গণধর্ষণ, হাথরস এবং দলিতগ্রাসী রাজনীতি

সুজন ভট্টাচার্য

 


লেখক প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক

 

 

 

 

 

গণধর্ষণ কি শুধু হাথরসেই হয়েছে? আর কোথাও হয় না? পশ্চিমবঙ্গে হয়নি? তাহলে শুধু হাথরস নিয়েই এত চিৎকার কেন? প্রতিবাদের এই নাটকের পিছনে সুস্পষ্ট রাজনীতি আছে। অন্য কোথাও ধর্ষণ হলে এদের চোখে পড়ে না। এরাই আসল চক্রান্তকারী। উত্তরপ্রদেশ সরকার তো ব্যবস্থা নিয়েছেন। তাহলে আর কী চাই এদের?

কথাগুলো নিশ্চয়ই অপরিচিত মনে হচ্ছে না। হাথরসের নারকীয় ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিবাদ বেড়ে ওঠার পর এমন যুক্তি (বা অপযুক্তি) শোনা যাচ্ছে। এবং বেশকিছু মানুষ তো প্রভাবিত হচ্ছেনই। কাজেই ফালতু কথা বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। হ্যাঁ, ধর্ষক কুত্তাগুলো যদি মুসলিম হত, তাহলেই এরা আবার সঙ্কীর্তন শুরু করে দিতেন, হিন্দুরা আক্রান্ত বলে। সে যাই হোক, অভিযোগের সারবত্তাটা একবার খতিয়ে দেখা যাক।

ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী এদেশে প্রতি ১৬ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ পুলিশের কাছে আসে। অর্থাৎ দিনে ৯০, মাসে ২৭০০ আর বছরে ৩২,৮৫০। এগুলো হল সেইসব ঘটনা যা পুলিশের কাছে ডায়েরি করা হয়েছে। এর বাইরেও বহু ঘটনা থাকে যেগুলো দিনের আলোয় আসে না। কারণ লজ্জা, সঙ্কোচ বা ভয়। এক আশ্চর্য সমাজে আমরা বাস করি। এখানে ধর্ষকের মত অপরাধীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি জোরে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়। আর চোরের মত লুকিয়ে থাকে ধর্ষিতা বা তার পরিবার।  

যাই হোক, এতগুলো ঘটনার প্রতিবাদ কোনও মানুষ তো দূরস্থান, মহামানবের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাহলে হঠাৎ কেন হাথরস নিয়ে এত উত্তেজনা? কারণ হল, উত্তরপ্রদেশ সরকার ও পুলিশের আচরণ। পুলিশ ঘোষণা করে দিল আদৌ কোনও ধর্ষণ হয়নি। মৃতার শরীর জোর করে গ্রামের মাঠেই পুড়িয়ে দিল ধর্মীয় সংস্কার ছাড়াই। পরিবারের কাউকে সামনে রাখাও হল না। বাইরের কেউ যাতে গ্রামে ঢুকতে না পারে তার জন্য গোটা গ্রাম ঘিরে ফেলা হল পুলিশি পাহারায়। স্বয়ং জেলাশাসক মৃতার পরিবারকে ধমকি দিয়ে এলেন।

হাথরস নিয়ে সামাজিক আলোড়নের এক ও একমাত্র কারণ হল এটাই। স্বয়ং সরকার একটা অপরাধকে শুধু চেপে দিচ্ছেন, এমন নয়, উলটে প্রতিবাদীদের দিকে চোখ রাঙাচ্ছেন। এমন ঘটনা যত্রতত্র দেখা যায় না। এর আগে দেখা গেছে জম্মুর কাঠোরে। পদ্ম-কোম্পানির লোকজন সেখানে প্রকাশ্যে মিছিল করে গণধর্ষণে অভিযুক্তদের রেহাই দাবী করেছিল। সম্ভবত কাঠোরই সেই মহান প্রবণতার জন্মদাতা, যেখানে ধর্ষকদের হয়ে রাস্তায় গলা ফাটানো হয়।

হাথরসও সেই একই পথের পথিক। শুনলাম। নবদ্বীপে নাকি গেরুয়া ছাত্ররা প্রকাশ্যেই দাবী তুলেছে ধর্ষকদের মুক্তি চাই। হাথরসের আশপাশের গ্রামগুলোর সাবর্ণ সমাজ (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ঠাকুর ও বেনে) মিটিং করে বলেছে, এমন ঘটনা তাদের ঘরের কোনও ছেলে করতেই পারে না। যুক্তি খুবই সরল। দলিতদের ছোঁয়া জল খায় না উচ্চবর্ণের মানুষ। তারা কেন দলিত মেয়েকে স্পর্শ করবে? ফুলন দেবীর উদাহরণ টেনে এনে লাভ নেই। কারণ, এরা যা বলছে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই বলছে।

কামদুনি বা পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার দোহাই দিয়ে হাথরসকে আড়াল করা যায় না। প্রাথমিকভাবে সরকারি ঔদাসীন্য থাকলেও, এইসব ঘটনায় কোনও রাজনৈতিক দল ধর্ষকদের পক্ষে মিটিং-মিছিল করেনি। দুটি ঘটনাতেই দায়রা আদালতে অপরাধীদের শাস্তি হয়েছে। কামদুনির ক্ষেত্রে আনসার আলি, সাইফুল আলি এবং আমিনুর আলিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ইমানুল ইসলাম, ভোলা নস্কর এবং আমিনুর ইসলামকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাবাসের শাস্তি। হ্যাঁ, এখনও হাইকোর্টে মামলা ঝুলে আছে। সরকারি গাফিলতি নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এটাও বাস্তব, সরকার বা শাসক দল আজ পর্যন্ত অপরাধীদের পক্ষে একটা কথাও বলেনি।

প্রাক্তন গেরুয়া সাংসদ স্বামী চিন্ময়ানন্দের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগটি খেয়াল আছে? জনৈকা আইনের ছাত্রী অভিযোগ এনেছিলেন, দিনের পর দিন মহান স্বামী তাকে ধর্ষণ করেছে। দেশজোড়া প্রতিবাদের মুখে গতবছর আগস্ট মাসেই ধরা দেন ‘স্বামীজী’। আর কিছুদিনের মধ্যেই অভিযোগকারিণীকেও গ্রেপ্তার করা হল। ‘স্বামীজী’ তার বিরুদ্ধে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ করলেন। শেষ খবর, এলাহাবাদ হাইকোর্ট ‘স্বামীজী’কে জামিন দিয়েছেন চলতি সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।

এটাই সেই লক্ষ্মণরেখা যা কাঠোর, শাহজাজানপুর আর হাথরসকে আলাদা করে দেয়। এখানে কেবল ধর্ষণ নয়, জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে ওঠে ধর্ষকদের হয়ে মুখ খুলে ফেলা রাজনৈতিক শক্তি ও প্রশাসন। এবং ঘটনাচক্রে সবক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুলটা একটা শিবিরের বিরুদ্ধেই উঠছে। পাল্টা অভিযোগ করে অপরাধ স্খালন করা যাবে না। কান্নাকাটি করেও নয়। অপরাধীতন্ত্রের বিরুদ্ধে সুস্থ মানসিকতার মানুষ লড়াই করছেন, করবেনও।

ধর্ষণের কারণ নিঃসন্দেহে যৌন তাড়না। যেমন ডেঙ্গুর কারণ হল মশা। এই সহজ অঙ্কটুকু বোঝার জন্য দিগগজ হবার দরকার পড়ে না। কিংবা মাথা খাটানোর। আরেকটু পিছনে হাঁটতে গেলে তবেই আবার খুলির ভিতরে থাকা বস্তুটার শরণ নিতে হয়। সেটা করব কিনা, সেটা অবশ্যই যার যার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। 

ধর্ষণ অবশ্যই অবদমিত যৌন তাড়নার প্রকাশ। কথাটা সত্যি, তবে আংশিক। যতক্ষণ বিষয়টা একের বিপরীতে একের উপস্থিতি থাকে, ততক্ষণই। গণধর্ষণ নিছক যৌন তাড়না থেকে ঘটে না, ঘটা সম্ভব নয়। যৌনতার মধ্যে যে চরম ব্যক্তিকতা থাকে, গণধর্ষণ তাকেই খারিজ করে দেয়। তাহলে কিছু মানুষ কেন একযোগে ধর্ষণ করে?

একটা উত্তর অবশ্যই মাদক। মাদকের প্রয়োগে বোধবুদ্ধি হারিয়ে গেলে এমন কাণ্ড আকছার ঘটতে পারে।

কিন্তু এই উত্তরটাও আংশিক। গণধর্ষণ আসলে একটা রাজনৈতিক অস্ত্র, ক্ষমতার প্রকাশ। জনগণের আন্দোলন দমানোর জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীদের মদতে গণধর্ষণের ইতিহাস অনেক পুরনো। যুদ্ধে বিজয়ী সেনাদলের হাতে ব্যাপকহারে গণধর্ষণের অজস্র উদাহরণ আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার খুব জ্বলন্ত উদাহরণ। 

পুরুষতন্ত্রের প্রভাব তো আছেই। সম্পদের পারিবারিক উত্তরাধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য পুরুষতন্ত্র সবচেয়ে কার্যকর সামাজিক কাঠামো। কিন্তু সেই মৌলিক ভিত্তিকে ছাপিয়ে গিয়ে নিজেদের গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য গণধর্ষণ হয়ে ওঠে এক চরম হাতিয়ার। গণধর্ষণের উদ্দেশ্য স্রেফ শারীরিক আনন্দ নয়। গণধর্ষণের এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য হল অবদমিত কিংবা বিরোধী গোষ্ঠীকে নিজেদের ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়া।

হাথরসের গণধর্ষণ চারজন বিকৃত মস্তিষ্কের হঠাৎ করে ঘটিয়ে ফেলা অপকর্ম বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা হয় মূর্খ, নয় তো ধান্দাবাজ। ভারতবর্ষে বিশেষত উত্তরপ্রদেশে গত পাঁচ-ছয় বছরে দলিত ও মুসলিমদের উপর অত্যাচার যেভাবে বেড়েছে, সেই প্রেক্ষাপটেই হাথরসকে বিচার করতে হবে। ভারতবর্ষের যাবতীয় সম্পদকে যেভাবে ইদানিং বানিয়া- শিল্পপতিদের উপঢৌকন দেওয়ার উন্মাদ প্রক্রিয়া চলছে, সেই প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে। তা না হলে হাথরসের নারকীয় ঘটনার তাৎপর্যকে বোঝা যাবে না। 

গত ছয় বছরে ভারতীয় অর্থনীতিকে ভেন্টিলেশনে পাঠানোর কাজ দ্রুততার সঙ্গে সারা হচ্ছে। লাটে তুলে দেওয়া হচ্ছে সরকারি ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান, জল-জঙ্গল-জমি। তার প্রাথমিক দায় যাদের বহন করতে হচ্ছে, তারা হয় আদিবাসী নয় দলিত। তাদের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যই হিন্দুত্ব-হিন্দিত্বের আক্রমণ এত বেড়েছে। দলিত নারীদের উপর সংঘবদ্ধ আক্রমণের কারণও সেটাই। 

জম্মুর কাঠোরের ঘটনা কি ভুলে গেছেন? রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গণধর্ষণের অনেক কাহিনিই আছে। ক্ষমতার মধু খেয়েছে, এমন কেউই সেই দায় থেকে মুক্তি পাবেন না। কিন্তু কাঠোরে গেরুয়া কোম্পানি সরাসরি মিছিল করে অভিযুক্তদের মুক্তির দাবী তুলল। এমন নির্লজ্জ ঘটনা ভারতবর্ষে এই প্রথম ঘটল। হাথরসে সেই প্রবণতা আরও মারাত্মক চেহারা নিল। রাজ্য সরকার ও প্রশাসন সরাসরি ধর্ষণের অভিযোগকে খারিজ করে দিয়েছে। নির্যাতিতার দেহ পরিবারের সম্মতি ছাড়াই পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হল। পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে পুরো গ্রাম যাতে কেউ না ঢুকতে পারে। 

যৌন তাড়নার প্রসঙ্গ তুলে দলিত নির্যাতনের এই ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনকে আড়াল করা যাবে না। পুরো প্রক্রিয়ার রাজনৈতিক চেহারা বড় স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাই উত্তরপ্রদেশে একের পর এক দলিতহত্যা কিংবা দলিত নারীকে গণধর্ষণের পরেও গেরুয়া কোম্পানির দলিত এমপি বা নেতারা নির্বাক। কারণ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতার মধু তাঁরা পেয়ে গিয়েছেন। সংরক্ষণ বজায় রাখতেই হবে বলে যারা গলা ফাটাচ্ছেন, সেই দলিত এলিটদের কতজন এই নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন? 

বাস্তবতায় আসুন। আগুনকে আড়াল করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন না। আজকের ভারতে শ্রমিক-কৃষকদের উপর নামিয়ে আনা আক্রমণ আর দলিত নির্যাতন এক হয়ে মিশে গেছে। বাঁচতে গেলে লড়তে হবে। ফ্যাসিবাদের যাবতীয় আগ্রাসী রূপের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াতে হবে। লেখায়, কবিতায়, ছবিতে, মন্তব্যে, গানে, নাটকে এবং অবশ্যই রাস্তায়। তাহলেই মুক্তির উপায় আছে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4885 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...