সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক কবি, চিত্রনাট্যকার, গবেষক
জন্মেছি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ পদবী নিয়ে, বাঙালী মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোক’ পরিবারে। অতএব, এ লেখা লেখবার অধিকার আমার কতটুকু আছে, সেই নিয়ে শুরুতেই সংশয় প্রকাশ করে রাখি। সংশয়ের কারণ এই নয় যে আমি নিজেকে কোথাও ‘ব্রাহ্মণ’ হিসেবে আলাদা করে চিনেছি, কিন্তু সংশয় এই কারণে যে তত্ত্ব আর তথ্যর থেকেও বেশি যাপনের একটা ভূমিকা থাকে যেকোনও মতামত তৈরির পিছনে। তাছাড়া মানবীবিদ্যার বা নারীবাদের এই সময়ের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হল ‘স্ট্যান্ড পয়েন্ট থিওরি’। সান্দ্রা হার্ডিং বলছেন যতক্ষণ না কেউ সেই ঘটনার বা যাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়াবে ততক্ষণ তার মতামতে মিশে থাকতে পারে ভ্রান্তি, কারণ সেই মতামত দূর থেকে আসছে, পরোক্ষভাবে। আর তাই নিজস্ব সামান্য মতামত বা মনে হওয়া লিখে ফেলবার আগে আমি নিজেকে এবং পাঠকদের সাবধান করে দিতে চাই সেই ভ্রান্তির বিষয়ে। এমনকী কেবল আমার মতামতই নয়, যে কোনও লেখা, যে কোনও মতকে এই স্ট্যান্ড পয়েন্ট থিওরির নিরিখে একবার প্রশ্ন করে নিলে চোখে পড়তে পারে তার ভ্রান্তিগুলি। আর সবচাইতে ভালো করে বুঝতে পারব, যখন কেউ সেই কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে লিখে ফেলবেন নিজের কথা।
তাই মেরুনা মুর্মুর প্রসঙ্গে লিখতে গেলে আমাদের সবচাইতে বেশি করে ভরসা করতে হবে ওঁর কথার উপরে। কারণ যাপনটা ওঁর। লড়াইয়ের, অপমানের, রুখে দাঁড়ানোর। কিন্তু কেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল হঠাৎ মেরুনা মুর্মুর এই ঘটনা? আমার কাছে চিন্তার আসলে এইটেই। বুঝিয়ে বলি। ভারতবর্ষ জুড়ে যখন চলছে দলিতদের প্রতি অত্যাচার, কখনও নগ্ন করে হাঁটানো হচ্ছে, কখনও দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে, কখনও লাঠি পেটা করা হচ্ছে, তখন কোথায় আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মেরুনা মুর্মুর ঘটনা? এই ঘটনাকে দেখতে গেলে আমাদের তো দেখা উচিত সমগ্র ভারতবর্ষের সঙ্গে তাকে জুড়ে। দলিত আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে। এ প্রসঙ্গে নিশ্চিতভাবে মনে হবে বি আর আম্বেদকরের ‘অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট’-এর কথা । ১৯৩৬, ১৫ মে আম্বেদকরের নিজের খরচে প্রকাশিত হচ্ছে এই পুস্তিকা। কারণ ঠিক এর আগেই, কণ্ঠরোধ করা হয়েছে ওঁর। এই ভাষণ দেওয়া যাবে না বলে একপ্রকার ফতোয়াই জারি করা হয়েছে। আম্বেদকরও অটল, একটি কমাও তিনি বদলাবেন না। কিন্তু কেন নিষেধ, কেন কন্ঠরোধ? ‘অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট’ পড়লেই সে কথা সহজে বোঝা যায়। ইতিহাস আসলে লেখা হয়েছে চিরকাল উচ্চবর্ণ পুরুষদের হাতে আর তাই যে কোনও নতুন কণ্ঠ, যেকোনও প্রান্তিকের ভাষণ আসলে একটু একটু করে বদলে বদলে দেয় সেই ইতিহাসকে। যে ইতিহাস লেখা হয় কেন্দ্র থেকে। যদিও সময় এসেছে ‘কেন্দ্র’ আর ‘প্রান্ত’— এই অবস্থানগুলোকেও প্রশ্ন করার। কিন্তু সে প্রসঙ্গ ভিন্ন।
এইখান থেকে যদি আসি মেরুনা মুর্মুর ঘটনায়, তাহলে শুরুতেই বলতে হবে ‘ইন্টারসেকশনালিটি’র কথা। কী এই ইন্টারসেকশনালিটি? অর্থাৎ যে কোনও ব্যক্তির প্রতি হওয়া বৈষম্যকে বুঝতে গেলে তার পরিচিতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ধর্ম, বর্ণ, জাত, লিঙ্গ এইসব দিয়ে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে এর মধ্যে কোন কোন প্যারামিটারগুলো দিয়ে তৈরি হচ্ছে এই বৈষম্যের আর বঞ্চনার ন্যারেটিভ। মেরুনা মুর্মুর ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে কেবল বর্ণ বা জাত নয় বরং লিঙ্গও হচ্ছে সেই প্যারামিটার। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বৈষম্য হচ্ছে দ্বিগুণ। সমাজে লিঙ্গরাজনীতির কথা নতুন করে বলবার কিছু নেই, এ লেখায় কোনও রাজনীতির ইতিহাস লেখা আমার উদ্দেশ্য নয় বরং আমি ধরিয়ে দিতে চাইছি সেই সমস্ত সূত্র যা দিয়ে আমি ঘটনাটিকে দেখব। মতামতে পৌছনোর থেকেও জরুরি হল সেই দেখাটা বা বোঝাটা। অর্থাৎ কেবল ‘আদিবাসী’ ‘দলিত’ নয়, ‘আদিবাসী মহিলা’, ‘দলিত মহিলা’— মনে রাখতে হবে এভাবে। লিঙ্গরাজনীতির নিরিখে আমি অপছন্দ করি এই কোনও পরিচয়ের আগে ‘মহিলা’ বা এ ধরনের কোনও লিঙ্গ বা জাতের উল্লেখ। কিন্তু আন্দোলনগুলির ইতিহাসের দিকে নজর রাখলে মেনে নিতে হয় যে যেকোনও আন্দোলনের শুরুর দিকে এই পরিচয়গুলিই আসলে হয়ে ওঠে সাবভার্সানের হাতিয়ার। অর্থাৎ যে যে প্যারামিটার দিয়ে তুমি আমার ওপর নিয়ে আসছ বৈষম্যের অত্যাচার, আমিও সেগুলো দিয়েই তৈরি করছি আমার লড়াইয়ের যাত্রাপথ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এ সময়ের একজন কবি লেখক কল্যাণী ঠাকুর, উনি নিজের নামের সঙ্গে লেখেন ‘চাঁড়াল’। কারণ ওইটিই ওঁর নিরন্তর লিখে যাওয়ার কারণ। লেখা ওঁর কাছে নিছক মনের ভাব প্রকাশ করা নয় বরং লড়াই। ঢুকে পড়তে চাই না ভাষার রাজনীতির ভিতরে, কিন্তু পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে যেকোনও মননে, যেকোনও আন্দোলনে ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। দলিত এবং নারী এই দুইয়ের সেতুর উপর তৈরি হওয়া বৈষম্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় বামার লেখা ‘সঙ্গতি’র কথা। যেখানে একদিকে এক দলিত গোষ্ঠীর মহিলাদের সহ্য করতে হচ্ছে উচ্চবর্ণের মানুষদের অত্যাচার, আবার নারী হিসেবে সহ্য করতে হচ্ছে পুরুষদের অত্যাচার। বামা বারবার বলছেন, এই অত্যাচার থেকে মুক্তির পথ সহজ ছিল না কারণ তাদের শিক্ষার অধিকার দেওয়া হয়নি। মেরুনা মুর্মুর ঘটনাকে, সংরক্ষণকে, আজকের ভারতবর্ষের সমাজকে বুঝতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে এই ‘অধিকার’-এর কেন্দ্রবিন্দু থেকে, অধিকারের ইতিহাস থেকে।
কিন্তু যেখান থেকে শুরু করেছিলাম এই লেখা, অর্থাৎ কেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে হঠাৎ এই ঘটনা, আমার কাছে চিন্তার সেটাই। তার মানে ‘কলকাতা’, ‘যাদবপুর’, ‘বেথুন’, ‘অধ্যাপক’ এই সমস্ত ছবিই আসলে আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছিল যে এই সব শব্দের মধ্যেও লুকিয়ে থাকতে পারে জাতপাতের বৈষম্যের এই গভীর বীজ। বীজ নাকি গাছই? আমরা এড়িয়ে চলেছি সেই গাছকে আর প্রতিদিন নতুন নতুন করে আমাদের মধ্যে বেড়ে উঠছে সেই বৈষম্যের গাছ, যে গাছের সবচেয়ে নিচু ডালটায় আমরা লিখে রাখছি ‘দলিত’ ‘আদিবাসী’ এই শব্দগুলিকে। বুঝতেও পারছি না কীভাবে তা বিষ ছড়াচ্ছে আমাদেরই ভিতর। আমরা দলিতকে বেঁধে রাখার ঘটনায় ভাবছি ওটা ‘আমাদের’ থেকে অনেক দূরের ঘটনা। ‘আমরা’ নই। ‘ওরা’। মেরুনা মুর্মুর ঘটনায় আমাদের সেই ঘুম ভাঙছে। আমরা বুঝতে পারছি, কোথাও কোনও ‘ওরা’ নেই। ওই সব্বাই আসলে ‘আমরা’, ‘আমরা’। আমরাই দেশের কোথাও নগ্ন হাঁটাচ্ছি, বেঁধে রাখছি দলিতকে। আর কোথাও ইন্টারনেট ব্যবহার করে উগড়ে দিচ্ছি আমাদের গলা অবধি আটকে থাকা বিষ। ঘটনাটির উল্লেখ নতুন করে করার কিছু নেই, সকলের কাছে তা জানা, তবু মনে রাখবার বিষয় এই যে, কথা আসলে শুরু হয়েছিল এই বিশ্বব্যাপী অতিমারির সময় পরীক্ষা হওয়া ঠিক না বেঠিক, সেই নিয়ে। আর সেই মতামত প্রকাশ করতে গিয়েই অধ্যাপক মেরুনা মুর্মুর দিকে ধেয়ে আসে জাতপাত নিয়ে, সংরক্ষণ নিয়ে মন্তব্য। সুতরাং গল্প আসলে সেই ‘লড়াই’য়ের। আর আমরা কিন্তু এখনও বসে বসে ভাবছি, যা বলেছে, একটি মেয়ে বলেছে আরেকটি মেয়েকে। কিন্তু এখানেও আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে— কথা আসলে কোনওদিন কোনও ব্যক্তি বলে না। বলে সমাজ, সংস্কার, ইতিহাস, মনের ভিতরে বাসা বাঁধা আলো কিংবা অন্ধকার। আর তাই মেরুনা ও সেই বেথুন কলেজের মেয়েটিকে মুখোমুখি রেখে আমরা যদি ভাতঘুম দিতে যাই তাহলে এক মস্ত বড় ভুল হবে। আমাদের নিজেদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। প্রশ্ন করতে হবে, বামার ‘সঙ্গতি’, আম্বেদকরের ‘অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট’ এইসব লেখা হয়েছে ভারতবর্ষেরই বুকে। তাহলে কেন বদলাল না ভারতবর্ষের অন্তরাত্মা? আইন কোনওদিন কোনও দেশের আত্মাকে বদলাতে পারে না, নিয়ম করে তাকে সুশৃঙ্খল করার চেষ্টা করতে পারে। দেশের আত্মার উন্নতি করতে পারে একমাত্র দেশবাসীরা। আর তার জন্য সেই দেশবাসীদের বারবার ভাবতে হয় ‘আমরা, আমরা, আমরা’… কোথাও কোনও ‘ওরা’ নেই। এই ‘অপর’-এর ধারণা কেবল বৈষম্যের রাজনীতির জন্ম দেয় তা নয়, কিছুতেই উপড়ে ফেলতে দেয় না সেই বৈষম্যের গাছকেও। যার কোনও ডালে ধর্ম, কোনও ডালে লিঙ্গ, কোনও ডালে ‘জাত’ আর কোনও ডালে ‘বর্ণ’। আমাদের উচিত সেই সমস্ত ডাল বেয়ে একেবারে গাছের মাথার দিকটা পৌছতে। যেখানে রয়েছে এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে ‘সাম্য’। যে সাম্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ প্রসঙ্গে মনে পড়তে পারে ‘অচলায়তন’-এ শোণপাংশুদের কথা। আমাদের আসলে প্রয়োজন এক দাদাঠাকুরের যিনি আমাদের মনগুলোকে পঞ্চকের মতো করে তুলবেন। তবেই ভাঙবে এই ভারতবর্ষের গভীরে বাসা বেঁধে থাকা এই ‘অচলায়তন’। তবেই আর আলাদা করে চোখে পড়বে না ‘মুর্মু’ কিংবা ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’।