বিদ্যাসাগর, নাস্তিকতা ও মদীয় আচার্যদেবগণ সংক্রান্ত আরও কিছু কথা

বিদ্যাসাগর, নাস্তিকতা ও মদীয় আচার্যদেবগণ সংক্রান্ত আরও কিছু কথা -- দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

 


লেখক প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী

 

 

 

 

আমার পূর্ববর্তী লেখায় খানিক বিস্তার সহযোগে বর্ণনা করেছিলাম, সারা জীবন জুড়ে বিদ্যাসাগর কীভাবে কথা, আচরণ ও কর্মে ধর্ম ও ঈশ্বর থেকে দূরে থেকেছেন, সে নিয়ে কথা বলতে সাধারণত অস্বীকার করেছেন, কথা বলতে বাধ্য হলে আশ্রয় নিয়েছেন রঙ্গ-ব্যঙ্গ-সংশয়-তাচ্ছিল্যের, এবং ধর্মের ভুয়ো-পণ্ডিতি কুপ্রথা কুসংস্কার অন্ধত্ব অমানবিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন সজোরে এবং সপাটে।

এখন, বিদ্যাসাগরের জীবনের এত সব কথাবার্তা ও কাজকর্ম থেকে ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর চিন্তার অবয়বটি বেশ পরিষ্কারভাবেই ফুটে ওঠে হয়ত বা, সে নিয়ে সংশয় বা বিভ্রান্তির আর খুব বেশি পরিসর থাকে না। তাঁর মূল চারজন জীবনীকার, যাঁরা সকলেই ধার্মিক মানুষ ছিলেন, তাঁদেরকে স্বভাবতই এ অবয়বটি বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে। এ নিয়ে তাঁরা হয়ত কখনও বা অনুযোগ করেছেন, কিন্তু মূলত আশ্বাস পেতে চেয়েছেন এই বিশ্বাসে যে, বিদ্যাসাগরের আচরণ অনেকটাই অপ্রথাগত ও ব্যতিক্রমী হলেও (তেজি পুরুষদের অমন হয়েই থাকে), আসলে তো তিনি পরম ধার্মিকই ছিলেন, তা না হলে তিনি তাঁরই রচিত শিশুপাঠ্যে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও মহিমা ঘোষণা করেছেন কেন? সারাজীবন হিন্দু ব্রাহ্মণের সুনিশ্চিত চিহ্ন উপবীত ধারণ করলেন কেন? ‘হিন্দুর অভক্ষ্য’ কখনও খেলেন না কেন? তাঁর স্বহস্তে লেখা চিঠিপত্রের মাথায় সব সময়ে ‘শ্রীহরি শরণং’ লিখতেন কেন? পিতার মৃত্যুর পরেই বা পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করলেন কেন? বলা বাহুল্য, শিক্ষা-সংস্কার প্রসঙ্গে সরকারকে বারবার পাঠানো বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে অজ্ঞতা এ ব্যাপারে তাঁদের নিশ্চিন্ত মনোভাবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তবে, বিদ্যাসাগরের মূল জীবনীকাররা যে সব সময়েই তাঁর অ-ধার্মিক প্রবণতাগুলোকে ক্ষমা করেছেন বা সে সম্পর্কে নীরব থেকেছেন, এমনটা মোটেই নয় কিন্তু। বিহারীলাল সরকার এবং সুবলচন্দ্র মিত্র উভয়েই সুর মিলিয়ে বলেছেন, বিদ্যাসাগরের কাজকর্মে হিন্দুধর্ম ও সমাজের অনেক ক্ষতি হয়েছে, তবে সেই সঙ্গে তাঁরা এটুকু ছাড় দেন যে, ওটা ছিল ওই যুগেরই বৈশিষ্ট্য, এবং বিদ্যাসাগর যা করেছেন তা তাঁর নিজের দোষ নয়, সবই তিনি করেছেন ওই যুগধর্মেরই তাড়নায়। আরেক মূল জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিভ্রান্তস্বরে বলেন, বিদ্যাসাগর মোটের ওপরে ধার্মিকই বটেন, কিন্তু তাঁর আচরণ হিন্দু বা ব্রাহ্ম কারও সঙ্গেই মেলানো যায় না।

অবশ্য, শুধু ধার্মিকেরা নয়, এই একই প্রশ্নগুলোকে সামনে রেখে বিদ্যাসাগরকে রক্ষণশীল বামুনঠাকুর সাজাবার খেলায় নেমেছেন নিজেকে প্রান্তিক-দরদী বলে দাবি করা র‍্যাডিক্যাল বুদ্ধিজীবীও— তবে সে কথায় পরে আসছি। আপাতত একটু দেখে নিই, বিদ্যাসাগরের জীবনীকারেরা ছাড়া অন্যান্য সমসাময়িক ঘনিষ্ঠ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এ প্রসঙ্গে তাঁর অবস্থানকে কীভাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। যাঁর নাম প্রথমেই আসবে তিনি ‘পজিটিভিস্ট’ দর্শনের অনুগামী কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, যিনি নিজেকে এবং বিদ্যাসাগরকেও ‘নাস্তিক’ বলে দাবি করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের কথাবার্তা ও জীবনযাপন প্রত্যক্ষ করা ছাড়াও, কৃষ্ণকমলের ঝুলিতে ছিল কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি। বিদ্যাসাগর তাঁকে একবার বলেছিলেন, ঈশ্বর যদি থাকেনও, তিনি তো আর কামড়াবেন না! তাছাড়া, কৃষ্ণকমল তাঁকে পরকালতত্ত্ব নিয়ে হাসাহাসিও করতে দেখেছেন। ‘যোগসাধন-পথে কতকটা অগ্রসর’ হওয়া ললিত চাটুজ্জেকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, হ্যাঁ রে, আমারও কি পরকাল আছে নাকি রে? এ সব অভিজ্ঞতা থেকে কৃষ্ণকমল সিদ্ধান্তে আসেন, বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন। গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছেন, এক কৃষ্ণকমল ছাড়া আর কেউই নাকি কখনও বিদ্যাসাগরকে ‘নাস্তিক’ বলেননি (৩, পৃষ্ঠা ৩০), কিন্তু কথাটা ভুল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওই একরকমের নাস্তিক ছিলেন, যাকে বলে অজ্ঞেয়বাদী।’ একই কথা কিঞ্চিৎ ক্ষোভের সঙ্গে ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও। ব্রাহ্মধর্মের প্রচার ও সংশ্লিষ্ট ধর্মতত্ত্বচর্চার উদ্দেশ্যে তিনি প্রকাশ করেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, তার সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ করেন অক্ষয় দত্তকে, সে ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করার জন্য ‘গ্রন্থাধ্যক্ষ’ নামে পদ সৃষ্টি হয়, এবং তাতে নিযুক্ত হন বিদ্যাসাগর। দুজনে মিলে সে পত্রিকায় ধর্মতত্ত্বকে পেছনে ঠেলে ক্রমাগত বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কের লেখাপত্র ছাপতে থাকেন, ফলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রাহ্ম নেতা রাজনারায়ণ বসুকে ব্যক্তিগত পত্রে লেখেন, ‘কতকগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে, ইহারদিগকে এ পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে আর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।’ এরই ধারেকাছে মন্তব্য আরও পাওয়া যায়। অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বসু তাঁকে এক নিঃশ্বাসে ‘একেশ্বরবাদী’ এবং ‘(Agnostic) সংশয়বাদী’ বলে অভিহিত করেন, যাতে শব্দদুটির অর্থ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু বিভ্রান্তির ইঙ্গিত মিললেও (যেহেতু দুটো আখ্যা একসঙ্গে সত্যি হতে পারে না), বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মোটাদাগে তাঁর মনোভাব বুঝতে বিশেষ কিছু অসুবিধে হয় না।

বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সমসাময়িকদের মূল্যায়ন নিয়ে খানিক নড়াচড়া হয়ে যাওয়ার পর, আধুনিক বিদ্যাসাগর-গবেষকরা এ বিষয়ে কী বলেন সেদিকে তাকাবার এটাই বোধহয় সেরা সময়।

বিশ শতকের শেষার্ধে যাঁরা বিদ্যাসাগর চর্চায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তাঁরা হলেন বিনয় ঘোষ, গোপাল হালদার, অশোক সেন, রাধারমণ মিত্র, বদরুদ্দিন উমর ইত্যাদিরা (অন্যান্যরাও আছেন, তাঁদের কারও কারও নাম যথাস্থানে আসবে)। এঁরা কেউই (রাধারমণ মিত্র ছাড়া) তাঁকে সেই অর্থে ‘নাস্তিক’ বলে ঘোষণা করেননি (কেউ বলেছেন ‘অজ্ঞেয়বাদী’, কেউ বলেছেন ‘একেশ্বরবাদী’), কিন্তু সকলেই সশ্রদ্ধচিত্তে মেনেছেন, তিনি ছিলেন আদ্যন্ত ‘সেক্যুলার’ বা ধর্মনিরপেক্ষ। অর্থাৎ, তাঁর নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস যাই হোক না কেন, মানুষই তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে ছিল, ঈশ্বর নয়। এবং, মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে গেলে পরলোক নয়, ইহলোকের মাটিতেই করতে হবে, এবং ধর্ম ও কুসংস্কারের বাধা সবলে সরিয়েই তা করতে হবে, এই উপলব্ধিই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কথা ও কাজে। সেই অর্থে, ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীভিত্তিক এক প্রাচীন ও আবদ্ধ গ্রামসমাজ থেকে এই যে আমাদের এক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতি হিসেবে উঠে আসা, যে প্রক্রিয়া হয়ত বা আজও অনেকটাই অসম্পূর্ণ, সেই উৎক্রমণে যে ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের অবদান সবচেয়ে বেশি, বিদ্যাসাগর তাঁদের মধ্যে একজন।

আর, যাঁরা এসব কথা মানেননি, তাঁদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নাম ইন্দ্রমিত্র (অরবিন্দ গুহ), শঙ্করীপ্রসাদ বসু এবং পরমেশ আচার্য। এঁদের বক্তব্য, যুক্তি নয়, ভক্তিই ছিল বিদ্যাসাগরের সম্বল। এই শেষোক্তদের কথা একটু পরে এক এক করে আলোচনা করব। সবিস্তারেই করব, কারণ আমি এঁদের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে চাইব।

কিন্তু আগে তাঁদের কথাই বলি, যাঁরা তা মেনেছেন। রাধারমণ মিত্র বিদ্যাসাগরকে সরাসরি ‘নাস্তিক’-ই বলেছেন, কাজেই সে নিয়ে খুব বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই হয়ত বা। বাকিদের বক্তব্যগুলো বরং একটু জটিল এবং ‘ক্রিটিক্যাল’, কাজেই সেগুলোর দিকে ভালো করে নজর দেওয়া যাক। বিনয় ঘোষ বলেছেন, ‘তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না এমন কথা বলা যায় না, তবে তিনি যে একেশ্বরবাদী ছিলেন এবং তাঁর ধর্মবিশ্বাস ও ঈশ্বরবিশ্বাস একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’ (২, পৃষ্ঠা ৪৪৫) অর্থাৎ, বিদ্যাসাগর যে তাঁর রচিত শিশুপাঠ্যে (বিশেষত ‘বোধোদয়’ ও ‘আখ্যানমঞ্জরী’) ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও মহিমা ঘোষণা করেছেন, হিন্দু ব্রাহ্মণের পরিচিত পরিধেয় ধারণ করেছেন, স্বহস্তলিখিত পত্রাবলির শুরুতে দেবতার নাম করেছেন, এইসব তথ্যকে বিনয় ঘোষ সরল মনেই গ্রহণ করেছেন। ‘বিদ্যাসাগর যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস যদি না-ই করবেন, তো এইসব করতে গেলেন কেন’— এইরকমই ছিল নিশ্চয়ই শ্রীঘোষের মনের সহজ সরল অথচ অনুচ্চারিত প্রশ্নটি। কিন্তু, তার পিঠেই থাকে পাল্টা প্রশ্ন। বিদ্যাসাগর যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করবেনই, তো তাহলে আবার তাঁর শিক্ষা-সংস্কার সংক্রান্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রস্তাবে সাংখ্য-বেদান্ত-নব্যন্যায়কে ভ্রান্ত ও অসার বলে চিহ্নিত করতে গেলেন কেন (হিন্দু দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অন্য কোনও ধারাকেই যে কখনও সারবান বলে মেনেছেন, এমন কোনও দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত মেলেনি)? সত্যি বলতে কী, কেন যে তা করেছেন, সে ব্যাপারে বিদ্যাসাগর নিজে তো আর একটুও ধোঁয়াশা রাখেননি। অত্যন্ত পরিষ্কার এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে তিনি আবাহন করতে চান, এবং হিন্দু ধর্মতত্ত্ব তার ঠিক বিপরীতে কুসংস্কার ও অসার বাগাড়ম্বরে আচ্ছন্ন, কাজেই তা ভ্রান্ত। তাহলে, বিদ্যাসাগরের এই অতিদৃঢ় অবস্থানের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের এইসব আচরণের সঙ্গতি কোথায়? দার্শনিক এবং/অথবা মানসিক কোনও এক স্তরে কি এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন সম্ভব, নাকি, সঙ্গতির প্রশ্ন নেই, এ হল নিছক এক আখাম্বা অসঙ্গতিই? যদি অসঙ্গতিই হয়, তো বিদ্যাসাগরের মত একটি একমুখী জেদি সাহসী ব্যক্তিত্বের মধ্যে এমন অসঙ্গতির উদ্ভবই বা হল কোথা থেকে? না, বিনয় ঘোষ তাঁর পৃথুল গ্রন্থে এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে অগ্রসর হওয়ার অবকাশ পাননি। এমনটা আদৌ নয় যে তিনি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বা বিদ্যাসাগরীয় ‘অসঙ্গতি’ নির্ণয়ে অনাগ্রহী, তেমন দৃষ্টান্ত তাঁর গ্রন্থে অতি সুলভ (অন্য বিদ্যাসাগর-গবেষকরা সে সবের সঙ্গে সব সময়ে একমত হতে না পারলেও), তবুও এ ক্ষেত্রে তিনি সে চেষ্টা করেননি। বস্তুত, তিনি এ ব্যাপারে আদৌ কোনও অসঙ্গতিই দেখতে পাননি। তিনি লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগরচরিত্রের অত্যাশ্চর্য সংগতি দেখা যায় তাঁর মূল জীবনদর্শনের মধ্যে। প্রচলিত ধর্ম (Religion) ও অধ্যাত্মবাদী ভারতীয় দর্শনের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবের কোনও পরিবর্তন, তাঁর বার্ধক্য ও ব্যর্থতার জন্য, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত হয়নি।’ এবং তার পরেই, ‘তাঁর দৈনন্দিন জীবনের আচার-আচরণের মধ্যেও তিনি কখনও এদিক দিয়ে কোনও অসঙ্গতির পরিচয় দেননি।’ নিজের বক্তব্যের সপক্ষে সাক্ষ্য হিসেবে শ্রীঘোষ হাজির করেন অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বসুর স্মৃতিকথা (২, পরিশিষ্ট ৪), যেখানে অধ্যাপক বসু বলেছেন, তিনি বিদ্যাসাগরকে ব্রাহ্মণসুলভ ধর্মাচারে লিপ্ত হতে কখনওই দেখেননি। কিন্তু তাহলে, যে ব্যক্তি হিন্দু ধর্মতত্ত্বকে অসার বাগাড়ম্বর বলে মনে করেন, এবং পুজো-আর্চাও মোটেই করেন না, তিনিই আবার কেন শিশুপাঠ্যে ঈশ্বরের মহিমাকীর্তন করেন, উপবীত ধারণ করেন, পিতার মৃত্যুতে পারলৌকিক ক্রিয়া করেন, চিঠির মাথায় দেবতার নাম করেন? বিনয় ঘোষ এ ধাঁধার দার্শনিক-মনস্তাত্ত্বিক সমাধানের অন্বেষণে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি, শুধু তাঁকে ‘ব্যক্তিগত একেশ্বরবাদী’ বলে ঘোষণা করাটাই যথেষ্ট বলে মনে করেছেন।

অশোক সেন বিদ্যাসাগরকে ‘অ্যাগনোস্টিক’ বা অজ্ঞেয়বাদী বলে রায় দিয়েছেন (১১, পৃষ্ঠা ১৫৬)। সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় বলেছেন, বিদ্যাসাগর কখনওই পরিষ্কারভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি, কিন্তু আবার সে সব নিয়ে কোনওদিনই কোনও মতও প্রকাশ করতে যাননি । তিনি ব্যস্ত ছিলেন এই ইহজগতে আমাদের সমাজের মঙ্গল করতে, আমাদের অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দুর করতে, অজ্ঞ অযৌক্তিক ক্ষতিকর সামাজিক রীতিনীতিকে তাড়াতে। এই যে ‘ঈশ্বর আদৌ আছেন কিনা সেটা জানা যায় না বা তা জানার কোনও দরকার নেই’ এমনটা মনে করা, একেই বলে ‘অজ্ঞেয়বাদ’। আর, পরলোক নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ইহলোকেই যা করার করতে হবে বলে এই যে ভাবনা, এটাই হল ‘সেক্যুলার’ বা ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান।’

গোপাল হালদার বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে পাঁচ পাতাব্যাপী আলোচনার পরে (১৯, ‘ভূমিকা’ অংশ, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৭) এ নিয়ে রায় দিতে অস্বীকার করেছেন, ‘… বিদ্যাসাগরের ধর্মমত একটা গৌণ প্রসঙ্গ; প্রায় নিষ্ফল আলোচনা। তাতে নিজেদের মতভেদ প্রমাণ করা যেতে পারে, এইমাত্র।’ বিদ্যাসাগর ধর্ম আর ঈশ্বর নিয়ে একটুও মাথা না ঘামিয়ে এই যে অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের পাহাড় ঠেলে সমাজকে সবলে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার— ‘আমাদের সে যুগের ‘ফার্স্ট ম্যান’— ধর্মনিরপেক্ষ জীবনযাত্রার, বস্তুমুখী জীবনদর্শনের, জ্ঞানবিজ্ঞানসম্মত যুগসাধনার।’ কাজেই, তাঁর ধর্মমত নিয়ে গবেষণা অর্থহীন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, বিদ্যাসাগরের উপরোক্ত প্রশ্নায়িত আচরণগুলোর প্রসঙ্গে কিছু বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন তিনি বোধ করেছেন। তাঁর বক্তব্যে নজর দেওয়া যাক— ‘ঈশ্বরচন্দ্রের রচিত পাঠ্যপুস্তকাদিতে পরমেশ্বরের সম্বন্ধে কোথাও কোথাও উল্লেখ আছে— ‘বোধোদয়ে’র সেই ঈশ্বর প্রসঙ্গ তো সুবিদিত। বিদ্যাসাগরের নিজের চিঠিপত্রে ‘শ্রীদুর্গা’, ‘শ্রীহরি সহায়’ প্রভৃতি শিরঃপাঠ রয়েছে— এসব ‘প্রমাণ’ থেকে অনেকের বক্তব্য, বিদ্যাসাগর ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হলে বই বা চিঠিপত্রে এসব লিখতেন না। কিন্তু ছাত্রপাঠ্য পুস্তকে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ না থাকলে সেদিনে কর্তৃপক্ষের নিকট বই গ্রাহ্য হত না; চিঠিপত্রে ‘শ্রীহরি সহায়’ ইত্যাদি পাঠ তো তখনকার দিনের চিঠিপত্রে প্রথাগত ব্যাপার— যেমন প্রথাগত ছিল সাধারণভাবে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রীয় বিবাহশ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া ও আচারনিয়ম পালন। এসব লেখায় বা আচরণে তাই বেশি গুরুত্ব আরোপ করা কি সমীচীন? বিদ্যাসাগরের লেখা ও সাধারণ কথাবার্তায় অন্যরূপ ‘প্রমাণ’ তো অনেক বেশি।’ মনে সামান্য অস্বস্তি জাগালেও, এ ব্যাখ্যার মধ্যে ভয়ঙ্কর অসঙ্গতি কিছু আছে বলে মনে হয় না। শিশুপাঠ্যে ঈশ্বর প্রসঙ্গ না থাকলে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমস্যা হতে পারে বা সমাজে প্রতিক্রিয়া হতে পারে— আজ থেকে দুশো বছর আগে সম্ভবত এ আশঙ্কা খুব বেশি অমূলক ছিল না। তবু, পরমেশ আচার্য বেশ বাড়াবাড়ি রকমের তীব্র ভাষায় এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন, এবং যথাসময়ে আমরা সে প্রসঙ্গে আসব।

‘বিদ্যাসাগর কি নাস্তিক ছিলেন?’ প্রবন্ধে প্রায় একই কথা বলেছেন অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (৬, পৃষ্ঠা ২৩০-২৪২)। ধর্ম নিয়ে বিদ্যাসাগরের অনীহা-ঠাট্টা-তামাশার নানা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে শেষে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, এ নিয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা অসম্ভব, এবং তা অপ্রয়োজনীয়ও বটে, যেহেতু তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মানবপ্রেমী, এবং মানুষের অকুণ্ঠ সেবাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তিনিও এই আচরণগুলো নিয়ে আলাদা করে কোনও আলোচনা বা ব্যাখ্যাদানের চেষ্টা করেননি।

এ প্রসঙ্গে আরেক প্রখ্যাত বিদ্যাসাগর-গবেষক বদরুদ্দিন উমরের রায় হল, এ বিষয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসার মত যথেষ্ট তথ্য হাতে না থাকলেও, এবং বিদ্যাসাগর আদৌ এ নিয়ে স্পষ্টভাবে তাঁর মত ব্যক্ত না করলেও, ‘এ ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান অনেকটা অজ্ঞেয়বাদীদের (Agnostics) মতোই।’ একদিকে বিদ্যাসাগর হিন্দুসমাজের ধর্ম-সংশ্লিষ্ট কুপ্রথাগুলোর বিরুদ্ধে লড়ছেন এবং হিন্দু ধর্মতত্ত্বকে অসার বাগাড়ম্বর বলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছেন, অজ্ঞতা-অন্ধত্ব-কুসংস্কারের প্রতিষেধক হিসেবে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শন পড়ার বিধান দিচ্ছেন, এবং অপরদিকে আবার ধারাবাহিকভাবে ধর্ম নিয়ে মতপ্রকাশে অনীহা প্রদর্শন করছেন, কাজেই অজ্ঞেয়বাদী ছাড়া তিনি আর কীই বা হতে পারেন— বদরুদ্দিন উমরের যুক্তিটা বোধহয় মোটামুটি এইরকমই। সুখের বিষয়, গোপাল হালদারের মতই তিনিও বিদ্যাসাগরের তথাকথিত ‘ধার্মিক’ আচরণগুলো নিয়ে আলাদা করে কথা বলাটা জরুরি মনে করেছেন, এবং বিষয়টির আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছেন। যে বিদ্যাসাগর হিন্দু ধর্মতত্ত্বকে অসার বলে সপাটে খারিজ করেন তিনিই আবার ‘শ্রীহরি’ বা ‘শ্রীশ্রীদুর্গা’-য় বিশ্বাস করে চিঠির মাথায় তাঁদের শরণ নেবেন, এমন সম্ভাবনা বদরুদ্দিন উমর গোড়াতেই অসম্ভব বলে খারিজ করেছেন। কিন্তু তাহলে, বিদ্যাসাগর তা আদৌ করতেন কেন? এ প্রসঙ্গে লেখকের যা উত্তর, সেটি এখানে সরাসরি উদ্ধৃত করব, তবে তা একটু বড় হওয়ায় এখানে একসঙ্গে না দিয়ে নিচে একটু চোখে পড়ার মত করে আলাদাভাবে রাখব।

আসল কথা হল, লোকাচার সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের নিজের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। যে সমস্ত লোকাচারকে তিনি তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে নিজের সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রতিবন্ধক মনে করতেন, সেগুলিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন এবং সেগুলির বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন। কিন্তু যে সমস্ত লোকাচার অনেকখানিনিরীহ প্রকৃতিরছিল, সেগুলিকেমান্যকরলে সমাজসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হত না, সেই সমস্ত লোকাচার ও প্রচলিত নিয়মগুলিকে তিনি ‘সশ্রদ্ধভাবে’ নয়, নিতান্তই যান্ত্রিকভাবে মান্য করে চলতেন। চিঠিপত্রের শিরোনামায় ’শ্রীশ্রীদুর্গা শরণং’ ইত্যাদি লেখা এবং নিজ দেহে উপবীত ধারণ ইত্যাদি এই দ্বিতীয় ধরনেরই লোকাচার এবং প্রচলিত নিয়ম। এগুলি মান্য করার মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আস্তিকতা অথবা জাতিভেদে বিশ্বাস কোনোটিই বিন্দুমাত্র প্রমাণিত হয় না। কারণ একদিকে তিনি যেমন কোনোদিন লোকাচারের দাসত্ব করেননি, অন্যদিকে তেমনি তিনি প্রতিটি লোকাচার, দেশাচার ও প্রচলিত সামাজিক ব্যবহারের (social practice) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণারও কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি। এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অতিশয় বাস্তবমুখী। (১৮, পৃষ্ঠা ৫৪)

এ ব্যাপারে বদরুদ্দিন উমরের অবস্থান এ উদ্ধৃতিতে যেভাবে মূর্ত হয়েছে, তার চেয়ে পরিষ্কার করে বোধহয় আর কেউই তা অন্য কোনওভাবে বোঝাতে পারত না। এই একই কারণে, বিদ্যাসাগর রচিত ‘বোধোদয়’ নামক শিশুপাঠ্যে ‘নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’ ঈশ্বরের ব্যাখ্যান তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থান গোপাল হালদারেরই অনুরূপ, শুধু একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। গোপাল হালদার যখন মনে করছেন বিদ্যাসাগরের সারা জীবনের কর্ম ও আচরণের প্রেক্ষিতে তাঁর এই আচরণগুলো স্রেফ গৌণ এবং গুরুত্বহীন, তখন বদরুদ্দিন উমর ইঙ্গিত দিচ্ছেন, হ্যাঁ সে তো বটেই, কিন্তু একই সঙ্গে আবার হয়ত বা এগুলো তাঁর এক ধরনের ‘কাম্যুফ্লাজ’-ও বটে, যার আড়ালে থেকে তিনি বাঙালি সমাজকে আধুনিক যুগের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে সমস্ত গবেষকেরা বিদ্যাসাগরকে মোটের ওপরে ধর্ম-অনীহ বলে মানতে রাজি হয়েছেন তাঁদের বক্তব্যে আমরা এতক্ষণ একটু দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলাম, এবার আমরা নজর দেব তাঁদের দিকে যাঁরা তা মানেননি। তালিকায় প্রথমেই আসবেন ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ নামক সুবৃহৎ জীবনীগ্রন্থের লেখক ইন্দ্রমিত্র (আসলে সাহিত্যিক অরবিন্দ গুহ)। বিদ্যাসাগরের প্রচলিত জীবনীগ্রন্থগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে তথ্যবহুল, এমন এক প্রশংসা এ বই আদায় করেছে। তাছাড়া, এটি বেশ সুখপাঠ্যও বটে, বিদ্যাসাগরের জীবনের ঘটনাবলি এখানে বৈঠকি চালে গল্প বলার ঢঙে পরিবেশিত হয়েছে। অথচ, বইটিতে ভক্তির প্রাবল্য অত্যন্ত বেশি, বিচার-বিশ্লেষণের বালাই নেই, এবং তার গড়নের মধ্যে কোনও বিষয়ভিত্তিক বা কালানুক্রমিক সংগঠনও নেই (বইয়ের জ্যাকেটের ভেতরের ফ্ল্যাপ-এ লেখকের ছবিসহ যে পরিচয় দেওয়া আছে, তার শেষে রয়েছে এই অমোঘ ঘোষণা— “দুর্বলতা: দোক্তা ও জ্যোতিষচর্চা”)। অধ্যায়গুলো বিষয়ভিত্তিক নয় বলে তাদের কোনও শিরোনামের দরকার পড়েনি আদৌ— সেগুলো এক থেকে পঁচিশ পর্যন্ত স্রেফ সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত। ফলত, মোটেই দরকার পড়েনি সূচিপত্রেরও। লেখকের ভক্তসুলভ মেজাজটি চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে বইয়ের শেষদিকে, বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর মুহূর্তগুলো বর্ণনা করার সময়ে। অন্যতম মূল জীবনীকার বিহারীলাল সরকারের বই থেকে বিদ্যাসাগরের জীবনের শেষ কয়েকটি মুহূর্তকে তুলে এনেছেন ইন্দ্রমিত্র। তার দৃশ্যগুলো এইরকম। অন্তিম শয্যায় শায়িত বিদ্যাসাগর বাকশক্তিরহিত এবং প্রায় অচৈতন্য, যদিও তাঁর চোখদুটি খোলা। ঘরের পূর্বদিকের দেওয়ালে তাঁর মা ভগবতী দেবীর ছবি টাঙানো আছে, আর তিনি নিজে শুয়ে আছেন উত্তরে মাথা করে। একেবারে শেষ মুহূর্তে তাঁর মাথা ঘুরে গেল পশ্চিমে, যেখান থেকে তিনি পূর্বদিকের দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ছবির মুখোমুখি হতে পারেন। তারপর তিনি নিষ্পলক চেয়ে রইলেন মায়ের দিকে, চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল দরদর ধারায়, এবং ওই অবস্থাতেই ঘটল জীবনাবসান। বিবরণটি মর্মস্পর্শী, কিন্তু অলৌকিকতার ছিঁটেফোঁটাও নেই এখানে। ওই অবস্থার রুগির পক্ষে শুয়ে শুয়ে সমকোণে ঘুরে যাওয়া বেশ কঠিন, কিন্তু ভয়ঙ্কর অসম্ভব কিছু মোটেই নয়। পরিষ্কার বোঝা যায়, বাকশক্তিরহিত হলেও সম্পূর্ণ অচৈতন্য তিনি ছিলেন না, তা যদি হত তো খোলা চোখে মায়ের ছবির দিকে ফিরতে চাইতে পারতেন না। তাঁর মাথা ছিল উত্তরে, ঘুরে গেল পশ্চিমে— অন্তিম দশার এ বিবরণ তো আর জ্যামিতির উপকরণ দিয়ে মাপজোক করে বলা নয়। যদি এমন হয় যে তাঁর শিয়র প্রথমেই ছিল পশ্চিমঘেঁষা উত্তরে (যা মোটাদাগে ‘উত্তর’ বলে বর্ণিত হয়েছে), আর তার চূড়ান্ত অবস্থান হল উত্তরঘেঁষা পশ্চিমে (যা মোটাদাগে ‘পশ্চিম’ বলে বর্ণিত হয়েছে), তা হলে মোদ্দা ব্যাপারটা এই রকম দাঁড়াবে যে তাঁকে হয়ত সর্বসাকুল্যে বিশ পঁচিশ ডিগ্রি ঘুরতে হয়েছিল, যাকে একান্ত অবাস্তব বলে সাব্যস্ত করা যায় না। মায়ের সঙ্গে তাঁর সারা জীবনের যে তীব্র আবেগ ও আনুগত্যের বন্ধন, তাতে তাঁর শরীর এ আবর্তনের সুতীব্র কষ্টমিশ্রিত আশ্রয়ে সায় দিতেই পারত। অথচ, বিহারীলাল সরকার ঘটনাটির বিবরণ দেবার সময়ে বলেছেন, ‘কি এক মন্ত্রপ্রভাবে’ যেন বিদ্যাসাগর এটি ঘটিয়ে ফেললেন! আর, মিশন-ঘনিষ্ঠ ধার্মিক গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু বিহারীলালের উদ্ধৃতি সহকারে এ ঘটনার বিবরণ দিয়ে সিদ্ধান্ত টেনেছেন, ‘লৌকিক ভক্তির অলৌকিক রূপান্তর!’ (৩, পৃষ্ঠা ৪২)

দুঃখের বিষয়, ইন্দ্রমিত্র ছাড়িয়ে গিয়েছেন শ্রীবসু এবং শ্রীসরকারকেও। তিনি এই বিবরণটি দিয়েই তার অব্যবহিত পরে টেনে এনেছেন বৈষ্ণব সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সাক্ষ্য (১, পৃষ্ঠা ৬০৪)। বিদ্যাসাগর কলকাতার বাদুড়বাগানে তাঁর নিজের গৃহে অন্তিম নিঃশ্বাস ফেললেন রাত আড়াইটের সময়ে, আর পরদিন বেলা একটা নাগাদ গোস্বামী মহাশয় দেখলেন, সুন্দরী দেবকন্যারা সোনার রথে বিদ্যাসাগরকে তুলে নিয়ে স্বর্গের পথে রওনা হয়েছেন, নৃত্যগীত এবং চামর সহযোগে বাতাস করছেন, পতপত করে উড়ছে পতাকা। বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগানের বাড়ি থেকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে স্বর্গ-রথের যদি রাত আড়াইটে থেকে বেলা একটা বেজে যায়, তবে স্বর্গে পৌঁছতে যে কত সময় লাগতে পারে, সে হিসেব বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী সম্ভবত কোনওদিনই কারও কাছে দেননি, তবে রথযাত্রার রোমহর্ষক বিবরণটি সরবরাহে মোটেই কসুর করেননি। সোনার রথের রং স্বভাবতই হলুদ, সূর্যকরোজ্জ্বল আকাশের রঙ হলুদ, এবং কী আশ্চর্য, পতাকাগুলোও নাকি হলুদ! গবেষক আশীষ লাহিড়ীর অনুমান, সাধক গোস্বামী মহাশয়ের এ অলীকদর্শন সম্ভবত তাঁর দীর্ঘদিনের মরফিন-আসক্তির ফল, যেহেতু মরফিনসেবনজাত অলীকদর্শনে হলুদ রঙেরই প্রাবল্য দেখা যায় বলে বিজ্ঞানীরা রায় দিয়েছেন (১৫, নাম-প্রবন্ধটি দ্রষ্টব্য)। ইন্দ্রমিত্র এ উদ্ধৃতিটি সংগ্রহ করেছেন কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীর ‘শ্রীশ্রীসদ্গুরুসঙ্গ’ নামক বই থেকে। এ ধরনের উৎস যে সিরিয়াস গবেষণায় ব্যবহৃত হতে পারে, সেও এক অভিজ্ঞতা বটে !

তবে দুঃখের এখানেই শেষ নয়, কারণ, ইন্দ্রমিত্রের তরফে এ ধরনের স্খলনের এটিই একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। ‘হিন্দু অ্যানুইটি ফান্ড’-এর দায়িত্ব নিয়েও বিদ্যাসাগর পরে তা থেকে পদত্যাগ করেন, কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে ওখানে টাকাপয়সার হিসেবনিকেশে মোটেই স্বচ্ছতা থাকছে না। পদত্যাগের চিঠিতে তিনি নাকি লিখেছিলেন, ‘এই ফণ্ডের সহিত আর সংযুক্ত থাকিলে আমাকে দুর্নামের ভাগী হইতে হইবে এবং ঈশ্বরের কাছেও জবাবদিহি করিতে হইবে।’ এই উদ্ধৃতিটি সরবরাহ করেই ইন্দ্রমিত্র প্রশ্ন ছোঁড়েন, ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকলে কি ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহির কথা এমন করে লিখতে পারতেন বিদ্যাসাগর?’ কিন্তু, গৌতম নিয়োগী তাঁর ‘বিদ্যাসাগর উনিশ শতকের একমাত্র ‘সেকুলার’ চরিত্র’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিহারীলাল সরকারের মূল জীবনী থেকে এ চিঠির প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, এ পত্রে আসলে ঈশ্বরের উল্লেখ আদৌ ছিল না (১০, পৃষ্ঠা ৩০৯-৩১০)! পরিশ্রমী তথ্যবহুলতার প্রশংসা আদায় করে নেওয়া পৃথুল গবেষণা-গ্রন্থের পক্ষে, শ্লাঘার ব্যাপার নয় নিশ্চিতই। তবে, ইন্দ্রমিত্রের তরফে এ ধরনের স্খলনে অভিপ্রায় বা পরিকল্পনার ছাপ তেমন নেই, সবই যেন এক মুক্তকচ্ছ ভক্তের অসংবৃত শৈথিল্যের প্রকাশ। কে জানে, সবই হয়ত স্রেফ দোক্তা আর জ্যোতিষচর্চার লীলা!

কিন্তু মিশন-ভক্ত অতি বিচক্ষণ গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু যখন বিদ্যাসাগরকে ভক্ত আস্তিক সাজাতে চান, তখন সেখানে সচেতন পরিকল্পনার ছাপ থাকে অনেক বেশি। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা তাঁর বইয়ের গোড়াতেই তিনি ‘নিবেদন’ করেছেন, ‘আমি তো মূর্তি-পূজক হিন্দু, দেবতাকে সাক্ষাৎ দেখাই আমার স্বপ্নের সাধনা। দেবতাকে কাছে এনে দেখা এবং তাঁদের নিয়ে একটু-আধটু মজা করার অধিকার আমাদের আছেই। তাই যদি হয়, সেকালে ‘নরদেবতা’ রূপে কথিত বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে আমাদের সে অধিকার থাকবে না কেন?’ (৩, পৃষ্ঠা ৫)। কাজেই, লেখকের উদ্যোগটি যে অতি মহৎ, সে নিয়ে সন্দেহ করা কঠিন। এখন অতি সংক্ষেপে দেখা যাক, সে উদ্যোগের ফলাফল কী দাঁড়িয়েছে।

যথারীতি, ‘বোধোদয়’ ও ‘আখ্যানমঞ্জরী’ শিশুপাঠ্যদ্বয়ে ঈশ্বর-উল্লেখ, পত্রশিরে দেবতার শরণ, পিতামাতার পারলৌকিক ক্রিয়া— এইসব বিষয়ের সবিস্তার বর্ণনার পরে লেখক সিদ্ধান্তে আসেন, ‘…… তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দিহান ছিলেন, একথাও প্রমাণিত হয়নি। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, বিদ্যাসাগর নিরীশ্বরবাদী তো ননই, অজ্ঞেয়বাদীও নন, তিনি পরিষ্কার আস্তিক।’ যারা বিদ্যাসাগরকে ভক্ত ধার্মিক বানানোর বিরোধিতা করে থাকে, তাদেরকে বেশ এক হাত নিয়ে, কিন্তু কারও নাম না করে, শ্রীবসু সজোরে বলেন,

এই আলোচনায় তবু কিছু মজা আছে। এখন যাঁরা বিদ্যাসাগরকে নাস্তিক প্রমাণ করতে ব্যস্ত, তাঁরাই বিদ্যাসাগরকে আস্তিক প্রমাণ করার পটভূমি তৈরি করে দিয়েছেন। দয়ামায়া, কাঁদাকাটার কাদা মাখিয়ে বিদ্যাসাগরের হিন্দুমূর্তি নির্মাণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ঘোর আপত্তি জানিয়ে, তাঁরা বহু যত্নে বিদ্যাসাগরের এমন একটি ইমেজ তৈরি করে ফেলেছেন, যাতে দেখি, বিদ্যাসাগর আদর্শে অগ্নিশর্মা, নীতি বা কর্তব্যের ক্ষেত্রে একচুল এধারওধার সহ্য করতে প্রস্তুত নন। এক কথায়, এসব ক্ষেত্রে তিনি টগবগ করে ফুটতেন।

নিশ্চয়। আমরাও তাই বলি। আমরা সমস্বরে বলি, তিনি ভণ্ড ছিলেন না। সুতরাং যদি তিনি চিঠির ওপরে ‘শ্রীশ্রীহরিঃ শরণং’ লিখে থাকেন, তাহলে হরিকে (মূর্তির মধ্য দিয়ে না হলেও) অবশ্যই মানতেন। (৩, পৃষ্ঠা ৩১)

কিন্তু তাহলে, বেদান্ত আর সাংখ্য দর্শনকে কেন তিনি ভ্রান্ত দর্শন বললেন? এর যে ব্যাখ্যা শ্রীবসু খাড়া করেন, তা আমাদেরকে সত্যিই অবাক করে (৩, পৃষ্ঠা ৩৮)। প্রথমত, তিনি উল্লেখ করেন, কয়েক বছর পরেই আবার বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যসূচি থেকে বেদান্তকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। অর্থাৎ, বিদ্যাসাগর শিগগিরই তাঁর অবস্থান থেকে সরে এসেছিলেন। সহজ ইঙ্গিত, এবং বলা বাহুল্য, অপদার্থ ইঙ্গিত। বিদ্যাসাগর শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপার নিয়ে যতগুলো চিঠিচাপাটি করেছিলেন সরকারের সঙ্গে, তার কোনওটিতেই কখনও আদৌ বেদান্ত বা হিন্দু দর্শনের অন্য কোনও বিশেষ ধারার বইপত্রকে বাদ দিতে বলেননি, উল্টে এটাই বারবার বলেছেন যে, পাঠ্যসূচি থেকে এগুলোকে বাদ দেওয়ার কোনও উপায়ই তাঁর নেই। গোড়াতেই বলেছি, এ ব্যাপারে তাঁর লক্ষ্য ছিল মাত্র দুটি। এক, পাঠ্যসূচি এমনভাবে স্থির করা যাতে করে হিন্দু দর্শনের সবকটি ধারারই যথাযথ প্রতিনিধিত্ব থাকে এবং কোনও বিশেষ ধারারই একপেশে উপস্থিতি না থাকে, এবং দুই, ইউরোপীয় বিজ্ঞান, যুক্তিশাস্ত্র ও দর্শন এমনভাবে পড়ানো যাতে করে ছাত্র তার সাহায্যে হিন্দু দর্শনের ধ্যানধারণাগুলোকে প্রশ্ন করতে শেখে। কাজেই, বেদান্তকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা এটা মোটেই প্রমাণ করে না যে, হিন্দু দর্শন সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের অবস্থানের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, তিনি এই তথ্য তুলে ধরেন যে, বিদ্যাসাগর হিন্দু দর্শনের এক অতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ উদ্ধার করে সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন— মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’। এটি হিন্দু দর্শনের মূল ধারাগুলোর একটি চমৎকার অথচ সংক্ষিপ্ত সঙ্কলন ও উপস্থাপনা, যা থেকে হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন ধারার পরিচয় পাওয়া যায়। শ্রীবসুর দাবি, এটাও নাকি হিন্দু দর্শন সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ও শ্রদ্ধারই প্রকাশ, এবং এটাও ভুল দাবি। হিন্দু দর্শন সম্পর্কে তাঁর যে আদৌ কোনও আগ্রহ ও শ্রদ্ধাই ছিল না, তা হয়ত নয়। কিন্তু, ছাত্রদের কাছে হিন্দু ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন ধারার যথাযথ প্রতিনিধিত্বসহ তার সামগ্রিক পরিচয়দানের যে লক্ষ্য বিদ্যাসাগরের ছিল, সেটা অবশ্যই তাদেরকে হিন্দুত্বে মজাবার জন্য নয়, তাদেরকে প্রশ্ন-সক্ষম করে তোলার জন্যই। এখানে অনুমানের কোনও জায়গাই নেই, কারণ এ কথা তিনি স্বয়ং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন। কাজেই, তাঁর এ পদক্ষেপ সে লক্ষ্যের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ, এবং নির্ভুলভাবে সে দিকেই চালিত। এবং, আরও একটি বিষয় এখানে অবশ্য-উল্লেখ্য। ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ বইটির অন্যতম আলোচ্য ছিল চার্বাক দর্শন, যা অতি প্রাচীন ভারতের একটি নাস্তিক্যবাদী ধারা, যাকে মূলস্রোতের হিন্দু পণ্ডিত সমাজ মুছে ফেলতে চেয়েছিল, এবং সেইহেতু যা ভারতীয় দর্শনের এক বিস্মৃত বিষয় হয়েই ছিল। বিদ্যাসাগর সম্ভবত নিঃশব্দে তাকে আবার ছাত্র ও বিদ্বৎসমাজের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। সফলও হয়েছিলেন, সন্দেহ নেই, দেরিতে হলেও।

তৃতীয়ত, তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কে বলতে পারে, সাংখ্য ও বেদান্ত প্রচলিত অর্থে ঈশ্বরবাদী দর্শন নয় বলেই বিদ্যাসাগর তার বিরোধিতা করেছিলেন কিনা? ওই দুই মতের মধ্যে বিদ্যাসাগরের কাঙ্ক্ষিত মঙ্গলময় ঈশ্বরের স্থান নেই।’ এখানে তাঁর যুক্তিটি যে বেশ সহজ সরল, তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর বক্তব্য যা বোঝা যাচ্ছে সেটা বোধহয় এই রকম যে, সমাজ-মঙ্গলে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ বিদ্যাসাগর নিশ্চয়ই এক মঙ্গলময় ইশ্বরকেই মনেপ্রাণে চেয়ে থাকবেন, এবং সাংখ্য ও বেদান্তের ঈশ্বর যেহেতু জগতের দৈনন্দিন মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি উদাসীন এক কঠিন তত্ত্বনির্মিত অতি বিমূর্ত ঈশ্বর, অতএব বিদ্যাসাগর তা পছন্দ করেননি। এই অতি সরল যুক্তি মানলে এটাও মানতে হয় যে, ঈশ্বরাদিষ্ট মঙ্গলের প্রত্যাশী যে কোনও একজন গড় আমভক্তের বিশ্বাসের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বিশ্বাসের কোনও তফাতই ছিল না। ঈশ্বর বলে কেউ আছেন যিনি মঙ্গল করবেন, এ প্রত্যাশা তো অতি সাধারণ ভক্তের প্রত্যাশা, তাহলে বিদ্যাসাগরের আচরণ এত আলাদা কেন? কেন তিনি ধর্ম আর ইশ্বর নিয়ে কথাই বলতে চান না (পুজো-আচ্চা করা তো বহু দূরের কথা), কথা বলতে বাধ্য হলে হাসিঠাট্টা করেন, বিরাট বড় গণহত্যা বা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কেন বাঁচাতে আসেন না সে নিয়ে বেয়াড়া অভিযোগ করেন ধার্মিকদের আখড়ায়? ঐশ্বরিক মঙ্গলের প্রত্যাশী একজন আমভক্তের পক্ষে এ কি স্বাভাবিক আচরণ? শ্রীবসুও জানেন, তা নয়, তা কিছুতেই হতে পারে না। এর একটু আগে তো তিনি নিজেই বলেছেন, ‘একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। এখানে আমি বিদ্যাসাগরকে প্রচলিত অর্থে ধার্মিক প্রমাণ করতে চাইছি না। তিনি বিহ্বল ঈশ্বরপ্রেমিক ছিলেন না। ধর্ম বা ঈশ্বর-ব্যাপারকে তিনি প্রকাশ্যে অন্তত এড়িয়ে চলতেন।’

তাই, তাঁর ব্যাখ্যাকে তিনি আরেকটুখানি টেনে নিয়ে যেতে চান, এবং শেষ পর্যন্ত যা খাড়া করেন সেটা যারপরনাই নাটকীয়। একটু পরেই তিনি বলেন (৩, পৃষ্ঠা ৪১-৪২), ধর্ম বিষয়ে বিদ্যাসাগরের এই তাচ্ছিল্য এবং অনীহা আসলে নাকি বিদ্যাসাগরের তরফে এক ধরনের একান্ত নিজস্ব দার্শনিক ঔদাসীন্য, এবং এমন কি, শৈথিল্যও— ‘কেবল অধ্যাত্মদর্শন সম্বন্ধেই নয়, সর্ববিধ দর্শন সম্বন্ধেই!’ এবং, ‘তিনি কোনও দর্শনেই গভীরভাবে প্রবিষ্ট হবার মতো মেজাজের মানুষ ছিলেন না। ফলে, তাঁর ঈশ্বরবিশ্বাস প্রচলিত মঙ্গলময় ঈশ্বর-ধারণার চারধারে ঘুরপাক খেয়েছে।’ এবং সেইজন্যেই, বিদ্যাসাগর, ‘পৃথিবীতে অমঙ্গলের অস্তিত্ব দেখে চীৎকার করে বলেছেন— ঈশ্বর যদি মঙ্গলময় তাহলে জগতে অবিচার কেন?’ এদিকে, মূর্তিপুজোয় তিনি বিশ্বাস করেন না। কাজেই সহজ সিদ্ধান্ত, বিদ্যাসাগর, ‘মোটামুটি সগুণ নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন।’ এখানে ‘সগুণ নিরাকার’ কথাটার মানে হচ্ছে, বিদ্যাসাগরের ‘ঈশ্বর’ মূর্তিবিহীন, অথচ নির্লিপ্ত নির্গুণ নন, মঙ্গলময়তার গুণসম্পন্ন। কিন্তু, বিদ্যাসাগরকে দার্শনিকভাবে উদাসীন ও ‘শিথিল’ সাব্যস্ত করে তাঁর আস্তিকতাকে বাঁচানোর এই প্রকল্পটি যে কিঞ্চিৎ আশ্চর্যজনক, সেটা সম্ভবত বুঝেছিলেন বিচক্ষণ গবেষক শ্রীবসু। সেইজন্য তিনি তাঁর ব্যাখ্যাকে এর পরেও আরও একটু টেনে নিয়ে যেতে চান, এবং এভাবে শেষপর্যন্ত নিজের ফাঁদটি নিজেই রচনা করেন। তিনি বলেন, বিদ্যাসাগর মঙ্গলময় ইশ্বরকে চান, কিন্তু জগতে অমঙ্গলের ছড়াছড়ি দেখে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন, এদিকে আবার বিহ্বল ভক্ত বা কঠোর অদ্বৈতবেদান্তীর মত জগতকে মায়ার খেলা সাব্যস্ত করে তা থেকে সান্ত্বনাও আহরণ করতে পারেন না। অদ্বৈতবেদান্তী হওয়ার ক্ষমতা তো আর বিদ্যাসাগরের নেই, কারণ তিনি দার্শনিকভাবে উদাসীন, শিথিল, অগভীর। কাজেই, জগতে অমঙ্গলের বাড়াবাড়ি, এবং জগতের মঙ্গল করতে গিয়ে জগতেরই তরফে নিষ্করুণ, হিংস্র প্রতিরোধ— এর হাত থেকে বাঁচতে তিনি ধর্ম ও ঈশ্বর থেকে যথেষ্ট আশ্রয় পাননি, এবং শেষপর্যন্ত ঈশ্বরের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর অনন্যসাধারণ পিতামাতাকে। বাস্তবিকই, পিতামাতার প্রতি বিদ্যাসাগরের কমিটমেন্ট-টি অতি বিরল রকমের অসাধারণই বটে। সম্ভবত শ্রীবসু এই ভেবে তৃপ্তিলাভ করেছেন যে, বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত তাঁর এই দার্শনিক-মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণটি নিশ্চয়ই অত্যন্ত জোরালো, কারণ, তাই দিয়ে পিতামাতার প্রতি বিদ্যাসাগরের নিবিড় কমিটমেন্টের মত এক অতি বিশিষ্ট চারিত্র-লক্ষণকে তিনি ‘এক্সপ্লেইন’ করতে পারছেন। যদি সত্যিই তাই হয়, তো সেটা বেশ বৈজ্ঞানিক ব্যাপার বটে! কিন্তু, লেখক হয়ত খেয়াল করে দেখেননি যে, এই তৃপ্তিদায়ক ফুলটির ঠিক নিচেই আছে অসঙ্গতির কাঁটা। বিদ্যাসাগর যদি বাস্তবিকই ঈশ্বরের জায়গায় পিতামাতাকে বসিয়ে থাকেন (স্বয়ং বিদ্যাসাগরের তরফে এমন দাবির অস্তিত্ব আছে), তাহলে তো নিশ্চয়ই বিদ্যাসাগরের কাছে ‘ঈশ্বর’ মহোদয় আর তাঁর নিজের ‘স্বাভাবিক’ আসনটিতে উপস্থিত নেই, তাই না? শ্রীবসু-নির্মিত বিদ্যাসাগরীয় ‘সগুণ নিরাকার’ তবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, বিদ্যাসাগরীয় চেতনা-পরিসরের কোন স্থানাঙ্কটি তবে তার জন্য পড়ে থাকছে আর? বিদ্যাসাগরকে দার্শনিকভাবে উদাসীন-শিথিল-অগভীর সাব্যস্ত করাটাকে না হয় কেউ ক্ষমা করেই দিলেন, কিন্তু তাতে করে তাঁর এই আশ্চর্য দার্শনিক-মনস্ততাত্ত্বিক নির্মাণ-প্রকল্পটি আত্মধ্বংসের হাত থেকে বাঁচল কি আদৌ?

নাঃ, অনেক হয়েছে, বসু-পর্বে এবার বোধহয় ইতি টানাই ভালো। শেষে এসে এইটা পরিষ্কার করে বলাই ভালো যে, শ্রীবসু-নির্মিত শব্দ ও বাক্যজালের গভীরে ঢুকে এই যে এত সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার, এর সবটাই আসলে বোধহয় সম্পূর্ণ বৃথা ও অবান্তর। এ দিয়ে বিদ্যাসাগরীয় ধর্মবিশ্বাসের কোনও এক মডেল অন্তত নড়বড় করতে করতেও খাড়া হতে পারত হয়ত, যদি বিদ্যাসাগরের সুবিদিত কাজকর্ম ও কথাবার্তাগুলোই শুধুমাত্র আমাদেরকে ব্যাখ্যা করতে হত, এবং শিক্ষা-সংস্কারের প্রস্তাব হিসেবে তৎকালীন শিক্ষাসচিব জেএফ মৌয়াট সাহেবকে পাঠানো বিদ্যাসাগরের বিস্ফোরক চিঠিগুলোর আদৌ কোনও অস্তিত্ব না থাকত (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত পরিস্থিতি তাইই ছিল)। এই চিঠিগুলো যদি সত্যি সত্যি পুরোটা মন দিয়ে পাঠ করা যায়, তাহলে, কেন যে তিনি বেদান্ত আর সাংখ্যকে ভ্রান্ত বলেছেন (হিন্দু ধর্মতত্ত্বের অন্য কোনও ধারাকেই যে কোনও কালে খুব পছন্দ করেছেন এমন কোনও প্রমাণ নেই), সে নিয়ে জল্পনার আর বিন্দুমাত্র পরিসর থাকার কথা না। আগে এ নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছি, কাজেই পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই মোটেই, কিন্তু মোদ্দা কথাটা আরেকবার বললে সম্ভবত খুব বেশি অপরাধ হবে না। বিদ্যাসাগর বেদান্ত ও সাংখ্যকে ‘ভ্রান্ত’ বলেছেন, কারণটা যারপরনাই সোজাসাপটা— তাকে তিনি ‘সত্য’ বলে মনে করেননি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভুয়ো পণ্ডিতি কচকচি এবং অসার বাগাড়ম্বর বলেই মনে করেছেন। তাঁর কাছে উন্নততর সত্যের সন্ধান নিয়ে এসেছিল ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শন, এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারপদ্ধতি হিসেবে ইউরোপীয় যুক্তিশাস্ত্র, এবং তার সঙ্গে হিন্দু ধর্মতত্ত্বের যে বিন্দুমাত্র সাযুজ্য নেই, সেটা তিনি সহজেই বুঝেছিলেন। এ সব কথা বিদ্যাসাগরের কথাবার্তা থেকে গভীর বিশ্লেষণ সহযোগে পরোক্ষে অনুমান করার কষ্টস্বীকার করতে হয় না মোটেই, কারণ তিনি নিজেই অতি পরিচ্ছন্ন ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সরাসরি এইসব মত প্রকাশ করে গেছেন।

কাজেই, ‘মোটামুটি সগুণ নিরাকার’-এর গল্পটি ফুরোল, যদিও, ‘আস্তিক বিদ্যাসাগর নির্মাণ’ প্রকল্পের গাছটি এখনও পুরোপুরি মুড়োয়নি। শুধু ধার্মিক গবেষকদের কথা নয় এটা। পরমেশ আচার্যের মত নিজেকে এলিট-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, র‍্যাডিক্যাল বাম হিসেবে হাজির করা গবেষকও যে কীভাবে এই আশ্চর্য প্রকল্পে নিজেকে সামিল করতে পারেন, সেটা আমরা পরে কখনও দেখব।

 

[এখানে যেসব তথ্য ব্যবহার করেছি সে সবই বিদ্যাসাগর-চর্চা প্রসঙ্গে সুবিদিত, কাজেই বিস্তারিত সূত্র-নির্দেশের প্রয়োজন সেভাবে বোধ করিনি, অল্প দুয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও ‘ক্রিটিক্যাল’ ক্ষেত্র ছাড়া। নিচে যে সমস্ত বই ও প্রবন্ধের উল্লেখ করেছি, এখানে ব্যবহৃত হয়েছে এমন সব তথ্যই তাতে পাওয়া যাবে। বইয়ের নামগুলো বোল্ড এবং লেখকের নামগুলো ইটালিক্সে রাখলাম, আশা করি তাতে পাঠকের পড়তে সুবিধে হবে।]

 

তথ্যসূত্র

করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্রমিত্র, আনন্দ, ২০০৭
বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১১
রসসাগর বিদ্যাসাগর, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯২
বাঙালি প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫
সমকালে বিদ্যাসাগর, স্বপন বসু, বাংলার মুখ, ২০১৯
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, অর্ণব নাগ (সম্পাদনা), অক্ষর প্রকাশনী, ২০২০
রেনেসাঁসের আলোয় বঙ্গ দর্শন, শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, পুনশ্চ, ২০১৯
উনিশ শতকের বাঙালিজীবন ও সংস্কৃতি, স্বপন বসু ও ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী (সম্পা), পুস্তক বিপণি, ২০১৯
‘সংবর্তক’ পত্রিকা, কলকাতা, বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা, কলকাতা বইমেলা ২০২০
১০ ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকা, কলকাতা, বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যা, একত্রিংশ বর্ষ, ২০১৩-১৪, তৃতীয়-চতুর্থ সংখ্যা
১১ Iswar Chandra Vidyasagar & His Elusive Milestones, Asok Sen, Permanent Black, 2016
১২ বিদ্যাসাগর : নানা প্রসঙ্গ, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১১
১৩ জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, দ্বিজেন্দ্র ভৌমিক (সম্পা), আনন্দ, ২০২০
১৪ বিদ্যাসাগর কি সত্যিই আস্তিক ছিলেন ?, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য  (আন্তর্জাল ঠিকানা ‘academia.edu’ থেকে প্রাপ্ত)
১৫ ভদ্রলোকী যুক্তিবাদের দক্ষিণাবর্ত, আশীষ লাহিড়ী, ঋতাক্ষর, ২০১৭
১৬ Ballantyne-Vidyasagar Controversy : A Re-view, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, বিদ্যাসাগর কলেজ : স্মৃতিধন্য একশ পঁচিশ বছর (আন্তর্জাল ঠিকানা ‘academia.edu’ থেকে প্রাপ্ত)
১৭ নির্বাচিত প্রবন্ধ, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৯
১৮ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ, বদরুদ্দিন উমর, চিরায়ত প্রকাশন, ২০১৪
১৯ বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, ১৯৭২

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

4 Comments

  1. আমার এক বন্ধু, শুভঙ্কর চন্দ, একটি অনুরোধ পাঠিয়েছেন, নিম্নরূপ

    প্রিয় চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ,
    একটা বিশেষ অনুরোধ , লিবারেশন থিয়োলজি নিয়ে একটা এক্সক্লুসিভ লেখা
    চাইছি ।( ছোট করে লেখা নয় , যথেষ্ট ডিটেলসে লেখা )।

    • এটা তো আমার লেখার প্রতিক্রিয়া দেবার থ্রেড, কাজেই আমি জানিনা যে “চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম”-এর পরিচালকেরা আপনার এ অনুরোধটি দেখতে পাবেন কিনা । আমার মনে হয়, আপনি সরাসরি ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ভাল হবে ।

      • আমি দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য বলছি, এই প্রবন্ধের লেখক ।

    • প্রিয় রাহুলবাবু,

      চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম পত্রিকায় লিবারেশন থিওলজি নিয়ে আলাদা করে কোনও লেখা এখনও প্রকাশিত হয়নি বটে, তবে কদিন আগেই নিকারাগুয়ার বিপ্লবী-যাজক ফাদার এর্নেস্তো কার্দিনালের প্রয়াণে কবীর সুমনের একটি দীর্ঘ স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে লিবারেশন থিওলজির প্রসঙ্গ বিস্তারিতভাবে এসেছে। আপনি আগ্রহী হলে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের মহাফেজখানা থেকে সে লেখা ‘কবীর সুমন’ বা ‘এর্নেস্তো কার্দেনাল’ চাবিশব্দের সাহায্যে বেছে পড়ে নিতে পারেন। আপনার অনুরোধ নিয়ে আমরা অবশ্যই ভাবব। ধন্যবাদ।

      সম্পাদক
      চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...