পায়েল চ্যাটার্জি
একটা ঝুপ ঝুপ শব্দ। ঘুম ভেঙে গেল। অন্তরাত্মার অবস্থা তখন ভয় ও বিস্ময় মিশিয়ে জটায়ুর মত। ‘হাইলি সাসপিশাস’। তবে কি সেই অতৃপ্ত প্রেমিকের আত্মা! ধুর! লেপচাজগতের ‘পাখরিন হোম স্টে’তে পৌঁছে এদিকওদিক থেকে দু-এক কথা কানে এসেছিল বটে। ‘হোম স্টে’র আশেপাশের গা ছমছমে পরিবেশ দেখে কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেছিল। ছোটবেলায় ঠাকুমার শোনানো অশরীরীদের গল্পের মতন। হয়তো সত্যি নয়। তাও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করত। রহস্যের লোভে। ঝুপ ঝুপ শব্দটা বেড়েই চলেছে। সাহস করে নিজের ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি একটা ক্ষুধার্ত বেড়াল হোম স্টে-র ছাদে আস্ফালন করছে। কোথায় অ্যাডভেঞ্চার! সে গুড়ে বালি। অগত্যা ঘুমের সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব পাতালাম।
আমরা কেজো, শহুরে মানুষরা ব্যস্ততা, অ্যাসাইনমেন্ট, অ্যাচিভমেন্ট-এর কাটাকুটি খেলায় কোণঠাসা হয়ে পড়লে প্রকৃতির কোলে ছুটে আসি। অক্সিজেনের লোভে। মনের অক্সিজেন। পাহাড়। মনের ভেতর চলতে থাকা নানা অনুভূতির লুকোচুরি খেলা। মেঘের আড়াল থেকে রোদের ঝিলিকের মত। পাহাড়ের চূড়া দেখে সেই সব রোদ স্পষ্ট হয়। লেপচাজগতে পাহাড়ের কোলে ‘পাখরিন হোম স্টে’। গুরং দা। তিনদিন ধরে ওঁকে এই নামেই ডেকেছিলাম। পাখরিন হোম স্টে-র রান্নাঘরে গুরুং দা ও তাঁর সঙ্গীদের সারল্য মাখানো গল্পের মাঝেই শুনেছিলাম প্রেম, অলৌকিকতার উপাখ্যান। এই হোম স্টে-র অনতিদূরেই ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকত লামা। সুকিয়ারানি। ওদের পড়শি। ভালোবাসা। সুকিয়ার বাড়ির অমতে বিয়ে নাকি সম্ভব হয়নি। তারপর কোন এক জটিল রোগে লামা মারা যায়। সুকিয়ার বিয়ে হয়ে যায় সময়মত। সেই অতৃপ্ত আত্মার মিথ। কুসংস্কারমুক্ত চিন্তাভাবনা সঙ্গে থাকার পরেও ওদের কথাগুলো অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনি। আমাদের চারপাশের ‘নো গ্যারান্টি ফুল রিস্ক’ওয়ালা প্রেমের গল্পে, এই কাহিনি যেন সবুজে মাখানো। সত্যতা বিচারের ঊর্ধ্বে।
লেপচাজগত সবুজে মেশানো পাহাড়ি জায়গা। পাহাড় মানেই অ্যাডভেঞ্চার আমার কাছে। ‘লামার বাড়ি ওই দিকে আছে’। অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ। গুরুংদার থেকে পথ জেনে এগিয়ে গেলাম একদিন বিকেলে। কাঠ। পাথর। নির্মীয়মান কোনও দোকান। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে টুরিস্ট। লামার জনশ্রুতি জীবন ও জীবিকার সঙ্গে মিশে গেছে। ওখানেই মুন্নুর সঙ্গে আলাপ। পাথর নিয়ে খেলছিল। পাহাড়ি ঝরনা। মিষ্টি মেয়ে। ও ইউটিউব জানে না। কার্টুন দেখেনি। সোশ্যাল মিডিয়া জানে না। তাই হয়তো আনসোশ্যাল নয়। স্কুলে যায়। দুই কিলোমিটার দূরে। হেঁটে হেঁটে যায় পাহাড়ি রোদ আর মেঘ গায়ে মেখে। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড লাল ঝুঁটিওয়ালা মুরগিটা। মুন্নুদের বাড়ি থেকে আমাদের হোম স্টে বেশি দূরে নয়। মুন্নুর বাবা রান্না করে আমাদের হোম স্টে-তে। ওদের চায়ের দোকান আছে। মুন্নু চারিদিকে দৌড়ে বেড়ায়। ‘উচ্ছ্বল জলধিতরঙ্গ’।
হোম স্টে-র বাইরের রাস্তা ধরে বেরিয়েছি। ভোরবেলা। অলক্ষ্যের উদ্দেশ্যে। জামায় আলগা একটা টান। মুন্নু। সঙ্গে আরেকজন। ওর থেকে একটু বড় হবে। গুক্কি। আমার হাতে ক্যামেরা দেখে দুজনে এগিয়ে এসেছে। ‘ফোটো তুলব’। আবদার। ওরা পোজ জানে না। তবে ট্যুরিস্টরা কেমন করে নিজেদের ছবি তোলে তা শিখে নিয়েছে। পাহাড়ি সারল্য। নিষ্পাপ হাসি। প্রকৃতির কোলে বড় হওয়ার সুখানুভূতি ওদের চোখে মুখে স্পষ্ট। আমার খুব হাসতে ইচ্ছে করছিল। ওদের মত। অন্তরের আনন্দের বহিঃপ্রকাশের ভাষা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। প্রতিযোগিতা, হিংসে আর ইঁদুরদৌড়যুক্ত পরিবেশ সঙ্গী আমার। হাসতে গিয়ে দেখলাম দন্ত বিকশিত করে যা আসছে তা বড় মেকি। বৃথাই চেষ্টা। ছবি তুলে আমার ক্যামেরা থেকে ছবিগুলো ওদের দেখালাম। ওদের চকচকে চোখ। ওদের সোশ্যাল মিডিয়া নেই। তাতে ওদের ভাগে আনন্দ কিছু কম পড়ে না। ছবিগুলো ওদের পৌঁছে দেওয়ার অপারগতা বুঝিয়ে বলতেও ওদের চোখেমুখে আনন্দের কোনও পরিবর্তন হল না। ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্তেই জীবনের পরশপাথর খুঁজে নিতে পারে ওরা।
ওদের সঙ্গে নিয়েই লেপচাজগত ভিউ পয়েন্টে পৌঁছলাম। হোম স্টে থেকে সোজা রাস্তা ধরে এগিয়ে একটা মাঠ পেরিয়ে ভিউ পয়েন্ট। তখনও সূর্যের আলো পাহাড়ের কোলে পৌঁছয়নি। মেঘাচ্ছন্ন প্রকৃতিই লেপচাজগতের বৈশিষ্ট্য। কুয়াশায় ঘেরা থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনের চোরাকুঠুরিতে লুকিয়ে থাকা গোপন কথাগুলোর সঙ্গে পরিচয় হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম কত শব্দ জমে আছে যা কথা হয়ে প্রকাশ পায়নি। ‘দিদি এখানে অনেক জুকা আছে।’ মুন্নুর ডাকে সম্বিত ফিরল। জুকা মানে জোঁক। লেপচাজগতের স্থানীয় ভাষা নেপালি। ‘তোরা আছিস তো, চিন্তা কী!’ নিজের অজান্তেই যেন কথাগুলো বেরিয়ে এল। একদিন আগে আলাপ হওয়া এই বালিকার উপর নিজের সকল চিন্তার ভার অর্পণ করতে পারলে বেশ হত বোধহয়। জীবন। বড্ড ভারী। মুন্নু প্রকৃতির সমার্থক।
এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি ঢালে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। মুন্নু আর গুক্কি অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। মেঘ আস্তে আস্তে সরতে শুরু করছে। পাহাড় সেজে উঠছে। সূর্যের আলোয়। সেই সাজ দেখার জন্য পাহাড়ি ঢালে খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। অ্যাডভেঞ্চারের লোভে একটু নিচের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল জীবনের প্রতিচ্ছবি। সুবিস্তৃত একটা খেলার মাঠ। কয়েকজন ছেলে সেখানে ফুটবল খেলছে। হই-হুল্লোড়। কী সহজ, সাবলীল। ওদের উপস্থিতি আনন্দের খোরাক জোগাচ্ছে। আনন্দ খুঁজে পাওয়ার জন্য কোনও উদ্দীপকের প্রয়োজন হচ্ছে না। ওরা নিয়ম মেনে ফ্রিকিক, গোল করার চেষ্টা করছে না। অবিন্যস্তভাবে দৌড়াদৌড়ি করছে মাঠ জুড়ে। শৃঙ্খলাহীনভাবে বলটা নিয়ে এদিক ওদিক করছে। সময়, নিয়মানুবর্তিতার শৃঙ্খলে বেঁধে যাওয়ার ভয় নেই। ব্যস্ততা নেই। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে ছুটে চলা নেই। ঠিক যেন সময় এগিয়ে চলেছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমিও এগিয়ে গেলাম। ভিউ পয়েন্টের দিকে। খানিকটা এগিয়েই ভিউ পয়েন্ট। মুন্নু বসে আছে দোলনায়। গুক্কি দোলা দিচ্ছে। জীবন হাসছে। লেপচাজগতের এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকা শুকমায়া তামাং-এর স্মৃতিফলক ঘিরেই এই ভিউ পয়েন্ট। শুকমায়া তামাং এখানে প্রথম স্কুল তৈরি করেছিলেন। ভিউ পয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তা ট্যুরিস্টদের জন্য নিশান-পতাকা লাগানো। রাস্তা হারিয়ে না ফেলার ব্যবস্থা। ২০১৬ সালে তৈরি হয়েছে এই ভিউ পয়েন্ট। আমাদের পর্যটনকে কেন্দ্র করেই মুন্নু, গুক্কিদের জীবন। তাকে আরেকটু সুনিশ্চিত করতে ভিউ পয়েন্টটি তৈরি করে পর্যটকদের আকর্ষণ করার প্রচেষ্টা। ওই হাঁটা পথেই জীবনের রাস্তা খোঁজার আলো।
ভিউ পয়েন্ট থেকে ফেরার পথে সময় কম লাগল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামা। কিন্তু খুব ক্লান্তি অনুভব করছিলাম। কিসের ক্লান্তি! নিয়ম, বাঁধন এসবের ভারী পাথর আবার ফিরে গিয়ে বইতে হবে। তার অবসন্নতা। পা দুটো চলতে চাইছিল না। ‘দিদি জুকা লেগেছে’। গুক্কির চিৎকার। আমার হাতে পায়ে জোঁক। মুন্নু ওদের বাড়ি নিয়ে গেল। হাত-পা জোঁকমুক্ত করলাম। জোঁকে ধরলে নাকি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। এমনটাই প্রচলিত আছে ওখানে। লেপচাজগতে দুধ ও ভুট্টা দিয়ে এক ধরনের লজেন্স তৈরি হয়। তারপর দার্জিলিং সহ নানা জায়গায় টুরিস্টের হাতে পৌঁছে যায়। মুন্নুরাও বাড়িতে ওই লজেন্স তৈরি করে। অবসন্নতা ঝেড়ে ফেলে ওদের বাড়ি থেকে যখন বেরোলাম, মুন্নুর তৈরি করা ওই লজেন্স তখন আমার হাতে। দরজায় মুন্নু আর গুক্কি দাঁড়িয়ে। ওদের চোখ দুটো চিকচিক করছে। সূর্যের আলোয়। জীবনের আলোয়। আমায় ফিরতে হবে। পরাধীনতার কাছে। নিয়মানুবর্তিতার কাছে। সীমাবদ্ধতার শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলতে হবে নিজেকে। এগিয়ে চললাম।
লেখার ভেতরের ছবি: লেখক, হেডার ছবি: আত্রেয়ী কর