পড়গুম্মি সাইনাথ
পড়গুম্মি সাইনাথ সাংবাদিক, দ্য হিন্দু-র প্রাক্তন গ্রামীণ-বিষয়ক সম্পাদক এবং পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। নয়া কৃষি বিলগুলির প্রেক্ষিতে তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য ওয়ার-এর মিতালি মুখার্জি, যেটি গত ২৩শে সেপ্টেম্বর দ্য ওয়ার-এর ইউটিউব চ্যানেলে এবং ওয়েব সংস্করণে প্রকাশিত হয়। সেই সাক্ষাৎকারটিরই বাংলা অনুবাদ চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই অক্টোবর ২০২০-র মেল ট্রেনে প্রকাশ করা হল। সাক্ষাৎকারটির ইউটিউব ভিডিও নিচে দিয়ে দেওয়া হল।
প্রথমেই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে আসার জন্য ধন্যবাদ জানাই, সাইনাথ। তা, আমরা দুটো ঝোড়ো দিন পার করলাম। হ্যাঁ, স্পষ্টতই আমি তিনটি কৃষি বিলের কথা বলছি, যার মধ্যে দুটি ইতিমধ্যে রাজ্যসভায় পাশ-ও হয়ে গেল। আমরা এই বিলগুলিরই মূল বিষয়গুলি নিয়ে আজ আলোচনা করব। বিশেষত এই কারণে, যে আমরা দেখছি অনেকেই এরকম রয়েছেন যাঁরা মনে করছেন এই বিলগুলিতে অসুবিধার সেরকম কোনও বিষয় নেই। তা, আমরা শুরু করি প্রথম বিলটি অর্থাৎ ‘ফার্মারস’ প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স অর্ডিনান্স’-টি দিয়ে, যেটিকে অনেকেই বলছেন ‘এপিএমসি (এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেট কমিটি) বাইপাস অর্ডিন্যান্স’! তা কৃষিজীবীদের জন্য এই বিলটিতে সমস্যার জায়গা কোনগুলি সেগুলি যদি আপনি একটু আমাদের দর্শকদের ব্যাখ্যা করেন…
হ্যাঁ, এগুলির অর্থ কী এবং এগুলির ভিত্তিই বা কী সে নিয়েই আলোচনা করা যাক। সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রথমত এই বিলগুলিতে এপিএমসি-কে যত নষ্টের গোড়া হিসেবে হাজির করা হচ্ছে এবং দেখানো হচ্ছে যে এই বিলগুলি দিয়ে এপিএমসি-র সেই মৌরসিপাট্টা ভাঙার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর ওই যে বললেন, অনেকেই বিলগুলির পক্ষে কথা বলছেন, তা তাঁদের কথায় খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কি কোনও প্রয়োজন আছে? আজ যাঁরা এই বিলগুলির পক্ষে বলছেন আমি কিন্তু সেই একই লোকগুলিকে নোটবন্দির পক্ষেও বলতে শুনেছিলাম, যার মাস ছয়েক পরেই তাঁরা ঢোক গিলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
তাহলে আমরা এমন একটি বিল পাচ্ছি যা নাকি এপিএমসি-র একচেটিয়া রাজত্বের দাসত্ববন্ধন থেকে কৃষককে মুক্তি দিচ্ছে, তাই তো? তো তার সঙ্গেই আসছে চুক্তিচাষ সংক্রান্ত বিল। যেখানে চুক্তি লিখিত করার বাধ্যবাধকতা রাখা হচ্ছে না, বরং সেটা স্ব-আরোপিত করার কথা বলা হচ্ছে। আর যে তৃতীয় বিলটি— সেটি তো স্রেফ মজুত করার ঊর্ধ্বসীমা উঠিয়ে দিয়ে মজুতদারিকে আইনি করার একটি ব্যবস্থাপত্র মাত্র।
এখন এই প্রথম যে কথাটা— এপিএমসি সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে— মানে এর চেয়ে বড় বোকা বোকা কথা বোধহয় আর কিছু হয় না। আমাদের দেশের কৃষিপণ্য এবং কৃষিজ জিনিসের বেচাকেনার বেশিরভাগটাই হয় এপিএমসির নাগালের বাইরে। অধিকাংশ কৃষক— এখন অঞ্চলভেদে এঁদের সংখ্যার কিছু তারতম্য হতে পারে, কিন্তু সেটা যে একটা ব্যাপক অংশ তাতে কোনও সন্দেহ নেই— নিজেদের জমিতেই নিজেদের উৎপন্ন ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। কারণ, তাদের আগেই ‘চুক্তি’ করা থাকে— অলিখিত চুক্তি— সাহুকারদের সঙ্গে, দালালদের সঙ্গে, বড় মহাজনদের সঙ্গে। তাঁরা তো এমনকি এটা কখনও টেরই পান না যে এপিএমসি-তে গেলে তাঁদের ফসলের কত দাম (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য — এমএসপি) পেতে পারতেন।
ফলে বস্তুত, এই এগ্রিমেন্ট বা এই আইনগুলি দিয়ে আমরা সেই বাস্তবতা তৈরি করতে চলেছি যাতে বেসরকারি পুঁজির একচেটিয়া আগ্রাসনের পথ সুগম হয়। যদি এরকমটাও হত যে, কৃষিপণ্য লেনদেনের ৯৮ শতাংশই এপিএমসিতে হচ্ছে এবং সেটা ভাঙতে চাওয়া হচ্ছে— তাও তার একটা অর্থ হত। একবার খোঁজ করে দেখুন না কত শতাংশ কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করতে পারেন, সেই দামে ফসল বিক্রি করার ক্ষমতা তাঁদের কতজনের রয়েছে? কৃষকরা যে ঋণচক্রে জর্জরিত থাকেন, সরকার কি সেটা ভাঙতে পারবে? যে সমস্ত মুনাফাখোররা কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্তণ করে, সরকার কি তাদের এই নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে পারবে? এটা একটা জ্বলন্ত সত্য, যে কৃষক তাঁর নিজের উৎপাদিত ফসলের দাম স্থির করেন না।
এবার এই বিষয়টা অন্য সেক্টরগুলির চেয়ে আলাদা কিছু নয়। ১৯৯১ থেকেই এই আগ্রাসন নানাভাবে আসতে শুরু করেছে। সেটা যদি এখনও অব্দি কৃষিতে পুরোপুরি থাবা গাড়তে না পারে তবে তার জন্য দায়ী কৃষকদের প্রতিরোধ। আবার মজাটা দেখুন— কৃষকরা এখন আবার প্রতিরোধে নামছেন তার বিরুদ্ধে, যাকে নাকি দাবি করা হচ্ছে তাঁদের জন্য এত ভালো জিনিস আগে কখনও হয়নি বলে! যাকগে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
তৃতীয়ত, এটি কোনও নতুন জিনিস নয়— আগেও হয়েছে। এই যে আমি এখন মহারাষ্ট্রে বসে আছি, ভাসি এপিএমসি এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। কংগ্রেস সরকার সেখানে কয়েক বছর আগেই একই জিনিস চালু করেছে। এখন এই যে এপিএমসি-দের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাদের ডানা ছাঁটা— এর কারণটা কী? কারণ, যা বলা হচ্ছে, এতে প্রচুর বেসরকারি লগ্নি আসবে, বেসরকারি বাজার খুলে যাবে, প্রতিযোগিতা বাড়বে। ভারতীয় কর্পোরেটরা কোনও প্রতিযোগিতার ধারণা একদমই পছন্দ করে না। যখন সরকারের থেকে তারা কোনও সরকারি সম্পত্তি হস্তগত করে, তখনও তাদের চাহিদা থাকে সেগুলি যেন একদম আমাজনকে দিয়ে তাদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেওয়া হয়।
ফলে, ভাসিতে কিছুই হল না। আমরা একটা মডেল এপিএমসি খুললাম, কিন্তু তাতে কি-ছু-ই হল না। বেসরকারি বাজারের কোনও বাড়বাড়ন্ত দেখা গেল না। বিহারকে একটা উদাহরণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু সেখানে এখনও এই আইন প্রয়োগই হয়নি। বেসরকারি বাজার বাড়ছে, ফলে চাষি বেশি দাম পাচ্ছেন ফসলের— এমন ঘটনাও কোথাও হয়নি। কেরলে কোনওদিনই কোনও এপিএমসি ছিল না। কিন্তু সেখানে কোনও বেসরকারি বাজারও নেই। বেসরকারি বাজার বলতে আমি বড় কোনও কর্পোরেট চেনের কথা বলছি যাকে আমরা এপিএমসির বিকল্প ভাবতে পারি।
সরি, ওই এপিএমসি নিয়েই একটা কথা বলতে চাইছিলাম… যাই হোক, আপনি বলুন…
অন্য জিনিসটা হলে ফসলের ভালো দাম পাওয়ার লোভ দেখানো। আমি খুব জোর দিয়ে বলছি যে, কি আদর্শগতভাবে, কি দার্শনিকভাবে গ দুই দশকে এর চেয়ে জঘন্য ধারণা আর কিছু আসেনি। তার সঙ্গে এটাও যোগ করে নিন— ‘খোলা বাজার মানেই স্বাধীনতা, দরিদ্রতম নাগরিকদের রাষ্ট্র সাহায্য করার আসল অর্থ ক্রীতদাসত্ব।’ ‘খোলা বাজার মানে স্বাধীনতা’— হাঃ! স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই পলিসি কেমন কাজ করেছে দেখা যাক একবার। এই অতিমারিতে আমরা এই গ্রহের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দেশ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন ৯০ থেকে ৯৮ হাজার কেস পাওয়া যাচ্ছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়েছে—এবং এই সব পরিসংখ্যানের মধ্যেই যে ভেজাল আছে সে-ও সবাই জানে। র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট ত্রুটিপূর্ণ— আরটি-পিসিআর টেস্টের সঙ্গে এর সংখ্যা মেলে না। আমি এই মুম্বাইতে বসে আছে—এখান থেকে পাঁচ মিনিট ড্রাইভ করলে আমি তিনটে ফাইভ স্টার হসপিটাল পাব। যেখানে কোথাও ৬৫০০ টাকার নিচে কোভিড টেস্ট হয় না। সঠিক সংখ্যাটা মনে হয় ১০০০০-এর আশেপাশে। এই হচ্ছে কর্পোরেট পরিষেবা।
আর এই কর্পোরেট সেক্টরেই আমরা আমাদের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সমস্ত জিনিসগুলিকে মুক্ত করেছি, স্বাধীনতা দিয়েছি— নাকি? শেষ বাজেটে এই সরকার— হ্যাঁ, এই সরকারই— জেলাস্তরের হাসপাতালগুলিতে বেসরকারি পুঁজি আহ্বান করেছে। এবার তোমার দেশের জনসাধারণ চরম দারিদ্রে দিন কাটান, খুবই বিপজ্জনক, দুর্বল অবস্থায় বাস করেন। সেই বাস্তবতাকে মাথায় না রেখে তুমি পরিষ্কার আমেরিকাকে নকল করতে চাইছ!
তাহলে এই হচ্ছে ‘খোলা বাজারের স্বাধীনতা দেওয়া’র ধারণা! এবার আমরা যদি আয়ারল্যান্ড, স্পেনের মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির দিকে তাকাই— এই অতিমারির এক সপ্তাহের মধ্যে তারা স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সমস্ত কিছুকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। সমস্ত কিছু! আর আমরা কী করলাম? দিল্লি সরকারের কর্পোরেট সেক্টরকে খালি যত বেশি সম্ভব বেড তারা যেন এই অতিমারির জন্য বরাদ্দ রাখে সেটুকু অনুরোধ করতেই দু মাস সময় লাগল। এর পরেই মহারাষ্ট্র সরকার জানায় যে ৮০ শতাংশ বেড এই রোগের জন্য রাখা উচিত। এই হচ্ছে তফাত!
ফলে, সরকার আদৌ কিছু নজর করছে না। যে দর্শন থেকে তারা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে চালিত হয়েছে, এই কৃষিক্ষেত্রেও তাদের দর্শন একই। এবং সেই একই দর্শন এবার শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হবে।
সাইনাথ, এপিএমসি-র পয়েন্টটা আমরা একটু শেষ করে নিই। কারণ, আমার মনে হচ্ছে এর ফলাফল বা পরিণতিটা কৃষকরা ঠিক বুঝতে পারছেন না। তো, আপনি যেগুলি দেখালেন, প্রথমত— মুষ্টিমেয় বড় কর্পোরেটদের বাজারটাকে একচেটিয়া করে ফেলার ভয় থাকছে, যার ফলে ফসলের দাম অনেকটাই কমে যাবে। এখন কৃষকরা সেটা বুঝতে পারছেন না এক্ষুণি। আর দ্বিতীয় আপনি যেটা বললেন, বিহারের অভিজ্ঞতা থেকে, যে সেখানে বেসরকারি মান্ডি থাকলেও তাতে ফসলের দাম সুস্থিত হওয়ার বদলে দাম নিয়ে এক চূড়ান্ত অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে কৃষক দ্বিমুখী আক্রমণের মুখোমুখি এটা আমরা বলতে পারি…
এই শেষ মাসে মহারাষ্ট্রের কিছু জিনিস দেখা যাক, যেগুলি পুরোপুরি এপিএমসি-র বাইরে ঘটেছে। ধরা যাক, দুগ্ধব্যবসায়ের কথা। এই দুধের ক্রেতারা কিন্তু সবটাই বেসরকারি। সরকারি ক্রেতা হয়তো একটা আছে, কিন্তু বেসরকারি ক্রেতারাই মূল খরিদটা করে থাকে। অতিমারির শুরুতে আমরা মুম্বাইয়ের যে এলাকায় থাকি, সেখানে গরুর দুধ ৪৮ টাকা এবং মোষের দুধ ৬০ টাকা পর্যন্ত লিটার কিনেছি।
এবার এই গরুর দুধের লিটারপ্রতি ৪৮ টাকার মধ্যে মহারাষ্ট্রের একজন দুগ্ধ-উৎপাদনকারী কৃষক পান ৩০ টাকা— চূড়ান্ত ৪৮ টাকা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ৩০ টাকা। এবং এই ৩০ টাকাও অর্জন করার জন্য ২০১৮-১৯ তাঁদের রীতিমতো রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করতে হয়েছে। এবার লকডাউন শুরু হওয়ার এক মাস পরের পরিস্থিতি দেখুন। আমরা কিন্তু এখনও গরু আর মোষের দুধের জন্য সেই ৪৮ আর ৬০ টাকা দামই দিচ্ছি লিটারপিছু। কিন্তু এপ্রিল থেকে কৃষক লিটারপিছু ১৭ টাকা করে পাচ্ছেন, যেটা তিনি এই অতিমারির আগে ৩০ টাকা করে পেতেন।
এখানে কোন এপিএমসি কৃষককে বন্দি করে রাখল? কোন এপিএমসি দাম কমিয়ে দিল? হ্যাঁ, এপিএমসিগুলিতে প্রচুর কাঠামোগত গলদ আছে— কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু এই যে লেনদেনের গল্পটা আমি বললাম, যেটা পুরোটাই হল বেসরকারি ক্ষেত্রে, সেখানে কৃষকের মোটামুটি ৫০ শতাংশ— ঠিক করে বললে ওই ৪৫ শতাংশ হবে— আয় নষ্ট হল। টিভিতে হয়তো দেখে থাকবেন— যদিও আগস্ট মাসে কৃষকদের এই রাস্তায় দুধ ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ জানানোর ঘটনা খুব অল্প চ্যানেলই কভার করেছে। তাহলে আমাকে বলুন, এখানে এপিএমসিকে ভিলেন কীভাবে ঠাওরানো যাবে? দ্বিতীয়ত, আবারও বলি, আমি যখন বলছি এখানে লেনদেনের বড় অংশটাই ঘটে এপিএমসির আওতার বাইরে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হবে—কেন? এপিএমসি আছে তো! সত্যিই! আছে তো! যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি স্কুল আছে! তুমি তাদের উন্নতির জন্য কিছুই করছ না, তোমার যাবতীয় কাজকর্মই শিক্ষাক্ষেত্রে যাতে বেসরকারি পুঁজি ঢোকার পথ সুগম হয় সেই লক্ষ্যে, ফলে এখন আমাদের বাচ্চারা কোন অবস্থায় যাচ্ছে সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। আমরা আগে ডিজিটাল ভাগ (ডিভাইড)-এর কথা বলতাম, এখন তো ডিজিটাল বিভাজন (পার্টিশন)-এর কথা বলতে হবে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের গরীব ছেলেমেয়েরা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমি আবারও বলছি, গত ২৮ বছর ধরে যে দর্শন আমাদের রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি, এই কৃষি বিলগুলিও তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আবারও শিক্ষাক্ষেত্রে আসি। গত কয়েক মাসে বাইজু নামক কর্পোরেট সংস্থাটির মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ৫৫০ কোটি টাকা থেকে ১০৫০ কোটি টাকা, গত ১২ মাসে, যার অধিকাংশটাই এই অতিমারির সময়কালে।
এবার, আমরা যদি বিশেষ করে স্কুলছাত্রীদের কথা ভাবি, দেশের ১৫ বছরের নিচে কটা মেয়ের নিজের স্মার্টফোন আছে? আপনার বাংলার কথাই আমি বলতে পারি— এরকম মেয়ের আদৌ অস্তিত্বই নেই। মহারাষ্ট্রের মেয়েদের কথা বলতে গেলে, তারা তাদের ১৭ বছরের দাদার জন্য অপেক্ষা করে, যে কিনা ইটভাটা থেকে হয়তো সাপ্তাহিক ছুটিতে শনি বা রবিবার বাড়ি আসবে, এবং তখন সে তার ফোনটা নিয়ে পিডিএফগুলি ডাউনলোড করবে। শুধু স্মার্টফোনই হলেই হল না, তাদের বেশি দামী প্যাকেজও নিতে হবে। কারণ সবচেয়ে সস্তার যে প্যাকেজটা তারা সাধারণভাবে ব্যবহার করে সেটা হল মাসিক ২০০ টাকায় দৈনিক ২ জিবি ডেটা। এখন যদি তারা তাদের সব টেক্সট বই, পিডিএফ, ক্লাসের নোট সমস্ত কিছু ডাউনলোড করতে চায় তবে অবধারিতভাবেই এই প্যাকেজে চলবে না— বেশি দামের প্যাকেজ নিতে হবে। আর সেটা কোন সময়? যখন পরিবারের কারও কোনও কাজ নেই!
তাহলে, যে কর্পোরেট সেক্টর আমাদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাক্ষেত্রে এই ভয়ানক অবস্থার মধ্যে ফেলেছে, সে কেমন করে কৃষিক্ষেত্রে একটা ভালহাল্লা বা সাংগ্রি-লা নিয়ে আসবে?
এবার আমরা দ্বিতীয় পয়েন্টের দিকে যাই সাইনাথ, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি)-এর ইস্যুটি, যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অন রেকর্ড বলেছেন যে সরকার এখনও একটা এমএসপি দেবে, কিন্তু একমাত্র সরকারই সেটা দেবে। আমি এই বিষয়টির সঙ্গে একটা ডেটার দিকেও আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব— আপনি অবশ্যই জানেন— শান্তা কুমার কমিটি বলেছিল ভারতে ৬ শতাংশেরও কম কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করতে পারেন। তাহলে আমরা কি এটা বলতে পারি যে এই এমএসপি-র ঘটনাটিই গোটা পাঞ্জাব এবং হরিয়ানাকে আজ রাস্তায় টেনে নামিয়েছে?
না না। এটা হয়তো তাৎক্ষণিক ইন্ধন জুগিয়েছে, কিন্তু এর পেছনে আরও অনেক কারণ আছে। কৃষকরা এপিএমসি এবং নিশ্চিত-করা দাম নিয়ে চিন্তিত। এখন মিতালি, দেখুন আপনি শান্তা কুমার কমিশনের কথা বললেন। কিন্তু শান্তা কুমার কমিশনের পরে আমরা স্বামীনাথন কমিশন নামে আরও একটি কমিশন পেয়েছি যেটি আরও বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক ছিল। কারণ এটি জনৈক মিঃ স্বামীনাথনের কমিশন ছিল না, এটি কৃষকদের জাতীয় কমিশন ছিল, যার সভাপতিত্ব করেছিলেন বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী ডঃ এমএস স্বামীনাথন।
এবার দ্রুত একবার প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীর দিকে দেখা যাক। গত ছ বছরের এমএসপির হিসেবটা দেখি আমরা। আমি যে এ নিয়ে কতবার কথা বলেছি…! যাই হোক, আমাদের দেখতে হবে সরকার এবং প্রতিষ্ঠান দুটিকেই, কারণ এখানে সরকার একা নয়। এবং আমরা দেখতে পাব তারা হিসেবটা করছে শুধু মিডিয়ার অবহেলা এবং মিডিয়াতে কায়েমি স্বার্থের ওপর ভর করে। আরও দুর্ভাগ্যজনক, যে হিসেবটা বেশ ভালোই করছে।
প্রকৃতপক্ষে ওরা করল কী? আমাদের তো কাউকে তার কৃতকর্ম অনুসারেই বিচার করতে হবে। ২০১৪-র নির্বাচনের আগে বিজেপি এবং এনডিএ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে বারো মাসের মধ্যে—কেউ কেউ তো এক মাসের মধ্যে বলেছিল—স্বামীনাথন কমিশনের সমস্ত সুপারিশ কার্যকর করবে। সুপারিশগুলির মধ্যে বিশেষ করে এমএসপি সংক্রান্ত স্বামীনাথন কমিশনের সূত্রায়ন: COP2+50%। কস্ট অফ প্রোডাকশন বা উৎপাদন-ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বামীনাথন কমিশন বেশ বিস্তৃত আকারে কাজ করেছিল। যাই হোক, বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে ১২ মাসের মধ্যে স্বামীনাথন কমিশনের উৎপাদন ব্যয় এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত সুপারিশ কার্যকর করবে।
তা তারা সেই ১২ মাসে কী করেছিল? তারা আদালতে একটা এফিডেবিট দাখিল করে জানিয়েছিল যে এটা বাস্তবসম্মত নয়, আমরা এটা করতে পারব না, কারণ এতে বাজার ধ্বসে পড়বে। ভেবে দেখুন— সেই একই লোকগুলো, যারা এই প্রতিশ্রুতি দিল যে তারা ক্ষমতায় এসে এটা কার্যকর করবে, দিয়ে প্রচুর কৃষকদের ভোট পেল, পেয়ে এসে আদালতে এফিডেবিট ফাইল করে বলল যে আমরা এটা করতে পারব না। কৃষকদের জীবন বিপর্যস্ত— সে তো হতেই পারে, কিন্তু বাজারকে বিপর্যস্ত করা কীভাবে সম্ভব!! সেটা একদমই সম্ভব নয়!! এটা ২০১৫।
২০১৬-তে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিং— ভালো কথা— এঁরা কি আদৌ এসব সিদ্ধান্ত নেন? ক্যাবিনেটের বেশিরভাগ মন্ত্রীকেই কেউ চেনে না—আপনি বলুন তো, কজন সম্পাদক বর্তমান কৃষিমন্ত্রীর নাম বলতে পারবেন এই মুহূর্তে? এর মধ্যে একদিন একটি বড় টিভি চ্যানেলে দেখলাম বিজেপি মুখপাত্র কৃষিমন্ত্রীর নাম বলতে পারলেন না। প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিং-এর নাম মনে করতে পারলেন কিন্তু [নরেন্দ্র সিং] তোমারের নাম বলতে পারলেন না! ঠিক আছে? বুঝতে পারছেন এঁরা রাজনৈতিক জগতে কতটা অপরিচিত, অপ্রাসঙ্গিক, অস্তিত্বহীন?
তাহলে, ২০১৪— “১২ মাসের মধ্যে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করব”; ২০১৫— “আমরা এটা করতে পারছি না, কারণ তাতে বাজারের স্থিতি নষ্ট হবে” বলে কোর্টে এফিডেবিট দাখিল; ২০১৬— রাধামোহন সিং বলছেন “আমরা এরকম কোনও প্রতিশ্রুতি দিইইনি”; ২০১৭— রাধামোহন সিং বলছেন “স্বামীনাথন কমিশনের কথা বাদ দিন, মধ্য প্রদেশের দিকে দেখুন। শিবরাজ সিং চৌহানের মডেল স্বামীনাথন ক্মিশনের চেয়ে ঢের ভালো।” এর পরে মধ্যপ্রদেশ নির্বাচনে কী হয়েছিল সেটা আমরা জানি, যাকগে, আমি আর সে সবের মধ্যে ঢুকব না। তবে একটা কথা বলি। এই সময়েই ওরা মধ্য প্রদেশ নিয়ে যাবতীয় ঢক্কানিনাদের মধ্যেই কারও একজনের— এক মহামান্য বুদ্ধিজীবীর, যিনি কিনা আরও অনেক কিছুর সঙ্গে মধ্য প্রদেশ মডেলেরও প্রশংসা করেছিলেন— বই প্রকাশ উপলক্ষে আইআইসি-তে একটি অনুষ্ঠান করেছিল। এটা সেই সপ্তাহেই যে সপ্তাহে মন্দৌসরে পাঁচজন কৃষককে গুলি করে মারা হয়।
২০১৮-১৯-এর বাজেট বক্তৃতায়—প্লিজ, অরুণ জেটলির সেই বাজেট বক্তৃতাটি একবার পড়ুন, পুরোটা না, শেষের ফিনান্স বিল বক্তৃতার ১৩ এবং ১৪ নম্বর প্যারাগ্রাফ দুটো একটু পড়ে দেখুন। আচ্ছা, আমি সময় বাঁচিয়ে দিচ্ছি। আরেকবার ক্রোনোলজিটা সাজাই। ’১৪: ১২ মাসের মধ্যে করছি; ’১৫: করতে পারব না; ’১৬: অপ্রাসঙ্গিক, এরকম কোনও প্রতিশ্রুতি দিই-ইনি; ’১৭: মধ্য প্রদেশ এর চেয়ে অনেক ভালো করছে; আর এই ’১৮-’১৯-এ এসে বাজেট বক্তৃতায় বলা হচ্ছে, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ ইতিমধ্যেই কার্যকর করা হয়ে গেছে! হ্যাঁ, আমি জেটলির বক্তৃতার শেষের ১৩ এবং ১৪ নম্বর প্যারাগ্রাফ থেকে উদ্ধৃত করছি— “আমরা রবিশস্যে এটি ইতিমধ্যেই কার্যকর করেছি, এবং খরিফ শস্যেও করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
এখন এই ২০২০-তে, সংসদ কক্ষে, আমাদের বর্তমান নামহীন কৃষিমন্ত্রী, তোমার, যাঁর নাম কোনও সম্পাদক এবং সঞ্চালক জানেন বলে মনে হচ্ছে না— এবং তাতে তাঁদের দোষও দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ তিনি এতটাই গুরুত্বহীন— তিনি বললেন, যখন চারিদিকে হইচই বেধে গেছে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, “আমরাই একমাত্র দল যারা স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশগুলির পক্ষে দাঁড়িয়েছি, সুপারিশগুলি কার্যকর করেছি। আমরাই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিয়েছি।”
২০১৭ থেকে যে চালাকিটা এখানে করা হচ্ছে সেটি হল উৎপাদন ব্যয়ের সংজ্ঞা নিয়ে। আসলে এটি নির্ধারণের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। যেমন ধরুন A2। এটি কেবলমাত্র আমদানি খরচই হিসেব করে। অর্থাৎ কীটনাশক, বীজ এবং সার কিনতে কত খরচ হল, সেইটা। আর একটি পদ্ধতি, এর চেয়ে কিছুটা ভালো— A2+FL— যাতে এ২-র সঙ্গে জমিতে শ্রমের খরচটাকেও (এফ-এল: ফার্ম লেবার) ধরা হয়। কিন্তু স্বামীনাথন কমিশন কখনওই এই দুটোর কোনওটির কথা বলেনি। বলেছিল COP2+50%-এর কথা, যেটি উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণের একটি অনেক বিস্তৃত মাপকাঠি। এতে শ্রম সহ সমস্ত অ-পৌনপুণিক (নন-রেকারিং) খরচ, জমির ভাড়া ইত্যাদি সবই ধরা হয়।
এখন A2 আর COP2+50%-এর তফাতটা জানেন? কুইন্টাল প্রতি ৮০০ টাকা! A2+FL-এর সঙ্গে কুইন্টাল প্রতি ৫০০ টাকা। এটাই সরকার আধাখেঁচড়াভাবে চালু করেছে, এবং তার ভিত্তিতেই জেটলির সেই বাজেট-বাগাড়ম্বর।
তাই আমি যেটা বলতে চাইছি, যে এই সব ছলচাতুরিই… হ্যাঁ এটা সত্যি, যে খুব সংখ্যক কৃষকই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্রহণ করতে পারেন। এই কারণেই আমি বারবার রেকর্ড চেক করতে বলি। শুধু সাংবাদিক হিসেবেই নয়, এমন একজন হিসেবে যে নেশন ফর ফার্মারস ফোরাম-এর একজন অংশগ্রহণকারী। বুঝে দেখুন তাঁদের কতরকম দাবি, কতরকম সমস্যা। যার অস্তিত্ব আছে তাকে তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না। দেখুন, এপিএমসি বা এমএসপি নিয়ে যেটা বলা হচ্ছে সেটা হল, “লোকটা ভুগছে… ওকে মেরে দাও!” লোকটাকে সুস্থ করার চেষ্টা নয়। এখন, কৃষকরা কী চান? তাঁরা ফসলের একটা নিশ্চিত দাম চান, স্থিরতা চান। তাই তো? এবার তাঁর ওপর কী চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? উন্মাদের মতো দোলাচল— দুধের দামের কথা ভাবুন— ১৩ দিনের মধ্যে ৩০ টাকা থেকে ১৭ টাকা— তাহলে এই এপিএমসি নিয়ে এত কথাবার্তার অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে?
তাহলে কী হতে পারে বলে আমরা ভাবতে পারি? দেখুন, সরকারের মনোভাব যে পুরোপুরি কর্পোরেটপন্থী সেটা পরিষ্কার। কিন্তু তারা যেভাবে চাইছে সব সেভাবে ঘটবে না। আমার মনে হচ্ছে ফড়ে-দালালদের আধিপত্য আরও বাড়বে। কারণ, অনেক কৃষকই যেটুকু সরকারি সহায়তা পেতেন, আর পাবেন না। যেসব কৃষকরা বেসরকারি লেনদেনই করতেন তাঁদের সংখ্যা আরও বাড়বে। যদি ভাসির উদাহরণটাই দেখা যায়, এটা পরিষ্কার, ভারতীয় কর্পোরেটদের প্লেটে করে সাজিয়ে না দিলে তারা কোনও কিছুতে ওরকম ঝাঁপিয়ে পড়বে না। ফলে শেষ অব্দি একটা চূড়ান্ত ডামাডোল এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে চলেছে বলে আমার মনে হচ্ছে।
এবং অতীতেও, সাইনাথ, আমার মনে হয়, সরকার সবসময় উপভোক্তাকে কৃষকের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। সেদিক থেকে, আমার মতে, সরকার এবং কৃষকের মধ্যে অবিশ্বাসের এক প্রতীক হিসেবে কাজ করছে এমএসপি। কিন্তু, আপনি যেমন বলেছেন, কৃষকেরা যে এই প্রথম প্রতিবাদে নামছেন তা নয়— আমরা তাঁদের মুম্বইয়ের রাস্তায় হাঁটতে দেখেছি, অথবা দুগ্ধ সংক্রান্ত সমস্যায় প্রতিবাদী হতে দেখেছি, এখন আমরা তাঁদের অনেক বেশি সংখ্যায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় নামতে দেখছি যা ক্রমশ দক্ষিণ ভারতেও ছড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু, খুব স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে, এখান থেকে কী পাওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? বৃহত্তর অংশের দিক থেকে ভাবলে, এই ঘটনাগুলিই বাস্তবায়িত হওয়ার দিকে যাবে এবং তৃতীয় বিলটিও বাস্তবায়িত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আপনি কি মনে করেন, সরকার বিষয়টি আবার নতুন করে ভেবে দেখবে? যেকোনও চুক্তির আইনের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, এরকম একটা পরামর্শ রয়েছে যে সরকার বিলে একটা লাইন ঢুকিয়ে দিক এই বলে যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য যেমন ছিল তেমন থাকবে। আপনি কি মনে করেন, এঁরা এক্ষেত্রে সেই পরামর্শই মানবেন, নাকি সেটা একদমই অসম্ভব বলে আপনার মনে হচ্ছে?
দেখুন, এই সরকার সবকিছুই বলপূর্বক সরলীকরণ করে দিতে বেশ পারদর্শী। তাই, সরকার ইচ্ছে করলে ইতোমধ্যেই প্রাইভেট মেম্বার বিল হিসেবে থাকা দুটো বিল খুব সহজেই পাশ করে নিতে পারে। যার একটি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট করা সংক্রান্ত এবং অন্যটি কৃষকদের ঋণমুক্ত করা সংক্রান্ত। সরকার কিন্তু পারে— যদি ইচ্ছে করে।
তবে মিতালি, আমি একটি সরলীকরণের সঙ্গে সহমত হব না যে সরকার সবসময় উপভোক্তাকে সমর্থন করে এসেছে। না, তা ঠিক না। আসলে সরকার কর্পোরেট বিশ্বকে সমর্থন করে আসছে। দয়া করে ভুলে যাবেন না, ১৪ কোটি ভারতীয় কৃষক— ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী যাঁদের মধ্যে সাড়ে ন কোটি পূর্ণ সময়ের কৃষক— তাঁরাও কিন্তু আসলে উপভোক্তাই। মিতালি, ভারতীয় কৃষকদের ৭০ শতাংশেরও বেশি অংশই বাজার থেকে খাদ্যশস্য ক্রয় করে আসছে।
অর্থাৎ, লোকজন যেরকম বলছে, খাদ্যের উচ্চ মূল্য নাকি কৃষকদের উপকারে আসবে, বাস্তব হল আদৌ এতে তাঁদের কোনওরকম সুবিধে হবে না, বরং তাঁরা উল্টে ক্ষতিগ্রস্তই হবেন। আপনি কোভিড ১৯ এবং এই অতিমারির প্রেক্ষিতে বিষয়টিকে দেখলে দেখতে পাবেন যে আমাদের সামাজিক গঠনেরই একটা অংশ হয়ে উঠেছে এই ধরনের নিষ্ঠুরতা, বৈষম্য, বৈষম্যের জয়গান এবং সর্বোপরি সেই বৈষম্যের উদযাপন।
গত ২৬ মার্চ, যেদিন নির্মলা সীতারামন ভাষণ দিয়েছিলেন, আমি The Wire-এ একটি লেখা লিখেছিলাম যেটি পরে PARI-তেও প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে আমি বলেছিলাম যে আমি অনুরোধ করছি যেন সমস্ত ভারতীয় কৃষক এই বছরেই আগামী খারিফ মরসুমের জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদনে ফিরে যায়। কারণ আমি আশঙ্কায় ছিলাম এবং এখনও আশঙ্কায় আছি ৭০ শতাংশ কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে— যাঁদের অধিকাংশই গত ২৫-৩০ বছর ধরে ক্রমাগত বাধ্য, প্রভাবিত এবং প্রলুব্ধ হয়ে শেষমেশ অর্থকরী ফসল উৎপাদনের দিকে চলে গেছেন।
এখন, এঁদের অনেকেই অর্থকরী ফসলের ক্ষেত্রে রবি মরসুমে বিপুল লাভের মুখ দেখেছেন; আমাদের প্রচুর পরিমাণে তুলা এবং ইক্ষু উৎপাদন হয়েছে। এখন, মিতালি, গোটা বিশ্ব জুড়ে আয়ের দিকটি ধ্বসে গেছে, তেমনি ব্যয়ের দিকটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিনবে কে? আইএলও বলছে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ আয় কমে গেছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় এই হিসেবটি একটু বেশি। এবং গ্রামীণ এলাকায়, আমি নিশ্চিৎ, আরও বহুগুণ বেশি।
এবার রবি শস্যের দিকটিই যদি ধরি, বৃদ্ধির হিসেব কিন্তু কোনওভাবেই ভালো থাকার সংজ্ঞা হতে পারে না। এটি বরং সেই মৌলিক দর্শনগত সমস্যা যা মুক্ত অর্থনীতির ধামাধরা-রা কখনওই মেনে নেবেন না। তাঁরা মানতে পারবেনই না, নচেৎ তাঁদের বিশ্বাসের ভিতটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এইজন্য, মহারাষ্ট্রে জুলাইয়ের শেষে বা আগস্টের শুরুতে যা ঘটতে দেখা গেছে— ৩০ লাখ কুইন্টাল অবিক্রিত তুলা, লাখ লাখ টন অবিক্রিত ইক্ষু— এবং খারিফ মরসুমে রাষ্ট্রের প্ররোচনায় কৃষকেরা সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছেন। তার ফলে, এখন, অক্টোবর-নভেম্বরের শেষে তুলো আর আখে জগৎ থইথই। এসব কার কাছে বিক্রি হবে? কিনবেই বা কারা?
কৃষি বিলের আরেকটি চিত্তাকর্ষক দিক হল কৃষক যেখানে চাইবেন সেখানেই শস্য বিক্রি করতে পারবেন। অসাধারণ! আবারও মুক্ত অর্থনীতির তলায় একধরনের ক্রীতদাস হয়ে যাওয়া! ঠিক এটিই হয়েছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে যাদের আজ আমরা অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে চিনি। তাঁরা তাঁদের শ্রম যেখানে খুশি বেচতে পারছেন, কিন্তু সেই শ্রম কিনছে কে? তিরিশ বছর আগে মানুষ মুম্বাইতে এসে মিল বা কারখানার কাজে যেতেন। আজ এঁরা মুম্বইয়ে এসে আমার আপনার বাড়ির চাকর হয়ে যাচ্ছেন, তাই না? কৃষকদের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি একই। এঁরা মুক্ত হতে চলেছেন। সত্যিই তো, যেখানে ন্যায্য মূল্য পাবেন, সেখানেই তাঁরা ফসল বিক্রি করতে পারবেন। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না, মধ্যপ্রদেশের ধানের ভালো বাজার থাকার খবর শুনে উৎফুল্ল হয়ে কন্যাকুমারী থেকে চাষি গরুর গাড়ি করে সূর্যাস্তের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছেন?! বুঝতেই পারছেন, এর ফলে লাভ কাদের হতে চলেছে।
অভিবাসী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে আমার কিছু কথা বলার আছে। অবশ্য তার আগে, সাইনাথ, বর্তমান গ্রামীণ ভারতবর্ষকে আপনি আমার চেয়ে অনেক ভালোভাবে চেনেন যেখানে এলিট মিডিয়ার প্রচারে মূলত দুচাকার গাড়ি এবং সিমেন্ট বিক্রির নিরিখে গ্রামীণ অর্থনীতির সাংঘাতিক এক উন্নয়নের কথা প্রচার করা হলেও আমরা জানি বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর চেহারা ঠিক বিপরীত।
তৃণমূল স্তরে, বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষকদের নিরিখে পরিস্থিতি ঠিক কীরকম? এ প্রসঙ্গে এনআরইজিএ-র সংখ্যার দিকটিও মাথায় রাখা দরকার, যা ২০০৬-এর পর থেকে এবছরই শীর্ষে পৌঁছেছে এবং যা প্রমাণ করে যে মানুষ জীবিকা এবং জীবনযাপনের জন্য ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
আপনার কথাতেই স্পষ্ট হয়ে গেছিল যে এনআরইজিএ-র সংখ্যাটি এই মরিয়া হওয়ারই প্রমাণ, যা উন্নয়ন না, বরং দুর্ভাগ্যের দিকটিই প্রতিফলিত করছে। ২ কোটিরও বেশি সংখ্যক মানুষ পিছিয়ে পড়ছে। যাই হোক, সরকার থেকে বলা হয়েছে তাদের কাছে অভিবাসীদের মোট সংখ্যা এবং তাঁদের মৃত্যু সংক্রান্ত কোনও তথ্যই নেই! প্রথমত, এই একই সরকার ১ মে থেকে ২৬ মে পর্যন্ত শ্রমিক ট্রেনে ওঠা মোট ৯১ লক্ষ শ্রমিকের হিসেব দিয়েছিল। বলা বাহুল্য, মে মাসের আরও পাঁচটি দিন বাকি রয়ে গেছিল এই হিসেবের মধ্যে।
এখন নরেন্দ্র সিং তোমার বলছেন তিনি নাকি সাম্প্রতিক আপডেটের জন্য রাজ্যগুলি থেকে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছেন।
কিন্তু রেলমন্ত্রক থেকে সেই তথ্য আমাদের দেওয়া হল ২৭ মে, এবং সেটি The Wire সহ সমস্ত প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হল। হিসেব দেওয়া হয়েছে কিন্তু শ্রমিক ট্রেনের প্রথম ২৬ দিনের, মনে রাখতে হবে ২৫ মার্চ থেকে ১ মে পর্যন্ত কিন্তু কোনও শ্রমিক ট্রেন ছিল না— বস্তুত কোনও ট্রেনই ছিল না। এই সময়টা শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাসে করে নিজের রাজ্যে ফিরছিলেন। সরকার সংখ্যাটা দু কোটির একটু নিচে হলেও তাকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না, তাই তো? আসলে সংখ্যাটি কিন্তু তার চেয়েও বেশি হতে পারে।
এছাড়াও আমরা মিডিয়া মারফত শিখে অভিবাসী সংক্রান্ত একটি ভুল ধারণা পোষণ করি। তা হল অভিবাসী তাঁরাই যাঁরা গ্রাম থেকে বড় শহর বা মেট্রো শহরে কাজের খোঁজে আসেন। হায়, মিডিয়ার ওরা যদি স্রেফ জনগণনার হিসেবটাই একবার ভাল করে পড়ত! গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া অভিবাসীরা রয়েছেন। তাঁরা কিন্তু বিপুল সংখ্যক। ঝাড়খণ্ড এবং বিহার থেকে প্রচুর কৃষক— লক্ষাধিক— ফসল কাটার সময়ে পাঞ্জাবের গ্রামীণ এলাকায় যান। প্রচুর সংখ্যক অভিবাসী আছেন, যাঁরা নিজের রাজ্যের মধ্যেই অভিবাসন করছেন। যেমন ধরুন তামিলনাডুর পুডুক্কোট্টাই থেকে তাঞ্জাভুরে যাচ্ছেন ইট তৈরির মরশুমে। লকডাউনের সময় এই গ্রাম থেকে গ্রামে অভিবাসন সাংঘাতিকভাবে থমকে যায়। দ্বিতীয়ত, শহর থেকে শহরেও মাইগ্রেশন হয়। এবং খুব সামান্য হলেও শহর থেকে গ্রামেও একটা মাইগ্রেশন হয়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে অভিবাসন এবং অভিবাসী বহু রকমের।
অভিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল হলেন তাঁরা যাঁদের জনগণনা হিসেবে মধ্যে ফেলে না। দ্য হিন্দুতে করা আমার একটি স্টোরিতে আমি লিখেছিলাম, সেন্সাস কমিশনার বা রেজিস্টার জেনারেলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, জনগণনা স্বল্প সময়ের এবং অবাধ মাইগ্রেশনকে ঠিকমতো ধরতে পারে না। দেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল অভিবাসী হিসেবে বলা হচ্ছে অবাধ অভিবাসীদের (footloose migrants) যাঁদের আসাযাওয়ার স্থানের কোনও স্পষ্ট রূপরেখা নেই। ধরা যাক কালাহান্ডি থেকে আসা কিছু অভিবাসীকে ট্রেনের মধ্যে আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’, উত্তরে তাঁরা হয়ত বলবেন মুম্বই, অথচ দেখা যাবে তিনি কোনও ৯০ দিনের সেতু নির্মাণ কাজের জন্য সান্ধিব যাচ্ছেন। তখন তিনি হয়ত বলবেন, সেখান থেকে তাঁর শ্যালক মুম্বইতে একটি ৪৫ দিনের কনস্ট্রাকশন কাজের জন্য ডাকবেন। তাঁরা ক্রমাগত স্থান বদল করেই চলেছেন। চিরস্থায়ী নিরাপত্তাহীনতা এবং চলনশীলতার অদ্ভুত এক জীবন— চরম নিরাপত্তাহীনতা, কম আয়, কোনওরকম সুযোগসুবিধা না পাওয়া এবং অসম্মান। আন্তরাজ্য অভিবাসী আইন অনুযায়ী, সরকারি হিসেবে মোট অভিবাসী সংখ্যা ৮৫০০০, তাই তো? এই দেশে তথ্য অন্তত এটাই বলে। তাই আমরা এক দিক থেকে নির্ভুল থাকি যখন আমরা বলি কোনও তথ্য নেই— অথচ জনগণনা বলছে ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ভারতীয়দের স্থান পরিবর্তন মানব ইতিহাসে সর্বাধিক।
এইজন্য, প্রচারমাধ্যমে, মিতালি, আমরা সকলে এই প্রশ্নগুলো করতেই পারি: ‘ওঃ, ওরা গ্রামে ফিরে যাচ্ছে কেন? শহরে আমাদের মতো কত ভালো ভালো লোক থাকতে ওরা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে কীভাবে?’ অথচ প্রচারমাধ্যমের যে প্রশ্নটা করা উচিত ছিল তা হল— ওদের নিজেদের গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার কথা ভাবতে হয়েছিল কেন সেটাই হল প্রথম কথা। এবং এটিই প্রকৃতপক্ষে যাকে বলে কৃষির সঙ্কট, যা প্রচারমাধ্যম দেখেও না দেখার ভান করে এসেছে, অন্তত যতদিন পর্যন্ত তা করা সম্ভব।
এখন, আপনারা আমার কাছে গ্রামীণ ভারতের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে জানতে চাইছেন, জানতে চাইছেন গ্রাম-ভারতের দুরবস্থাটা ঠিক কোন জায়গায়? গ্রামীণ সমস্যা কিন্তু শুধুমাত্র কৃষিভিত্তিক নয়। কতজন সাংবাদিক, সঞ্চালক বা সম্পাদক জানেন, কৃষির পরের দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান ঠিক কোন সেক্টর থেকে আসে? সেটি কিন্তু আইটি বা হাইটেক না, সেটি হল হস্তশিল্প (হ্যান্ডিক্র্যাফ্টস) এবং তাঁতশিল্প (হ্যান্ডলুম)। এই দুই সেক্টর মিলিতভাবে কৃষির পরেই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের উৎস। হ্যান্ডলুম সেন্সাস থেকে বা গত ২০-৩০ বছরের ক্র্যাফট কাউন্সিলের রিপোর্ট দেখলেই এটা জানা যাবে। এরা কৃষির পরেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ভারতবাসীর রোজগারের উৎস।
এখন, এই দিকগুলিও জানা হয়ে গেছে যে, বয়নশিল্পী, কুমোর, হস্তশিল্পী, হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজন, এঁরাও কিন্তু কৃষির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হলে এঁদের অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে যায়। আপনারা যদি কৃষক আত্মহত্যার দিকগুলি দেখেন, লক্ষ্য করবেন, দেশের অনেক জায়গায় কৃষক আত্মহত্যার সঙ্গে বুননশিল্পীদের আত্মহত্যার খবরও এসেছে। পোচামপল্লীর কথাই ধরুন। পুরনো অন্ধ্রপ্রদেশের পোচামপল্লীতে বেশ কিছু বয়স্ক বুননশিল্পী আত্মঘাতী হয়েছেন। কেন? যখন কৃষকরা দেউলিয়া হন, এই শিল্পীরাও বাজার হারান। তাঁদের প্রথম বাজারটিই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এদের এইজন্য কৃষির সংশ্লিষ্ট পেশা হিসেবেই ধরা হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, প্রচারমাধ্যম কৃষি-অর্থনীতি এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির মধ্যেকার এই ফারাকটা বুঝতেই পারে না। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি অনেকটা বড়, এটি কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশাগুলিকেও হিসেবের মধ্যে ধরে। আমাদের দারুশিল্পী, বয়নশিল্পী, মৃৎশিল্পী, মধু আহরণকারী অথবা মৎস্যচাষী— সকলে মিলেই এই কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি প্রস্তুত করেন। কৃষির উপর নির্ভর করা বৃহত্তর সমাজ হল কৃষিভিত্তিক সমাজ। তাই, কৃষি অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে এঁরাও শেষ হয়ে যান।
তিরিশ বছর ধরে, পরিকল্পনামাফিক, আমরা সেই অর্থনীতির পেছনে লেগে থেকে সেটা ধ্বংস করেছি। তাহলে তখন ভাবনাটা ঠিক কী ছিল, মিতালি? কৃষি থেকে, কৃষির একঘেয়েমি থেকে আমাদের মানুষকে মুক্ত করতে হবে যাতে তাঁরা তাঁদের পছন্দ মতো যেকোনও কাজের দিকেই যেতে পারেন। তাঁরা চাইলে সিসকো বা ইনফোসিসেও যেতে পারবেন। হ্যাঁ, তাঁদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই ইনফোসিসে গেছেন। আপনারা তাঁদের ক্যান্টিনে খুঁজলে পেয়ে যাবেন। মান্ডোয়ার চাষিরা আপনাদের চা ইত্যাদি সার্ভ করবেন।
তাই, ভিশন ২০২০-র পরিকল্পনা অনুযায়ী, ধরা যাক চন্দ্রবাবু নাইডু সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম দু পাতায় ৪০ শতাংশ মানুষকে কৃষি থেকে বের করে আনার লক্ষ্যমাত্রা দেখানো হয়েছে— ঠিক আছে? অর্থাৎ, আমরা কৃষি থেকে বেরিয়ে আসছেন এমন প্রচুর সংখ্যক মানুষকে পাচ্ছি। ১৯৯১ এবং ২০১১-র জনগণনার মধ্যবর্তী সময়সীমায়, দেশে পূর্ণ সময়ের কৃষকের সংখ্যা দেড় কোটি হ্রাস পেয়েছে। তার মানে, গড়ে প্রতি দিন ২০০০ জন করে ব্যক্তি পূর্ণ সময়ের কৃষিকে পেশা হিসেবে ত্যাগ করছেন।
যখন অতিমারি এবং লকডাউন এল, মানুষ গ্রামের দিকে ফিরে গেলেন শুধুমাত্র সেইসব জীবিকার খোঁজে, যা ভারতবর্ষ গত পঁচিশ বছরে পেরিয়ে এসেছে।
আরেকটি শেষ প্রশ্ন আপনার কাছে, সাইনাথ, কারণ আমরা বিমুদ্রাকরণের সময়সীমাও এই অবস্থা দিয়েই পেরিয়েছি এবং আমাদের কথোপকথনে বারবার উঠে এসেছে এবং আপনি বলেছেন যে, এই এমএসপি ইস্যুই কৃষকদের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার সরাসরি অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। আপনি নিশ্চয়ই এসবের পরবর্তী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবছেন কারণ এই তিনটি বিল নিয়ে উত্তর ভারত শুধু নয় সমগ্র দেশজুড়েই প্রতিবাদের সংগঠিত হচ্ছে। আপনার কী মনে হয়, এর রাজনৈতিক ফলাফল কী কী হতে পারে?
আমার মনে হয় সবচেয়ে আসন্ন এবং তার পরবর্তী ফলাফল হবে অরাজকতা। আপনি কিছু একটা ভাঙলে অবশ্যই শূন্যতা তৈরি হবে। এই শূন্যতার উপর ভিত্তি করে আপনি যে গঠনটি প্রত্যাশা করছেন, তা প্রস্তুত হতে পারে, নাও পারে। দ্বিতীয়ত, একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে বলে দেওয়া ভালো, এমএসপি অবশ্যই ক্ষোভের অনুঘটক সন্দেহ নেই, কিন্তু এই এমএসপি-র নিজস্ব এক গুরুত্বও আছে যা অস্বীকার করা যায় না। কৃষি সমাজ স্থিতাবস্থা অর্জনের জন্য ধিকিধিকি করছে। সাংঘাতিক এক দোলাচলের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এবং তার ফল গিয়ে পড়ছে সরাসরি কৃষকদের ওপর। দেখুন, কৃষক এমন একজন যিনি নিজে তাঁর উৎপাদিত পণ্যের মূল্য স্থির করতে পারেন না, বদলে তা করে দেন অন্য কেউ। কিন্তু মূল্যের এই বীভৎস উত্থানপতনের ফল কিন্তু ভুগতে হয় তাঁদেরই।
কেরলে ২০০২-২০০৩-এ ভ্যানিলা বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ৪০০০ টাকা দরে। দেড় বছর পর, ঠিক দুটো মরশুম পরেই এটি কেজি প্রতি ৬৮ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। আপনি প্রতি বছরই পড়েছেন এবং The Wire-এ লিখতে থেকেছেন যে লাসালগাঁওতে পেঁয়াজের দামের সাংঘাতিক ওঠানামা চলছে। এই মূল্যের হেরফেরকে আমরা একটা সময় নিন্দা করেছি অথচ এখন এটাকেই কিছু সংস্থার সহায়তা থেকে মুক্ত করে স্পষ্ট এক সংঘবদ্ধ রূপ দিতে চেষ্টা করছি। এখন, এসব বজায় থাকতে গেলে সেইসব হতভাগ্য সংস্থাগুলিকে ঠুঁটো জগন্নাথ হিসেবে হলেও টিকিয়ে রাখতে হবে। তারা থাকবে, এবং খুব কমসংখ্যক মানুষের কাছেই পৌঁছবে এবং তাঁদের কাজে আসবে।
তাহলে রাজনৈতিক ফলাফল কী কী হতে পারে? আমার মনে হয়, বিজেপির পরেই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দল এমন একটি কাজের সমালোচনা করছে যে কাজের সঙ্গে দার্শনিক দিক থেকে তাদের নিজেদের মৌলিক কোনও ফারাক নেই। ইউপিএ সরকারও তো এই একই কাজ করেছিল। আপনিই বলুন, এঁরা কি আদৌ অতিমারি থেকে কিছু শিক্ষা নিচ্ছে? কোভিড-১৯ ঠিক কী করেছে আমাদের জন্য? খুব স্পষ্ট এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শতকরা ১০০ শতাংশ অটোপসি করেছে আমাদের সমাজের উপর, উদারনীতির উপর, উদারনৈতিক পুঁজিবাদের ভিত্তিতে দাঁড়ানো পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানের উপর। সমাজের প্রতিটি স্নায়ু, পেশী, শিরা, ধমনী, এমনকী শূককীট পর্যন্ত বেরিয়ে গিয়ে প্রকৃত চেহারায় দৃশ্যমান হয়েছে।
আমরা এখনও একজন কংগ্রেস সাংসদ পাচ্ছি যিনি তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দর বেসরকারিকরণ সমর্থন করছেন, যেখানে কেরলের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিই এর বিরোধিতা করছে। অর্থাৎ, আমি একটি কাজের বিরোধিতা করছি অথচ সেই কাজটি যে মূলগত ভাবনা থেকে আসছে তার কোনও বিরোধিতা করছি না, তাই তো? এইজন্য আমি মাঝে মাঝে বলি, ইউপিএ একটা জোট যারা কখনওই সোজাসুজি গুলি করতে পারে না। এনডিএ একটা দল যারা গুলি থামাতেই জানে না। যেকোনও দিকে, যেকোনও জায়গায় এরা আঘাত হানতে পারে।
একটা ব্যাপার, মিতালি, আমার মনে হয় একটা দিকে আমার সঠিক বিচার দেখানো উচিত, সেটি হল, এর রাজনৈতিক ফলাফল কী কী হতে পারে? এটা আমাকে অবাক করছে যে, অতিমারি সত্ত্বেও, সংক্রমণের ভীতি সত্ত্বেও, লাখ লাখ কৃষক রাস্তায় নামছেন হয় এমএসপি নাহয় অন্য কোনও ইস্যু নিয়ে। দুধের দাম একটা ইস্যু, এমএসপি অন্যটি, অথবা কৃষি সংক্রান্ত ঋণের বোঝা আরেকটি ইস্যু। আমার মনে হয়, আমরা কৃষি সমাজে একটা বড়সড় বিক্ষোভ দেখতে চলেছি।