খইরলাঞ্জি থেকে হাথরস: দলিত মহিলাদের ধর্ষণ করার পরম্পরা চলছেই

স্ম্রুতি কোপ্পিকার

 


লেখক মুম্বাই-নিবাসী সাংবাদিক এবং কলামনিস্ট। বর্তমান নিবন্ধটি নিউজক্লিক-এ গত ১ অক্টোবর ইংরাজিতে প্রকাশিত হয়।

 

 

 

 

ভয় এবং যন্ত্রণার মর্মন্তুদ আর্তনাদ, ক্ষমতাহীনতার চূড়ান্ত অসহায়তা, সমস্ত ভয়ানক হুমকিগুলির আতঙ্ক সত্য হয়ে যাওয়া, চরম নিষ্ঠুরতা— হাথরসের বুলগাঢ়ি গ্রামের উনিশ বছরের মেয়েটির সঙ্গে মহারাষ্ট্রের খইরলাঞ্জি গ্রামের সপ্তদশী মেয়েটি ও তার মা-র এই সব কটা ব্যাপারেই হুবহু মিল ছিল অবশ্যই। থাকতেই হবে।

দলিত মহিলাদের গণধর্ষণ এবং খুনের এই দুই অভিযোগের মধ্যে ব্যবধান ১৪ বছরের। এর মধ্যে নির্ভয়া মামলা ঘটে গেছে— আমরা ধরে নিতে পারি এই ধরনের অপরাধের প্রতি ভারতীয় জনগণের সামগ্রিক চেতনা এবং সংবেদনশীলতা তীক্ষ্ণতর হয়েছে। কিন্তু তাতেও মহিলাদের— বিশেষ করে দলিত মহিলাদের নিরাপত্তা সেই ২০০৬-এ যা ছিল তার চেয়ে কণামাত্রও বৃদ্ধি পায়নি। বরং তাঁদের প্রতি অপরাধ— বিশেষত নিগ্রহ আর ধর্ষণ— গুণিতক হারে বেড়েছে।

মহারাষ্ট্রের সেই মা-মেয়ের বিকৃত দেহ উদ্ধার হয়েছিল ভান্ডারা জেলার খইরলাঞ্জির একটা খাল থেকে— সঙ্গে মেয়েটির দুই কিশোর ভাইয়ের দেহও— ২০০৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। গণরোষ তৈরি হয়েছিল— বিশেষত দলিত সংগঠনগুলির মধ্যে— মহারাষ্ট্র সরকার তৎপর হতে বাধ্য হয়েছিল। চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছিল মুম্বাই এবং দিল্লির মিডিয়া মহলেও। আজ, ১৪ বছর পর, এইসব দিক থেকেও বিশেষ কিছুই পাল্টায়নি।

মহারাষ্ট্রের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে আক্রান্ত পরিবারটি মাওবাদী। আর এই হাথরসের ঘটনায় উত্তর প্রদেশ পুলিশ তো নির্মমতার সমস্ত নজিরই দেখিয়ে দিয়েছে। তারা প্রথমে ঘটনাটি অস্বীকার করেছে, তারপর বলেছে ভুয়ো (ফেক নিউজ), তারপর ন্যূনতম ভদ্রতারও তোয়াক্কা না করে নির্মমভাবে আক্রান্ত উনিশ বছরের মেয়েটিকে ঠা ঠা রোদের মধ্যে একটি বেঞ্চে ফেলে রেখে দেয়, শেষে একটা স্থানীয় হাসপাতালে পাঠায়। স্বাভাবিকভাবেই অবস্থা সঙ্কটজনক হতে থাকে, কারণ তার আঘাত মারাত্মক ছিল। এবং তখন একরকম বাধ্য হয়েই মেয়েটিকে তারা দিল্লি পাঠানোর ব্যবস্থা করে। তার পরিবারের দাবি সেরকমই। এতেই শেষ নয়। মেয়েটি মারা যাওয়ার পর পুলিশ তার পরিবারকে তাদের বাড়িতে আটকে রেখে মাঝরাতে মেয়েটির দেহ পুড়িয়ে দেয়। তার পরিবারকে ধমক দেওয়া হয় এই বলে যে— “আপ সে ভি কুছ গলতিয়াঁ হুয়ি হ্যায়!”

দলিত মহিলারা জীবৎকালে খুব সামান্যই সম্মান পেয়ে থাকেন— এই সব ঘটনাগুলি দেখিয়ে দেয় তাঁদের মরতেও হয় কতটা অসম্মানের সঙ্গে। খইরলাঞ্জি থেকে হাথরস পর্যন্ত লাখো গল্প ছড়ানো আছে। লাশের গল্প—বিশেষ করে দলিত এবং আদিবাসী মহিলাদের লাশ— চরম নৃশংসতার শিকার হওয়া, সারা শরীরে বিষাক্ত পৌরুষ এবং লিঙ্গ ও জাতি আধিপত্যবাদের জ্বলন্ত ক্ষত ছড়ানো লাশ।

২০১৬ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে ৪০০০০০-এরও বেশি ধর্ষণের ঘটনার কথা জানা গেছে এবং কিছু সমীক্ষা অনুযায়ী এর এক-চতুর্থাংশই ঘটেছে দলিত মহিলাদের ওপর। মনে রাখতে হবে, এগুলি জানা গেছে, অজানা রয়ে গেছে এর ঢের বেশি। এবং আরও মনে রাখতে হবে, এর মধ্যে বৈবাহিক ধর্ষণ ধরা নেই।

 

সংখ্যা যখন সোচ্চার

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ডেটা থেকে দেখা যাচ্ছে ২০০৬-এ ২০০০০-এর অল্প কিছু কম সংখ্যাক ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল। দশ বছর পর, সংখ্যাটা ৪০০০০-এর কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। এবার এর মধ্যে কখনও কখনও কোনও ঘটনা সারা দেশকে কাঁপিয়ে দেয় আর আমরা নড়েচড়ে উঠি। যেমন ২০১২-র নির্ভয়ার ঘটনা। গণরোষ দিল্লি এবং কেন্দ্রের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে জনমতে পরিণত হয়। ধর্ষণ সংক্রান্ত ক্রিমিনাল আইন সংশোধিত হয়। “নো মোর নির্ভয়াজ” আওয়াজ ওঠে সারা দেশ জুড়ে। একটি ফান্ড গঠিত হয়। এবং অবশেষে ভারতীয় জনতা পার্টি এসবের ফায়দা তোলে ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনে।

মোট ধর্ষণের সংখ্যায় প্রতি বছরই এই উত্তরোত্তর বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে একটা যুক্তি শোনা যায়। মহিলাদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা গোপন করার প্রবণতা কমছে। এ আংশিক সত্য। নির্ভয়া মামলা নিয়ে ব্যাপক হইচইয়ের ফলে হয়তো অনেক মহিলাই এরকম ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সাহস পেয়েছেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে এতজন মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছেন ফি-বছর। এত বলতে সংখ্যাটা প্রতি বছর ৩২-৩৩ হাজার— এর মধ্যে গত সাত বছরে ২০১৬ ছিল জঘন্যতম— যার অর্থ, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯০ জন মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছেন।

বেশিরভাগই নিছক পরিসংখ্যান হিসেবে রয়ে যায়। কিছু ঘটনা ব্যতিক্রম, যেগুলি মনে থাকে, যেমন—চেন্নাইয়ের একটি কাঠুয়া মন্দিরের সেই বারো বছরের মেয়েটি যাকে সাত মাস ধরে ধর্ষণ করা হয়েছিল; কেরলের সন্ন্যাসিনীরা; উন্নাওয়ের ঘটনা— যেখানে ধর্ষিতাকে একটি কোর্টের সামনেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল; উত্তর প্রদেশের সেই মেয়েটি— বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাতে যে নিজের পরিবারকে মুছে যেতে দেখেছিল; বা হায়দ্রাবাদের সেই পশু-চিকিৎসক…

যদিও মহিলাদের যে আতঙ্কের সঙ্গে প্রতিদিন যুঝতে হয়, সংখ্যা দিয়ে তা মাপতে যাওয়াটা স্রেফ উপরিতলে আঁচড় কাটার মতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই সংখ্যাগুলি— বিশেষত জাতিভেদ এবং ধর্ষণের সম্পর্ক, বা মহিলাদের ওপর হওয়া যে কোনও অপরাধ— থেকে পালানোর কোনও উপায় নেই। এবার এই সংখ্যাগুলিকে রাজ্যভিত্তিক ডেটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্য প্রদেশে, যে রাজ্যগুলিতে বিষাক্ত পৌরুষ এবং জাতের গুমোর সমার্থক, সেসব রাজ্যেই মহিলা, বিশেষত দলিত মহিলাদের ওপর ধর্ষণ-জাতীয় ন্যক্কারজনক অপরাধগুলি সংঘটিত হয় সবচেয়ে বেশি। আর অপরাধীরা, ব্যতিক্রমহীনভাবে, উচ্চবর্ণের।

এই বছরের ন্যাশনাল দলিত মুভমেন্ট ফর জাস্টিস (এনডিএমজে)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৮-র মধ্যে দলিতদের উপর অপরাধের ঘটনা ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে: “দলিত মহিলাদের প্রায়শই উচ্চবর্ণের লোকেদের করা নানাবিধ হিংস্রতার চিহ্ন বয়ে বেড়াতে হয়। এই হিংস্রতার মধ্যে পড়ে শারীরিক হিংসা, যৌন হিংসা, এবং ডাইনি তকমা দিয়ে পীড়ন। এই কোভিড ১৯ অতিমারির মধ্যেও দলিত মহিলাদের বিভিন্ন রকমের পাশবিকতার মোকাবিলা করতে হয়েছে…। গত পাঁচ বছরে এই ধরনের অপরাধের ২০.৪০ শতাংশ— সংখ্যার বিচারে ৪১৮৬৭— সংঘটিত হয়েছে তফসিলি জাতিভুক্ত মহিলাদের ওপর।”

এনসিআরবি দলিতদের ওপর নিপীড়ন বৃদ্ধির এই প্রবণতা স্বীকার করেছে। তারা ২০১৩ থেকে ২০১৮ অবধি প্রতি বছরে এই বৃদ্ধি নথিভুক্ত করেছে। এই ধরনের ঘটনাগুলির ২৫.৬ শতাংশ একাই ঘটিয়ে যোগীর উত্তর প্রদেশ এই তালিকার শীর্ষে। ২০১৭ সালে তফসিলি জাতি ও উপজাতি (নিপীড়ন প্রতিরোধ) আইন ১৯৮৯-এ যতগুলি অভিযোগ জমা পড়েছিল এনসিআরবি সেগুলি প্রকাশ করে। দেখা যায় মোট নথিভুক্ত কেসের সংখ্যা ৫৭৭৫, যার ৫৫ শতাংশ হল দলিতদের “উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপমান করা এবং অবমাননার উদ্দেশ্যে হুমকি দেওয়া”র। অন্যগুলির মধ্যে রয়েছে দলিতদের জমি কেড়ে নেওয়া, তাঁদের পাবলিক স্পেস ব্যবহারে বাধা দান, এবং সামাজিকভাবে বয়কট করা।

 

সংখ্যার ওপরেও যাহা সত্য— জাতপাত

প্রচারমাধ্যমকে বলা ধর্ষিতার ভাইয়ের কথামতো বুলগাঢ়ি-হাথরসে তাঁদের গ্রামে অল্প কিছু দলিত পরিবারের বাস, এবং তাঁরা ছিলেন সেই তাদেরই এক ঘর। তাঁদের প্রতিবেশী উচ্চবর্ণের ঠাকুরদের সঙ্গে জমি নিয়ে তাঁদের একটা গোলমাল চলছিল। তাঁর কথা থেকেই জানা যায়, কিছুদিন আগে এইধরনেরই একটি আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার সময়ে তাঁর পিতামহের একটি আঙুল কেটে বাদ পড়ে যাওয়ার কথা; তাঁদের দেওয়া টাকাপয়সায় দোকানদারদের জল ঢেলে নষ্ট করে দেওয়ার কথা; কিংবা দোকানে জিনিসপত্রে তাঁদের স্পর্শ করাও নিষিদ্ধ করে দেওয়ার কথা।

ফলে জাতিভেদের দিকটি অগ্রাহ্য করে শুধু একটি যৌন অপরাধ হিসেবে ঘটনাটিকে দেখলে তা একেবারেই অর্থহীন হয়ে যায়। সমাজকর্মী এবং তাত্ত্বিকদের মতে, ঠাকুররা ওই তরুণীর উপর আক্রমণ ও অত্যাচার করে তাঁদের স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছিল: নিজেদের গণ্ডির মধ্যে থাকো, আমাদের সমকক্ষ হতে এসো না।

খইরলাঞ্জিতেও সেই একই গল্প। গ্রামে কিছু দলিত পরিবারের অন্যতম ছিল নিপীড়িত পরিবারটি। গ্রামে দাপট ছিল ওবিসি-কুনবি সম্প্রদায়ের। পরিবারটির উপর হওয়া বর্বর অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে স্থানীয় গুঞ্জন মূলত সেই পরিবারটির একটি পাঁচ একর জমির মালিকানা ও চাষাবাদের দিকেই নির্দেশ করে। মেয়েটির মা, যিনিও ধর্ষিত এবং নিহত হন, জমি সংক্রান্ত কাজকর্ম নিজেই দেখতেন এবং লক্ষ রাখতেন যেন তাঁর ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো পড়াশুনো করতে পারে। একজন পুলিশের সঙ্গে কিছু গ্রামবাসীর কলহের সময়ে তিনি সাক্ষী হিসেবেও দাঁড়িয়েছিলেন। সবমিলিয়ে, তাঁর কাজকর্মগুলি উঁচু জাতের লোকেরা অপরাধ হিসেবে দেখেছিল। পরিবারটিকে গ্রামে পাকা বাড়ি বানাতেও দেওয়া হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই প্রতিবেদককে বলা গ্রামের এক অভিযুক্তের বক্তব্য অনুযায়ী ‘ওই দলিত মহিলা আমাদের স্রেফ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাচ্ছিল।’

মহিলাটিকে শুধু ধর্ষণই করা হয়নি, তাঁকে নগ্ন করে প্রকাশ্য রাস্তায় ঘুরিয়ে বেশ কিছু লোককে দিয়ে এমনভাবে যৌন অত্যাচার করা হয়েছিল, যে তাঁর মাথার খুলি ভেঙে গেছিল এবং চোখদুটি প্রায় বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। তাঁর মেয়েকেও একইভাবে নগ্ন করে ঘোরানো হয়েছিল, ধর্ষণ করা হয়েছিল, এবং তাঁর গোপন অঙ্গে বাইরের কিছু জিনিসপত্রও ঢোকানো হয়েছিল। মেয়েটির ভাইদুটিকেও একইরকম অত্যাচার করা হয়। এগুলো যে তীব্র এক ঘৃণ্য জাতিবিদ্বেষের দৃষ্টান্ত সে নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই। নিহত মহিলাটির স্বামীর কথায়, ‘গোটা গ্রামটাই জড়িত ছিল। আমি প্রথমে আমার ফার্মে ছিলাম তারপর বাধ্য হয়ে একটা ঝোপের আড়ালে লুকোই।’

স্থানীয় পুলিশদের সাসপেন্ড করা হয়েছিল এবং সিবিআইকে ঘটনাটির তদন্তভার দেওয়া হয়েছিল। ফাস্ট-ট্র্যাক আদালতের বিচারে আটজন দোষী সাব্যস্ত হয় যাদের মধ্যে ছজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরে ২০১০ সালে বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে ২৫ বছরের কারাদন্ডে নিয়ে আসে এবং সেই সঙ্গে বলে এটি একধরনের ‘প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড’ এবং খুনিদের কোনও পূর্বপরিকল্পনা এবং জাতিবিদ্বেষ ছিল না। তফসিলি জাতি ও উপজাতি (নিপীড়ন প্রতিরোধ) আইন অগ্রাহ্য করা হয় এবং তার পেছনেও যুক্তি খাড়া করা হয়।

একইরকম বিস্ময়করভাবে অপরাধ থেকে ধর্ষণের মামলাকে সরিয়ে নেওয়া হল। কেস রেজিস্টার করতে এবং মেডিকেল পরীক্ষা করতে দেরি করা, প্রমাণ লোপাট আটকাতে পুলিশের অনিচ্ছা এবং দায়সারা বিচারব্যবস্থা সকলেই এর পেছনে দায়ী ছিল। বিচারে মেয়েটির শরীরের প্রায় সমস্ত জায়গায় ক্ষতচিহ্নের কথা এবং নিজেদের “কামুক চোখের পরিতৃপ্তির জন্য” অভিযুক্তদের তাকে নগ্ন করার কথাও আনা হয়েছিল। কিন্তু, আদালত বলল কোনও ধর্ষণের ঘটনাই নাকি ঘটেনি। মেয়েটির বাবা কিছু ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন এবং অন্যত্র বসবাস করা শুরু করেছিলেন। প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর সেই পুরনো বাড়ি গিয়ে একটি বাতি জ্বেলে আসতেন। বছর তিনেক আগে তিনি মারা গেছেন। আপিল এখনও সুপ্রিম কোর্টে আটকে আছে।

হাথরসের ঘটনাতেও পুলিশ মেয়েটির পরিবারকে তাকে একবার শেষ দেখা দেখতেও বাধা দিয়েছে এবং সমস্ত গ্রামবাসীদেরও আটকে রেখেছিল। আরও ভয়ঙ্কর, শেষমেশ মেয়েটির শরীর রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দেওয়া হল। দেশ জুড়ে ক্রোধের পরিণতি হিসেবে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার তো করা হল। কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে যে, যে ডাক্তারি প্রমাণ জোগাড় করা হয়েছে তা দিয়ে চাপের মুখে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নির্দেশে তৈরি হওয়া ফাস্ট-ট্র্যাক আদালতে ধর্ষণের অভিযোগ আদৌ প্রমাণ করা যাবে কিনা।

একটি সাবর্ণ (উচ্চবর্ণ) গোষ্ঠী ইতোমধ্যেই অভিযুক্তকে সমর্থন করতে জোটবদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু অন্যদিকে— হয়তো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য অপেক্ষাতেই— এমনকী ঘটনাটির তদন্তে বিশেষ তদন্ত কমিটি তৈরির সিদ্ধান্ত নিতেও মুখ্যমন্ত্রী দুসপ্তাহ অপেক্ষা করেছেন। এমনকী এসব ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বলরামপুরের একইরকম ভয়ঙ্কর আরেকটি ঘটনাও আলোয় এসেছে— আবারও সেই একইরকম এক দলিত নারীর গল্প, শিক্ষা পাওয়ার জন্য গণ্ডি টপকানোর চেষ্টা করতেই যাঁকে দুজন মুসলিম কর্তৃক ধর্ষণ করে হত্যা করা হল।

 

ধর্ষণ হল দলিতদের একটা বার্তা দেওয়া

দলিত এবং আদিবাসীদের সঙ্গে ঘটা অপরাধ, বিশেষত ধর্ষণ হঠাৎ করে হয় না। এই ঘটনাগুলি প্রায়শই বহু প্রাচীন কিছু বৈষম্য থেকে শুরু হয়— জমি, জল বা সামাজিক সুবিধেগুলি প্রাপ্তির জন্য দলিতদের উপর বহু মাস বা বছর ধরে চলে আসা অত্যাচার একধরনের পরিবেশ তৈরি করে যেখানে দলিতদের যখনতখন আক্রমণ করার একধরনের অধিকার জন্মে যায়। পরিস্থিতি এমনই আসে যে এসব তথাকথিত ছোট ছোট ঘটনা শাস্তি বা বিচার ছাড়াই অতিবাহিত হয়, কারণ প্রশাসন তাদের পক্ষে থাকায় উচ্চবর্ণের মানুষেরা সহজেই পার পেয়ে যায়। জাতীয় ও স্থানীয় প্রচারমাধ্যমের খুব সামান্য অংশই গত কয়েক মাসে দলিতদের উপর চলা এই ‘ছোট ছোট’ অপরাধের দিকগুলি তুলে ধরেছে; হাথরস ঘটনার পর দুদিনে প্রায় আঠারোটি ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত করেছেন এক সাংবাদিক।

বর্তমানে মাওবাদী যোগাযোগের অভিযোগে অভিযুক্ত এবং জেলবন্দি দলিত স্কলার ও অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বড়ের মতে, এই দীর্ঘস্থায়ী এবং বীভৎস অপরাধগুলি একধরনের বার্তার কাজ করে। খইরলাঞ্জির ঘটনার দশ বছর পর পর তিনি এবং এস আনন্দ এই ঘটনাকে ‘ধর্ষকাম ও পাশবিকতার এক অভিনব মিশ্রণ‘ বলে আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, “এই অত্যাচারগুলি সমগ্র দলিত সমাজকে শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে আসছে।” তেলতুম্বড়ে বলেছিলেন কীভাবে খইরলাঞ্জি অনেকগুলো ধারণা ভেঙে দিয়েছে, যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন জাতিভেদ প্রথাকে উচ্ছেদ করে দেয় অথবা রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতায় দলিতদের অন্তর্ভুক্তি তাঁদের সুবিচার পাওয়ার পথ তৈরি করতে প্রশাসনকে বাধ্য করে।

উত্তর প্রদেশ বিধানসভায় সামান্য যেসব দলিত বিধায়ক আছেন, এইসব অপমান ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখনও অবধি তাঁদের কিছু বলতে শোনা যায়নি। শেষ ২০১৭-র বিধানসভা ভোটের পর এখন শতকরা ৪৫ জন বিধায়কই উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি, এবং সংখ্যাটি আগের বিধানসভার থেকে ১২ শতাংশ বেশি। মোদি সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যরা, অবশ্যই খোদ মোদিকে ধরে— নির্ভয়ার ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে যাঁদের কোনও কসুর করতে দেখা যায়নি— এই ঘটনাগুলি সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কোনওরকম সান্ত্বনা বা নিন্দাবাক্য প্রকাশ করেননি। উত্তরপ্রদেশ থেকে নির্বাচিত বিদায়ী কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গান্ধি এবং বর্তমান ভারপ্রাপ্ত স্মৃতি ইরানিদের মতো বাকপটু মহিলারাও এব্যাপারে একটিও কথা বলেননি। বিজেপি যে সবসময়েই উচ্চবর্ণ, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ঠাকুর বা বেনিয়াদের পক্ষে, ভোট কৌশল এবং রাজনৈতিক পুঁজি— দু দিক থেকেই, এব্যাপারে কোনও দ্বিধাই থাকতে পারে না। কেউ যেন তাদের ‘সব কা সাথ’ স্লোগান নিয়ে বিভ্রান্ত না হয়।

তাঁর বিশ্লেষণধর্মী বই ‘খইরলাঞ্জি: আ স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড বিটার ক্রপ’-এ তেলতুম্বড়ে বিস্তৃতভাবে বলেছেন কেন দলিত— বিশেষত দলিত নারীদের উপর চলা এইধরনের বীভৎস অত্যাচার কোনওরকম ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বা ‘কিছু অসামাজিক বর্বর দানবের দুর্বৃত্তি’ নয়। দলিতদের উপর চলা হিংসা, বিশেষত ধর্ষণ, সামাজিক ক্রম বলবৎ রাখার জন্য একধরনের কার্যকর ও পরিকল্পনামাফিক পথ। যে কারণে “একটি গোষ্ঠী দ্বারা কৃত হয়ে বাকি সবার চশমা হিসেবে কাজ করে এইসব অপরাধ … ধর্ষণ আর কোনও ব্যক্তিগত অপরাধ থাকে না, এটি তখন এক সামাজিক উদযাপনের কারণ হিসেবে কাজ করে।” তাঁর কথায় “অত্যাচারগুলি এমন জটিল এবং নারকীয়ভাবে পরিকল্পনা করা হয় যাতে সেগুলি সমগ্র দলিত সমাজের কাছে একটা শিক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারে।”

এইজন্যই হাথরসের ঘটনার পর আবার উঠতে থাকা সেই ‘ধর্ষকদের ফাঁসি চাই’ ডাক, নির্ভয়ার ধর্ষকদের ফাঁসি দেওয়া, অথবা হায়দ্রাবাদে অভিযুক্তদের এনকাউন্টারে হত্যা করা ইত্যাদি দিয়ে দলিতদের উপর বেড়ে চলা নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচারের ঘটনার মতো গভীর সমস্যার দিকে এক ফোঁটাও আলোকপাত করা যায় না। এইসব প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক ক্রোধান্বিত জনতার প্রতিশোধস্পৃহার সাময়িক উপশম করে মাত্র, কোনওভাবেই ভেতরে ঢুকে থাকা জাতপাতের সমস্যাকে চিহ্নিত করে না। এই কারণেই, তাঁর বইতে তেলতুম্বড়ে সাবধান করেছিলেন— ‘ভারতের প্রতিটি গ্রামই আসলে এক একটি সুপ্ত খইরলাঞ্জি।’

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...