সৌম্য শাহীন
লেখক কেন্দ্রীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
অঙ্কের হিসেবে এ রাজ্যে এখনও তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হলেও বহু মানুষ প্রমাদ গুনছেন যে আগামী নির্বাচনে এই দলটিকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিজেপি রাজ্যের মসনদে বসতে পারে। কিন্তু আমাদের এটা বুঝতে হবে যে বর্তমান রাজনৈতিক লড়াই শুধুমাত্র বিজেপি নামক দলটার বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ নয়। লড়াই হিন্দুত্ববাদ নামক একটা বিপজ্জনক আদর্শের বিরুদ্ধে, যারা একশো বছর ধরে সাভারকর-গোলওয়ালকরদের তৈরি তাত্ত্বিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে একটা বিপুল সংগঠন গড়ে তুলেছে। এই আদর্শগত সংগ্রাম তৃণমূল কখনওই দীর্ঘমেয়াদে লড়তে পারবে না। কারণ বিকল্প রাজনৈতিক আদর্শ তাদের কাছে নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি ঘোরাফেরা করে নরম হিন্দুত্ব আর ইমাম-মৌলবী-মুয়াজ্জিম তোষণের মধ্যে। এছাড়াও সরকারে থাকার সুযোগ নিয়ে পঞ্চায়েত স্তর থেকে একটা দাতা-গ্রহীতা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দল ও কর্মীদের মধ্যে। সেই সাংগঠনিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একটার পর একটা নির্বাচন তাঁরা জিতেছেন, পঞ্চায়েতগুলো বিরোধীশূন্য হয়েছে।
রাজনীতির নয়া বাঁক ও মুসলিম ভোট
কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির বিপুল সাফল্যের পর চাকা উল্টো দিকে ঘুরেছে। মোদি-শাহের নেতৃত্বে এনডিএ-২ তাদের অ্যাজেন্ডাগুলো একটার পর একটা রূপায়িত করছে। বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার কাজকর্মে সরকার সরাসরি নাক গলাচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ইউজিসি থেকে শুরু করে ইডি, সিবিআই, এনআইএর মত প্রতিষ্ঠান তাদের অঙ্গুলিহেলনে চলছে। এমনকি বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা পর্যন্ত প্রশ্নচিহ্নের মুখে। ৩৭০ ধারা অবলোপ থেকে শুরু করে বাবরি মসজিদ মামলার রায় এবং সর্বোপরি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯— একটার পর একটা ক্ষেত্রে সাংবিধানিক মূল্যবোধকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ছিল বিজেপির কাছে “শেষ সীমান্ত”। সেখানেও ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃণমূলের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে তারা।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে এনার্সি-ক্যা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মোট ৪৬টা বিধানসভা আসনে সংখ্যালঘু ভোট ৫০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে ১২৫টা সিটে মুসলিম ভোট নির্ণায়ক। মমতার “মুসলমান-প্রীতি” যে পুরোপুরি নির্বাচনকেন্দ্রিক, এটা জানা সত্ত্বেও প্রকৃত বিকল্প না থাকার দরুণ ২০১৯-এ ব্লক ভোটিং করতে একপ্রকার বাধ্য হন বাংলার ৩১ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটার। ফলে তৃণমূল ১২টা আসন খোয়ানো সত্ত্বেও শতাংশের হিসেবে মোট ৪৩ শতাংশ ভোট পেতে সক্ষম হয় গত লোকসভা নির্বাচনে। বস্তুতপক্ষে, ২০১৪-র থেকে সামান্য হলেও ভোট বাড়ে তাদের। এটা সবথেকে ভালো বোঝেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। তাই কলকাতা ছাড়া অন্যান্য জেলাগুলিতে নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে আন্দোলনরত গণমঞ্চগুলোকে তীব্র প্রশাসনিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কারণ সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার মাধ্যমে বাংলার মুসলিম সমাজকে পণবন্দি রাখতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন প্রধানত নিপীড়িত একটি সম্প্রদায়। যারা প্রধানত কৃষক, গ্রামীণ ও শহুরে শ্রমজীবী, হস্তশিল্পী অথবা ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। স্বভাবতই এঁরা সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। নন্দীগ্রাম আন্দোলন পর্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সংগঠনটি এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু ২০১১ পরবর্তীকালে ওই সংগঠনের নেতৃত্ব সুবিধাবাদের সঙ্গে আপস করে সরকারি ক্ষমতার ভাগিদার হয়। বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন শক্তি এই বাঙালি মুসলিমদের সংগঠিত করতে থাকে। নিজেদের আভ্যন্তরীণ কারণে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে, ওয়েলফেয়ার পার্টি, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া, সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশন ইত্যাদি বিভিন্ন নামের সংগঠন পশ্চিমবঙ্গে সংগঠন করতে শুরু করে। ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী ও আব্বাস সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন দুটি অংশ তাদের রাজনৈতিক ভূমিকা ক্রমশই বাড়াতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে পরস্পর বিবদমান শক্তিতে পরিণত হয়। সেই সঙ্গে হাজির হয় আসাদুউদ্দীন ওয়েসির নেতৃত্বাধীন মিম পার্টি। অর্থাৎ নন্দীগ্রাম পর্বে মুসলিমরা জমিয়তে উলামা হিন্দের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করলেও, বর্তমানে এই শক্তিটি বহুধাবিভক্ত। সর্বজনগ্রাহ্য কোনও নেতাও বাঙালি মুসলিম সমাজে এখনও অনুপস্থিত। শেষ দুটো বিধানসভা নির্বাচনে, বিশেষত দক্ষিণবঙ্গে, এঁদের ঢালাও সমর্থন পেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু লকডাউনের সময় অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা অঙ্কটা বদলে দিয়েছে। প্রায় তিন মিলিয়ন শ্রমিক, তাঁদের পরিজনদের ধরলে ভোটারের সংখ্যাটা কোটির কাছাকাছি। এর সঙ্গে যোগ করুন আমফানের ক্ষতিপূরণ নিয়ে নির্লজ্জ দুর্নীতি। যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁদের অধিকাংশ ২১-এ তৃণমূলকে ভোট দেবে না। এই মানুষগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। বিজেপি এদের জন্য বিকল্প নয়। এই জায়গা থেকেই এবারের নির্বাচনে বামপন্থীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
লকডাউন পর্বের সামাজিক উদ্যোগ
তিনমাস লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন বহু শ্রমিক। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় তিরিশ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক ঘরে ফিরে এসেছেন। পুরো চাপটা এসে পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর। যে কৃষিজীবী মানুষ চিরকাল খাবার জুগিয়েছে নগরসভ্যতাকে, সময় এল তাঁদের কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার। বিভিন্ন বামপন্থী গণসংগঠন, ছাত্র-যুবসমাজ, ক্লাব, অসরকারি সংস্থা এই সময়ে মহামারির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। শুরু হল চাঁদা তুলে অর্থ সংগ্রহ করা, চাল-ডাল-তেল-নুন-আলু-পেঁয়াজ-সয়াবিনের এক অন্য জীবন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ওঁরা বুঝতে পারলেন যে এভাবে দীর্ঘদিন মানুষকে ত্রাণের ওপর নির্ভর করে বাঁচানো যাবে না। যে যৌথতা আমাদের জীবনের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে শেখায়, সেই যৌথতার প্রয়োজন এই দুঃসময়ে। বিপুল উৎসাহে বিভিন্ন জায়গায় শুরু হল জনগণের রান্নাঘর— গ্রামের মানুষ জোগান দিলেন ক্ষেতের সব্জি, রান্নার কাঠ, জোগালেন সম্মিলিত শ্রম। এই উদ্যোগের কথা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ সাহায্য পাঠালেন। গ্রাম আর শহরের এই মেলবন্ধন মানুষকে নতুন স্বপ্ন দেখতে শেখাল। একই সঙ্গে অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য তৈরি হল হেল্পলাইন, তাঁদের ত্রাণ পাঠানো, সরকারি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা, শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের টিকিট বুক করা— এরকম অজস্র কাজ।
এরই মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা বহুগুণ বাড়িয়ে দিল আমফান ঝড়। কারও বাড়ি ভাঙল, কারও ছাদ উড়ে গেল। ক্ষেতের ফসল, পুকুরের মাছ, আসবাবপত্র, বই-খাতা নষ্ট হল। মাথার ওপর আস্তরণ দেবে নাকি খাবার জোগাড় করবে, সেই চিন্তায় রাতের ঘুম নষ্ট। এদিকে সরকারি ক্ষতিপূরণ ঢুকছে শুধু শাসকদলের ঘনিষ্ঠদের অ্যাকাউন্টে। বাংলার গ্রামের পর গ্রাম— এই এক চিত্র। কিন্তু এই চিত্রের মধ্যে আর একটা চিত্র আছে, যেটা সামনে আসে না। গ্রামের পর গ্রামে এই বেহাল দশায় মানুষের পাশে সমস্ত শক্তি সামর্থ্য আর আশ্বাস নিয়ে কিন্তু মানুষই দাঁড়িয়েছে। কেউ চাঁদা তুলে কমিউনিটি কিচেন চালিয়েছেন, তো কেউ ত্রিপল, শুকনো খাবার, ওষুধ, পানীয় জল নিয়ে পৌঁছে গেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সম্মিলিত সামাজিক প্রচেষ্টায় সর্বস্ব হারানো মানুষগুলোও কিন্তু আজ ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছেন। ঘর বাঁধছেন নতুন করে। এক অনন্য জীবনীশক্তি নিয়ে বাঁচার লড়াইয়ে তারা জিতছেন।
ইতিমধ্যে আনলক পর্ব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনার প্রকোপ আরও বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লকডাউনে ঘরে বন্দি হয়ে থাকার মেয়াদ। দীর্ঘ ছয়মাস স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় পড়ুয়াদের লেখাপড়া করার অভ্যাস ছুটে গেছে। মধ্য/উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা যখন অনলাইনে ক্লাস করছে, তখন প্রথম প্রজন্মের এই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জগৎ থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে সরে যাচ্ছে। বাড়িতে নিত্য অনটনের ফলে এই শিশুদের একাংশ কচি বয়সেই শ্রমের বাজারে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। মেহনতি মানুষের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাব সবথেকে বড় প্রতিবন্ধকতা। মহামারির কারণে আর্থিকভাবে দুঃস্থ পরিবারের শিশুদের সঙ্গে সচ্ছল ঘরের ছেলেমেয়েদের একটা অনতিক্রম্য ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য “সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ চাই”— এই ভাবনাকে জনপ্রিয় করে তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলে অবৈতনিক নৈশ বিদ্যালয় এবং পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে কলকাতার বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা নিয়মিতভাবে ক্লাস নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, এলাকার শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাও স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ার মাধ্যমে এই প্রচেষ্টাগুলোর সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে নিয়েছেন।
এরই পাশাপাশি গত ছয় মাস ধরে দুরূহ সময়ে সীমিত সামর্থ্য নিয়ে বিভিন্ন ধারার বামপন্থী কর্মীরা এঁদের পাশে থেকেছেন, এঁদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন। ফলে বামেদের সম্পর্কে একধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা জন্মেছে খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে। এর সুফল নির্বাচনে পেতে গেলে প্রয়োজন সমস্ত বামশক্তির বৃহত্তর জোট। প্রগতিশীল গণআন্দোলনের কর্মীরা লাগাতার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষকে আরএসএসের বিভাজনমূলক রাজনীতির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাস্থ্যশিবির, কমিউনিটি কিচেন পরিচালনা থেকে শুরু করে জনগণের বিভিন্ন অধিকার অর্জনের লড়াই, যেমন একশো দিনের কাজের দাবি, আমফান বিপর্যয়ে ক্ষতিপূরণের দাবি, ক্ষুদ্র ঋণমুক্তির দাবিতে এঁরা ধারাবাহিকভাবে সংগ্রাম করে চলেছেন।
মহামারির মধ্যে এঁরা অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ক্রমাগত কাজ করে গেছেন। আমফান বিপর্যয়ের পর ত্রাণ নিয়ে পৌঁছে গেছেন দুর্গম থেকে দুর্গমতর অঞ্চলে।
ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির সীমাবদ্ধতা
বাংলার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের যে ছবি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে, তাতে আমরা দেখছি আদিবাসী-দলিত-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আর স্রেফ ভোটব্যাঙ্ক হয়ে থাকতে রাজি নন। প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর দাপটের বদলে এই আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠে আসছেন সাধারণ মানুষ— ছাত্রযুব থেকে বর্ষীয়ান গণআন্দোলনের কর্মীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিচ্ছেন একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর পর্বেও সুশীল সমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেবার সেলিব্রেটি বুদ্ধিজীবীদের দাপটে সাধারণ মানুষ কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সেই আন্দোলনকে নিজের অনুকূলে টানতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। পালাবদলের পরে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নানান সরকারি ভূষণে ভূষিত হয়ে নিজেদের নিরপেক্ষ স্বর হারিয়ে ফেলেন।
এবারের জনজাগরণের চরিত্রটা অনেকটাই আলাদা। ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে ঝড় উঠেছে, তার স্বতঃস্ফূর্ততা রাজনৈতিক দলগুলোকে চমকে দিয়েছে। অর্থ আর পেশিশক্তির জোরে ভোটবাজারে জিততে অভ্যস্ত নেতানেত্রীরা এই গণ-উত্থানকে বিশ্লেষণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। যে মুসলিম সমাজকে এতদিন তাঁরা দুধেল গাই হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তারা হঠাৎ নাগরিকত্বের বুনিয়াদি অধিকারগুলো দাবি করে বসায় চেনা অঙ্কগুলো ঘেঁটে গেছে। সিএএ-এনআরসি বিরোধী সভাসমাবেশগুলো থেকে ধারাবাহিকভাবে রুটিরুজির মৌলিক প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে। কৃষিআইন বিরোধী আন্দোলনে দেশব্যাপী যে বিপুল সাড়া পড়েছে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও তা গভীর ছাপ ফেলেছে।
শ্রমিক-কৃষক-জনজাতি ওপর যে ভয়ঙ্কর আক্রমণ নেমে এসেছে গত ছয় বছরে, তার বিরুদ্ধে নাগরিক স্বর ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। উঠে আসছে দশকের পর দশক ধরে বিভিন্ন শাসকের আমলে জাতি-ধর্ম-ভাষাভিত্তিক বৈষম্যের কথাও। আজাদির সঙ্গে সঙ্গে জয় ভীম স্লোগানেও উত্তাল হয়ে উঠছেন মিছিলে পা মেলানো জনতা। দেশব্যাপী এই আন্দোলনে সংখ্যালঘু মহিলাদের ব্যাপক হারে উপস্থিতি এতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে— ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে সঙ্গে পিতৃতন্ত্রের কাঠামোকেও চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছেন শাহিনবাগ-পার্ক সার্কাসের মা-বোনেরা।
বিকল্পের খোঁজে
হিন্দুত্ববাদ বিরোধী লড়াইতে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান আজ সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। বিভিন্ন মঞ্চে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা মানুষকে এবার সংগঠিত হয়ে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে। কাজটা কঠিন। মানুষ বিভিন্ন কারণে নিপীড়িত হন, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের আত্মপরিচয়ের বিবিধ স্তরের ওপর সেই নিপীড়নের মাত্রা নির্ভর করে। এক নিপীড়িত শ্রমিকের একই সঙ্গে নারী, মুসলমান এবং বাঙালি আইডেন্টিটি তাঁর নিপীড়নের মাত্রাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এত বিবিধ পরিচয় এক জটিল বিন্যাস তৈরি করে। প্রশ্ন হল কোন পরিচয়ে তিনি রুখে দাঁড়াবেন? এক নারী হিসেবে নিজের সমানাধিকার দাবী করতে হিজাব-বোরখা তিনি কি সরিয়ে দেবেন, নাকি মুসলমানদের ওপর বিশ্বজোড়া পশ্চিমী পুঁজির হাতধরা পশ্চিমী সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হিজাব-বোরখাই হবে তার আত্মপরিচয়? আরও গভীর প্রশ্ন হল একজন দলিত কিংবা আদিবাসী রমণী কোন প্রশ্নে হিজাব-বোরখা পরেই আত্মমর্যাদার লড়াই লড়তে থাকা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রীটির সঙ্গে একাত্ম হবেন? আরও একটা প্রশ্ন হল, এক গরীব হিন্দু চাষি একজন গরীব মুসলিম চাষির ওপর চলা মুসলিমবিরোধী নিপীড়নের প্রশ্নে কী ভূমিকা রাখবেন?
কমিউনিস্টদের একটা অংশ বলেন ‘শ্রেণির প্রশ্নে সমস্ত নিপীড়িত মানুষ এক হবেন’। এই অতিসরলীকরণ শুধু ভারতে নয়, সারা পৃথিবীতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এতে ধরে নেওয়া হয় যেন ‘শ্রেণি’শোষণে ঐ পরিচয়গত নিপীড়নগুলো কোনও ভূমিকা রাখে না। ঐ পরিচয়গত নিপীড়নগুলোকেই যে অধিকতর শোষণ করতে, অতি-মুনাফা পাওয়ার কাজে, সস্তা শ্রমিক তৈরির কাজে, সস্তায় শ্রমশক্তি কেনার কাজে ব্যবহৃত হয়, তারা তা বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে অসম্পূর্ণ স্লোগান ওঠে— জাত নয়, ভাতের লড়াই করুন। আর এভাবেই তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে নিপীড়িত জাতের আত্মমর্যাদার লড়াই, সমানাধিকারের লড়াই।
কিন্তু নিপীড়িত পরিচয় নিয়ে উঠে দাঁড়ানো গোষ্ঠীগুলোও কি এ কথা বোঝেন? বোঝেন যে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই পরিচয়গত নিপীড়ন শুধু তাকে হেয় করা নয়, তার কাছ থেকে, তার পরিচয়ের গোষ্ঠীর কাছ থেকে সস্তা শ্রম পাওয়ার উপায়ও বটে? একজন দলিত যুবক কি বোঝেন যে একজন মুসলমান চাষির ওপর চাপিয়ে দেওয়া পরিচয়গত নিপীড়ন আসলে তাঁর কাছ থেকে সস্তা শ্রম আদায়ের কায়দা, কিংবা মুসলমান চাষিও কি সেকথা বোঝেন? একজন উচ্চবর্ণের বাঙালি বেকার যুবক কি এক দলিত বিহারী মজুরের পরিচয়ের সমস্যার কথা বোঝেন, বোঝেন একজন সাঁওতাল বা গোর্খা অভিবাসী শ্রমিকের সমস্যার কথা?
এই বোঝায় পৌঁছনো, এই বোধে পৌঁছনো যে এই পরিচয়গত নিপীড়নের আসল উদ্দেশ্য শুধু তাকে হেয় করা নয়, বরঞ্চ কর্পোরেটশাসিত এক ব্যবস্থার অধীন করে রাখা, এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভারতজোড়া এক জনজাগরণের চাবিকাঠি।
নিপীড়িত পরিচয়ের লড়াই আর শোষিত শ্রেণির লড়াইকে একসূত্রে গাঁথার কাজ তাই সচেতনভাবে চালিয়ে যেতে হবে। নতুন প্রজন্মের সমাজতাত্ত্বিকরা ভারতবর্ষের শ্রেণিচরিত্র ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে জাতের প্রশ্নকে, এবং তার সঙ্গে পরিবেশ, নারীস্বাধীনতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি জল-জঙ্গল-জমির উপর মূলনিবাসী মানুষের অধিকারের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভাষ্য নির্মাণ করতে সক্ষম হলে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করবে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-ধীমান বসাক।
“নিপীড়িত পরিচয়ের লড়াই আর শোষিত শ্রেণির লড়াইকে একসূত্রে গাঁথার কাজ তাই সচেতনভাবে চালিয়ে যেতে হবে।”- সহমত পোষণ করেও বলছি যে কাজটা কঠিন। কেননা এদেশে বাম মনস্কদের অনেকেই এখনও মনে করেন যে একমাত্র শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জাতিগত পরিচিতির সমস্যা, পরিবার ও সমাজে নারীদের নিপীড়ন জনিত সমস্যা কিংবা পরিবেশ দূষণ জনিত সমস্যাগুলোর সমাধানসম্ভব। তাই দুনিয়া পাল্বাটানোর লড়াইয়ের সাথে সাথে বাম মনস্কদের নিজেকে পাল্টানোর লড়াইটাও চালিয়ে যেতে হবে।
পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই। মৌলবাদীদের সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে বাম ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রকৃতই আন্তরিক হলে সব ধরণের সংকীর্ণতা এবং অস্পৃশ্যতার মনোভাব দূর করতে হবে। নিজেদের মধ্য মতাদর্শগত সংগ্রাম অবশ্যই চলবে, কিন্তু আসুন না একে অপরকে নকু, মাকু, সুসি, লিবারেল, দালাল ইত্যাদি বলার থেকে, একে অপরের অতীত নিয়ে কাদা ছোড়াছুঁড়ি থেকে বিরত থাকি ।