সীমানা

সীমানা: ঝুম্পা লাহিড়ী | ভাষান্তর: নাহার তৃণা

ঝুম্পা লাহিড়ী

 

ভাষান্তর: নাহার তৃণা

ঝুম্পা লাহিড়ীর জন্ম ইংল্যান্ডে ১৯৬৭ সালে। বেড়ে উঠেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডে বাবা মায়ের একান্ত সান্নিধ্যে তাঁর শৈশব কৈশোর কেটেছে। ইংরেজি প্রধান একটি দেশে বেড়ে উঠলেও বাড়ির নিয়ম মেনে তাঁকে বাংলাভাষাতে অভ্যস্ত হতে হয়। ফলে বিদেশে বড় হলেও মাতৃভাষাটি তাঁর দারুণভাবেই আয়ত্তাধীন।

রেনেসাঁস সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভীষণ একটা ঝোঁক ছিল, এবং সে বিষয়ের উপর তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০০ সালে ‘ইন্টারপ্রেটার অফ মেলোডিজ’-এর জন্য পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। ‘দ্য নেমসেক’, ‘লো-ল্যান্ড’, ‘আনঅ্যাকাস্টমড আর্থ’, ‘নো বডিজ বিজনেস’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি।

 

প্রত্যেক শনিবার, একটা নতুন পরিবার এখানে থাকতে আসে। কেউ কেউ অনেক দূর থেকেও খুব ভোরে চলে আসে এবং ছুটির আনন্দে মেতে ওঠে। কেউ কেউ আবার সূর্যাস্তের আগে পৌঁছাতেই পারে না, রুক্ষ মেজাজ নিয়ে হাজির হয় তারা। মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলার কারণে দেরি হয়েছে। এসব পাহাড়ে পথ হারিয়ে ফেলা সহজ, রাস্তাগুলো ঠিকভাবে চিহ্নিত করা থাকে না।

আজ, আগত পরিবারটির পরিচয়পর্ব শেষ করার পর, চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব আমার। অতিথি অর্ভ্যথনার কাজটি সচরাচর আমার মা-ই করে থাকেন। মা এখন কাছের শহরে, গ্রীষ্মের এই সময়টায় প্রবীণ এক ভদ্রলোক যিনি কিনা ছুটি কাটানোর জন্যই এসেছেন তাকে সাহায্যের উদ্দেশ্যে সেখানে থাকছেন, কাজেই মায়ের দায়িত্বটা এখন আমার উপর বর্তেছে।

পরিবারটিতে যথারীতি চারজন সদস্য; মা, বাবা, আর দুটি কন্যা। চোখে উৎসাহের ঝিলিক নিয়ে পায়ের আড়ষ্টতা কাটাতে পারার আনন্দে তারা সবাই আমাকে অনুসরণ করে। স্বল্প সময়ের জন্য আমরা ঘরের সামনে খোলা বারান্দায় দাঁড়াই, যার খড়ের চালটি উঠোনের খানিক অংশকেও ছায়াবৃত করেছে। সেখানে দুটি আর্মচেয়ার, একটি সোফা রয়েছে, সোফাটি সাদা কাপড়ের আচ্ছাদনে ঢাকা। সূর্যস্নানের জন্য রয়েছে একটি লাউঞ্জ চেয়ার, এবং দশজনের পক্ষেও যথেষ্ট বড় মাপের একটি কাঠের টেবিল।

কাচের স্লাইডিং দরজাটি খুলে আমি তাদের ভেতরটা দেখাই; ফায়ারপ্লেসের সামনে দুটি আরামদায়ক সোফা সহ স্বাচ্ছন্দ্যময় লিভিংরুম, প্রয়োজনীয় মজুদে ভরপুর রান্নাঘর, দুটি শোবার ঘর। ভদ্রলোক গাড়ি থেকে মালপত্তর নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে মেয়ে দুটি যাদের একজনের বয়স সম্ভবত সাত এবং অন্যটির নয়, দুজনই উধাও হয়ে যায়, নিজেদের ঘরে গিয়ে তারা দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রয়োজন পড়লে বাড়তি তোয়ালে আর রাতে যদি ঠান্ডা লাগে তবে উলের কম্বল কোথা থেকে সংগ্রহ করতে হবে সেসব ভদ্রমহিলাকে জানিয়ে দেই।

এছাড়াও ইঁদুর মারার ওষুধগুলো কোথায় কোথায় দেয়া আছে সেটাও তাকে দেখিয়ে দেই। ঘুমোতে যাওয়ার আগে মাছিগুলো মেরে ফেলা বুদ্ধিমানের হবে এমন পরামর্শ দেই, নইলে ভোর হওয়া মাত্র মাছিদের গুঞ্জন বিশেষ উপদ্রব হয়ে দেখা দিতে পারে। সুপার মার্কেটে যাওয়ার পথ, বাগানের পেছনে থাকা কাপড় ধোবার মেশিনটা কীভাবে চালাতে হবে, ধোয়া কাপড় আমাদের বাগানের অন্য দিকেই শুধুমাত্র শুকোতে দেওয়া যাবে, ইত্যাদি আমি মহিলাকে পই পই করে বুঝিয়ে দেই। আরও জানাতে ভুলি না যে অতিথিরা বিনা দ্বিধায় বাগান থেকে লেটুস আর টমেটো তুলে নিতে পারেন। এ বছরে প্রচুর টমেটো ফলেছিল, কিন্তু জুলাইয়ের বৃষ্টিতে তার বেশিভাগই নষ্ট হয়েছে।

আমি তাদের দেখেও না দেখার ভান করছি, যেন তারা বুঝতে না পারে আমি তাদের লক্ষ করছি। নিজের মনে আমি ঘরের কাজ করি, বাগানের গাছে পানি দেই, কিন্তু কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাদের লক্ষ না করেও পারি না, আড়চোখে দেখি, তারা কত আনন্দিত আর উচ্ছ্বসিত। মেয়ে দুটি যখন লন পেরিয়ে দৌড়ে যায় তাদের গলা শুনতে পাই, ইতিমধ্যে ওদের নাম জেনেছি। যেহেতু অতিথিরা সাধারণত কাচের স্লাইডিং দরজাটা খোলাই রাখেন, ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা দুজনে ঘরের ভেতর এক অন্যের সঙ্গে যে সব কথা বলেন আমি সবই শুনতে পাই, এমনকি তারা তাদের সুটকেস খুললে অথবা মধ্যাহ্নভোজনে কী খাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি আলাপের প্রায় সবটা শোনা যায়।

যে কটেজে আমার পরিবার বাস করে সেটা কয়েক গজ দূরে। তার পেছনে ঘন গাছপালার বেড়া যেটাকে দূর থেকে সবুজ পর্দার মতো লাগে। বহু বছর ধরে, আমাদের বাড়িতে শুধু একটি ঘরই ছিল যা একাধারে আমাদের তিনজনের শোবার ঘর এবং রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। তারপর, দুবছর আগে, আমি যখন তেরো বছরে পা দিলাম মা তখন বয়স্ক লোকদের সাহায্যের কাজটা শুরু করে, নিজেদের হাতে বেশ কিছু টাকা জমা হওয়ার পর বাবা মা এই বাড়ির মালিকের কাছে আমার জন্য বাড়তি একটি ঘর তুলে দেওয়া সম্ভব কিনা তার প্রস্তাব দেন।

আমার বাবা এ অতিথিশালার তদারকির কাজ করেন। তিনি অতিথিশালার জন্য কাঠ কাটেন, ক্ষেতের কাজের পাশাপাশি আঙুর ক্ষেতেরও যত্নআত্তি করেন। এছাড়াও ঘোড়াপ্রেমী বাড়িওয়ালার প্রিয় ঘোড়াগুলোর দেখাশোনা বাবাকেই করতে হয়।

অতিথিশালার মালিক বিদেশে থাকেন তবে তিনি আমাদের মতো বিদেশি নন। নিজের খেয়ালখুশি মতো তিনি যখনতখন চলে আসেন। তার নিজের কোনও পরিবার নেই। এখানে থাকার সময়ে দিনের বেলায় তিনি ঘোড়ায় চড়ে এবং সন্ধ্যায় ফায়ারপ্লেসের সামনে বই পড়ে সময় কাটান। তারপর তিনি আবার বিদেশে পাড়ি জমান।

গ্রীষ্মকাল ছাড়া অন্যান্য সময়ে এ বাড়িটা লোকে তেমন ভাড়া নেয় না। এখানকার শীতকালটা যেন হাড়ে কামড় বসায়, গোটা বসন্ত জুড়ে থাকে প্যাচপ্যাচে বৃষ্টি। সেপ্টেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে বাবা আমাকে স্কুলে পৌঁছে দেন, যেখানে নিজেকে স্থানচ্যুত জনবিচ্ছিন্ন একজন মনে হয় আমার। চট করে অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাটা আমার স্বভাবে নেই। গায়ের রঙের কারণে আমাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা লাগে।

আগত অতিথি পরিবারের মেয়েদুটির চেহারায় যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। দেখামাত্র যে কেউ বলে দিতে পারবে যে তারা সহোদরা। সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে দু বোনে ইতিমধ্যেই একইরকমের স্নানের পোশাক পরেছে। সমুদ্রসৈকতটি এখান থেকে প্রায় পনেরো মাইল দূরে। তাদের মাকেও কমবয়েসি মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। ভদ্রমহিলা ছোটখাটো এবং চিকন গড়নের, তিনি তার লম্বা চুল খোলা ছেড়ে রেখেছেন। তার কাঁধজোড়াও বেশ কৃশ এবং কমনীয়। তিনি ঘাসের উপর খালি পায়েই হাঁটা শুরু করেন, যদিও ভদ্রলোক তাকে সেটি করতে নিষেধ করেন (এবং এ বিষয়ে ভদ্রলোক একদমই ঠিক) যে সেখানে শজারু, বোলতা কিংবা সাপখোপ থাকতে পারে।

মাত্র কয়েক ঘন্টা হয়েছে অতিথি পরিবারটি এসেছে, অথচ তাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন তারা বহুদিন এখানে থেকে অভ্যস্ত। এক সপ্তাহের জন্য যেসব জিনিস তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সেগুলো পুরো জায়গা জুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে; বই, ম্যাগাজিন, একটা ল্যাপটপ, পুতুল, হুডি, রংপেন্সিল, কাগজের প্যাড, স্পঞ্জের স্যান্ডেল, সানস্ক্রিন। মধ্যাহ্নভোজের সময় আমি কাঁটাচামচ আর প্লেটের ঠোকাঠুকি শুনতে পাই। এটাও খেয়াল করি যে প্রতিবারই তাদের কেউ না কেউ পানির গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রাখছে। তাদের মৃদু কথোপকথন আমার কানে ভেসে আসে, আরও ভেসে আসে তাদের কফিপটের ঘ্রাণ এবং সিগারেটের ধোঁয়া।

মধ্যাহ্নভোজের পর ভদ্রলোক মেয়েদের একজনকে তার চশমাটা এনে দিতে বলেন। বহুক্ষণ সময় নিয়ে তিনি একটি রাস্তার ম্যাপ পর্যবেক্ষণ করেন। পরিদর্শনের জন্য তিনি নিকটবর্তী ছোট শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো, ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদির তালিকা তৈরি করেন। কিন্তু ভদ্রমহিলা ওসবে মোটেও আগ্রহী নন। তার মতামত হল, বছরের এই একটা মাত্র সপ্তাহই তিনি নিজের জন্য পান যেটি কোনওরকম অ্যাপয়েন্টমেন্ট আর বাধ্যবাধকতার ঘেরাটোপমুক্ত। কাজেই সেটা তিনি নিজের ইচ্ছেমতোই উপভোগ করতে চান।

কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক মেয়েদুটিকে নিয়ে সমুদ্রের দিকে রওনা দেন। যাওয়ার আগে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন যেখানে যাচ্ছেন সেখানে পৌঁছাতে তাদের কতক্ষণ লাগতে পারে, কোনটি সবচেয়ে সুন্দর সৈকত। তিনি পুরো সপ্তাহের আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কেও আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এবং আমি তাকে লু হাওয়া ধেয়ে আসার বার্তাটি জানাই।

ভদ্রমহিলা ঘরেই থেকে যান। রোদ পোহানোর জন্য এর মধ্যে তিনি তার স্নানের কাপড় পরে নিয়েছেন। লাউঞ্জের একটি চেয়ার ধরে তিনি শরীরের আড় ভাঙতে থাকেন। আমার কেমন অনুমান হয় কিছুক্ষণের জন্য তিনি হয়ত একটু ঘুমিয়ে নেবেন, কিন্তু আমি যখন কাচা কাপড়গুলো শুকোতে দিচ্ছিলাম তখন তাকে কিছু লেখালেখি করতে দেখি। উরুর উপর ছোট্ট একটা নোটবুক রেখে হাতেই তিনি কিছু লিখছেন।

একটু পর পর তিনি মাথা তুলছেন এবং আমাদের চারপাশের ল্যান্ডস্কেপটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। তিনি ঘরের সামনের খোলা চত্বরের চারপাশের বিভিন্ন ধাঁচের সবুজের সমারোহ, পাহাড়, দূরের বন গভীর চোখে দেখতে থাকেন। আকাশের উজ্জ্বল নীল, হলুদরঙা খড়; পরিছন্ন বেড়া এবং ঢালের পাথুরে প্রাচীর যা সম্পত্তিরেখা চিহ্নিত করে; সেসব যা আমি প্রতিদিন দেখে আসছি, সেসব তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। মহিলাটিকে গভীরভাবে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে এসবের মধ্যে তিনি কী এমন দেখছেন ভেবে আমার কেমন অবাক লাগে।

সূর্যটা ঢলতে শুরু করলে মশার হাত থেকে বাঁচার তাগিদে অতিথি পরিবারের সবাই সোয়েটার এবং ফুলপ্যান্ট পরে নিয়েছেন। সৈকতে হুটাপাটির পর গরম জলে গোসল করায় ভদ্রলোক আর মেয়েদুটির চুল এখনও ভেজা।

সৈকত থেকে ফিরে মেয়েরা হড়বড় করে তাদের সমুদ্র ছুঁয়ে আসার অভিজ্ঞতা বয়ান করে। উত্তপ্ত বালি, ঈষৎ ঘোলা জল, ঢেউয়ের ক্ষুদ্রতা নিয়ে তাদের হতাশা ইত্যাদি বিষয়ে তাদের গল্প। এরপর পুরো পরিবার মিলে আশপাশ চক্কর দিতে বের হয়। তারা ঘোড়া, গাধা, এমনকি আস্তাবলের পেছনে বেঁধে রাখা বুনো শুয়োরটিকেও দেখে। এই সময় প্রতিদিন যে ভেড়ার পাল বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েক মিনিটের ধুলোর ঝড় তুলে গাড়িঘোড়ার পথ রোধ করে তাদেরও দেখতে যায় ওরা।

ভদ্রলোক তার সেলফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলতেই থাকেন। তিনি মেয়েদের বরই গাছ, ডুমুর গাছ আর জলপাই গাছ দেখান। তিনি মেয়েদের বলেন গাছ থেকে সরাসরি তোলা ফলের স্বাদ গ্রামাঞ্চলে একদমই অন্যরকম, কারণ তাতে রোদের গন্ধ লেগে থাকে। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা পেছনের খোলা বারান্দায় বসে একটি ওয়াইনের বোতল খোলেন। তার সঙ্গে সামান্য পনির এবং স্থানীয় মধুর স্বাদ গ্রহণ করেন। ঝকঝকে পরিষ্কার দিগন্তরেখার উপর ভেসে থাকা উজ্জ্বল মেঘপুঞ্জ এবং বাগানে অক্টোবরের পাকা ডালিমের রক্তিম সৌন্দর্য দেখে তারা ভীষণভাবে মোহিত। সন্ধ্যা নামছে। তারা ব্যাং, ঝিঁঝিপোকা আর বাতাসের মর্মরধ্বনি শুনতে পান। যথেষ্ট বাতাস থাকা সত্ত্বেও প্রলম্বিত আলোর সুবিধা নেওয়ার জন্য পরিবারটি বাইরে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি আর বাবা ঘরের ভেতর নিঃশব্দে খাওয়াদাওয়া করি। খাওয়ার সময় বাবা একদমই মুখ তুলে তাকান না। মার অনুপস্থিতিতে রাতের খাওয়ার সময় আমাদের কোনও কথাবার্তাই হয় না। মাই একজন, যিনি খাওয়ার সময় কথাবার্তা চালিয়ে থাকেন।

এই জায়গাটা আমার মায়ের একদমই পছন্দ নয়। বাবার মতো মাও বহুদূর থেকে আগত, যারা এখানে ছুটি কাটাতে আসেন তাদের চেয়েও বহু দূরের সে গ্রাম। এত দূরের একটা গণ্ডগ্রামে থাকতে ভীষণ অপছন্দ করেন মা। তাঁর মতে এখানকার লোকজন মোটেও আন্তরিক নয়। সবাই কেমন স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক।

মায়ের অনুপস্থিতিতে তার অভিযোগগুলো যে আমাকে শুনতে হয় না তা নিয়ে আমার কোনও আফশোস নেই, সেই অভিযোগগুলোর অনেকখানি সত্যি হলেও সেগুলো শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগে না। মাঝেমাঝে যখন মায়ের অভিযোগের মাত্রা লাগাম ছাড়ায়, বাবা তখন মায়ের সঙ্গে না ঘুমিয়ে গাড়িতে গিয়ে ঘুমান।

রাতের খাওয়ার পর মেয়েদুটো উঠোনে উড়ে বেড়ানো জোনাকি পোকাদের পেছনে ছুটাছুটি করে। জোনাকির শরীরে লেপ্টে থাকা আলো নিয়ে খেলা করে। তাদের মা-বাবা খোলা বারান্দায় চুপচাপ বসে অন্ধকার আকাশে দ্যুতিময় নক্ষত্রমালা দেখেন।

বসে বসে ভদ্রমহিলা লেবুমিশ্রিত গরম জলের গেলাসে চুমুক দেন, আর ভদ্রলোক অল্প অল্প চুমুক দিতে থাকেন ব্র্যান্ডির গেলাসে।

ঘুম থেকে উঠে সকালে আমার প্রথম কাজ হলো মুরগির খাঁচাগুলো থেকে ডিম সংগ্রহ করা। ডিমগুলো উষ্ণ, ফ্যাকাশে আর নোংরা। আমি সেগুলো একটা ঝুড়িতে করে অতিথিদের ব্রেকফাস্টের জন্য তুলে রাখি। সাধারণত এদিকে কেউ থাকে না এ সময়ে, আমি ডিমগুলো বারান্দার টেবিলে রেখে দেই। কিন্তু তখনই আমি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই বালিকারা ইতিমধ্যে জেগে গেছে। আরও দেখতে পাই সোফার উপর বিস্কুটের ভাঙা টুকরো এবং সিরিয়ালের ছেঁড়া প্যাকেট পড়ে আছে কফি টেবিলের ওপর।

বালিকা দুজন ঘরের মধ্যে ভ্যানভ্যান করতে থাকা মাছি তাড়াবার চেষ্টা করছিল। বড় মেয়েটার হাতে একটা মাছি তাড়াবার ঝাঁটা। ছোট মেয়েটা বেশ হতাশ হয়ে অভিযোগ করছিল কখন তার মাছি তাড়াবার পালা আসবে। সে নিজের পালার অপেক্ষায় আছে, সেও মাছি তাড়াতে চায়।

আমি ডিমগুলো নামিয়ে রেখে আমাদের ঘরে ফিরে গেলাম। তারপর দরজায় টোকা দিয়ে আমাদের মাছি তাড়ানিয়াটা মেয়েদুটোকে ধার দিলাম। তারা ওটা পেয়ে দারুণ খুশি। মাছিগুলোকে মেরে তারপর তাদের ঘুমোতে যাওয়া উচিত, এই ব্যাপারটা নতুন করে আর বলবার উৎসাহ হল না আমার। বোঝাই যাচ্ছে মাছির উৎপাত সত্ত্বেও তাদের মা-বাবার নিরুপদ্রব ঘুমের সুযোগে তারা দুজনে মজা করছে।

দুদিন না যেতেই একটা নিয়মিত রুটিন তৈরি হয়ে যায়। সকালের পর্ব শেষ করে ভদ্রলোক শহরের কাফেতে চলে যেতেন দ্বিতীয় কাপ কফি খেতে এবং দুধ আর পত্রিকা কিনে আনতে। দরকার হলে পাশের সুপারমার্কেটেও একবার উঁকি দেন তিনি। ফিরে আসার পর গরম আবহাওয়া সত্ত্বেও পাহাড়ের দিকে ঘুরতে চলে যান। একদিন ঘোরাঘুরি শেষে ফিরে আসার পথে একটা ভেড়া চড়ানো কুকুরের বাধা পেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নানান ঘুরপথ পেরিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন, যদিও শেষমেশ তেমন কোনও বিপদ ঘটেনি।

আমি ঘরের যেসব কাজ করি ভদ্রমহিলাও সেসব কাজ করেন; তিনি মেঝে ঝাড়ু দেন, রান্না করেন, বাসনকোসন ধোয়াধুয়ি করেন। দিনে অন্তত একবার তিনি কাচা কাপড় শুকোতে দেন। ভাগ করা দড়িতে দিব্যি সুন্দর মিলেমিশে আমাদের দুই পরিবারের কাপড়গুলো শুকিয়ে যায়। লন্ড্রির ঝুড়িটা বগলদাবা করে ভদ্রমহিলা স্বামীকে বলেন, এভাবে কাপড় শুকোনো কী আনন্দময় একটা ব্যাপার। যেহেতু তারা শহরের খুপরি আর জনাকীর্ণ অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করেন, এভাবে খোলা জায়গায় কখনও কাপড় শুকোতে দেননি তারা।

মধ্যাহ্নভোজের পর ভদ্রলোক তার দুই মেয়েকে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যান, এবং ভদ্রমহিলা বাড়িতেই থাকেন। একা বাড়িতে তিনি শরীরের আড় ভাঙেন এবং ধূমপান করতে করতে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার নোটবুকে লেখালেখি চালিয়ে যান।

একদিন, সমুদ্রসৈকত থেকে ফিরে মেয়ে দুটি ঘাসের উপর লাফালাফি করা ঝিঁঝিপোকাদের ধরার চেষ্টায় ঘন্টাখানেক ব্যয় করে। দুহাতে ঝিঁঝিপোকা খপাখপ ধরে একটা বোতলে তার কিছুসংখ্যক ঝিঁঝি আটকাতে সক্ষম হয়, বোতলে ছোট ছোট টমেটোর টুকরো দেয় যা তারা মা বাবার সালাদপ্লেট থেকে লুকিয়ে নিয়েছিল। বোতলে আটকে থাকা ঝিঁঝিগুলোকে তারা পোষ মানাতে চায়, দু বোনে পোকাদের নামকরণ পর্যন্ত করে। পরদিন বোতলে দমবন্ধ হয়ে পোকাগুলো মরে গেলে দু বোনের সে কি কান্না! পরে মৃতপোকাদের তারা বরই গাছের নীচে কবর দেয় এবং উপরে কিছু বুনোফুল ছড়িয়ে দেয়।

আরেক দিন, ভদ্রলোক খেয়াল করেন বাইরে তিনি যে স্পঞ্জ স্যান্ডেলটি খুলে রেখেছিলেন সেটি গায়েব হয়ে গেছে। আমি তাকে বলি এ অকাজ সম্ভবত কিছুদিন থেকে আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা শেয়ালেরই হবে। ঘটনাটি আমি আমার বাবাকে জানাই, যিনি এখানকার আশেপাশের যাবতীয় প্রাণীকুলের স্বভাব এবং গুপ্ত আশ্রয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। পাক্কা গোয়েন্দার মতো পূর্ব কোনও অতিথি পরিবারের হারানো বল এবং একটি শপিং ব্যাগের সঙ্গে আমার বাবা ঠিকই হারানো স্পঞ্জের হদিশ বের করে ফেলেন।

আমি বেশ বুঝতে পারি অতিথিরা গ্রামীণ এই পরিবেশ, এখানকার নিপাট প্রাকৃতিক দৃশ্য কতটা পছন্দ করছেন। এখানকার প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ, এসব বিষয় তাদের চিন্তাভাবনা, বিশ্রাম কিংবা স্বপ্ন বুনতে কীভাবে প্রভাব ফেলছে সেসব নিয়ে তারা উচ্ছ্বসিত। মেয়েদুটি গাছ থেকে ব্ল্যাকবেরি তুলতে গিয়ে তাদের সুন্দর জামায় দাগ লাগিয়ে বসে, তাদের মা সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ক্ষিপ্ত হন না; তার বদলে বরং তিনি হেসে ওঠেন। ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বলেন মেয়েদের ওই অবস্থার স্মৃতি হিসেবে একটা ছবি তুলে রাখতে এবং তারপর তাদের জামাগুলো ধোয়ার জন্য খুলে রাখেন।

একই সঙ্গে আমি এটাও ভাবি, তারা এই জায়গার একাকিত্ব সম্পর্কে কতটুকুই বা জানেন? আমাদের জরাজীর্ণ ঘরের প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবনযাপন সম্পর্কে কী জানেন তারা? রাতে দাপুটে বাতাসের প্রচণ্ডতায় যখন মনে হয় পুরো পৃথিবীটা কাঁপছে, কিংবা একটানা বৃষ্টির শব্দ যা আমাকে সারারাত নিদ্রাহীন রাখে। মাসের পর মাস আমরা পাহাড়, ঘোড়া, পোকামাকড়, মাঠের ওপাশের পাখপাখালিদের মধ্যে একা থাকি; একা থাকার যাতনা অনুভবে কতটুকু সক্ষম তারা? এক ধরনের নির্মম নির্জনতা যা গোটা শীতকাল জুড়ে থাকে সেটা কি তারা পছন্দ করতেন?

গতরাতে আরও কিছু গাড়ি এসেছে। অতিথি ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা তাদের কিছু বন্ধু পরিবারকে বাচ্চাকাচ্চাসহ এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আগত বাচ্চাগুলো এখন ঘাস বিছানো মাঠের চারপাশে ছুটোছুটিতে ব্যস্ত। আগতদের কয়েকজন জানান শহর থেকে এখানে আসবার পথে ট্র্যাফিক জ্যাম ক্রমেই হালকা হয়েছে। বড়রা অনেকেই বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং সূর্যাস্তের সময় বাগানে হাঁটেন। এরই মধ্যে উঠোনের খোলা বারান্দার কাঠের টেবিলটি সাজানো হয়েছে।

তাদের ভোজনপর্বের যাবতীয় আলাপচারিতা আমি শুনতে পাই। আজ রাতের আড্ডার হাসি এবং বকবকানির শব্দ স্বাভাবিকভাবে অন্যদিনের তুলনায় বেশ জোরালো শোনায়। এখানে আসার পর পরিবারটি যেসব দুর্বিপাকে পড়েন  সেসব তারা আগত বন্ধুদের বর্ণনা করেন: টমেটোখাদক ঝিঁঝিপোকা, বরই গাছের নীচে তাদের কবর দেওয়া, ভেড়ার পাল, স্পঞ্জ স্যান্ডেল নিয়ে পালিয়ে যাওয়া শেয়াল; কিছুই প্রায় বাদ থাকে না তাদের বর্ণনায়। ভদ্রমহিলা বলেন এখানকার গ্রামীণ প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের এই ব্যাপারটা তার মেয়েদের জন্য দারুণ একটা অভিজ্ঞতা।

নিদির্ষ্ট একটা সময়ে মোমবাতিসহ একটি কেক হাজির করা হয়, এবং আমি বুঝে যাই আজ ভদ্রলোকটির  জন্মদিন। তিনি পঁয়তাল্লিশে পা রাখলেন। প্রত্যেকে ভদ্রলোককে অভিনন্দন জানিয়ে গান ধরেন এবং গান শেষে কেকটি কাটেন।

রাতের খাওয়ার পর আমি আর আমার বাবা অতিরিক্ত পাকা কিছু আঙুর খেয়ে শেষ করি। খাওয়া শেষে টেবিল পরিষ্কার করতে যাচ্ছি এমন সময় শুনি দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। আমি দরজা খুলে দেখলাম মেয়েদুটো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রীতিমত হাঁপাচ্ছে। দৌড়ে এসেছে তাই। তারা আমাকে দু টুকরো কেক সহ একটি প্লেট এগিয়ে দেয়। এক টুকরো আমার আরেক টুকরো আমার বাবার জন্য। আমি ধন্যবাদ বলবার আগেই তারা ছুটে পালিয়ে যায়।

বাবা আর আমি যখন কেক খাচ্ছি অতিথিরা তখন রাজনীতি, ভ্রমণ, শহরের জীবনব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করেন। কেউ একজন ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করেন কেকটা তিনি কোথা থেকে জোগাড় করেছেন। তিনি বললেন এটা বিশেষ একটা বেকারি থেকে আনা হয়েছে এবং এখানকার এক অতিথি সেটা এনেছেন। তিনি সেই বেকারির নাম এবং সেই বেকারি যেখানে অবস্থিত সেই পিয়াজ্জা সম্পর্কেও জানিয়ে দেন।

খেয়াল করি, আমার বাবা হাতের কাঁটা চামচ নামিয়ে রাখেন এবং তাঁর মাথাটা আরও খানিকটা নুয়ে পড়ে। তিনি যখন মাথা তুলে আমার দিকে তাকান তখন তাঁর দুচোখে কেমন একটা বিচলিত ভাব লক্ষ করি। তিনি হঠাৎই উঠে দাঁড়ান এবং ধূমপানের তীব্র ইচ্ছা নিয়ে অতর্কিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।

আমরাও এক সময় শহরে থাকতাম। আমার বাবা ঠিক ওই পিয়াজ্জায় (এক ধরনের মার্কেট প্লেস) ফুল বিক্রি করতেন। আমার মা তাকে সে কাজে সাহায্য করতেন।

তারা দুজনে ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটা ফুল বিক্রির স্ট্যান্ডে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লোকজনের জন্য ফুলের তোড়া সাজাতেন যাতে তারা বাড়ি গিয়ে তাদের টেবিল কিংবা বারান্দায় সাজিয়ে রাখতে পারে। এই দেশে নবাগত হওয়াতে তারা প্রথমে ফুলের নামগুলো শিখে ফেলেন— গোলাপ, সূর্যমূখী, কারনেশন, ডেইজি ইত্যাদি। দুজনে ফুলগুলোকে সুন্দর করে বেঁধে ঝুড়িতে করে সারিবদ্ধ করে সাজিয়ে রাখতেন।

একরাতে হুট করে তিনজন ষণ্ডামতো লোক এসে হাজির হয়। আমার বাবা তখন একা, আমার গর্ভবতী মা বাড়িতে, আমি তখন মায়ের গর্ভে, যে কারণে রাতে মা কাজ করেন বাবা সেটা চাইতেন না। বেশ রাত হয়েছে। পিয়াজ্জার আশেপাশের অন্যান্য দোকানগুলোর ঝাপ ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে, এবং আমার বাবা তার দোকানের ঝাপ অর্ধেকটা প্রায় নামিয়েছেন মাত্র।

তিনজনের মধ্যে একজন বাবাকে আবার দোকান খোলার জন্য বলেছিল, তার ভাষ্য হল সে তার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। সেজন্য তার একটি সুন্দর ফুলের তোড়া চাই। লোকটা অভাব্য আর কিছুটা মাতাল হওয়া সত্ত্বেও বাবা তাকে একটি তোড়া বানিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন।

আমার বাবা যখন ফুলের তোড়াটি বানিয়ে লোকটার সামনে তুলে ধরেন তখন লোকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জানায় ওটা মোটেও সুন্দর হয়নি, সে তোড়াটা আরও বড় করার জন্য বলে। লোকটা সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত বাবা তোড়ায় একের পর এক ফুল জুড়ে দেন। তোড়াটার চারপাশ একটা পাতলা কাগজ মুড়ে তাতে রঙিন একটা ফিতের গিঁট বেঁধে দেন। এরপর বাবা লোকটিকে তোড়ার কত দাম সেটি বলেছিলেন।

লোকটি তার মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে বাবাকে দেয়। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। এবং আমার বাবা যখন সঠিক দাম না পাওয়া পর্যন্ত ফুলের তোড়াটি লোককে দিতে অস্বীকৃতি জানান; তখন লোকটা ক্ষেপে গিয়ে বাবাকে বলেছিল বাবা নাকি একটা গবেট, যে কিনা একজন সুন্দরীর জন্য কীভাবে একটি চমৎকার ফুলের তোড়া বানাতে হয় তার কিস্যু জানে না। তারপর তার বাকি দুই সঙ্গী, মোট তিনজনে মিলে আমার বাবাকে ততক্ষণ পর্যন্ত পিটাতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না বাবার মুখ রক্তে ভরে যায়, তার সামনের পাটির দাঁত নড়বড় হয়ে খুলে আসে।

আমার বাবা চিৎকার করেছিলেন, কিন্তু অত রাতে সে চিৎকার শোনার কেউ ছিল না। লোক তিনজন মারধোরের পর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে, যেখান থেকে এসেছ সেখানেই ফিরে যাও। তারা ফুলের তোড়াটা নিয়ে বাবাকে মাটিতে ফেলে রেখে চলে যায়। সেই রাতে বাবা একাই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়েছিলেন। প্রায় এক বছর বাবা শক্ত কোনও খাবার খেতে পারেননি। আমার জন্মের পর, বাবা যখন প্রথমবারের মতো আমাকে দেখেন, তখন তাঁর পক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করা সম্ভব হয়নি।

সেই ঘটনার পর থেকেই বাবার কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হয়। কথা বলতে গেলে কথাগুলো কেমন বিকৃত হয়ে যায়, শুনে মনে হয় যেন কত বৃদ্ধ একজন কথা বলছেন। হাসতেও তিনি যথেষ্ট বিব্রতবোধ করেন, কারণ তার সামনের পাটির দাঁতগুলো খোয়া গেছে। আমার মা এবং আমি বাবার এই অবস্থাটা বুঝতে পারি, কিন্তু অন্যরা সেটা বুঝতে ব্যর্থ। তারা ভেবে নেন যেহেতু বাবা একজন ভিনদেশি তিনি হয়ত এদেশীয় ভাষাটা জানেন না। এমনকি অনেক সময় কেউ কেউ বাবাকে বাকপ্রতিবন্ধীও ভাবেন।

বাগানের নাশপাতি, লাল আপেল যখন বেশ পেকে যায় তখন আমরা সেগুলো বেশ পাতলা, প্রায় স্বচ্ছ টুকরোয় কেটে বাবাকে খেতে দেই যেন তিনি ফলগুলোর স্বাদ নিতে পারেন।

তাঁর এক স্বদেশির মাধ্যমে বাবা এই নির্জন গ্রামের চাকরিটার সন্ধান পান। গ্রামাঞ্চল সম্পর্কে তাঁর তেমন জানাশোনা ছিল না। তিনি সব সময়ই শহরে থেকে এসেছেন। তা সত্ত্বেও এখানে চাকরি নেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল মুখ না খুলেও তিনি এখানে বসবাস এবং কাজ করতে পারবেন। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তিনি মোটেও ভীত নন। তাঁর পছন্দ চাষবাস এবং পশুপালন। এই অচেনা জায়গাতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, এবং এই পরিবেশটা তাঁকে নানান ঝক্কি থেকে রক্ষা করে।

আমাকে স্কুল নিয়ে যাওয়ার পথে বাবা অনেক কথা বলেন। বাবা সব সময় প্রায় একই কথা বলেন: যে তিনি তাঁর জীবনে কিছুই করতে পারেননি। এখন তাঁর একটাই চাওয়া আমি যেন ভালোভাবে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করি, কলেজে যাই এবং তারপর তাঁদের ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই।

পরদিন, বেশ একটু বেলা করে অতিথি ভদ্রলোক গাড়িতে মালপত্তর বোঝাই করতে শুরু করেন।

এ কয়দিনে ওরা চারজন রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ হয়ে গেছে, এ অঞ্চলের প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে একদম। ওদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এখান থেকে চলে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সকালের নাস্তার টেবিলে বলেছেন আগামী বছর তারা আবার এখানে ফিরে আসতে চান। বিদায়কালে প্রায় সব অতিথিই ঠিক এমনটাই বলেন। খুব কমসংখ্যকই কথার বিশ্বস্ততা রাখতে ঠিকই আবার ফিরে আসেন, বেশিরভাগের জন্য একবারই যথেষ্ট।

বেরোনোর আগে, ভদ্রমহিলা আমাকে ফ্রিজে রাখা জিনিসগুলো দেখান যা তারা শহরে ফিরিয়ে নিতে চান না। তিনি আমাকে বলেন, এই বাড়িটার উপর তার বেশ মায়া জন্মে গেছে, ইতিমধ্যেই তিনি বাড়িটাকে মিস করা শুরু করেছেন। যখন তার মন ভার হবে কিংবা কাজের চাপে জেরবার হয়ে পড়বেন তখন হয়ত তিনি এই নির্জন গ্রামীণ পরিবেশের বিশুদ্ধ বাতাস, পাহাড়, নির্মল মেঘ, সূর্যাস্তের গনগনে আকাশের কথা মনে করে চাপমুক্ত হবেন।

পরিবারটি যেন নিরাপদে ফিরে যায় সে শুভকামনাসহ তাদের বিদায় জানাই। ওদের গাড়িটি আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর আগামিকাল সকালে নতুন যে অতিথি পরিবার এখানে আসবে তাদের জন্য অতিথিশালা বাড়িটিকে পরিচ্ছন্ন করার কাজে মন দেই। বিছানাগুলো পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখি। মেয়েদুটোর ছন্নছাড়া করে রেখে যাওয়া ঘরটা সুন্দর করে গোছগাছ করি। মেঝেতে তাদের মেরে যাওয়া মাছিগুলো ঝাড়ু দিয়ে ফেলে দেই।

কিছু কিছু জিনিস ফেলে গেছে ওরা। হয়তো ভুলে, হয়তো ইচ্ছে করে, হয়তো তাদের দরকার নেই বলে। জিনিসগুলো আমি যত্ন করে তুলে রাখলাম। মেয়ে দুটির আঁকা ছবি, সৈকত থেকে কুড়িয়ে নেওয়া ঝিনুক, সুগন্ধী শাওয়ার জেলের প্রায় নিঃশেষিত টিউব, মলিন বাজারের ফর্দ, কয়েক পাতা কাগজ সমেত একটা ছোট খাতা যেখানে তাদের মা আমাদের সম্পর্কে লিখেছিলেন। ফেলে যাওয়া জিনিসগুলো এই নির্জন বনভূমিতে কেমন একটা মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে…

 


মূল গল্প: The Boundary

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...