ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট কথা

জগন্নাথদেব মণ্ডল

 


লেখক কবি, গদ্যকার

 

 

 

 

 

সকালবেলার দিকে পাড়া-মহল্লায় আজকাল নতুন নতুন মানুষ দেখা যাচ্ছে। সবার বয়সই প্রায় কুড়ি পঁচিশের মধ্যে। মুখ বোঝা যায় না, রুমালে বাঁধা। সাইকেলে করে এসেছে, সাইকেলে ঝুড়ি বা সাদা চটের বস্তা রাখা। সেখানে বাড়ি থেকে তুলে আনা মানকচুর মাথা কিছুটা, খানিক থোড় বা অপটু হাতে বাঁধা কয়েক আঁটি মাঠকলমি।

এদের একজন আমার বন্ধু। ওর নাম— জীবন। কেরলে সাবান কারখানায় কাজ করত ও। লকডাউনে ফিরে এসে এই কাজ করতে হচ্ছে এখন। বিক্রির সময় হতভম্ব হয়ে পড়ছে, তারপর সামলানোর চেষ্টা করে বিক্কিরিতে নজর দিচ্ছে।

বিক্রমের মা বাজারে বসে গুগুলি, কাঁকড়া, থানকুনি পাতা নিয়ে বসে, ছেলে বাইরে থাকত, ডালভাত জুটে যেত। এখন দুজনেই ভোর থাকতে উঠে জলা, বাড়ির আনাচকানাচ ঢুঁড়ে বিক্রির জিনিস যোগাড় করছে।

মানকচু, থানকুনি, ওলে তাল করতে না পেরে কদিন মাছের ব্যবসা শুরু করল বিক্রম। বাটা, ককিলা, ভোলা এনে সঙ্গে বঁটি রেখে ঘুরে ঘুরে বিক্রি। সারাদিন ঘুরেও লাভ থাকছে না। কারণ, যারা বাইরে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে ছিল, যারা সোনারুপোর কাজ করত সবাই ফিরে এসে ফল, সবজি, মাছ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে একই গেরাম-পাড়াগাঁয়ে।

এদিকে বাজারে যারা বসে তাদের পেটে লাগল টান। বাড়ি বসে জিনিস পেয়ে যাওয়া লোক কম আসছে বাজারে। হ্যাঁ, মাংসের দোকানে ভিড়ের খামতি নেই, বেশ লাইন প্রায় সময়ই।

আনন্দকাকা কাটোয়ার প্ল্যাটফর্মে ফল নিয়ে বসে। মুসুম্বি, কলা, আপেল এইসব। একটু কানে খাটো কাকা ভোরে বেরোয় ট্রেনে করে, রাতে বাড়ি আসে। এখন বাড়ির কাছে বসছে আড়ত থেকে আনা মাল নিয়ে, কিন্তু এখানে বিক্রি নেই। ছেলেমেয়েদের টিউশনির মাস্টারের হাত চেপে ধরে বলছে— বাবা, কিছু মনে করো না, এ মাসে পারব না, তিনমাসের টাকাটা আস্তে আস্তে দিয়ে দোব।

গতকাল চাষের মাঠের পাশে বসে আছি, চাষি আর তার বউ বসে আছে। এমনিতে চাষি মানুষদের মুখ দেখেছি পরিশ্রম ও তৃপ্তিতে টইটুম্বুর থাকে প্রায় সময়ই। এখন দেখলাম দুজন স্বামী স্ত্রীর মুখ বিরক্তি ও দুশ্চিন্তায় কুঁকড়ে। ওরা বলাবলি করছে মুড়ি চিবাতে চিবাতে— এমন মাগমারানি রোগ এল সব ছারখার করে দিল। বিক্রি নেইকো, বাট্টা নেইকো, দুহাজার সালের জলেও এমন হয়নিকো, কী দিয়ে দোব থোব ছেলেমেয়েদের… ঘাটের মড়ার রোগ…

টেকরখাঁজির মুখটাতে একজন কাকিমা মনোহারির দোকান দিয়েছিল। বিকিকিনি তেমন না হলেও চলত মোটামুটি। কাকিমার স্বামী মরেছে জোগাড়ের কাজ করতে গিয়ে ভাঁড়া ছিঁড়ে পড়ে। মেয়েদের সাজার জিনিসটিনিস, সস্তা বিস্কুট, হাতে তৈরি নাড়ু এসব রাখত। আজ গিয়ে দেখলাম দোকান আর নেই। হয়তো মাল কেনার পুঁজি ফুরিয়েছে লকডাউনে। তাই দোকান ভেঙে ফেলতে হয়েছে। খা খা করছে জায়গাটা।

পালপাড়াতে প্রতিমা কম। প্রতিমা-গড়িয়েদের মুখ যেন মাটির হয়ে গেছে, স্থির ভাবলেশহীন। আলোর নীচে বসে শোলার গয়না বানানো কাকিমা জেঠিমার দল অর্ডার পাচ্ছে না বলে বিড়ি বাঁধা শিখছে।

দিদিরা প্রতিবছর পুজোর আগেই বেলুন কিনে আনে, ফোলানোর যন্ত্র। আপেল বেলুন, সাবু ভরা ঝুনঝুনি বেলুন। এবার সব ভোঁ ভোঁ। রুজিরোজগারের পেটে জোর লাথি।

মোষের মাথার ক্ষুদ্র সংস্করণের মতো ছোট ছোট পানিফল নিয়ে পানুহাট থেকে আসছে হেঁটে হেঁটে এক বুড়ো। কেউ কিনছে না, রোদে ঘেমে-নেয়ে গ্যাছে। বাস ওকে চাপাবে না, দুই কাঁধে ঝাঁকা আছে বলে, তাই পয়সা হলে টোটোয় যাবে, পনেরো টাকা। পাশ দাঁড়িয়ে শুনলাম বুড়ো এককথায় বিড়বিড় করে বলছে— হালার সাউয়ামারানি মনিষ্যি কিনেও না, ভগবান তুমি আছ শুদুই বড়লোক, চাকুরি করোন মাইনষের লাইগ্যা….

দেবা আমার বন্ধু। সাইকেলের দোকান। খদ্দের ছাড়া দোকানে বসে কথা বলছি দুজনে। ওকে জিগগেস করছি— পুজোয় কিছু নিবি কিনা? ও লাফিয়ে উঠে বলছে— জগা, তুই পাগলি হলি? এবছর কী করে ভাতডাল জোটাব তার ঠিক নাই, আবার জামাকাপড়…

এই কথাবার্তার মধ্যেই খবর এল বীরবেগুন গ্রামে একজন ঋণ নিয়েছিল ত্রিশ হাজার টাকা। প্লাস্টিকের খেলনার ব্যবসা করবে বলে। লকডাউনে তো ব্যবসার পোঙা মারা গেছে। অর্ধেক টাকা শোধ দিয়েছিল আর অর্ধেক দিতে পারেনি বলে ভোরের নীল অন্ধকারে বেলগাছে গলায় দড়া দিল কাল।

কাঁটা ভরা শিবঠাকুরের বিল্বফলের শক্ত ডাল। তাতে গলায় দড়ি। কাঁধের হাড় পট করে ভেঙে গেল, ঠেলে এল চোখের মণি। পনেরো হাজার টাকা শোধ দিতে না পারার জন্য বীরবেগুন গাঁয়ের লোকটির দাঁত জিভ কেটে বসে যাচ্ছে…

 

[ভিতরের ছবি: লেখক]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. কি যে কষ্ট শুরু হয়েছে! খুব মনের কাছের লেখা।পাড়ায় সত্যি কতো নতুন মুখের আনাগোনা।

আপনার মতামত...