অনেকেই হয়ত কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধি থেকে বিরত থেকেছেন, অথবা বেতন দিতে কালক্ষেপ করেছেন।
চরম সঙ্কট
এদিকে অতিমারির যাত্রা আপাতভাবে অব্যাহত। কোভিডের রেখাচিত্রকে ধরাশায়ী করার সমস্ত অঙ্গীকার (অর্থনীতির সেই আজগুবি লতাঙ্কুরের মত, যার কথা সরকারি মুখপাত্র বারংবার বলে থাকেন) হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, আর তার জায়গা নিয়েছে সুস্থতার হার-সম্বলিত অর্থহীন পরিসংখ্যান, মোট আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে যা আপনিই বেড়ে চলবে। অমানবিক লকডাউনের জেরে অতিমারি ছড়িয়ে পড়ার আগেই অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। পরীক্ষা, সূত্র-অনুসন্ধান, পৃথকীকরণ এবং চিকিৎসা— যা ব্যয়সাপেক্ষ হলেও রোগ-প্রতিরোধের একমাত্র উপায়— না করে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও সতর্কীকরণ ছাড়াই সারা দেশকে স্তব্ধ করে দিলেন। এর পরেও ৮০ শতাংশের মত শ্রমিক, যাঁরা নিজেদের জীবিকা হারালেন, কোনও ক্ষতিপূরণ বা সামাজিক সুরক্ষা পেলেন না। অভিবাসী শ্রমিকেরা ভয়ঙ্কর দুর্দশার মধ্যে নিজেদের ঘরের দিকে ফিরতে বাধ্য হলেন। তাঁদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল, রোগ সেখানেও ছড়িয়ে পড়ল। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবার কারণে শ্রমজীবী মানুষেরা ও তাঁদের পরিবার শিকার হলেন পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্যহীনতার। এখন তাঁদের কাজে ফিরতে বলা হচ্ছে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগের থেকে কম মজুরিতে), যদিও রোগাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আগের থেকে বেড়ে গেছে বহুগুণ।
যা প্রত্যক্ষ করে আরও ভয় হয়, তা হল এখন সমস্যার মাত্র সূত্রপাত হয়েছে। রোগের বিস্তার বন্ধ হয়ে যাবে, এমন ভাবার কোনও কারণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের তরফে দেখা পাওয়া যাচ্ছে না জনস্বাস্থ্য বা অর্থনীতি-বিষয়ক কোনও কার্যকরী পদক্ষেপের। আর্থনীতিক মন্দা এই ত্রিমাসকেও নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করতে চলেছে। সম্ভবত এই বছরের বাকি মাসগুলিকেও। সুতরাং, আমরা যে স্বাধীন ভারতের সর্ববৃহৎ আর্থনীতিক সঙ্কটের দিকে তাকিয়ে আছি, তা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়।
রাজ্যগুলির ওপর আঘাত
চাহিদার ঘাটতি এই অবস্থার এক অন্যতম কারণ। অতিমারি জাঁকিয়ে বসার অনেক আগের থেকেই ভোগব্যয় এবং বিনিয়োগে পতন দেখা যাচ্ছিল। এর পরে অতিমারির সময়ে অর্থনীতিতে ধ্বস নামা সত্ত্বেও সরকারের তরফে ত্রাণব্যবস্থা ছিল অযুতসংখ্যক পীড়িতের কাছে নিতান্তই অপ্রতুল, এবং এর ফলে মোট চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তেমন কোনও প্রভাবই দেখা গেল না। তারল্য (লিক্যুইডিটি) সঙ্কটের মোকাবিলাতেও সরকারের দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপ কোনও সমাধান দিতে পারেনি। ব্যাঙ্কপ্রদত্ত ঋণের পরিমাণ কমেছে, এবং সব ধরনের ঋণার্থীরাই (বিশেষ সুবিধাভোগী বড় কোম্পানিগুলি ছাড়া) প্রয়োজনের তুলনায় কম ঋণ পেয়েছেন।
সবচেয়ে খারাপ আচরণ হয়েছে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে। ন্যাশনাল ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট রাজ্যগুলির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল, কিন্তু যথোপযুক্ত সমন্বয়ের বন্দোবস্ত করা হল না। উল্টে তাদের একরকম বাধ্য করা হল স্বাস্থ্যসঙ্কটের মোকাবিলায় সবথেকে বেশি দায়িত্ব নিতে, আর অতিমারির আর্থনীতিক ফলাফল সহ্য করতে, যদিও তার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পাওয়া গেল না। রাজ্যগুলির প্রাপ্য পণ্য ও পরিষেবা কর-সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণ শুল্ক পর্যন্ত কেন্দ্র দেয়নি। কেন্দ্র ও রাজ্যের চুক্তির এমন লঙ্ঘন দুর্বলভাবে পরিকল্পিত এবং বাস্তবায়িত এই জিএসটি ব্যবস্থার অকৃতকার্যতার কারণ হতে পারে।
এই ব্যয়কুণ্ঠতার ফল ভোগ করতে হবে দেশের নাগরিককে। অধিকাংশ রাজ্য সরকার তাঁদের সারা বছরের ব্যয় এই ক’মাসেই খরচ করে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন, এবং এখন তাঁদের সংস্থান শেষ হবার মুখে। রাজস্ব-বৃদ্ধির উপায়গুলি জিএসটি-র কাছে সঁপে দেবার পর তাঁদের এখন আয়ের সীমাবদ্ধতা মেনে চলতে হয়। রাজ্যগুলিকে তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে উলটে ঋণ নিতে বলা হচ্ছে, যদিও সেই ঋণ রাজ্য কীভাবে শোধ দেবে তা খুব স্পষ্ট নয়। এই অবস্থার ফলে বছরের বাকি সময়টুকুতে তাঁদের ব্যয়ক্ষমতা সঙ্কুচিত হবে, এ-কথা বলাই বাহুল্য এবং তার ফল ভোগ সাধারণ মানুষ, যখন তাঁরা ন্যূনতম সাধারণ পরিষেবাগুলি থেকেও বঞ্চিত হবেন।
আর্থিক প্যাকেজ
উপরে যে-যে সমস্যাগুলির কথা উল্লেখ করলাম, তার কোনওটিই অপরিহার্য ছিল না, ‘ঈশ্বরদত্ত’ তো নয়ই। বরং সঠিক নীতিপ্রণয়ন ও রূপায়নের মাধ্যমে এই বিপদ এড়ানো যেত। এমন কী এখনও এই ভয়ঙ্কর অধোগতিকে রুখে দেওয়া সম্ভব। এই দুরবস্থার মোড় ঘোরানো সম্ভব। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তব্য, যথাশীঘ্র একটি সত্য-অর্থে ব্যাপক আর্থিক প্যাকেজ (যাতে কত টাকা বরাদ্দ করা হল সে-বিষয়ে সঠিক তথ্য দেওয়া হবে, কেবল অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি নয়) ঘোষণা করা, যাতে থাকবে: রাজ্য সরকারগুলিকে জিএসটি ক্ষতিপূরণ বাবাদ প্রাপ্য মেটানো, তার সঙ্গে এই অতিমারি ও তার সমান্তরাল ক্ষতিসমূহের প্রতিকারের জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ; গণবণ্টন ব্যবস্থার সার্বজনীনকরণ এবং আগামী ছয় মাসের জন্য অভাবীদের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য (প্রতি মাসে প্রতিটি পরিবারকে ১০ কিলো করে) প্রদান; লকডাউনে আয়ের ক্ষতি পূরণ করার উদ্দেশ্যে আগামী তিন মাসের জন্য প্রতিটি অভাবী পরিবারপিছু ৭,০০০ টাকা করে সাহায্যদান; ২০০৫ সালের মহাত্মা গান্ধি রাষ্ট্রীয় গ্রামীণ রোজগার অধিনিয়মের অধীনে কর্মসংস্থানের দিনের সংখ্যা দ্বিগুণ করে প্রতি বছর ২০০ করতে হবে (অন্তত এই বছরের জন্য) এবং শহরের জন্যও চালু করতে হবে কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প; দেনাশোধ স্থগিত করতে হবে (যাতে স্থগিতকরণের সময়কালে সুদ না ধার্য করা হয়) এবং ছোট ব্যবসায়ী ও কৃষকদের ঋণদান নিশ্চিত করতে হবে; জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির জন্য সম্পদের সংস্থান করতে হবে— সমস্ত অতিমারি-সংক্রান্ত খরচ মেটানোর জন্য, এবং সেই সমস্ত স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যার নিরসনের জন্য, গত পাঁচ মাসে যেগুলিকে অবহেলা করা হয়েছে।
এর জন্য বিপুল অর্থের অবশ্যই প্রয়োজন; তবে এই পদক্ষেপগুলি না নিলে দেশের অর্থনীতি ও দেশের মানুষ ব্যাপকতর ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এখন খরচ না করলে অর্থনীতিকে আরও গভীর খাদের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। যার ফল ফলবে আয়হ্রাসে, ফলত রাজস্বহ্রাসে, এবং স্বল্পতর ব্যয়েও আরও বেশি রাজস্ব ঘাটতিতে। বর্ধিত ব্যয়ের জন্য অর্থের সংস্থান করতে কেন্দ্র রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নিতে পারেন (ঘাটতির মুদ্রায়ণ, বহু দেশের সরকার যেমন করতে শুরু করেছেন)। এই পদক্ষেপে মুদ্রাস্ফীতির হারে লাগাম থাকবে, যদি অত্যাবশ্যক পণ্যের যোগান বহাল রাখা যায়, কারণ চাহিদা বর্তমানে স্বল্প। কালক্রমে সম্পদ কর ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির (বিশেষ করে সেই সব ডিজিটাল জায়ান্টরা, যারা কর ফাঁকি দিতে দক্ষ) ওপর করের কথা ভাবতেই হবে। বলিষ্ঠ ভাবনা এবং তার সঙ্গে সময়োচিত পদক্ষেপ ছাড়া আর অন্য উপায় নেই।
মূল লেখার লিঙ্ক https://www.thehindu.com/opinion/lead/a-guide-to-flattening-the-curve-of-economic-chaos/article32508219.ece