গুণ্ডা, ভোট, ক্ষমতা আর বাহুবলী বিষয়ে দু-চার কথা

প্রবুদ্ধ ঘোষ

 


লেখক প্রাবন্ধিক, সাহিত্য-গবেষক, দাবা-প্রশিক্ষক

 

 

 

 

 

গুণ্ডা কারা না পোষে? সব সংসদীয় রাজনৈতিক দলেরই গুণ্ডা থাকে। তারা বোমাবাজি করে, খুন করে, তোলাবাজি করে, জনগণকে চমকায়, কিন্তু ভোটটুকু ঠিক কুড়িয়ে-বাড়িয়ে দেয়। বাংলার রাজনীতিতে নামজাদা রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত গুণ্ডা পোষা আর রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্যগোপন পোষাগুণ্ডার ঐতিহ্য বরাবরের। নেতা কয়েক বছরের, কিন্তু গুণ্ডা চিরদিনের। কখনও সেইসব গুণ্ডারা আলো নিভিয়ে ব্যালটবাক্স বদলে কংগ্রেসকে ভোট এনে দেয়, কখনও লোকাল কমিটির নির্দেশে পার্টিপন্থা-নিয়ে-প্রশ্নজাগানিয়াদের ভিটেমাটি চাঁটি করতে যায় বা প্রমোটারির হিস্যা নিতে যায় আবার কখনও সিন্ডিকেটের রমরমায় লবিতে-লবিতে ক্যালাকেলি করে। প্রয়োজন মিটলে এক গুণ্ডাকে অন্য গুণ্ডা দিয়ে খুন করায়, বা, জেলে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে পার্টি। কোনও কোনও গুণ্ডা বোমাবাজি করে আর মেশিন চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে স্বাদ ও স্টেটাস বদলাতে সংসদীয় রাজনীতিতে যোগ দেয়; ভোট আদায় করে মন্ত্রীও বনে যায়। কিন্তু, গুণ্ডা থাকেই! ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতিতে গুণ্ডা ছাড়া গণতন্ত্রের শর্তপূরণ হয় না। লুম্পেন, মস্তান আর গুণ্ডার পার্থক্য আছে। লুম্পেনদের কোনও দল ‘ওন্‌’ করে না, এরা নিজেদের মনমতো নৈরাজ্যের অনুশীলন করে; ভদ্রলোক সাজার ঢং করে না। মস্তান সাধারণত পাড়ার দখলদারি চালায়, পেশিশক্তির প্রয়োগে ছেলে-বুড়ো-মেয়ে সবাইকে চমকায় আর যে রাজনৈতিক দল টাকা দেয় ছত্রছায়া দেয়, তাদের হয়ে মাতব্বরি ফলায়। গুণ্ডারা ভদ্দরলোক সাজার জন্যে আঁকুপাকু করে, নেতা-মন্ত্রীদের ডানহাত-বাঁহাত-অজুহাত হয়ে ওঠে (কখনও গলগ্রহও), এরা লুম্পেন ও মস্তানদের নিয়ন্ত্রণ করে টাকা আর পেশিশক্তি দিয়ে এবং কোনও অঞ্চলের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক কারবারের নির্দেশক হয়ে ওঠে। লুম্পেন আর মস্তান সাধারণত খুন করে না, যদি না মটকা-গরম হয় আর রগ চটে যায়। কিন্তু, গুণ্ডা বিশেষত মন্ত্রী-বিধায়কের ডানহাত গুণ্ডা খুন-তোলাবাজি-সংগঠিত অপরাধে সিদ্ধহস্ত হয়। প্রদেশান্তরে এদের নাম পাল্টায়— গুণ্ডা বা মাফিয়া বা বাহুবলী বা ভাউ। সন্ত্রাসী গুণ্ডা থেকে কাউন্সিলর-মন্ত্রী-বিধায়ক হয়ে ওঠার যে যাত্রাপথ অর্থাৎ কালোপেশা থেকে ধোপদুরস্ত ভেক ধরার যে যাত্রাপথ, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেউ সফলতা পায় আর কেউ খুন হয়ে যায়। মণীশ শুক্লা খুন হয়ে গেছে।

#

মণীশের অল্পজীবনের গল্প যেটুকু সংবাদপত্রে ও লোকমুখে জানা যায়, তাতে বহুস্তরীয় মিশ্রণ। ভদ্দরলোকের ছাপ ছিল (পেশায় আইনজীবীও), দাপুটে ও বিনানির্বাচনে নির্বাচিত ছাত্রনেতা ছিল, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বাহুবলী সংস্কৃতির অনুশীলন করত, বাম থেকে ডান বাংলার সমস্ত মুখ্য সংসদীয় দলের ভোট-বৈতরণীর ত্রাতা ছিল সময়ান্তরে, মাফিয়া-গুণ্ডা পরিচিতি থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিল (নির্দল প্রার্থী হয়ে জিতে ফের তৃণমূলে যোগদান) এবং আরও উঁচুস্তরীয় ধোপদুরস্ত ইমেজে উত্তরণ চাইছিল। মণীশ পেশায় আইনজীবী (কোন মামলায় লড়েছিল কারও মনে নেই), এমবিএ ডিগ্রিধারী। মণীশের পারিবারিক পরিচিতি ও শিক্ষাগত অর্জনে ওই ‘ভদ্রলোক’ ছাপ এবং আধিপত্যকামী মানসিকতা বাম জমানায় কলেজের সম্পাদক (এসএফআই-র তরফে) ও দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাংসদ তড়িৎ তোপদারের ডানহাত হয়ে উঠতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। চটকল অঞ্চলে তোলাবাজি-খুন থেকে ভোট আদায়ে অতিসক্রিয়তা— মণীশ শুক্লা গব্বরসমান (কু)খ্যাত হয়ে উঠতে থাকে।[1] কিন্তু, ভুবনকে ছোটবেলায় মাসি যেমন প্রশ্রয় দিয়েছিল, তেমনই তাকেও প্রশ্রয় দিতে থাকে রাজনৈতিক দাদা-মেসো-কাকা-মামারা। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনের পরে সিপিআই(এম) পতনের শব্দ আঁচ করতে পেরে উঠতি-শাসক তৃণমূলের সঙ্গে যোগ দেয়। জামার রং পাল্টালেও শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে তার ভূমিকাবদল হয়নি। ভাটপাড়া-টিটাগড়ের ‘মাফিয়া’ নেতা অর্জুন সিং তখন তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ হয়ে উঠছে চটকল অঞ্চলে, মণীশের সাংগঠনিক দক্ষতা ও দুষ্কৃতি-আমদানির সূত্র অর্জুন-মণীশের জুটিকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। ২০১৫ সালে তৃণমূলের সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্কের ফলে নির্দল প্রার্থী হয়েও ভোটে জিতে কাউন্সিলর হয়েছে অনায়াসে। তারপর আবার তৃণমূলে ফেরা। ভাগীরথীর তীরের বিস্তীর্ণ শিলাঞ্চল জুড়ে ক্ষমতায়ন নতুন মাত্রা পায়। ২০১৯ লোকসভার আগে তৃণমূলের ক্ষমতাহ্রাস আঁচ করতে পেরে অর্জুন সিং বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কয়েকমাস পরে মণীশও বিজেপিতে যোগ দেয়। অব্যাহত থাকে খুন-তোলাবাজি-মারামারি। খুন হওয়া পর্যন্ত মণীশ বিজেপির ‘বাহুবলী’[2] নেতা হিসেবেই টিটাগড়-ভাটপাড়া-ব্যারাকপুরের ত্রস্ত মানুষের ভয় আদায় করে নিয়েছিল। সংসদীয় রাজনীতির মেরুদণ্ড হচ্ছে ভোট; সেই ভোট পেতে তড়িৎ-অর্জুন-মণীশদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কারণ, ‘ভোট-মেশিনারি’ থাকে এদের নিয়ন্ত্রণে আর, এই শব্দের গুরুত্ব সাধারণ ভোটাররাও জানেন। সব দলও এই সত্য জানে, মানে। শাসকদল মদত দেয়, বিরোধীদল চেঁচায়; কখনও ভাইসি-ভার্সা। ডন-মাফিয়ারা মন্ত্রীদের সু-কু সব কর্মেরই শরিক, জনগণ গল্পেসত্যে জানে সবটুকু।

কিন্তু, বাংলার রাজনীতিতে অন্তত গুণ্ডাদের প্রকাশ্যে উদ্‌যাপনের সংস্কৃতি খুব একটা নেই; ব্যতিক্রম হয়তো আছে। কিন্তু, মন্ত্রী-বিধায়ক না-হওয়া গুণ্ডা/মাফিয়াকে শীর্ষ নেতৃত্ব ও সাংবিধানিক পদাধিকারবলে ‘ওন্‌’ করার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গুণ্ডাদের ‘হিরো’ বানিয়ে বুক বাজানোর উদাহরণ এই রাজ্যে খুব একটা নেই। সিনেমার মাফিয়া-ভাউ-গুণ্ডাদের অ্যান্টি-হিরো রূপে নির্মাণ বহুবার হয়েছে। কিন্তু মণীশের ক্ষেত্রে সেই অত্যাচারিত থেকে সমাজদ্রোহী, নিপীড়িত থেকে প্রতিবাদী, ‘আন্ডার-প্রিভিলেজড’ থেকে ক্ষমতাবান এবং আর্থ-সামাজিক শোষণের চাপে ভালো থেকে মন্দ হয়ে যাওয়ার চিত্রনাট্যও খাপ খায় না। অনাথ ভুবনের শাসনহীন-অসহায়তার বশে বিপথে চালিত হওয়ার নীতিভ্রংশতাও এর ক্ষেত্রে খাটে না। অর্থ এবং ক্ষমতা— যে দুটো ট্রাম্পকার্ড পেয়ে গেলে সমাজের মাথা হওয়া যায়, সেই দুটোই মণীশের যথেষ্ট ছিল; কিন্তু অর্থ আর ক্ষমতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এই দুটো তেড়েফুঁড়ে বাড়তে চায় বারংবার বিনিয়োগে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাই পারে এই দুয়ের সফল-বিনিয়োগ ঘটাতে। মণীশকে তাই সিপিআই(এম) থেকে তৃণমূল থেকে বিজেপি— সব দলকে ব্যবহার করতে হয়েছে আর ব্যবহার হতেও হয়েছে। অনেকের মতে, ব্যারাকপুর-ভাটপাড়া অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এতটাই স্বতন্ত্র যে, সেখানে বন্দুক-বোমার ভাষাই শাসন ও ক্ষমতার একমাত্র বোধগম্য ভাষা; আর, মণীশ অর্জুনরা সেইজন্যেই সফল। অনেকের মতে, হিন্দি-উর্দুভাষী মানুষের সংখ্যা এই চটকলকেন্দ্রিক অঞ্চলে এতটাই বেশি যে, গোবলয়ের সংস্কৃতি (ধর্ম-রাজনীতি ও পেশিরাজনীতি) এই অঞ্চলে আধিপত্য করে;[3] অর্জুন-মণীশকে খুঁটি করে আরএসএস-বিজেপির দবদবা বৃদ্ধি এইজন্যেই। অনেকের মতে, মণীশ প্রকাশ্যে বিজেপি হলেও তৃণমূলের সঙ্গে গোপন আঁতাত রাখত।[4] মণীশকে খুন করতে সুবোধ যাদব, মুহম্মদ খুররম, গুলাব শেখের মতো ‘অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী (শার্প শ্যুটার)’ ভাড়া করা হয়েছিল বলে পুলিশের অনুমান;[5] দীর্ঘদিনের নিখুঁত ছকের বাস্তবায়নে সাতটা বুলেট মণীশের মুখে ও বুকে ঢুকেছে। তৃণমূল বনাম বিজেপির দুর্বৃত্ত সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে, বিশেষত অর্জুন সিং বিজেপিতে নাম লেখানোর পরে তা লাগামছাড়া।

কিন্তু, দুর্বৃত্তদের ক্ষমতায়নের দীর্ঘ রাজনীতিতে আর তাদের ঘিরে মিডিয়ার তৈরি করা বয়ানে আড়ালে চলে যায় শিল্পাঞ্চলের মৃত অর্থনীতি, চটকলের শ্রমিকদের দুর্গতি এবং একের পর এক চটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার অব্যক্ত বেদনা। মণীশ শুক্লার মৃত্যু নিয়ে সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের ফায়দা তুলতে যতটা মাথা ঘামাচ্ছে, সংবাদমাধ্যম বয়ান পাল্টা-বয়ানের যতগুলো টক-শো করছে, তার সিকিভাগও দেখা যায়নি চটকলগুলো বাঁচাবার উদ্যোগে কিংবা শ্রমিকদের দুঃসহ জীবনের সমস্যা সমাধানে। গত কুড়ি বছরে কতগুলো চটকল বন্ধ হয়ে গেছে, কতজন শ্রমিক প্রাপ্য টাকা না-পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন বা মারা গেছেন কিংবা কতগুলো পরিবার দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝতে না-পেরে সব খুইয়ে দেশের বাড়ি চলে গেছে সেসবের হিসেব অর্জুন-মণীশ-তড়িৎরা কেউ রাখেনি। না, আমরাও রাখিনি। সেইসব শ্রমিকের জীবন মণীশের চেয়ে কিছু কম দামি নয়।

#

গোবলয়ের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতির পার্থক্য আছে। কোনও গুণ্ডার মৃত্যুতে কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল গুণ্ডার ছবিতে ফুল-চন্দন চড়িয়ে মিছিল বের করেনি; একজন মাফিয়ার মৃত্যুতে রাজ্যপাল অধীর হয়ে রাজ্য সরকারের সমালোচনা করেনি কিংবা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন নেতারা সিবিআই তদন্তের দাবি জানায়নি। গুণ্ডা-মস্তানদের গড়েপিটে ব্যবহার করে ‘ডিজওন’ করার কৌশলী রাজনীতির জন্যেই বিভিন্ন জমানার বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রীদের নাম জড়ালেও তাদের ‘দল’ দায় এড়িয়ে গেছে। গোপনে শোকসভা করেছে কিংবা দুঃখপ্রকাশ করেছে কিন্তু প্রকাশ্যে সম্পর্ক স্বীকার করেনি। যুবভারতীর অন্দরমহল থেকে হাতকাটা দিলীপসহ বাকি গুণ্ডারা ধরা পড়ার পরে সিপিএম হাত ঝেড়ে ফেলেছিল। কংগ্রেসের মতো শিল্পপতিদের-টাকায়-চলা দলও গুণ্ডাদের নিয়ে মিছিল-উদ্‌যাপন করেনি। ষাটের দশকে নির্মল মিত্র, ইনু মিত্রদের[6] (আরেক কুখ্যাত ‘মিত্র’ গুণ্ডা রাজনৈতিক খুঁটির জোরে বিধায়ক বনে গেছিল) মতো গুণ্ডা ও সন্ত্রাসীরা কমিউনিস্ট দমনে আর ভোটদখলে কংগ্রেসকে প্রবল মদত দিলেও, কংগ্রেসি জমানার শেষে তাদেরও দিন ফুরিয়েছে। বামফ্রন্ট আমলেও গুণ্ডা-মাফিয়া কম তৈরি করা হয়নি; মজিদ মাস্টার, তপন-সুকুর… দু-একজন মন্ত্রী-বিধায়ক মুখ ফসকে তাদের ‘আমাদের পার্টির সম্পদ’ বলে ফেললেও, পার্টির ওপরমহল প্রকাশ্যে জিভ কেটেছে। বামফ্রন্ট জমানার শেষে তারাও প্রায় খরচের খাতায়। তৃণমূল জমানায় আরাবুল, ইকবালসহ বহু গুণ্ডা খাতা খুলেছে; কিন্তু দলের শীর্ষনেতৃত্বকে সময়বিশেষে তাদের ‘সংযত’ করার বিবৃতি দিতে হয়েছে। যতক্ষণ না কোনও গুণ্ডা/মাফিয়া কমপক্ষে বিধায়ক হচ্ছে, ততক্ষণ অবধি রাজনীতির ‘পবিত্রতা’র ভানটুকু করাই ছিল রীতি। মণীশের দ্রতোত্থান এবং রমরমা এখানেই আলাদা কারণ সময় ও সুযোগের সদ্বব্যবহারে তার ‘চাহিদা’ ক্রমেই বেড়েছ। সিপিএম থেকে তৃণমূল হয়ে বিজেপির রাজনীতিতে নিজেকে অভিযোজিত করে নিতে পেরেছে। সে এলিতেলি হুব্বা নয়; ‘প্রভাবশালী’ থেকে ‘বাহুবলী’ হয়ে পৌরপিতা হয়েছে ও বিজেপির মতাদর্শগত আদরে শিল্পাঞ্চলের যুবরাজ হয়ে উঠেছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব তাকে তার কাঙ্খিত সামাজিক সম্মান পাইয়ে দিয়েছে। আর, মাফিয়া-বাহুবলীদের নিয়ে প্রকাশ্যে সভা করার, তাদের স্বীকৃতি দিয়ে সামাজিক সম্মানের শীর্ষে পৌঁছে দেওয়ার সংস্কৃতি গোবলয়ের।

গোবলয়ের বাহুবলী-রাজনীতির সঙ্গে বঙ্গের গুণ্ডা-রাজনীতির আরও পার্থক্য আছে। বাহুবলী প্রকাশ্যেই বন্দুক নিয়ে ঘোরে, যাকে-তাকে ঠাণ্ডা বা গরম মাথায় প্রকাশ্যেই খুন ও লুঠ করে। বাহুবলী ধর্ষণ করে, অসবর্ণকে হেনস্থা করে আর, ‘সুপারি’ নিয়ে খুন করে এবং সরকারি প্রশাসনের সমান্তরাল প্রশাসন বলবৎ রাখে— উঁচুজাতের বাহুবলী হলে তো কথাই নেই; তার সব আচরণই জায়েজ শাসনতন্ত্রের প্রকাশ্য মদতে! অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতায় বাহুবলী যেকোনও আইএএস-আইপিএসকেও মুঠোয় ভরে রাখে। সংসদীয় দলের জনসভায় ও ভোটে বাহুবলীর নির্দেশই শেষকথা। মণীশ শুক্লার নামে ১৬টা গুরুতর মামলা ঝুলে আছে, যার মধ্যে খুন এবং খুনের চেষ্টা দুইই রয়েছে। যে খুররমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মণীশ হত্যার অভিযোগে, কয়েকবছর আগে সেই খুররমের বাবাকে হত্যার ঘটনায় মণীশের নাম জড়িয়ে গেছিল।[7] অর্জুন সিং ও তার অনুগামী আরএসএসপন্থীদের অতিসক্রিতায় ২০১৯ সালের মাঝামাঝি নৈহাটি-ভাটপাড়া এলাকায় সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা আর এলাকাদখলের রক্তনীতি ভীষণাকার ধারণ করেছিল।[8] সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের পরে ব্যারাকপুর-টিটাগড়-নৈহাটির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রক্তপাত আর বোমাবাজির ঘটনা প্রায়দিনই সংবাদ-শিরোনাম হয়। মণীশ শুক্লার খুন বিরোধী বনাম শাসক রাজনীতিতে রক্তের প্রলেপ দিয়েছে আরও একবার কিন্তু এক নতুন সংস্কৃতির ইঙ্গিতও দিয়েছে। রাজ্যের সাংবিধানিক শীর্ষব্যক্তিত্ব রাজ্যপাল যিনি ট্যুইট করাকে নিজের ‘মুদ্রাদোষ’ বানিয়ে ফেলেছেন, তিনিও বিবৃতি দিয়েছেন মণীশ-খুনে রাজ্য সরকারকে দুষে। ময়নাতদন্তের পরে মণীশের দেহ নিয়ে রাজভবনে যায় বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব; রাজ্যপাল সগৌরবে তার অনুমোদন দেন এবং কেন্দ্রীয় বিজেপি-নেতৃত্ব তাতে উৎসাহদান করে। এক ‘বাহুবলী’-র মৃত্যুতে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বন্‌ধের ডাক দেয় বিজেপি। ৮ই অক্টোবর প্রায় পঁচিশ হাজার সমর্থক জোগাড় করে নবান্ন-অভিযানের ডাক দেয় বিজেপি, মণীশ শুক্লা খুনের সিবিআই তদন্তসহ আরও কিছু দাবিতে। ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিস্ট-আধিপত্যে যে পার্টি সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছাড়া কোনও কিছুই জনগণকে দিতে পারে না, তারাই প্রবল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ল ‘গুণ্ডা’-থেকে-কাউন্সিলর হওয়া একটা লোকের হত্যারহস্য জানতে। সেই মিছিলে নিয়ে গেল পিস্তল; এর আগে দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীছাত্রদের ওপর হামলার সময়ে পিস্তল হাতে মস্তানের দৌড় দেখা গেছে, ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির রাজপথে পিস্তল তাক করা মুখ ভাইরাল হয়েছিল। গোবলয়ের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে বন্দুক-পিস্তল-তলোয়ার নিয়ে রাজনৈতিক সভা-মিছিলে ক্ষমতা প্রদর্শন রুটি-আচার খাওয়ার মতোই সাধারণ ঘটনা। আর, গোবলয়ের সেই সংস্কৃতিই আমদানি হচ্ছে বাংলার রাজনীতিতে। সাংবিধানিক ক্ষমতা-কাঠামোর ওপরতলার লোকেরা, সংবাদমাধ্যমের একাংশ ও রাজনৈতিক ফায়দাবাজেরা বাহুবলী সংস্কৃতির উদ্‌যাপনে শাবাশি দিচ্ছে, উস্কানি দিচ্ছে।[9] ২০২১-র নির্বাচনে বাংলা উগ্র-দক্ষিণপন্থার শোষণে নিষ্পেষিত হবে, নাকি আপাতত যে দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতায় তাদের অপশাসনে মাথানিচু থাকবে নাকি অন্য কোনও সংসদীয় দলের মতাদর্শে শোষিত-পীড়িত হওয়ার নতুন পাঠ নেবে— তা সময় বলবে। সমাজবদল যখন হচ্ছে না, কাঠামো যখন একই থাকছে, তখন নির্বাচনী গণতন্ত্রের ধাঁচায় খারাপ, অতি খারাপ আর ভীষণ খারাপ— এই তিন পছন্দের মধ্যে বেছে নিতেই হবে। আর, আমরাও জানি যে, ‘ভোট মেশিনারি’ অর্থাৎ ভোটে জেতার যে অমোঘ চাবিকাঠি সংসদীয় দলগুলির জন্যে শাসনশোষণ-ঘরের তালা খুলে দেয়, সেই চাবিকাঠির মালিক রাজনৈতিক গুণ্ডাদের হাতে থাকে। বিজেপির-আরএসএসের মতো সন্ত্রাসবাদী দল রাজনৈতিক গুণ্ডাদের সংস্কৃতিকে উদ্‌যাপন করছে প্রকাশ্যে এবং একেই সামাজিক সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছে বাংলার রাজনৈতিক ঐতিহ্যে।

#

পশ্চিমবঙ্গের চটকলগুলি একে একে বন্ধ হয়ে গেছে, যাচ্ছে। বাংলা তথা ভারতের অন্যতম অর্থকরী উৎপাদন বিগত কয়েক দশক ধরেই ধুঁকছিল, এখন তার লবেজান অবস্থা। লক্ষাধিক শ্রমিক দুরবস্থায় সব খুইয়েছেন এবং আরও লক্ষাধিক শ্রমিক সেই পরিস্থিতিতে পড়েছেন। ঊনিশ শতক থেকে হুগলি ও সংযুক্ত চব্বিশ পরগণায় এই চটকলগুলি বাংলাকে অর্থনৈতিক ভরসা জুগিয়েছে, হিন্দি-উর্দু-বাংলাভাষী শ্রমিকের বসতি গড়ে উঠেছে, শ্রমিকবস্তি গড়ে উঠেছে। ভাষা-ধর্ম-জাতির বিভিন্নতা ছিল, তবু শ্রমের উদ্‌যাপনে ‘শ্রমিক’ পরিচয়ে তাঁরা একাত্ম ছিলেন। আর, তাঁদের একসূত্রে বেঁধেছে মৃত্যু। নফরচাঁদ জুটমিলের শ্রমিক রেললাইনে গলা দিয়েছেন, আগরপাড়া জুটমিলের অস্থায়ী শ্রমিক দীর্ঘদিন কাজ না পেয়ে হৃদরোগে মারা গেছেন কারখানার গেটেই। এঁদের মৃত্যু বুঝি কোনও বাহুবলী-গুণ্ডার থেকে কম দামি? হুগলির গোন্দলপাড়া চটকল লোকসভা ভোটের পর থেকেই বন্ধ, অনাহারে ধুঁকছে শ্রমিক-পরিবারগুলো; ওই এলাকায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান রাখেন শুধু এলাকার বাসিন্দারাই। অথচ, সেই গোন্দলপাড়া সংলগ্ন তেলেনিপাড়াতে ২০২০ সালের মে মাসে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর বদ মতলব এঁটেছিল আরএসএস।[10] বিজেপি-তৃণমূলের ক্ষমতাদখলের রাজনীতিতে আগুন জ্বলে ওঠে হগলির একাধিক স্থানে। ব্যারাকপুর-নৈহাটি-টিটাগড়ের অসংখ্য চটকল বন্ধ হয়ে শ্রমিকেরা ধুঁকলেও ক্ষমতাদখলের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক উস্কানি আর দুর্বৃত্তায়ন নিরন্তর চলছে। বহু শ্রমিক অনাহারে নয়তো আত্মহত্যায় মারা যাচ্ছেন। এঁদের জীবন যেকোনও বাহুবলী আর গুণ্ডার থেকে দামি। কবে এঁদের দিকে তাকাতে শিখব আমরা? শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে টক-শো দেখব? কবে এঁদের মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে রাজপথে শোষণমুক্তির উদ্‌যাপন করব? যতদিন এই উদ্‌যাপনের অভ্যাস না হবে, ততদিন আমাদের ভোট ব্যবহার করে নেবে হরেক রঙের দল আর তাদের পোষা গুণ্ডারা।


[1] এলাকা দখলের জন্য দুষ্কৃতি আমদানির অভিযোগ ছিল মণীশের বিরুদ্ধে। বাম আমলে এক সময় দুষ্কৃতিদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল টিটাগড়। বিভিন্ন কারখানা, চটকল থেকে তোলাবাজি ঘিরে টিটাগড় বছরভর উত্তপ্ত থাকত। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ই অক্টোবর, ২০২০
[2] Singh, a four-time TMC MLA who carries the reputation of being a ‘bahubali’ or ‘strongman’, defeated former railway minister and TMC Leader Dinesh Trivedi from Barrackpore LSC in 2019…  Manish Shukla also had a reputation of being strongman. Source- Snigdhendu Bhattacharya, The Wire, October 6, 2020.
[3] The Wire, October 6, 2020
[4] তৃণমূলে থাকতে তিনিই ছিলেন বকলমে ব্যারাকপুরের বিধায়ক। তৃণমূল বিধায়ক শীলভদ্র দত্তের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এতটাই ভালো ছিল… অর্জুনের সঙ্গে সখ্য যতই থাক, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ ছিল। শোনা যায়, সেই ক্ষোভের কথা জানতে পেরে মণীশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে তৃণমূল। সূত্র: এই সময়, ৮ই অক্টোবর, ২০২০
[5] দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৯ই অক্টোবর, ২০২০
[6] ‘Peaceful’ trade in drugs, country liquor, Times of India, December 7, 2001
[7] দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৯ই অক্টোবর, ২০২০
[8] The residents have allegedly blamed the RSS and BJP workers for instilling this sense of fear and unabashed power display. State BJP president Dilip Ghosh, however, blamed the Trinamool Congress for the violence and said that his party would follow the “tit for tat” policy to counter it. Source: Sabrangindia, 25th May, 2020.
[9] মণীশের হত্যাকে রাজ্যপাল ‘কাপুরুষোচিত হত্যা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণেই এই হত্যা হয়েছে বলে রাজ্যপাল মনে করছেন। তার প্রেক্ষিতেই যে স্বরাষ্ট্রসচিব এবং ডিজি-কে তিনি তলব করেছেন, তাও রাজ্যপাল স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ই অক্টোবর, ২০২০।
[10] তেলেনিপাড়া তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন, ২০২০, আমরা এক সচেতন প্রয়াস, ২রা অক্টোবর, ২০২০

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...