সংগ্রামজিৎ সেনগুপ্ত
সংগ্রামজিৎ সেনগুপ্ত বিশিষ্ট নাট্যকর্মী, আলোচক ও অভিনেতা। সোনারপুর কৃষ্টি সংসদ দলের প্রাণপুরুষ। শোভা সেনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, শিখেছেন আর একসঙ্গে কাজ করেছেন।
ডাঃ নৃপেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ও কনকলতা সেনগুপ্তের সর্বজ্যেষ্ঠ সন্তান শ্রীমতি শোভা সেন। সতের সেপ্টেম্বর, উনিশশো তেইশ সালে ঢাকায় জন্ম। ছোট বয়েসেই কলকাতায় চলে আসেন, এবং বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক হন। স্কুলেই প্রথম অভিনয়। কলেজেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন অভিনয়ে।
প্রথমে গণনাট্য সংঘে যোগদান, পরে উৎপল দত্ত-প্রতিষ্ঠিত এল.টি.জি এবং পি.এল.টি নাট্যসংস্থায় আজীবন সক্রিয় ছিলেন। গণনাট্য সংঘ এবং উৎপল দত্তের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রেণিসংগ্রাম, মানুষের জন্য শোষণমুক্ত এক সমাজ গঠনে দীর্ঘদিন ধরে সচেতন, শৃঙ্খলাপরায়ণ দৃঢ়চেতা অভিনেত্রী এবং নাট্যকর্মে সাংগঠনিক নেত্রী হিসেবে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই সমর্পিতপ্রাণ নাট্যজন। জীবনে ঝড়ঝাপটা যতই এসেছে, ততই তিনি নিজস্ব ক্ষমতা, যোগ্যতা, দক্ষতাকে নিপুণভাবে প্রয়োগ করে ভারতবর্ষের আদর্শবাদী থিয়েটারকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন ‘মা’-এর মতো। ‘মা’-– ‘এক নির্ভীক সৈনিক’-– হয়তো যেন তিনিই।
উৎপল দত্তের গৃহিণী, এল.টি.জি ও পি.এল.টির তুখোড় সংগঠক, বাংলা মঞ্চের ও চলচ্চিত্রের দুর্ধর্ষ অভিনেত্রী হিসেবেই শুধু নন, তিনি ছিলেন প্রগতি থিয়েটারের এক যোগ্য অভিভাবক। উৎপল দত্ত যখন বিশাল প্রেক্ষাপটের বিশাল মাপের প্রযোজনা নিয়ে বাংলার দর্শককুলকে মাতাচ্ছেন, বোঝাচ্ছেন, ভাবাচ্ছেন, উত্তেজিত করছেন, সেই সময় লক্ষ্যে অবিচল, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শোভা সেন পাশে না থাকলে হয়তো তা সম্ভব ছিল না। সেই থিয়েটারের সংগঠনের কাজ শোভা সেন নিঃশব্দে, নীরবে, দক্ষ হাতে সামলেছেন শুধু শিল্পীপ্রতিভা দিয়ে নয়, কমিটেড মানসিকতা নিয়ে, অসম্ভব পরিশ্রম দিয়ে এবং দর্শনের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে যা এ যুগে প্রায় অবান্তর। থিয়েটারকে সাথী করে, প্রচুর বিপদের মধ্যেও মতাদর্শ নিয়ে পথ চলায় কোনও ছেদ নেই। কী না করেছেন এল.টি.জি ও পি.এল.টি অধ্যায়ে! তাঁর আত্মত্যাগের সীমা-পরিসীমা নেই। ‘মিনার্ভা’কালে বাংলা নাট্য আন্দোলনে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তার তুলনা নেই।
নিজ গৃহ বন্ধক রেখে থিয়েটারের জন্য টাকা যোগান দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ‘মিনার্ভা’ পর্বে এল.টি.জি আমল মানে স্বার্থত্যাগের আমল। আরও অনেকের ত্যাগের জন্যই বিস্ফোরক কিছু থিয়েটার সবাই প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিল। উৎপল দত্তের প্রতিভার প্রকাশের জন্য এঁদের ভূমিকা ছিল উচ্চকণ্ঠে বলার মতোই।
শোভা সেন শুধুমাত্র উৎপল দত্তের স্ত্রী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কমরেড, সহযোদ্ধা। উৎপল দত্ত লিখেছিলেন-– “আমাদের নাট্য আন্দোলনে শক্তিমান নটনটী অনেক আছেন, কিন্তু প্রকৃত সংগঠক নেই বললেই চলে।… শ্রীমতী শোভা সেনের সংগঠক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা ছিল-– মঞ্চের উপর তাঁর যে অভিনয়ের খ্যাতি গড়ে উঠেছে, তার চেয়ে নাট্য আন্দোলনের সফল সম্পাদক হিসেবে যশের দাবি কম নয়। এই কথাটা বাইরের কেউ তেমন বুঝতে পারবেন না বলেই আমার এই লেখনী ধারণ।” আলোকবিজ্ঞানী তাপস সেন বলেছিলেন-– “শোভা সেন মিনার্ভার দায়িত্ব ও সংগঠনের ভার কাঁধে তুলে না নিলে উৎপলের ‘অঙ্গার’, ‘কল্লোল’, ‘মানুষের অধিকার’-– হয়তো সৃষ্টি হত না। পরে পি.এল.টি.-তেও একই ভূমিকা। ‘কল্লোল’কালে শোভা সেনের তেজ ও সাহস দেখেছিলাম।”
গণনাট্য সংঘ এবং উৎপল দত্তের কাছে পাওয়া রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে, দৃঢ়ভাবে মেনে, যে সমস্ত চরিত্রে তিনি মঞ্চে ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, এমন সব অসাধারণ অভিনয় রাজনৈতিক ভাবনা ছাড়া সম্ভব ছিল না। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের এক নতুন ধারা এনেছিলেন শোভা সেন। মঞ্চের বিপরীত ধারা। জাতীয় নারী ও আন্তর্জাতিক বিপ্লবী নারী-– উভয় ভূমিকায় শোভা সেন ছিলেন অনবদ্য।
এই নষ্ট, ভোঁতা সময়ে শোভা সেনের জীবন ও মতাদর্শ আমাদের প্রেরণা ও ভরসাস্থল হতে পারে। তেরই আগস্ট থিয়েটারের মাতৃবিয়োগ হল।