লকডাউন আর আমফান: জোড়া ধাক্কায় বিধ্বস্ত বইপাড়া

বুলবুল ইসলাম

 


লেখক পেশায় প্রকাশক। নবজাতক প্রকাশনের কর্ণধার

 

 

 

বইপাড়া মানে কি শুধুই লেখক-প্রকাশক-পুস্তক বিক্রেতা এবং পাঠক-পাঠিকা?? না, বইপাড়া মানে এঁদের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য অনুসারী কাজের অসংখ্য মানুষ। সেখানে যেমন প্রচ্ছদশিল্পী আছেন, তেমনি আছেন কম্পোজিটার, প্রুফরিডার সহ অসংখ্য প্রেসের কর্মী, বাঁধাই কর্মী, প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মী, জড়িয়ে আছেন মুটে-মজদুর, প্যাকেট প্রস্তুতকারকরাও; জড়িয়ে আছে কলেজস্ট্রিট বইপাড়া সংলগ্ন চা ও খাবারের দোকানগুলিও। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের রুটি-রুজি করোনার কারণে লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার অসংখ্য মানুষ যাঁরা বইপাড়া-কেন্দ্রিক তাঁরাও অনেকে পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হওয়ায় আসতে পারছেন না কর্মস্থলে। কাজ হারাচ্ছেন অনেকেই। এখনও নতুন বই প্রকাশ করার ঝুঁকি নিতে চাইছে না প্রকাশকমহল, তাই পুরো ব্যবস্থাটাই অত্যন্ত সঙ্কটে।

করোনার মধ্যেই আমফানের বিধ্বংসী ঝড় আর বৃষ্টি কলেজস্ট্রিট বইপাড়াকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাথ থেকে কলেজ স্কোয়ার বা বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট-শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিটে কোথাও হাঁটুজল বা কোথাও কোমর সমান জল উঠেছিল। যার ফলে বন্ধ দোকান ও গুদামগুলিতে সারিসারি বই একপ্রকার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে টেমার লেন-কলেজ রো সহ এই অঞ্চলকে ঘিরে থাকা ছোট ছোট গলি বা তস্য গলিগুলিও প্লাবিত হয়েছে। নিস্তার পায়নি স্কুল বা কলেজপাঠ্য অত্যন্ত মূল্যবান অসংখ্য বই। তার সঙ্গেই সেই সময়ের বেশ কিছুদিন পূর্বে হয়ে যাওয়া কলকাতা বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হওয়া অসংখ্য অবিক্রিত প্রবন্ধ-গল্প-উপন্যাস-কবিতার বই জলে ভিজে মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়েছে। সেই বইগুলি আর বিক্রয়ের অবস্থায় ফেরত পাওয়া যাবে না জেনেও আমফান দুর্যোগের পরবর্তী পর্যায়ে বইপাড়ার রাস্তা জুড়ে শুধু ভেজা বই শুকোতে দিতে হয়েছে প্রকাশক-পুস্তক বিক্রেতাদের একটু স্বাভাবিক হওয়ার আশায়। সেই সময় বইপাড়ার প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের কয়েকটি সংগঠন ও ব্যক্তিগত স্তরে কয়েকজন ছাড়াও কলকাতা ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক- অধ্যাপিকারা, বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা সর্বতোভাবে বইপাড়ার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টায় যেমন ত্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের হাতে অনুদান তুলে দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন। যদিও সেই ত্রাণ বা অনুদান কোনওটাই সার্বিকভাবে বইপাড়াকে বাঁচানোর জন্যে যথেষ্ট নয়। সাময়িক সাহায্য হিসেবে সেগুলির গুরুত্ব কম না হলেও একটি শিল্প ও তার অনুসারী শিল্পকে শুধু ত্রাণ বা অনুদান দিয়ে বাঁচানো যায় না।

আমফানের পরে লকডাউন শিথিল হওয়ায় বইপাড়া পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার চেষ্টা করলেও প্রায় ক্রেতাশূন্য দোকানগুলি যেন খাঁ খাঁ করছে! স্কুল-কলেজ না খোলায় ছাত্রছাত্রী অভিভাবক-অভিভাবিকারাও তেমনভাবে বইপাড়ামুখী হতে পারেননি। আসতে পারেননি জেলাগুলির বইবিক্রেতারাও। কফি হাউজের আড্ডা থেমে না গেলেও স্বাভাবিক হয়নি এখনও। বইপ্রেমী পাঠক-পাঠিকারাও নতুন বা পুরনো বইয়ের ঘ্রাণ নিতে বইপাড়ায় আসছেন কম সংখ্যায়। তার অন্যতম কারণ যদি অতিমারি হয় আর একটি প্রধান কারণ প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সমস্যা।

এই অবস্থায় বইপাড়ার পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে আসতে যেমন সময় প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সার্বিক স্বাভাবিক পরিস্থিতি, যা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয় কবে আসবে। প্রশ্ন উঠছে আগামী জেলার বইমেলাগুলো বা আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা হবে তো? এখনও তার কোনও সদুত্তর কারও পক্ষেই হয়তো দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু এই ঐতিহ্যবাহী বইপাড়া কি শুধু স্বাভাবিক পরিস্থিতির অপেক্ষায় থাকবে? অনেকেই বলবেন এই ফিজিক্যাল ডিস্টেন্সের সময় যখন অনলাইন ব্যবস্থা শক্তিশালী হচ্ছে তখন অনলাইনের প্রতি প্রকাশকদের আগ্রহী হওয়া উচিত। কিন্তু বুঝতে হবে সারা বিশ্বে আমাদের দেশের থেকেও যে সব দেশে অনেক আগে থেকেই অনলাইন ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সেই দেশগুলিতেও কিন্তু বইয়ের মূল স্তম্ভ এই যুগেও বাঁধাই বই। শুধুমাত্র অনলাইন বইয়ের মাধ্যমে একটি দেশের বা রাজ্যের সাহিত্যসংস্কৃতি বিকশিত হতে পারে না। সেই সঙ্গেই অতিরিক্ত অনলাইন নির্ভরতার কারণে বই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য অনুসারী শিল্প এমনকি দেশের অন্যতম ভারি শিল্প কাগজ শিল্পও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কাজ হারাবেন অসংখ্য কর্মী, যাঁরা আমার আপনার প্রিয় বই তৈরির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন।

বইপাড়াকে কেন্দ্র করে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, এগিয়ে আসতে হবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে। রাজ্যের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে সারা রাজ্য জুড়ে অসংখ্য ছোট বড় গ্রন্থাগারগুলিও প্রায় বন্ধ। তার ফলে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনের বই কেনাও সম্ভব নয়। এই বইপাড়া যেমন ছাত্র-ছাত্রী,পাঠক-পাঠিকাদের উপর নির্ভরশীল, তেমনই রাজ্যের বেশ কিছু সরকারি প্রকল্পের উপরেও বইপাড়ার প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতারা নির্ভর করে থাকেন। অথচ বইপাড়াকে কেন্দ্র করে সরকারি প্রকল্পগুলি গত ২ বছর ধরে বিভিন্ন কারণে একপ্রকার বন্ধ। এব্যাপারে সরকারের সঙ্গে বারংবার যোগাযোগ করেও কোনও সুরাহা মেলেনি বলে প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতারা জানিয়েছেন। অথচ পাশের রাজ্য ত্রিপুরা বা পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ— যেখানে করোনার মত একইরকম সমস্যা বর্তমান, সেখানকার সরকার বিভিন্ন প্রকল্প যেমন খুলছেন তেমনই নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন। এমত অবস্থায় রাজ্যের ভেঙে পড়া গ্রন্থাগার-ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করার অংশ হিসেবে রাজ্য সরকার যদি গ্রন্থাগারগুলিকে নতুনভাবে সাজানোর পরিকল্পনা নেন বা বন্ধ হয়ে থাকা গ্রন্থাগারিক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে অবিলম্বে চালু করার ব্যবস্থা করে গ্রন্থাগারিক নিয়োগের মাধ্যমে গ্রন্থাগার-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন তাহলে পুনরায় পাঠকপাঠিকারা গ্রন্থাগারমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত হবেন। মূলত পাঠক-পাঠিকা বৃদ্ধি পেলে, গ্রন্থাগারগুলির বই ক্রয়ের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করলে ও রাজ্যের বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রত্যেকটি প্রকল্প খুললে বইপাড়া পুনরায় পুরনো ছন্দ ফিরে পাবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...