শিবরাম চক্রবর্তী
পশ্চিমবঙ্গে না কি জাতপাত নেই, ব্রাহ্মণ্যবাদের উগ্র প্রকাশ নেই। সম্প্রতি কলকাতার এক নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দলিত অধ্যাপককে অপমানিত হতে হল তাঁর ছাত্রীর দ্বারা। এই সুযোগে আমরা একবার পড়ে নিলাম শিবরাম চক্রবর্তীর ইস্তেহার-প্রতিম টেক্সট 'মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী' থেকে কিছু অংশ। প্রবন্ধগুলি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৯ সালে।
সমস্ত শূদ্রকে ব্রাহ্মণ বলে ঘোষণা করা হোক, এই মর্মের একটা প্রস্তাব সম্প্রতি হয়েছে।
এই প্রস্তাবে আমার আপত্তি। পৃথিবীর কোথাও একদল মানুষ আছে যারা নরখাদক, সেই কারণে পৃথিবীর সব মানুষকে নরখাদক বলে ঘোষণা করা হোক — এই মতে আমি কিছুতেই সায় দিতে পারিনে। বরং আমার মতে, সম্ভব হলে, নরখাদকদেরই মানুষ করার পক্ষে চেষ্টা হওয়া উচিত।
‘ইংরাজ’ এই শব্দটি উচ্চারণ করলে পৃথিবীর আজ যে-কোনও প্রান্তে যে-কেহ সমঝদার লোক বুঝতে পারে যে, এই নামধেয় যে-জাতি, তারা বর্বরতার একটা সভ্যরকম রূপ দিতে পেরেছে, অত্যাচারকে শান্তি ও শৃঙখলার নামে চালাতে পেরেছে এবং শোষণের ফলে শোষিতের মনে অবিমিশ্র আনন্দ দান করতে পেরেছে- এইরূপ অসাধারণ প্রয়োগনৈপুণ্য আছে বলেই পৃথিবীর তারা অষ্টম আশ্চর্য। বর্তমান যুগে ইংরেজ যা সম্ভব করেছে, সেই বস্তু অতি-প্রাচীন যুগেই আমাদের ব্রাহ্মণেরা সমাধা করেছিলেন। এজন্যে তাঁরাও কিছু কম যান না- পৃথিবীর আদিম আশ্চর্য তাঁরা।
শোষণের জন্যই শাসন– এই সনাতন মূলনীতির মূলাধার ব্রাহ্মণ। শোষণকে প্রচ্ছন্ন করতে হলে শাসনকে একটা আদর্শের নামে খাড়া করতে হয়, অতীতকালের ব্রাহ্মণরা ডিপ্লোমাসির এই গূঢ়-তত্ত্ব ভাল করেই জানতেন। ভারত যে একদা সভ্য ছিল অর্থাৎ বর্বরতাকেও লজ্জা দিতে পেরেছে– সেকালের বামুনেরাই তার প্রমাণ।
‘ও’– এই একাদশ বর্ণকে অনুনাসিক সুরে উচ্চারণ করলে যে প্লুতস্বরের সৃষ্টি হয়, তার সঙ্গে সংস্পর্শ ঘটলে শূদ্রের বিষম দশা! তা যদি শূদ্রের কণ্ঠ থেকে বেরোয়, তাহলে তার জিভ কেটে ফেলতে হবে এবং যদি কানের ভেতরে ঢোকে তাহলে তার কর্ণকুহরে সীসে গলিয়ে ঢালার সুব্যবস্থা। বামুনদের সভ্যজনোচিত শাসন-নীতির এমন বহুতর দৃষ্টান্ত মনুসংহিতার পাতায় পাতায়। জলদস্যুদের যে-সব বংশধর আধুনিককালে সভ্য হয়ে উঠেছে, শাসন-নীতির দিক দিয়ে, ‘দেববংশসম্ভূত’ পৌরাণিক ব্রাহ্মণদের এখনও তারা লজ্জা দিতে পারেনি।
শোষণ-নীতির দিক দিয়েই পেরেছে কি?
আমি বলি, আজ্ঞে না।
ইংরেজরা রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিকে জড়ীভূত করবার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু প্রায়ই তার জোড় ভাঙে– তখন দ্বিধাগ্রস্থ দুই নীতির আপনা আপনির মধ্যে ঠোকাঠুকি বেধে যায়। কিন্তু সেকালের ব্রাহ্মণ ধর্মনীতির সঙ্গে অর্থনীতির যে সমন্বয় সাধন করেছিলেন, তা আজও অক্ষুন্ন রয়েছে,– তাঁরা সেই প্রাচীন যুগে যে শোষণ;যন্ত্রের স্থাপনা করে গেছেন, তার যন্ত্রণাহীন চক্রতলে নিস্পিষ্ট হতে আজও আপনা থেকেই লোক এগিয়ে আসে৷ সত্যি, দিব্যদর্শন ছিল বইকি তাঁদের। কেননা, এই মানুষ-পেষা-কল চালিয়ে তাঁদের বংশধরেরা যে চিরকাল ধরে করে খাবে, এটা তাঁরা দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁদের দূরদৃষ্টির বলেই এই সেদিন পর্যন্ত বামুনরা নিজেদের দূরদৃষ্টকে বাঁচিয়ে এসেছে।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ট্যাকসো আদায়ের যে ‘শিডিউল’ তাঁরা সেকালে বেঁধে গেছেন, একালে এমন কোনও অর্থনীতিক মাথাই নেই যে তার সমান একটা কিছু বানাতে পারে৷ বারো মাসে তের পার্বণ, নিত্য-নৈমিত্তিক পূজার্চজা, শান্তিস্বস্ত্যয়ণ, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহণ— এ-সব তো লেগেই রয়েছে— বরাবরের ব্যাপার৷ কিন্তু এ-সব উপক্ষ্যে পৌরোহিত্য করবে কে? — বামুন। দান করব কাকে?— বামুন। দানের বৈচিত্র্যই-বা কত কত রকমের! সোনা-রূপো-হাতি-ঘোড়া কাপড়-চোপড় বাসন-কোশন থেকে শুরু করে কাহন কাহন কড়ি পর্যন্ত — যার যেমন সাধ– যথাসাধ্য।
শুধু কি দান? তার সঙ্গে গণ্ডেপিণ্ডে ভোজন! নেহাত কম হলেও অন্তত ‘দোয়া-দশটিকেও’ তো খাওয়াতে হবে? এবং ভোজনের সঙ্গে দক্ষিণাটাও নগদ! অথচ দাতার পুলক ধরে না৷ অপাত্রে এই নির্বিচারদানের কোনও যুক্তি হয় না; কিন্তু দাতার মনে কোনও প্রশ্নই নেই৷ এই কায়মনোবাক্যে দানের ফলে তাঁর অক্ষয় স্বর্গবাস কায়েম হচ্ছে! পোষণের ফলে তোষণের সৃষ্টি করার অদ্ভুত এই প্রতিভা, আমি শুধু ভাবি, সে-যুগে এ-সম্ভব হল কী করে? এ;যুগের ট্যাকসো আদায়ের একশো রকম কায়দার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে অবাক হতে হয়– কানুনের হেরফের থাকলেও কায়দায় এরা এতই অনুরূপ যে, মৌলিকতার দিক দিয়ে রূপের মিল অণুমাত্র হলেও লৌকিকতায় এরা সমগোত্র। ইতিহাসের মত, সভ্যতাও কি খোল-নোলচে বদলে বদলে আসে নাকি?
বানান অপরিবর্তিত