প্রসঙ্গ উমর খলিদ ও রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত

শৌভিক দে

 


লেখক গণ-আন্দোলনের কর্মী, কবি, চিত্রনাট্যকার

 

 

 

 

ভারতবর্ষ না ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র? দেশ নাকি রাষ্ট্র?

দেশ এবং দেশপ্রেম নিয়ে কথা বলতে বলতে আমি আপনি অজান্তেই ঢুকে পড়ব পদবিতে। হ্যাঁ, একদম ঠিক পড়ছেন। পদবি।

এই পদবিতেই যাবতীয় গোলমাল। কারণ এই পদবি দেখেই যাবতীয় বাছবিচার শুরু করে রাষ্ট্র, মিডিয়া, তথা সমাজ। এবং এদের শিকার হয়, এই ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রের শিকার হয় দলিত এবং মুসলমান।

তাই এপিজে আবদুল কালাম কিম্বা রামনাথ কোভিন্দকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে পাল্টা ন্যারেটিভ নামানোর চেষ্টা করে আরএসএস, বিজেপি।

যাই হোক। মূল আলোচনায় আসা যাক।

আমাদের আজকের নায়ক অথবা ভিলেনের নাম উমর খলিদ। দিল্লির জেএনইউ-এর ছাত্র উমর খলিদ।

এই উমর খলিদের কথা আমরা প্রথম জানতে পারি বেশ কয়েক বছর আগে। অবশ্যই মিডিয়া এবং ভক্তদের কল্যাণেই। কানহাইয়া কুমার এবং উমর খলিদের নাম তখনই প্রথম আমাদের দৃষ্টিগোচরে আসে।

টুকরা গ্যাং। যারা স্লোগান তুলেছে, ‘ভারত তেরা টুকরা হোগা!’

ছি ছি। এরা তো দেশদ্রোহী। এরা দেশকে টুকরো টুকরো করে দিতে চায়!

কিন্তু আরএসএস, বিজেপির মিথ্যে প্রমাণ হল না। আজাদির যে স্লোগান তুলেছিল উমর-কানহাইয়ারা, তা কানের পর্দায় আঘাত করল ‘ভুখ সে মাঙ্গো আজাদি’ বলে।

মানুষ চমকে উঠল। এ মুক্তির দাবি তো খিদের থেকে মুক্তির কথা বলে। ব্রাহ্মণ্যবাদ, মনুবাদ থেকেও মুক্তির কথা বলে যদিও। কিন্তু সেগুলো খায় না মাথায় দেয় বুঝি না।

দিন যায় দিন আসে। ভারতবর্ষ ক্রমশ দীন হতে থাকে। বিমানবন্দর, খনি বিক্রি হতে থাকে। মোদিবাবু গ্ল্যামারাস গল্প দিতে থাকেন।

আর হিন্দু মুসলমান তাস খেলতে থাকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ।

সেই আরএসএস। ব্রেনওয়াশিং। হীরক রাজার দেশের সেই মস্তিষ্ক প্রক্ষালক যন্ত্র। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মাথায় এদের ন্যারেটিভ গেঁথে দিতে এরা সিদ্ধহস্ত। কমিউনিস্ট পার্টির কথা মাথায় রেখেই বলছি, এই দিক থেকে আরএসএস-এর মতো সংগঠন গোটা ভারতবর্ষে আর একটিও নেই।

সেই আরএসএস-বিজেপির সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় ঠিক করা হল উমর খলিদকে কেস দিতে হবে। পদবি মুসলমানের। সুতরাং কেস দেওয়া সহজ।

কেস দাও। কেস দিল। তো, কী সেই কেস?

বলা হল উমর দিল্লি দাঙ্গার নেপথ্যে রয়েছে। এবং নেপথ্যে শুধু না, উমরই প্ল্যান করেছে দিল্লি দাঙ্গার।

কবে কীভাবে প্ল্যান করেছে উমর? কাদের সঙ্গে প্ল্যান করেছে?

আট জানুয়ারি উমর তাহির হুসেইন এবং খালিদ সইফির সঙ্গে নাকি প্ল্যান করলেন যে ট্রাম্প ভারতে আসলে বিশৃঙ্খলা ঘটাতে হবে‌। দাঙ্গা করতে হবে যাতে বাকি পৃথিবীর কাছে বার্তা দেওয়া যায়।

৮ জানুয়ারি
৮ জানুয়ারি
৮ জানুয়ারি

তারিখটা তিনবার মেনশন করলাম।

ট্রাম্প ভারতে এসেছিলেন ২৪ ফেব্রুয়ারি।

ভারতবর্ষে ট্রাম্পের আসার কথা ঘোষণা হয় ১৩ই জানুয়ারি।

অর্থাৎ ভারতের ইন্টেলিজেন্স জানাচ্ছে তেরো তারিখে, সেখানে আট তারিখে উমর প্ল্যান করে ফেলেছে!!!

আসলে রাষ্ট্রের এগুলো খুব পুরনো কৌশল। এর আগেও আমরা দেখেছি প্রতিবাদীদের জঙ্গি বলে দেগে দেওয়ার এই পুরনো খেলা। আমরা দেখেছি ৮১ বছর বয়সী কবি ভারভারা রাওকে দিনের পর দিন কীভাবে জেলের ভেতরে আটকে রাখা হয়েছে। আমরা দেখেছি সিএএ-র প্রতিবাদী অন্তঃসত্তা সফুরা জারগারকে জেলবন্দি করার ঘটনায় ভক্তকুলের নোংরা উল্লাস। আমরা দেখেছি ডাঃ কাফিল খানের মতো মানুষকে কীভাবে মিথ্যা মামলায় মাসের পর মাস আটকে রাখা হয়।

ছাড়া পাবার পরে কাফিল খান ধন্যবাদ জানান উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার ও প্রশাসনকে, বিকাশ দুবের মতো ফলস এনকাউন্টারে তাঁকে মেরে না ফেলার জন্য। নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাই পরে কংগ্রেসে যোগ দেন কাফিল খান।

দিল্লি দাঙ্গার জন্য সম্প্রতি যাঁদের অভিযুক্তের তালিকায় রাখা হয়েছে তাঁদের মধ্যে আছেন সীতারাম ইয়েচুরিও। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। যিনি নিজে রাস্তায় নেমে দিল্লি দাঙ্গার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ফেব্রুয়ারি মাসে।

অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন স্বরাজ অভিযানের নেতা যোগেন্দ্র যাদব, শিক্ষাবিদ জয়তী ঘোষ এবং অপূর্বানন্দদের নাম। কিছুদিন আগেই নাট্যকর্মী এবং গণ আন্দোলন কর্মী জয়রাজ ভট্টাচার্যকে বাড়ি থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। অভিযোগ বেশ কয়েক বছর আগের ‘কামদুনি কেস’! প্রায় চব্বিশ ঘন্টা থানায় বসিয়ে রাখার পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদিকে ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মী পার্থসারথি রায়কে নোটিশ পাঠিয়েছে এনআইএ। এবং এভাবেই প্রতিবাদীদের প্রতি রক্তচক্ষু প্রদর্শন এবং ভয় দেখানোটা চলছেই।

অথচ এঁরা প্রত্যেকেই দাঙ্গাবিরোধী এবং শান্তিপ্রক্রিয়ায় উদ্যোগী মানুষ। তার মানে কী দাঁড়াল? শাসক ভয় পেয়েছে! শিরদাঁড়া টান টান করা মানুষগুলোর কণ্ঠস্বর চেপে রাখার চেষ্টা তো একসময় ইন্দিরা গান্ধিও করেছিলেন। কিন্তু জরুরি অবস্থা জারি করার মূল্য তাঁকে চোকাতে হয়েছিল। বর্তমান শাসককেও চড়া মূল্য দিতেই হবে।

ইতিহাসে যাঁরা সড়গড় নন, একটু হিটলার মুসোলিনির পরিণতিও গুগল করে নিতে পারেন।

একদিকে ইয়েচুরি, উমরদের ভয় দেখানো চলছে, অন্যদিকে দিল্লি দাঙ্গার আসল মাস্টারমাইন্ড দেশের বর্তমান শাসক দলের গুন্ডা কপিল মিশ্ররা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু না, দিল্লি পুলিশকে ধন্যবাদ দিচ্ছে উমরের গ্রেপ্তারির জন্য।

একজন অভিযুক্ত যে অপরাধেই অভিযুক্ত হোক না কেন, তাঁকে জেরার জন্য এগারো লক্ষ পাতার নোট!!

এ তো ঘোড়ায় হাসবে!

কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। একদিকে আম্বানি আদানিদের বাড়ির চৌকিদার আর অমিত শাহ, কপিল মিশ্রর মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি। অন্যদিকে কানহাইয়া, জিগনেশ, উমর, সফুরা, আমি, আপনি আমরা সবাই। এ লড়াই লড়ব আমরা।

ভারতবর্ষের বুকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...