দীপসিতা ধর
লেখক ছাত্র-আন্দোলনের কর্মী ও নেতা, গবেষক
দেশ কে গদ্দারো কো
গোলি মারো শালো কো!!
–এখন প্রশ্ন হল দেশের গদ্দার কে??
নরেন্দ্র মোদির ভারতবর্ষে আপনাকে স্বাগত।
নরেন্দ্র মোদির ভারতবর্ষ মানে বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি হয়নি। ১৫ লাখ টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে আসেনি। পেট্রোলের ডিজেলের দাম বেড়েছে। দেশের বেকারত্ব বেড়েছে ৪৪ শতাংশ প্রায়। প্যান্ডেমিকের সময় সরকার আপনাকে থালা বাজাতে বলেছেন। পরিযায়ী শ্রমিকরা পথ পথ হাঁটতে হাঁটতে পথেই জীবন হারিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদির ভারতবর্ষ মানে দেশের জিডিপি মাইনাস ২৩.৮ শতাংশ।
নরেন্দ্র মোদির ভারতবর্ষে আপনি এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। আপনি প্রশ্ন করলে আপনার বিরুদ্ধে মামলা হবে। আপনাকে জেলে ভরা হবে। আপনি বলতে পারবেন না যে, মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা না রেখে গদ্দারি করেছে। তাহলে আপনাকে প্রাইম-টাইমে দেশদ্রোহী বানানোর স্ক্রিপ্ট তৈরি হবে। আপনার দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট লিখবে চোদ্দ পুরুষ ব্রিটিশের গোলামি করা-দের উত্তরসূরিরা।
নরেন্দ্র মোদির ভারতবর্ষে আপনাকে স্বাগত।
ভারতবাসীর মনে প্রথম সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনেছিল ব্রিটিশরা। হান্টারের “Divide and Rule” দিয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়েছিল হিন্দু-মুসলিমের বিভেদের রাজনীতির। কারণ ব্রিটিশরা জানত যে, দেশের জনগণকে ডিভাইড না করলে রুল করা যাবে না। ব্রিটিশের গোলামি করা সাভারকরের চ্যালারা এই থিওরি জন্ম থেকেই অনুসরণ করে আসছে। রামমন্দিরের নামে জিগির তুলে হিন্দুদের একত্রিত করো। মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াও। মানুষ রুটি-রুজির লড়াই ভুলে গিয়ে ধর্মের লড়াই নিয়ে মেতে থাকুক। প্রতিদিন একটা করে নতুন এপিসোড চালিয়েছে আরএসএস-বিজেপির সরকার। একটা রামমন্দির তো একটা ৩৭০। একটা পাকিস্তান তো একটা চিন। একটা এনআরসি-সিএএ তো একটা গরুর মাংস। ভাগ করো মানুষকে। ধর্মের নামে। জাতের নামে। এটাই নরেন্দ্র মোদিদের স্বপ্নের ভারতবর্ষ।
এনআরসি-সিএএর নামে বিভাজনের রাজনীতি নামানো হল দেশজুড়ে। বাপ-ঠাকুরদার বসতভিটেতে যারা ছোট থেকে বড় হল তাদের কাছে দেশের নাগরিক হওয়ার কাগজ চাইল মোদি-অমিত শাহরা। গোটা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। দিল্লিতে শাহিনবাগ হল। দেশের প্রতিটা মহল্লা, প্রতিটা প্রান্তরে মানুষ নেমে এল রাস্তায়। এই কালাকানুন বাতিলের দাবীতে একজোট হল। তারপর পরিকল্পিতভাবে শুরু হল দিল্লির বুকে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা। প্লট তৈরি হল। কপিল মিশ্র থেকে অনুরাগ ঠাকুররা আগুনে ঘি ছড়াল। কেঁপে উঠল রাজধানী। দাঙ্গার আগুনে জ্বলতে লাগল দিল্লি।
তারপর আবার শুরু হল মানুষ বাঁধার কাজ। দিল্লির আক্রান্ত মানুষের কাছে ছুটে গেলেন বামপন্থী সহ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষজন। ছুটে গেলেন সীতারাম ইয়েচুরিরা। ভরসা দিলেন মানুষকে। ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস দিলেন। একসঙ্গে বাঁচার রসদ দিলেন। এবং স্বাভাবিকভাবেই আরএসএস-বিজেপির কাছে ভিলেনের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হলেন তাঁরা। এবং সিডিশন। মামলা। ষড়যন্ত্র। সীতারাম ইয়েচুরি সহ জয়তী ঘোষ, যোগেন্দ্র যাদবদের নামে এফআইআর করার হিড়িক পড়ে গেল। মিথ্যে মামলা সাজানো হল যে, এনারা দিল্লি দাঙ্গার মূল চক্রী। ২৪ ঘন্টা যেতে না যেতেই শাসকের ল্যাজেগোবরে অবস্থা। কোনও পয়েন্ট দাঁড় করাতে পারল না। মানুষের প্রতিবাদও পুঞ্জিভূত হচ্ছিল গোটা দেশজুড়ে। তারপর ওদের লিস্ট থেকে আপাতত বাদ গেল সীতারাম ইয়েচুরি সহ বাকিদের নাম। গ্রেপ্তার করা হল উমর খলিদ-কে। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করাই ফ্যাসিবাদের প্রবণতা। তাই ওদের বারবার গ্রেপ্তার করতে হয় উমর-দের। আটকে রাখতে হয় ভারভারা রাওদের। ষড়যন্ত্র করতে হয় সীতারাম ইয়েচুরিদের বিরুদ্ধে।
আমরা পশ্চিমবঙ্গেও দেখেছি যে আরএসএসের দুর্গার হাত ধরে ধর্মের তাস খেলছে মোদি-শাহরা। মানুষের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়ার একই ব্লু-প্রিন্ট। এবং হকের দাবী নিয়ে লড়াই করতে গেলে এরাজ্যেও মিথ্যে মামলায় বামপন্থীদের গ্রেপ্তার করছে মমতা ব্যানার্জীর পুলিশ।
আপনি রুটি-রুজির কথা বললে আপনি দেশদ্রোহী। আপনি জীবন-জীবিকার কথা বললে আপনি দেশদ্রোহী। আপনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বললে আপনি দেশদ্রোহী। আপনি অধিকারের দাবীতে রাস্তায় প্রতিরোধের মহড়া সাজালে আপনি দেশদ্রোহী। আর দেশপ্রেমের সমস্ত পেটেন্ট ব্রিটিশদের দালাল গোলওয়ালকার-সাভারকরের চ্যালা মোদি-অমিত শাহদের হাতে। ওরা মনে করে এটাই হয়তো নিউ নর্মাল। ওরা মনে করে প্রাইম টাইম কিনে ক্রাইম টাইম থেকে মানুষকে সরিয়ে দেবে অন্য গল্পে, অন্য এপিসোডে।
আর আমরাও বলছি এসব আর হবে না। এভাবে আর হবে না। এবার, আমাদের ভারতবর্ষে আপনাকে স্বাগত। আমাদের ভারতবর্ষ মানে গরীব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। অসাম্যের ব্যবধান ঘোচানো। সবার শিক্ষা, সবার কাজ। কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা৷ জাতের লড়াই ভুলিয়ে দিয়ে ভাতের লড়াইতে মানুষকে একজোট করা। আর এই একজোট করার লড়াইতে, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইতে কমিউনিস্টরা, বামপন্থীরা বরাবর ছিল বলেই শাসকের প্রাইম টার্গেট আমরা। ব্রিটিশ শাসনে আমরা দেখেছি একের পর এক মামলা। নিষিদ্ধ করা হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিকে। ১৯২২ পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯২৪ কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯২৯ মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা। কারণ ব্রিটিশরা জানত যে তাদের কাছে সবচেয়ে বড় বিপদ কমিউনিস্টরাই। ব্রিটিশদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল চট্টগ্রাম। ব্রিটিশদের চোখে চোখ রেখে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলেছিল ভগৎ সিং-রা।
আর আজকের ভারতবর্ষে ব্রিটিশের দালালদের উত্তরসূরিরা যে একই ঘটনা ঘটাবে তাতে কোনও সন্দেহ থাকার কথাও নয়। ওরা জেলে পুরবে। একটার পর একটা মিথ্যে মামলা করবে। খুন করবে। আর সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে ভাগ করার রাজনীতির প্রয়োগ করবে গভীরভাবে। লুটে-খাওয়াদের আধিপত্যবাদ কায়েম করবে দেশজুড়ে। আর তাতে অসাম্য বাড়বে। খিদে বাড়বে। যন্ত্রণা বাড়বে মানুষের।
উল্টোদিকে আমরা থাকব। সে দিল্লি হোক বা মুজফফরনগর। ধূলাগড় হোক বা হালিশহর। প্রতিটা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে মানবতার গান আমরা ফোটাবই। প্রতিটা মহল্লাতে ভালোবাসার ইস্তেহার পৌঁছে দেব। প্রতিটা উনুনে ভাতের গন্ধের জন্য লড়াইয়ের এপিটাফ এঁকে দেব। প্রতিটা প্রাঙ্গণে অর্চনা আর আয়েশারা যাতে একসঙ্গে খেলতে পারে তার জন্য সমস্ত ধর্মকারার প্রাচীর ভেঙে দেব। প্রতিটা শিশুর হাতে বই পৌঁছে দেব দিনবদলের হাতিয়ার হিসেবে।
আমরা জানি যে আমাদের আক্রান্ত হতে হবে। আমাদের রক্তাক্ত হতে হবে। আমাদের জেলে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের লড়াই থামবে না৷ ফ্যাসিস্টদের চোখে চোখ রেখে লড়াই হবে। মাঠটাকে বড় করে লড়াই হবে। আমাদের ভারতবর্ষে লড়াইতে কখনও লকডাউন নেই। ওদের লক-আপ আছে আর আমাদের আকাশ।
ওরা সিডিশন লিখুক…
আমরা আকাশে ইনকিলাব লিখব!