দেবাশিস্ ভট্টাচার্য
লেখক প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী
বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যাঁরা জীবনী লিখেছেন বা গবেষণা করেছেন তাঁরা প্রায় সকলেই একটা বিষয়ে একমত, ধর্ম ঈশ্বর এইসব নিয়ে কথা বলতে বিদ্যাসাগর একদমই ভালবাসতেন না, আর নিজের ধর্মবিশ্বাস ব্যাখ্যা বা প্রচার করার তো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ, এও সুবিদিত যে তিনি খুব একটা অন্তর্মুখী বা মুখচোরা বা লাজুক গোছের মানুষ ছিলেন না। মজলিশি আড্ডা, প্রবল হাসিঠাট্টা, সুতীব্র ক্রোধ প্রকাশ, এমনকি প্রকাশ্য রোদন— কোনও কিছুতেই তাঁর কিছুমাত্র কমতি ছিল না— প্রকাণ্ড ও প্রচণ্ড কর্মমুখরতার বহুচর্চিত প্রসঙ্গটি বাদ দিলেও। অর্থাৎ, ধর্ম-কথনে তাঁর এই অনীহার পেছনে আর যা-ই হোক, ভাব প্রকাশের অপ্রতুলতা কোনও কারণ হতে পারে না নিশ্চয়ই। বস্তুত, এ নিয়ে মত প্রকাশ আদৌ না করলেও, বিরল কিছু ক্ষেত্রে তাঁকে এ নিয়ে ভাব প্রকাশ করতে দেখা গেছে, এবং সেগুলো বেশিরভাগই ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে হাসিঠাট্টা, বা নিদেনপক্ষে ক্ষোভ ও হতাশা। কাজেই, ধর্ম ও ঈশ্বর নিয়ে চর্চায় তাঁর এই অনীহাটি আসলে ওই দুই বিষয়ে তাঁর আন্তরিক অনীহা এবং ঔদাসীন্যেরই প্রকাশ কিনা, এ প্রশ্ন প্রায় অনিবার্য। প্রশ্নটি চমৎকার খাপ খায় তাঁর সারা জীবনের কর্মকৃতির সুপরিচিত নকশার সঙ্গেও।
রক্ষণশীল হিন্দু-সমাজের প্রবল বিরোধিতা ও কুৎসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বৈধব্য-বহুবিবাহ-বাল্যবিবাহের মত ধর্মীয় কুপ্রথাগুলোর বিরুদ্ধে প্রবলভাবেই লড়ে যাওয়া, প্রাচীন ধর্মঘেঁষা শিক্ষা বাতিল করে ইংরেজি ভাষা এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন শিক্ষার পক্ষে জোরালো সওয়াল, হিন্দু দর্শনের প্রধান ধারাগুলোকে বাগাড়ম্বর ও ভুয়ো জ্ঞান বলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে দেওয়া, প্রাচীন ধ্যানধারণা ও অসার ধর্মতাত্ত্বিক কচকচির বাহক সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্যের অবসান ঘটিয়ে বাংলা ভাষাকে আধুনিক সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার উপযোগী এক স্বাবলম্বী ভাষা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ, প্রচুর অর্থ উপার্জন করেও তা মন্দির-নির্মাণ সাধন-ভজন বা ধর্মতত্ত্বচর্চার পেছনে ব্যয় না করে সরাসরি লোকসেবায় কাজে লাগানো, নিজের সম্পত্তির ‘উইল’-এ ধর্মকর্মের জন্য এক পয়সাও বরাদ্দ না করা। বলা বাহুল্য, নকশাটি ভীষণভাবে সেক্যুলার। এ ধরনের প্রতিটি কাজের মধ্যেই মানুষের ঐহিক উন্নতি ঘটানোর আকাঙ্খা যতটা দৃশ্যমান, পরলোকবিষয়ক দুশ্চিন্তার ছাপ ঠিক ততখানিই অনুপস্থিত। এবং তবুও, এ নিয়ে কিছু তাৎক্ষণিক মন্তব্য এবং সংক্ষিপ্ত ও অগভীর চর্চা ছাড়া আর প্রায় কিছুই পাওয়া যায় না, এত বড় মাপের মানুষটির ধর্মবিশ্বাস পূর্ণাঙ্গ ও পরিশ্রমসাধ্যভাবে পুনর্নির্মাণ করার কাজটিকে প্রায় কোনও গবেষকই প্রচেষ্টাযোগ্য বলে মনে করেননি। বিদ্যাসাগরকে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী বলে প্রতিপন্ন করে লেখালিখি যে খুব কম হয়েছে, এমনটা মোটেই বলতে চাইছি না, সেটা হয়ত দরকারের চেয়ে কিছু বেশিই হয়েছে। কিন্তু যেটা বলতে চাইছি সেটা হচ্ছে এই যে, তাঁর জীবন, উক্তি, আচরণ ও কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে প্রাপ্তব্য বিপুল পরিমাণ তথ্যভাণ্ডার থেকে ধর্ম বিষয়ে তাঁর অবস্থানটির কোনও পূর্ণাঙ্গ ও বিশ্বাসযোগ্য অবয়ব কখনও যুক্তি ও বিশ্লেষণের ছেনি-হাতুড়ি সহযোগে কুঁদে বার করে আনা হয়নি।
না, এহেন বৃহৎ প্রচেষ্টা অবশ্য আমার এই লেখাটিরও উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এখানে বিষয়টির অন্তর্নিহিত গুরুত্ব, গভীরতা ও জটিলতাকে তুলে ধরতে চাইব, এ ব্যাপারে এতদিনে যে যৎসামান্য চর্চা ও মতামত উঠে এসেছে তার একটি অতি-সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দিতে চাইব, এবং এ ধরনের চর্চার মধ্যে দুয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নমুনাকে কিঞ্চিৎ বিস্তার সহযোগে আলোচনা করে আমাদের বৌদ্ধিক অপারঙ্গমতা ও দুর্দশাকে উন্মোচিত করতে চাইব। তবে তার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিদ্যাসাগরের জীবন-সম্পর্কিত কয়েকটি সুবিদিত ও প্রতিনিধিস্থানীয় ঘটনা এবং উক্তি স্মরণ করা দরকার। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যে সব প্রামাণ্য জীবনী ও স্মৃতিকথা পাওয়া যায়, সেখানে ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রসঙ্গ যে বিরল, এবং যেখানে সেই বিরল ঘটনা ঘটেছে সেখানেও তাঁর মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুরাগ বা ভক্তি মোটেই প্রকাশ পায়নি, বরং প্রকাশ পেয়েছে প্রশ্ন-সংশয়-বিভ্রান্তি-ঔদাসীন্য-বিদ্রূপ-তাচ্ছিল্য-ক্ষোভ— এ কথা ওপরে বলেছি। এও বলেছি যে, সেগুলো সুবিদিত, অর্থাৎ বিদ্যাসাগরকে নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের কাছে এ সব কথা খুবই পরিচিত। তবু তা সত্ত্বেও তার সামান্য কিছু উল্লেখ এখানে হয়ত বা জরুরি, যাঁরা বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তত বেশি চর্চা করেননি তাঁদের জন্য শুধু নয়, সব পাঠকের জন্যই। কারণ, তা না হলে বোধহয় বর্তমান রচনাটির যথাযথ প্রেক্ষিত রচিত হবে না। শুরু হোক তবে, একটি দুটি করে।
বিদ্যাসাগরের ধর্ম-অনীহার ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাঁর বাল্যকাল থেকেই। মেদিনীপুরের এক অজ গ্রামের রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হয়েও, এবং শিশুবয়েসে যথাবিহিত ‘পইতে’ হবার পরেও, তিনি ‘সন্ধ্যা-আহ্নিক’ করতেন না, এমন কি সন্ধ্যা-আহ্নিকের মন্ত্রও ভুলে গিয়েছিলেন। মাথায় রাখা দরকার, মন্ত্র ভুলে যাবার কথা যখন বলছি, তখন আমরা কিন্তু সেই শিশুটির কথা বলছি, যার নাকি রাস্তার পাশের মাইলস্টোনের ওপরে আঁকা দূরত্বসূচক চিহ্নের ওপর ধারাবাহিকভাবে নজর রাখতে রাখতে ইংরেজি সংখ্যা একা একা শিখে ফেলার মত সুতীব্র মেধা ও স্মৃতিশক্তি ছিল! অভিভাবকদের কাছে ধরা পড়ে প্রবল ভর্ৎসনা সয়েছেন, কিন্তু তাঁর আচরণের পরিবর্তন হয়নি। অভিভাবকরা অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে ‘মন্ত্রদীক্ষা’ দিতে পারেননি। এই প্রবণতার ধারাবাহিকতা দেখতে পাওয়া যায় তাঁর সারা জীবন জুড়েই, এবং হিন্দু বা ব্রাহ্ম বা খ্রিস্টান কেউই তাঁর হাত থেকে অব্যাহতি পায়নি। রামকৃষ্ণের একান্ত শিষ্য ও ভাষ্যকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, যিনি ‘শ্রীম’ মানে খ্যাত, তাঁকে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, চেঙ্গিস খাঁ যখন লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করলেন, তখন তো ঈশ্বর নিবারণ করলেন না, স্রেফ বসে বসে দেখলেন, কাজেই তেমন ঈশ্বর থাকলেই বা মানুষের কীসের উপকার? সর্বশক্তিমান এবং মঙ্গলময় ঈশ্বর যদি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা বা ভয়ঙ্কর অত্যাচার বা নিপীড়ন এইসব থামাতে না-ই পারেন, তো তিনি যে আদৌ আছেন এইটাই বা কীভাবে বুঝব, আর কোনওমতে থেকে থাকলেও তাতেই বা লাভটা কী হচ্ছে— এ প্রশ্ন তিনি বিভিন্ন জায়গায় বারবারই তুলেছেন। একবার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক শশিভূষণ বসু এক বয়স্ক ব্যক্তিকে নিয়ে বিদ্যাসাগরের বাড়ি আসবার পথে রাস্তা গুলিয়ে ফেলে বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর অনেক দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছন। পৌঁছবার পরে বিদ্যাসাগর তাকে ঠাট্টা করে বলেন, তুমি যখন তোমার পাড়ার মধ্যে চলাফেরা করতে গিয়েই রাস্তা ভুলে এক বেচারা বৃদ্ধকে এত ঘোরাচ্ছ, তখন পরলোকের অজানা পথে যে সব লোকেদের চালান করছ তাদেরকে তো আরওই দুর্দশায় ফেলবে, কাজেই এ ব্যবসা ছাড়ো বাপু! শিবনাথ শাস্ত্রীর স্মৃতিকথায় জনৈক খ্রিস্টান পাদরির সঙ্গে তাঁর মোলাকাতের কৌতুকাবহ বিবরণ পাওয়া যায়। শিবনাথ তখন তরুণ, বন্ধুবান্ধবদের দল নিয়ে এসেছেন বিদ্যাসাগরের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, এবং তিনি এই তরুণ সাথীদের সঙ্গে বাড়ির দাওয়ায় বসে মুড়ি খেতে খেতে প্রবল হাসিঠাট্টা গল্পগুজবে মেতেছেন। এমন সময়ে হাজির হলেন এক খ্রিস্টান পাদরি, যিনি শিবনাথকে ব্রাহ্মধর্মের অনুগামী বলে চেনেন। এসেই শিবনাথকে নিয়ে পড়লেন, এবং মোক্ষলাভ করতে গেলে ব্রাহ্মধর্মে হবে না, খ্রিস্টের শরণ নিতে হবে, এই কথা বোঝাতে লাগলেন। বিদ্যাসাগর তাঁকে ডেকে বললেন, ওরা অল্পবয়সী, ওদের পরকালের কথা ভাবার সময় নেই, আপনি বরং আমাকে বলুন, আমার পরকালের ডাক এসে গিয়েছে। পাদরি মহাশয় বিদ্যাসাগরী রসিকতা বোঝেননি, সঙ্গে সঙ্গে খুব উৎসাহের সঙ্গে বিদ্যাসাগরকে তাঁর ধর্মের মাহাত্ম্য বোঝাতে গেলেন, এবং লোকটির নির্বুদ্ধিতা বুঝতে পেরে বিদ্যাসাগর তার সঙ্গে প্রবল হাসিঠাট্টায় মেতে উঠলেন। একটু পরে পাদরি মহাশয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আপনি এই বৃদ্ধ বয়েসেও এমন নাস্তিক, আপনার মৃত্যুর পরে নরকেও স্থান হবে না— এবং সবেগে প্রস্থান করলেন। যদিও বিদ্যাসাগর সমসাময়িক অন্যান্য ইংরাজি-শিক্ষিতদের মত সাহেবি বেশ ধারণ করেননি, গ্রাম্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের চিরাচরিত বেশেই নিজেকে রেখেছেন চিরকাল— ছোটবেলায় পাওয়া উপবীতটি সমেত, কিন্তু কোনও পুজো-আর্চা-আহ্নিক বা অন্য কোনও ধর্মীয় আচারে লিপ্ত হতে তাঁকে কেউ কোনওদিন দেখেনি। পুজোতে যে খরচা হয় তাই দিয়ে গ্রামের গরিবদের খাওয়ালে বরঞ্চ ভাল হয়, এই যুক্তিতে তিনি তাঁর বাড়ির দীর্ঘদিনের জগদ্ধাত্রী পুজো বন্ধ করে দেন, এবং তাঁর জননী তাতে সানন্দে সম্মতি দেন।
ধর্মবিশ্বাস নিয়ে তাঁর মনোভাবটি যদি হয় ঔদাসীন্য-সংশয়-তাচ্ছিল্যের, তবে ধর্মপ্রচার নিয়ে তাঁর অবস্থানটি আরও সুনিশ্চিত— নিখাদ অপছন্দের। ‘দল বাঁধা কাণ্ড’ আখ্যা দিয়ে তিনি একে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রাহ্মধর্মের নেতা কেশব সেনকে নিয়ে তিনি যে পারলৌকিক গল্পটি রচনা করে রামকৃষ্ণ-শিষ্য ‘শ্রীম’ ও অন্যান্যদের শোনান, তা টইটম্বুর হয়ে আছে স্বকীয় কৌতুক ও তাৎপর্যে। ধর্মোপদেশদানকে তিনি ঠিক কী চোখে দেখেন, সেটা বুঝিয়ে বলার জন্যই এ গল্পের অবতারণা। গল্পটি এইরকম। কেশব সেনের মৃত্যুর পরে যমদূতেরা তাঁকে নিয়ে গেছে ইশ্বরের কাছে, তিনি সেন মহাশয়ের অপরাধ বিচার করে পঁচিশ ঘা বেত মারার আদেশ দিলেন। এবার তারপর যখন কেশব সেনের শিষ্যরা এসে বলতে লাগল যে তারা যা করেছে তা কেশব সেনের ঈশ্বর-ব্যাখ্যায় প্রভাবিত হয়ে করেছে, তখন ঈশ্বর কেশব সেনকে আবারও বেত মারার আদেশ দিলেন, কারণ ঈশ্বর বিষয়ে তিনি নিজে শুধু ভুল বোঝেননি, অন্যদেরও বুঝিয়েছেন। এই বলে বিদ্যাসাগর বোঝাতে চাইতেন যে, তিনি যদি ধর্মোপদেশ দিতেন বা ধর্মপ্রচার করতেন, তাহলে তাঁরও দশা হত ওই কেশব সেনের মতই, অর্থাৎ পরকে ভুল বোঝানর জন্য বেত খেতে হত, এবং সেই ভয়েই তিনি কাউকে ধর্মোপদেশ দেওয়াটা উচিত বলে মনে করেন না। তাঁর এই একই মনোভাবের প্রতিফলন দেখা যায় রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর মোলাকাতের সুবিখ্যাত ঘটনায়, এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও। এই সাক্ষাৎকারটিতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ অবিশ্বাসী পুরুষ বিদ্যাসাগর বশ হয়েছিলেন রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞার কাছে, এমন একটি হাস্যকর গল্প কেউ কেউ চালানোর চেষ্টা করে থাকেন। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মত ধর্ম-গদগদ লেখক তো বিদ্যাসাগরকে আপাদমস্তক ভক্তই বানিয়ে ছেড়েছেন, এবং এমনকি বিনয় ঘোষের মত তন্নিষ্ঠ সেক্যুলার গবেষকও খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে লিখেছেন, “উভয়ের মানবকল্যাণের আদর্শ মূলত এক হলেও, দুজনের পথ ছিল ভিন্ন। অনর্থক তর্ক করে তাই তাঁরা পথের মীমাংসা করেননি, এবং কেউ কাউকে নিজের পথে আনতেও চাননি।” (২, পৃষ্ঠা ৩৫৬) বলা বাহুল্য, কথাগুলো সম্ভাব্য সমস্তরকম অর্থেই ভুল। ধর্মের মিঠে বুলিতে বিদ্যাসাগরের বশ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, ‘মানবকল্যাণ’ জিনিসটা বিদ্যাসাগরের আদর্শ হলেও রামকৃষ্ণ সম্পর্কে মোটেই তা বলা যায় না, সেই সাক্ষাৎকারে বিদ্যাসাগর আদৌ তর্ক না করলেও (সমর্থনসূচক ভঙ্গিতে বলা হালকা ঠাট্টা ও ইঙ্গিতগুলো বাদ দিলে) রামকৃষ্ণ ক্রমাগতই নানা তত্ত্বকথা ও উপমা দিয়ে বিদ্যাসাগরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, এবং বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণকে ‘নিজের পথে’ আনবার চেষ্টা অর্থহীন মনে করলেও রামকৃষ্ণের তরফে সে চেষ্টা অতি প্রকটভাবেই ছিল। গবেষক আশীষ লাহিড়ী তাঁর ‘শ্রীরামকৃষ্ণের আকুতি: বিদ্যাসাগরের উপেক্ষা’ শীর্ষক রচনায় (১৩, পৃষ্ঠা ২৫০-২৭৩) ওই সাক্ষাৎকারটির প্রায় প্রতিটি পংক্তি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে যা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন তা হল, “বস্তুত রামকৃষ্ণই বিদ্যাসাগরকে দলে টানতে না পেরে নিতান্ত মুষড়ে পড়েছিলেন। আর বিদ্যাসাগর সশ্রদ্ধভাবে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণকে।” রামকৃষ্ণ-বিদ্যাসাগরের পারস্পরিক শ্রদ্ধার সুমিষ্ট বয়ান যাঁরা সযত্নে নির্মাণ করতে চান, তাঁরা প্রায়শই উল্লেখ করতে ভুলে যান যে, বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়িতে গিয়ে রামকৃষ্ণ ওই সাক্ষাৎকার সেরে আসার পরে বিদ্যাসাগর একবারও তাঁর কাছে গিয়ে পাল্টা সাক্ষাৎ না করায় তীব্রভাবে আশাহত হয়ে রামকৃষ্ণ তাঁর সম্পর্কে বেশ কিছু কটু কথা বলেন, যদিও বিদ্যাসাগর কখনই রামকৃষ্ণ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেননি। সেই সঙ্গে এ কথাটাও বোধহয় এখানে যোগ করা চলে যে, এ বিষয়ে রামকৃষ্ণের উক্তিগুলো ‘শ্রীম’ কর্তৃক ঠিক যেভাবে ‘কথামৃত’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে ঠিক ওভাবেই বলা হয়েছিল কিনা, আজ আর সেটা যাচাই করার কোনও রাস্তা নেই।
ধর্ম প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে এমন উক্তির দৃষ্টান্ত আরও আছে। শশধর তর্কচূড়ামণি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসে ধর্ম নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হলে তিনি হিন্দু ধর্মতত্ত্বের দুর্বোধ্যতা নিয়ে অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রাবস্থায় হিন্দু দর্শন পড়ার সময়ে তাঁর পণ্ডিতমশায় যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি ঈশ্বর বোঝেন কিনা, তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “আপনি যেমন বোঝেন আমিও তেমনই বুঝি, যেমন পড়াচ্ছেন পড়িয়ে যান।” ধর্ম কী বস্তু তা বলা বা বোঝা যায় না, তিনি তাঁর ধর্মমত কখনওই কাউকে বলেন না, কোনও এক বিশেষ পথে চললেই ঈশ্বর খুশি হবেন এহেন পরামর্শ তিনি মোটেই মানতে পারেন না— এমন সব কথা তিনি বিভিন্ন সময়েই বলেছেন বিভিন্ন ব্যক্তিকে। শিবনাথ শাস্ত্রীর পিতা হরানন্দ ভট্টাচার্য পুণ্যের আশায় শেষ জীবনে কাশীবাসী হয়েছিলেন। কলকাতায় এসে তিনি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে এলে বিদ্যাসাগর তাঁকে গাঁজা খাওয়া অভ্যাস করতে বললেন। হরানন্দ অবাক হয়ে এহেন পরামর্শের কারণ জিজ্ঞাসা করলে বিদ্যাসাগর বলেন, কাশীতে মরলে তো শিবত্বপ্রাপ্তি ঘটবেই, আর তখন গাঁজাটা খেতেই হবে, কাজেই আগে থেকে অভ্যাসটা করে না রাখলে সমস্যা হতে পারে! এ সব কথাবার্তার মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের ধোঁয়াটেপনা, অন্ধত্ব ও হাস্যকরতা সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মনোভাবটি আদৌ চাপা থাকেনি। এমন দৃষ্টান্ত অনায়াসেই আরও বাড়ানো চলে, কিন্তু আর বোধহয় তার দরকার নেই, শুধু শেষ জীবনের দুয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করে এ পর্বে ইতি টানা যাক। লোকে বলে, শেষ জীবনে মানুষ নাকি শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যুক্তি-বুদ্ধির প্রতি আস্থা হারিয়ে ধর্মবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে, বিশেষত যদি সে গুরুতর অসুস্থ থাকে। কথাটা বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে মোটেই খাটেনি। তাঁর অন্তিম দিনগুলোতে যখন তিনি অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী, তাঁর কন্যা তাঁর নিষেধ সত্ত্বেও তাঁরই রোগারোগ্য-কামনায় বাড়িতে আয়োজন করলেন এক যজ্ঞের। তাঁরই কারণে যজ্ঞ, অতএব তাঁকে সামনে হাজির থাকতে হবে এটা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক দাবি। কিন্তু তিনি শত অনুরোধেও যজ্ঞের ঘরে হাজির হলেন না, এমন কি নিচেই নামলেন না, দোতলায় তাঁর নিজের ঘরেই রয়ে গেলেন সারাটা সময়। অনেক বলবার পরে দোতলাতেই তাঁর নিজের ঘরের দরজার সামনে কিছু সময়ের জন্য এসে দাঁড়ালেন, এবং কন্যাকে সস্নেহে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “মা, এখানেও ধোঁয়া আসছে, মনে দুঃখ করিস না!” তাঁর অন্তিম শয্যায়, জীবনের শেষ দিনে, পুত্র নারায়ণচন্দ্র যখন জিজ্ঞেস করলেন যে তাঁর শরীরে কোনও কষ্ট হচ্ছে কিনা, তখন বিদ্যাসাগর ধর্ম ঈশ্বর এসব কথা তো টানলেনই না, এমন কি শারীরিক কষ্ট বিষয়েও কোনও অভিযোগ করলেন না। শুধু বললেন, তাঁর একমাত্র কষ্ট, তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটান স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের অবসরকালীন সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা তিনি করে যেতে পারলেন না। অন্তিম শয্যায় এর চেয়ে বেশি ‘অধার্মিক’ তিনি আর কীভাবেই বা হতে পারতেন!
তবে কিনা, এত সব কথাবার্তাও আসলে স্রেফ বিদ্যাসাগর নামক সাগরটির উপরিতল দিয়ে সাঁতরে চলে যাওয়া, সে সাগরের গর্ভে কী আছে সে বিষয়ে ততটা অবহিত না হয়েই। ধর্ম নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন না এমন এক ব্যক্তির তরফে বিরল ও বিচ্ছিন্ন কয়েকটি মাত্র কাটা কাটা উক্তি, এবং তাও আবার তাঁর নিজের কলমে লিখে রাখা নয়, বেশিরভাগই অন্য কেউ স্মৃতি থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন জীবনী বা স্মৃতিচারণ বা ওই জাতীয় রচনায় (সব ক্ষেত্রে অবশ্যই তা নয়, যেমন, তিনি দেশাচারের দাস নন এবং আত্মীয়-স্বজন তাঁকে ত্যাগ করলেও তিনি যা উচিত মনে করছেন সেখান থেকে সরে আসবেন না— এই সুবিখ্যাত বজ্রঘোষণাটি আছে ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নকে লেখা তাঁরই স্বহস্ত-লিখিত একটি পত্রে)। এখন, সে সাগরের গর্ভে যদি ডুব দিই তাহলে মানতে হবে, ধর্মের বিরুদ্ধে আসল যে আঘাতটি তিনি করার চেষ্টা করেছিলেন সেটা কিন্তু কথায় নয়, কাজে। তিনি হিন্দু ধর্মের কুপ্রথাগুলোর বিরুদ্ধে কীভাবে লড়েছিলেন, কীভাবে দেশীয় শিক্ষার মধ্যে আধুনিক ইউরোপীয় ভাষা-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান আবাহন করতে চেয়েছিলেন এবং তার রূপায়ণের স্বার্থে কীভাবে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যসূচি গড়েছিলেন, সে সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁর মূল জীবনীকাররা জানতেন, কিন্তু তার পেছনে তাঁর প্রকৃত মনোভাবটি কেউই জানতেন না। তিনি যে সেই ১৮৫০ সাল থেকেই সরকারের শিক্ষাসচিব জেএফ মৌয়াট মহাশয়কে বার বার চিঠি লিখে হিন্দু ধর্মীয় দর্শনের অসার বাগাড়ম্বরের বিপক্ষে এবং তার কুপ্রভাব তাড়াবার জন্যে আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞান-দর্শন-লজিক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে প্রবলভাবে সওয়াল করে আসছেন, সে নিয়ে তিনি কখনওই প্রকাশ্যে কিছু বলেননি বা লেখেননি। ফলত তাঁর চার মূল জীবনীকার, অর্থাৎ বিহারীলাল সরকার, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং সুবলচন্দ্র মিত্র— যাঁরা মোটামুটিভাবে বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক ছিলেন, তাঁরা কেউই এ সব জানতেন না, এবং তাঁদের লেখা জীবনীগুলোতেও এসব কথা কিছুই নেই। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর সাড়ে তিন দশক পরে গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংস্কৃত কলেজের প্রাচীন দলিল দস্তাবেজের পাহাড় ঘেঁটে এই সব আশ্চর্য বস্তু উদ্ধার করেন, এবং তাতে স্বয়ং আবিষ্কারক অত্যন্ত বিস্মিত ও আহত হন। তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকা ‘মডার্ন রিভিউ’-তে এই নব আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করার সময়ে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য করেন (১৬, পৃষ্ঠা ৪১), ভারতীয় দর্শনের মধ্যে বিদ্যাসাগর কাজের জিনিস কিছুই খুঁজে পেলেন না, এ বড় দুঃখের। বলা বাহুল্য, আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই বিদ্যাসাগর-চর্চার অন্যতম প্রধান উপাদান হয়ে দাঁড়ায় দীর্ঘদিন চাপা পড়ে থাকা এই বিস্ফোরক চিঠিগুলো।
শিক্ষাসচিবকে ঠিক কী লিখেছিলেন বিদ্যাসাগর, এই চিঠিগুলোর মধ্যে? এ লেখা সে নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ চর্চার জায়গা নয় (পুরো চিঠিগুলোর জন্য দেখুন ১ পরিশিষ্ট, এবং সে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন ১৬), কাজেই চিঠিগুলোর মোদ্দা বক্তব্যটুকু তুলে দিয়েই এখানে দায় সারতে হবে।
মৌয়াট সাহেবকে লেখা বিদ্যাসাগরের প্রথম যে চিঠিটি পাওয়া যায় সেটা ১৮৫০ সালের ১৬ ডিসেম্বর লেখা, সঙ্গে এক সবিস্তার রিপোর্ট, তাতে রয়েছে সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন পাঠ্যসূচির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং তার প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের তরফে নানা সংশোধন-সংযোজন-বিয়োজন ইত্যাদির প্রস্তাব। বাংলা-ইংরিজি-সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষা, তাদের সাহিত্য ও ব্যাকরণ, এবং দর্শন গণিত বিজ্ঞান— এইসব পাঠ্য বিষয় মিলিয়ে বিরাট সে প্রস্তাবের পরিসর। তবে আজকের আলোচনার জন্য তার সামান্য একটু অংশমাত্র প্রাসঙ্গিক, কাজেই এখানে আমি শুধু সেটুকুর কথাই বলব। প্রস্তাবটির চতুর্থ অংশে বলা হয়েছে জ্যোতির্বিদ্যা (তখনকার ভাষায় ‘জ্যোতিষ’) ও গণিতের পাঠ্যবস্তু প্রসঙ্গে। তখন এই দুটি বিষয় ছাত্রদের পড়ানো হত ‘লীলাবতী’ ও ‘বীজগণিত’ নামক দুটি সুপরিচিত সংস্কৃত টেক্সটের মাধ্যমে। বিদ্যাসাগর তাঁর প্রস্তাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, ওই বিষয়ের আধুনিক ইংরিজি বইপত্রের তুলনায় এ দুটি বইতে না আছে পোক্ত পদ্ধতি আর না আছে সমৃদ্ধ বিষয়বস্তু, এবং সবই পদ্যে পড়তে হয়— ছাত্রদের কাছে সে এক মহা ঝকমারি, আর তার ওপর আবার অঙ্কের উদাহরণও সেভাবে দেওয়া থাকে না, ফলে ছাত্রেরা চার বছর ধরে ওই দুটি বই পড়ে অতি সামান্য অঙ্ক শেখে। কাজেই বড়সড় পরিবর্তন প্রয়োজন, এবং সে জন্য কয়েকটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, পাটিগণিত-বীজগণিত-জ্যামিতির ভালো ভালো ইংরিজি বই থেকে দরকারি পাঠ্যবস্তু বেছে নিয়ে সঙ্কলন বানাতে হবে ছাত্রদের জন্য। দ্বিতীয়ত, হার্শেলের লেখা জ্যোতির্বিদ্যার যে জনপ্রিয় বইটি আছে, সেটি বাংলায় অনুবাদ করে ছাত্রদেরকে পড়াতে হবে। তৃতীয়ত, শুধু সাহিত্য আর ব্যাকরণের ছাত্রদেরকে নয়, জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত পড়াতে হবে স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্রের ছাত্রদেরও। ওই প্রস্তাবের ষষ্ঠ অংশটি সংস্কৃতে ‘ন্যায়’ বা যুক্তিশাস্ত্রের (লজিক) পাঠ সম্পর্কিত। এই পাঠ্যসূচিতে যে যে সংস্কৃত বই পড়তে হত, তার কয়েকটিকে তিনি ধরে ধরে নাম করে অসার বাগাড়ম্বর বলে চিহ্নিত করেন, এবং ‘শিক্ষার গোলকধাঁধা’, ‘তত্ত্বজ্ঞানের ঘোলাজল’, ‘দুর্বোধ্য’, ‘ধোঁয়াটে’ জাতীয় সব কঠোর আখ্যায় ভূষিত করে পাঠ্যসূচি থেকে বিদায় করবার প্রস্তাব করেন। তিনি এই অংশে আরও প্রস্তাব দেন, এই বিষয়টিকে ‘যুক্তির পাঠ’ না বলে ‘দর্শনশাস্ত্রের পাঠ’ বলে পুনর্নামকরণ করতে হবে, এবং দর্শনের বিভিন্ন ধারার পরিচয়দানকারী বইকে পাঠ্য-তালিকায় ঢোকাতে হবে। কিন্তু, এই যে অন্য ধারার হিন্দু দর্শনের কিছু বইপত্র তালিকায় ঢোকাতে বলছেন, সেগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে তবে তাঁর অবস্থান কী ছিল? না, সে ব্যাপারে তিনি কোনও ধোঁয়াশা রাখেননি, এ প্রস্তাবের পেছনে দুটি সুবোধ্য কারণ দর্শিয়েছেন। তিনি বলছেন, প্রথমত, আধুনিক ধ্যানধারণার সঙ্গে এগুলো খাপ না খেলেও, সংস্কৃতে যিনি পণ্ডিত হতে চান তাঁর তো এগুলো না শিখে উপায় নেই। আর দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক দর্শনই তো বাকি প্রত্যেক দর্শনকে খণ্ডন করার লক্ষ্যে প্রতিমুহূর্তে তার খুঁত ধরছে, কাজেই সেগুলো একসঙ্গে করে পড়লে নিজে নিজেই সব কিছুর ভুল-ঠিক বিচার করবার ক্ষমতা জন্মাবে। আর তার ওপর যদি ইউরোপীয় দর্শনটাও একটু জানা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই!
১৮৫২ সালের ১২ এপ্রিল তিনি সংস্কৃত কলেজের নানা বিষয় নিয়ে একটি নোট লেখেন, পরবর্তীকালে এটি এডুকেশন কাউন্সিলে পেশ হয় হ্যালিডে সাহেবের মারফৎ। এতে তিনি গুছিয়ে ব্যাখ্যা করে বলেন, বাংলাদেশে যাঁরা শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্বে আছেন তাঁদের সর্বপ্রথম কর্তব্য হল জ্ঞানচর্চার উপযোগী উচ্চমানের পাঠ্যবস্তু তৈরি করা, এবং সে কাজটা শুধুই ইংরিজি বা শুধুই সংস্কৃত জানা লোক দিয়ে হবে না, এমন লোক চাই যে দুটোই ভালো করে জানে (এবং সেইহেতু সংস্কৃত কলেজকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে সেখান থেকে ওইরকম লোকজন উঠে আসতে পারে)। এরপর তিনি তাঁর আগের প্রস্তাবের প্রতিধ্বনি করে আবারও বলেন, সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে গণিতশিক্ষা নিছকই পণ্ডশ্রম, তাই তা পত্রপাঠ বাতিল করতে হবে, এবং হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন ধারা পড়াতে হবে— তাদের অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্যের কারণে নয়— যাতে তাদের নিজেদের মধ্যেকার মারামারি কাটাকাটি দেখে ছাত্ররা অসার বাগাড়ম্বরকে নিজে নিজে চিনতে শিখতে পারে, সেইজন্য।
১৮৫৩ সালের মাঝামাঝি বেনারস সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ জেম্স্ আর ব্যালান্টাইন কলকাতার সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শন করে সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট জমা দেন, তাতে সংস্কৃত কলেজের পঠনপাঠন বিষয়ক কিছু পরামর্শ ছিল। সে পরামর্শের মূল সুরটি এই রকম ছিল যে, ছাত্রদেরকে হিন্দু ধর্মীয় দর্শন এবং পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিশাস্ত্র একসঙ্গে পড়ালে নাকি তারা দুটোকেই একই সঙ্গে দুটো আলাদা রকমের সত্য বলে গ্রহণ করে নেবে, এবং ফলে ‘সত্য’ জিনিসটাকেই নাকি তারা দুরকম বলে ভাবতে শিখবে। সুতরাং, ব্যালান্টাইন সায়েবের পরামর্শ, তাদেরকে পাশ্চাত্য দর্শনের এমন ধারাগুলো পড়াতে হবে, এবং তাদের জন্য পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের বইপত্রগুলো এমনভাবে ব্যাখ্যা করে লিখতে হবে, যাতে করে তারা মনে করতে পারে যে, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শন আসলে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের কথাগুলোরই প্রতিধ্বনি করছে মাত্র (এইসব কথা বলবার লোক আজও আছে, একটু ভাবলেই মনে পড়বে)! ব্যালান্টাইনের মতে সেরকম উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে যেসব বই, তার মধ্যে আছে বিশপ বার্কলির চরম ভাববাদী দর্শন, এবং ব্যালান্টাইনের নিজের লেখা একটি বই, যাতে তিনি ন্যায়দর্শনের সঙ্গে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের নৈকট্য ব্যাখ্যা করেছেন।
এ রিপোর্ট বিদ্যাসাগরের হাতে এসে পড়ে ওই বছরের ২৯ অগাস্ট, এবং ৭ সেপ্টেম্বরই তার তীব্র প্রতিবাদ করে বিদ্যাসাগর এক সুবিস্তারিত ও বিস্ফোরক জবাব পাঠান শিক্ষাসচিব মৌয়াট-কে, এবং এই প্রসঙ্গে ওটাই সবচেয়ে বিখ্যাত। সেখানে তিনি যা বলেছিলেন তার মোদ্দা কথাগুলো এইরকম। প্রথমত, সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শন যে ভ্রান্ত সে নিয়ে এখন আর সন্দেহ নেই, অথচ তবুও নানা কারণে সে সব কলেজে পড়িয়ে যেতে হচ্ছে। এখন এই অবস্থায় যদি বার্কলির যুক্তিবিরোধী দর্শন পড়ানো হয়, তো ছাত্ররা হিন্দু দর্শনের সঙ্গে ইউরোপীয় দর্শনের মিল খুঁজে পেয়ে আরও বেশি করে কুসংস্কারে নিমজ্জিত হবে, যেখানে তিনি বরং চেয়েছিলেন ঠিক তার উল্টোটা— ছাত্ররা পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ পড়ে হিন্দু ধর্ম ও দর্শনকে প্রশ্ন করতে শিখুক। [আজকের দিনেও কি আমাদের শিক্ষাজগতের কোনও বড় কর্তাব্যক্তি সরকারের কাছে এই ভাষায় এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়ার সাহস দেখাতে পারবেন?] দ্বিতীয়ত, তিনি বললেন, সত্য তো সব সময়েই সত্য, তাকে ঠিকঠাক বুঝতে পারলে সত্য একটাই। সত্যকে ভুল বুঝলে তা দু-রকম বলে মনে হতে পারে বটে, কিন্তু সেরকম ভুল উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে সংশোধন করা যায়। কেউ যদি ইউরোপীয় দর্শনের তত্ত্ব ভারতীয় ভাষায় প্রকাশ করতে না পারে (বা উল্টোটা), তার অর্থ মোটেই এই নয় যে ইউরোপ আর ভারতে ‘সত্য’ জিনিসটা আলাদা, তার মানে শুধুমাত্র এই যে, হয় সে দার্শনিক বিষয়বস্তুটি ঠিকঠাক বোঝেনি, নয় সে যে ভাষায় ওটা ব্যাখ্যা করতে চাইছে সে ভাষায় সে যথেষ্ট দক্ষ নয়, আর তাও যদি না হয় তো সে দর্শনটিই অসার— তার মধ্যে হয়ত আদৌ প্রকাশ করার মত বিশেষ কথা তেমন কিছু নেই (এবং এই শেষ সম্ভাবনাটি হিন্দু দর্শনের ক্ষেত্রে প্রায়শই অতি বাস্তব)। [এখানে সামান্য একটি অনুচ্ছেদে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর বস্তুনিষ্ঠ সত্যের স্বরূপ সম্পর্কে যে বিরাট বড় কথাটা অনায়াসে বলে দিলেন প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে, আজকের দিনে ‘অবজেক্টিভ রিয়্যালিটি’ নিয়ে মাথা চুলকে ঘা করে ফেলা তাবড় সব পেশাদার বিজ্ঞানী-দার্শনিকেরা এই সোজা কথাটা এতখানি সোজাভাবে বলতে গেলে বোধহয় স্রেফ হেঁচকি উঠেই মারা যাবেন— যদিও আজ এখানে এই চিত্তাকর্ষক প্রসঙ্গটি নিয়ে চর্চার সুযোগ নেই মোটেই।] তৃতীয়ত, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানকে হিন্দু দর্শনের সঙ্গে মিলিয়ে ছাত্রদের কাছে হাজির করতে হবে, ব্যালান্টাইনের এ পরামর্শও বিদ্যাসাগর আদৌ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করলেন না। কারণ, একে তো এ অসম্ভব কাজটি করাই যাবে না, আর যদি বা তা কোনওমতে করাও যায়, তো তাতে করে আমাদের দেশের পণ্ডিতবর্গের কাছে শাস্ত্রের সমর্থন পেয়ে বিজ্ঞানের মর্যাদাবৃদ্ধি মোটেই ঘটবে না, বরং বিজ্ঞানের সমর্থন পেয়ে ধর্মশাস্ত্র আর কুসংস্কারের প্রতি অন্ধ ভক্তি চড়চড় করে বেড়ে উঠবে। কাজেই, বেনারসে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা যদি ব্যালান্টাইনকে এহেন পরিকল্পনার কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত করে থাকে, তো তিনি বেনারসেই তা প্রয়োগ করে দেখতে পারেন, বঙ্গে নৈব নৈব চ। চতুর্থত, সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যসূচি নির্ধারণের প্রশ্নে দেশীয় পণ্ডিতদের পাত্তা দেওয়ার মোটেই দরকার নেই— এ ব্যাপারে তাঁদের সাহায্য করা বা বাধা দেওয়া কোনওটারই ক্ষমতা নেই। তাঁদের প্রতিপত্তি ও কণ্ঠস্বর দিনকে দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে, এবং তাঁদের অবস্থা আর কোনওদিনই ফিরবে না। পঞ্চমত, আমাদের চাই এমন লোকজন যারা নিজের ভাষাটা খুব ভালো করে জানে, যাদের আধুনিক যুগোপযোগী জ্ঞান আছে, এবং যারা এ দেশের কুসংস্কারগুলো থেকে মুক্ত। সংস্কৃত কলেজ এমন মানুষই তৈরি করুক।
এই প্রতিবাদ সত্ত্বেও, ব্যালান্টাইনের সুপারিশ করা বইগুলো সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ এল সরকারের কাছ থেকে, এবং তার প্রতিবাদে বিদ্যাসাগর ৫ অক্টোবর আবারও একটি ছোট্ট চিঠি লিখলেন সেই মৌয়াট সাহেবকেই। বললেন, এভাবে সিদ্ধান্ত চাপালে পরিকল্পনামাফিক প্রতিষ্ঠান চালানোটা তাঁর পক্ষে খুবই সমস্যার ব্যাপার হয়ে উঠবে। এ চিঠিতে তাঁর শিক্ষাদর্শ নতুন করে ব্যাখ্যা করার মোটেই দরকার ছিল না, তবুও এখানে তিনি আরও একবার বললেন, সংস্কৃত ও ইংরিজি একসঙ্গে শিখিয়ে দু-রকম সত্যের উপলব্ধি হয়েছে এহেন ছাত্র ব্যালান্টাইন বেনারসে দেখেছেন কিনা তা তিনি বলতে পারবেন না, তবে, তিনি এটুকু অবশ্যই বলতে পারেন যে বঙ্গদেশে তাঁর ওরকম অভিজ্ঞতা একটিও হয়নি।
এখন, বিদ্যাসাগরের জীবনের এত সব কথাবার্তা ও কাজকর্ম থেকে ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর চিন্তার অবয়বটি বেশ পরিষ্কারভাবেই ফুটে ওঠে হয়ত বা, সে নিয়ে সংশয় বা বিভ্রান্তির আর খুব বেশি পরিসর থাকে না। তবু প্রশ্ন থাকে, থাকে উত্তর-প্রত্যুত্তরের খেলা। সে সব কথা, হবে, শীঘ্রই।
[এখানে যে সব তথ্য ব্যবহার করেছি সে সবই বিদ্যাসাগর-চর্চা প্রসঙ্গে সুবিদিত, কাজেই বিস্তারিত সূত্রনির্দেশের প্রয়োজন সেভাবে বোধ করিনি, অল্প দুয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও ‘ক্রিটিক্যাল’ ক্ষেত্র ছাড়া। নিচে যে সমস্ত বই ও প্রবন্ধের উল্লেখ করেছি তাতে এখানে ব্যবহৃত হয়েছে এমন সব তথ্যই পাওয়া যাবে। বইয়ের নামগুলো বোল্ড এবং লেখকের নামগুলো ইটালিক্সে রাখলাম, আশা করি তাতে পাঠকের পড়তে সুবিধে হবে।]
তথ্যসূত্র
- করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্রমিত্র, আনন্দ, ২০০৭
- বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১১
- রসসাগর বিদ্যাসাগর, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯২
- বাঙালি প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫
- সমকালে বিদ্যাসাগর, স্বপন বসু, বাংলার মুখ, ২০১৯
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, অর্ণব নাগ (সম্পাদনা), অক্ষর প্রকাশনী, ২০২০
- রেনেসাঁসের আলোয় বঙ্গ দর্শন, শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, পুনশ্চ, ২০১৯
- উনিশ শতকের বাঙালিজীবন ও সংস্কৃতি, স্বপন বসু ও ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী (সম্পা), পুস্তক বিপণি, ২০১৯
- ‘সংবর্তক’ পত্রিকা, কলকাতা, বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা, কলকাতা বইমেলা ২০২০
- ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকা, কলকাতা, বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা, একত্রিংশ বর্ষ, ২০১৩-১৪, তৃতীয়-চতুর্থ সংখ্যা
- Iswar Chandra Vidyasagar & His Elusive Milestones, Asok Sen, Permanent Black, 2016
- বিদ্যাসাগর :নানা প্রসঙ্গ,রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১১
- জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, দ্বিজেন্দ্র ভৌমিক (সম্পা), আনন্দ, ২০২০
- বিদ্যাসাগর কি সত্যিই আস্তিক ছিলেন?, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (আন্তর্জাল ঠিকানা ‘academia.edu’ থেকে প্রাপ্ত)
- ভদ্রলোকী যুক্তিবাদের দক্ষিণাবর্ত, আশীষ লাহিড়ী, ঋতাক্ষর, ২০১৭
- Ballantyne-Vidyasagar Controversy: A Re-view, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, বিদ্যাসাগর কলেজ : স্মৃতিধন্য একশ পঁচিশ বছর (আন্তর্জাল ঠিকানা ‘academia.edu’ থেকে প্রাপ্ত)
- নির্বাচিত প্রবন্ধ, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৯