স্টেশন মাস্টার
বিগত ছয়মাস ধরিয়া গোটা বিশ্ব অতিমারির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত, সংগ্রাম এখনও অব্যাহত, অভূতপূর্ব এই বৈশ্বিক সঙ্কট সারা পৃথিবীর মানবসমাজকে একসূত্রে গাঁথিয়া ফেলিয়াছে। স্বাভাবিকভাবেই, এই কয়মাস চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর প্রতিটি সংখ্যায় কোভিড উনিশ তার তীব্র ছাপ রাখিয়া গিয়াছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি নানা অভিমুখ হইতে আমরা পাঠ করিয়াছি এই মহাসঙ্কটকে। মহামারির এই অধ্যয়ন ও ব্যবচ্ছেদ, বলা বাহুল্য, কোনও নিরাপদ দূরত্ব হইতে নয়, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর অক্ষরকর্মীরা যেহেতু রক্তমাংসের মানুষ, পেটের দায়ে সকলের মতো আমাদেরও পথে নামিতে হয়, এই সঙ্কটকাল ঝড়ের কেন্দ্রে আনিয়া ফেলিয়াছে আমাদেরও। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়াইয়া যখন কোনও সর্বজ্ঞানী বলেন যে কোভিডে মৃত্যুর হার মাত্র ১.৫ শতাংশ, অতএব চিন্তার তেমন কোনও কারণ নাই, বিশ্বব্যাপী দশ লক্ষাধিক মৃত্যুর দিকে চাহিয়া এই পরিসংখ্যানগত তাচ্ছিল্য বড় অশ্লীল বলিয়া বোধ হয়। বস্তুত, কর্মী-লেখক-পাঠক সমন্বয়ে আমাদের পত্রিকাকে যদি একটি বৃহৎ পরিবার জ্ঞান করি, বিগত কয়মাসে আমরা বহু লড়াইয়ের সাক্ষী, আমাদের মনে আজ একাধিক স্বজনবিয়োগের ক্ষত। বিশ্বের প্রতিটি সঙ্কটাপন্ন দেশের মানুষের মতো আমরাও এই মুহূর্তে জানি না, এই কোভিড-পারাবার অতিক্রম করিয়া আমরা যখন অপর পারে পৌঁছাইব, দেশের আরও কতশত সহনাগরিককে আমাদের পিছনে ছাড়িয়া যাইতে হইবে৷
প্রাণহানি সংখ্যা যদিও কম, ধনেপ্রাণে মারা যাওয়া অর্থাৎ সর্বস্বান্ত হওয়ার নজির আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সর্বত্র। পিছনের দিকে উন্মাদের ন্যায় ছুটিয়া চলিয়াছে অর্থনীতি, দেশের কোটি কোটি মানুষের হাতে কাজ নাই। দেশে স্কুল ড্রপ-আউট ও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বহুগুণ বাড়িয়া গিয়াছে গত ছয় মাসে। ঋণ-বেকারত্ব ও বিষাদজনিত আত্মহত্যার ঘটনা বাড়িতেছে। বাংলায় আসন্ন শারদ উৎসব হিন্দু বাঙালির উৎসব হইলেও তাহা জাতিধর্মনির্বিশেষে গ্রামবাংলার মানুষের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। প্রতিমাশিল্পী পরেশ পালের হাতে এ বছর কাজ নাই৷ রহিম ওস্তাগরের কাছেও এবার নতুন জামাকাপড় বানাইবার বরাত অপ্রতুল। সুদূর বাঁকুড়া হইতে যে ঢাকি শহর কলিকাতায় আসিয়া ঢাক বাজাইয়া কিছু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করিয়া ঘরে ফিরিত, এই বৎসর তাহার সে উপার্জন নাই। স্বাস্থ্যবিধির কারণে ভিড় কমিবে, কমাই উচিত, কিন্তু ইহার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হইল মণ্ডপের পাশে রোল-চাউমিনের দোকান দেওয়া প্রৌঢ় দম্পতি। মানুষের হাতে অর্থ নাই, বাজারহাটে বিক্রিও নাই। ক্ষুদ্র স্থানীয় অর্থনীতি স্তব্ধপ্রায়।
আমাদের দেশের সরকারের যখন এই মুহূর্তে আরও বেশি করিয়া সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা, একের পর এক জনবিরোধী আইন ও নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে সে দেশের সম্পদ সাধারণ নাগরিকের অধিকারের বাইরে লইয়া যাইতে বদ্ধপরিকর। সুখে দুঃখে অনুদ্বিগ্ন দেশের নিরো-প্রতিম প্রধান সেবক ক্যামেরা কভারেজ সহযোগে ময়ুরের সেবায় রত। করোনার সঙ্কটকে ভারতবর্ষে বহুগুণ বিবর্ধিত করিয়া তুলিয়াছে কর্পোরেটের পদলেহনকারী বেনিয়া সরকার। এই সম্পাদকীয় লিখিত হইবার মুহূর্তে বিভিন্ন স্থানে পথে নামিয়াছেন আমাদের দেশের কৃষকেরা, সাম্প্রতিক কৃষিনীতি প্রত্যাহারের দাবিতে, কারণ বর্তমান শাসকের এই নীতি মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষকের কর্পোরেটের হস্তে সহজবধ্য করিয়া তুলিয়াছে।
বিপরীতে, একটি বিষয়ে আমরা বিস্মিত না হইয়া পারি না, তাহা হইল এই আতঙ্কের চোখে চোখ রাখিয়া সারা বিশ্বে সাধারণ মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন এবং আক্ষরিক মরণপণ লড়াই৷ এই লড়াই সে অর্থে হয়তো কোনও মহতী সংগ্রাম নয়, নিতান্ত গ্রাসাচ্ছাদনের দায়ে, নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে সাধারণ মানুষকে আজ সঙ্কট উপেক্ষা করিয়া পথে নামিতে হইয়াছে, কিন্তু মানুষের অস্তিত্বের চেয়ে মহৎ অন্য কিছু আছে নাকি? কোভিড ও লকডাইন কাড়িয়া লইয়াছে স্বাভাবিক উপার্জনের পথ, রূপকথার ফিনিক্স পাখির ন্যায় শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ খুঁজিয়া নিয়াছে জীবনধারণের নিত্যনতুন পথ। যে মানুষটি বড়বাজারে খাতা লিখিতেন, তিনি তার এলাকায় বাজারে শাকসবজির পসরা নিয়া বসিয়াছেন৷ যাহার শহরে রেস্টুরেন্টের চাকুরি চলিয়া গিয়াছে, তিনি অল্প পুঁজি লইয়া পথপার্শ্বে ডিমের ব্যবসা শুরু করিয়াছেন৷ বদলাইয়া যাইতেছে শ্রমের লিঙ্গরাজনীতি। লকডাউনে ঘরে বসিয়া গিয়াছেন অসংখ্য পুরুষ, বাড়ির মহিলারা ঘর হইতে বাহিরে আসিয়া বিকল্প পেশায় হাল ধরিতেছেন৷ বিপুলা ভারতের অগণন অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষ ও তাঁহাদের আপসহীন দুঃসাহস সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দেশকে অদ্যাবধি সচল রাখিয়াছে, ভবিষ্যতেও রাখিবে।
কোভিড লইয়া কোনরূপ তাত্ত্বিক আলোচনা নহে, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর অক্টোবর সংখ্যায় আমরা লিপিবদ্ধ করিতেছি সেইসব অতিসাধারণ শিল্পী-কারিগর-শ্রমজীবী মানুষের যাপনকথা, আসন্ন উৎসবের আলোকে তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা, জয়-পরাজয় এবং ধূলি হইতে পুনরায় উঠিয়া দাঁড়ানোর আখ্যানমালাকে৷ আমরা নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত, অথবা কর্মহীন, নানা পরিচয়ের মানুষের পাশে বসিয়া শুনিয়াছি তাহাদের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কথা, তেমনি দেখিয়াছি পুনরায় জীবনের ফিরিয়া আসার লড়াইকে। এই সংখ্যার পাঁচটি সুনির্বাচিত লেখায় আমরা সাজাইয়া দিলাম রোদেপোড়া জলেভেজা আটপৌরে জীবনকে, সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামকে। লেখাগুলি লিখিয়াছেন অভীক ভট্টাচার্য, শুভ্র মৈত্র, সৌমিত দেব, জগন্নাথদেব মণ্ডল, ও দিগন্ত শর্মা।
ইহার সহিত এই মেল ট্রেনের এই যাত্রায় আমরা স্মরণ করিলাম পর্বতারোহী আং রিটা শেরপা, রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী পূর্বা দাম এবং কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালকে। দেশের বামপন্থী আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেন শতবর্ষে পদার্পণ করিলেন। তাঁহাকেও শ্রদ্ধা জানানো হইল। এর রহিল নিয়মিত বিভাগগুলি— কবিতা, গল্প, অণুগল্প, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য, অন্যগদ্য, ফটোফিচার; এবং বিশেষ বিভাগগুলি— স্টিম ইঞ্জিন, ডিসট্যান্ট সিগনাল, উইন্ডো সিট, হুইলার্স স্টল, ভালো খবর।
অতএব, বন্ধুরা, ডালগোনা কফি তৈরি বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিনেমা দেখার অলস দুপুর ভারতবর্ষে করোনার প্রকৃত চিহ্নায়ণ নহে, কোভিড অতিমারির নখের আঁচড়ের দাগ ধরা রইল চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর দেওয়ালের গায়ে। প্রিয় পাঠক, আসুন, পড়ুন, রক্তাক্ত হোন।