সোমা মারিক
লেখক ইতিহাসের অধ্যাপক, গবেষক, প্রাবন্ধিক
এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু হল মানুষের বিবর্তন ও নারীশোষণ সম্পর্কে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের বিশ্লেষণ ও তা নিয়ে মার্ক্সবাদী, সমাজতন্ত্রী, নৃতত্ববিশারদ, নানা ধরনের নারীবাদীদের আলোচনা-সমালোচনা। এঙ্গেলস দ্য ওরিজিন অফ ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট [এখন থেকে শুধু ওরিজিন বলে লেখা হবে] প্রকাশ করেন ১৮৮৪ সালে, অর্থাৎ ১৩৬ বছর আগে। কিন্তু এই রচনা আজও প্রভাবশালী একটি পুস্তিকা। গার্ডা লার্নার তাঁর বই দ্য ক্রিয়েশন অফ পেট্রিয়ার্কি-তে বলেন, এঙ্গেলসের প্রতিটি উত্তর সঠিক কিনা, তার চেয়ে বড় কথা হল, নারীশোষণ বিষয়ক মৌলিক অনেকগুলি প্রশ্ন তিনিই প্রথম তুলেছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে আজ আমাদের বুঝে নিতে হবে যে মার্ক্সের পদ্ধতি ধরে এগোলে, এঙ্গেলসের ১৩৬ বছরের পুরনো রচনা শেষ কথা হতে পারে না। যদিও মার্ক্সবাদীরা একসময় সেরকমটাই মনে করত।
জার্মান ইডিওলজি-তে মার্ক্স ও এঙ্গেলস যখন ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার প্রথম ধারণা তৈরি করেন, তখন প্রাকৃতিক ইতিহাস ও মানব-ইতিহাস, দুয়ের সম্পর্কেই জ্ঞান কম ছিল। নিয়ান্ডারথালদের সম্পর্কে প্রথম জানা যায় ১৮৫৬ সালে, ডারউইনের ওরিজিন অফ স্পিসিস প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে, ডিসেন্ট অফ ম্যান ১৮৭১ সালে। লুইস হেনরি মর্গ্যানের এনসিয়েন্ট সোসাইটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে। এই বই মার্ক্সকে এথনোলজিক্যাল নোটবুকস-এর একাংশ আর এঙ্গেলসকে ওরিজিন লিখতে প্রেরণা দেয়। জোহান গ্রেগর মেন্ডেলের জেনেটিকস নিয়ে গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল ব্রনো শহর থেকে প্রকাশিত এক অখ্যাত পত্রিকায়, এবং হুগো দ্য ফ্রিস ১৯০১ সালে সেসব উদ্ধার করার আগে অন্য জীববিদ্যা বিশারদরা সে সব জানতেন না। সুতরাং ১৮৪৬, বা এমনকি ১৮৮৪ সালেও যা ছিল আধুনিক, আজ তার ততটা আধুনিক চেহারা থাকবে না। যেমন হোমিনিড বিবর্তন সম্পর্কে এঙ্গেলস জানতেন না। সুতরাং সমালোচনা করার আগে তাঁর নিজের যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এঙ্গেলসকে দেখতে হবে।
ওরিজিন-এর মূল প্রতিপাদ্য
ওরিজিন অংশত লেখা হয়েছিল অগাস্ট বেবেলের খুবই জনপ্রিয় নারী ও সমাজতন্ত্র পুস্তিকার প্রতিক্রিয়াতে। কিন্তু সেই সঙ্গে, এঙ্গেলস চেয়েছিলেন, তাঁর সমসাময়িক নৃতত্ত্ববিদরা মানুষের বিবর্তন নিয়ে যে সব প্রসঙ্গ তুলছিলেন, সে বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াও জানাতে। এ নিয়ে তিনি ইতিমধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন— ১৮৭৬-এর ‘দ্য পার্ট প্লেড বাই লেবার ইন দ্য ট্রানজিশন ফ্রম এপ টু ম্যান’ (এপ/বনমানুষ থেকে মানুষে উত্তরণে শ্রমের ভূমিকা)। অ্যাকাডেমিক জগতে মার্ক্সবাদ নিজের জায়গা তৈরি করার আগে পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক সমাজবিজ্ঞান এই নিবন্ধটিকে উপেক্ষাই করে গেছে। অবশেষে মানুষের বিবর্তনের একটি পূর্ণাঙ্গ বস্তুবাদী ব্যাখ্যা ডারউইনের চিন্তায় যে ভাববাদ থেকে গিয়েছিল তা থেকে আমাদের মুক্ত হতে সহায়তা করে। বিংশ শতাব্দীর শুরু এমনকি মাঝের দিক পর্যন্ত নৃতত্ত্ববিদ্যা এবং সমাজবিজ্ঞান সমাজ-বিবর্তনকে হয় উপেক্ষা, নয় নাকচ করে এসেছে। ফলত এই ক্ষেত্রে মর্গান, এঙ্গেলস এবং রবার্ট ব্রিফল্টের মতো তাঁদের অনুগামীদের অবদানকেও নাকচ করা হয়েছে। তার বদলে জোর দেওয়া হয়েছে লেভি স্ত্রস, ম্যালিনৌস্কি বা র্যাডক্লিফ ব্রাউনের স্ট্রাকচারালিস্ট ও ফাংশনালিস্ট নৃতত্ত্বের উপর। ফলে, মেয়েদের সামাজিক অবদমনকে একরকম স্বাভাবিক, বা মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গেই চিরকাল জড়িত, এমন একটা ভাবে দেখা হয়ে এসেছে।
এঙ্গেলসের মূল কথাগুলি প্রথমে দেখে নিতে হবে। তিনি তাঁর সময়ের নৃতাত্ত্বিক তথ্যের মধ্যে থেকে জার্মান ইডিওলজিতে তিনি ও মার্ক্স যে আদিম সাম্যবাদী সমাজের কথা বলেছিলেন তার নিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, ‘বন্য’ থেকে ‘বর্বরতায়’ উত্তরণের পর্যায় হিসেবে তিনি কৃষিকে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর কথায়, এর সূচনা মৃৎপাত্র নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে, পশুপালনের হাত ধরে এর পূর্ব গোলার্ধে যাত্রা, এবং সেচের সাহায্যে কৃষির বিকাশ এবং রোদে শোকানো ইট এবং পাথর দিয়ে গৃহ নির্মাণের হাত ধরে এটি গিয়ে পৌঁছয় আমেরিকায়। তিনি বলেন, শুধুমাত্র পূর্ব গোলার্ধে লোহা উৎপাদনের ফলে বর্বরতার এক উচ্চতর পর্ব এসেছিল। বর্বরতার যুগে উৎপাদনে এই পরিবর্তনের ফলেই প্রথম শ্রেণিসমাজের উদ্ভব সম্ভব হল— এই ছিল তাঁর বক্তব্য।
কয়েকটা প্রশ্ন থেকে যায়। মানুষ কেন খাদ্য সংগ্রহ থেকে খাদ্য উৎপাদনের দিকে গেল? কেনই বা তারা শাসকশ্রেণির উত্থান মেনে নিল? শাসকরা কেন সমাজকে পরিষেবা দেওয়ার বদলে শোষণ করা শুরু করল? ওরিজিন-এ তাঁর ব্যাখ্যা কিছুটা সরলীকৃত, যেন নিছক লোভ থেকে সব হল। কিছু লোক দেখল, তাদের হাতে উদ্বৃত্ত রয়ে গেছে, আর তারা সেটা অন্যদের ক্ষতি করতে ব্যবহার করল। কিন্তু অ্যান্টি ডুয়েরিং-এ তিনি অনেক পূর্ণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিছুটা উদ্বৃত্ত তখনই ভোগ না করে সরিয়ে রাখলে সমাজের সার্বিক উপকার হত বলেই সমাজ সেটা করেছিল। কিন্তু তিনি কোনও স্তরেই পুরো ব্যাখ্যা করে ওঠেননি— কেন যাদের ঐ উদ্বৃত্ত দেখার ভার দেওয়া হল, তারা সেটা নিজেদের ভোগে লাগাবে, আর কেনই বা অন্যরা সেটা মেনে নেবে। মনে হয়, মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মতে শ্রেণির উদ্ভবের কারণ সমাজ ঘাটতির মুখোমুখি পড়েছিল। সমাজের উন্নতির জন্য যে উদ্বৃত্ত জমানো হল, সেটা ব্যবহার করতে পারত কেবল বিশেষ কাজে দক্ষ কিছু লোক। আর, ঐ উদ্বৃত্ত এত সামান্য ছিল যে সেটা ব্যবহার করেও গোটা সমাজের সার্বিক উন্নতি সম্ভব ছিল না। ফলে ঐ নতুন এলিট ঐ উদ্বৃত্ত ব্যবহার করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে থাকল এবং নিজেদের স্থায়ী জায়গা করে নিল। আদিম সাম্যবাদের অবক্ষয় সম্পর্কে এঙ্গেলস লেখেন যে এর অধঃপতন অনিবার্য ছিল। এর ভিত্তি ছিল অবিকশিত অর্থনীতি। উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোভ, সকলের সম্পদকে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করার ইচ্ছা, ইত্যাদির ভিত্তিতে এল সভ্য সমাজ। তাই এই সমাজ কখনওই ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের শোষণ ও নিপীড়নের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুর উন্নয়ন ছাড়া আর কিছুই না।
আদিম সাম্যবাদের ধারণা আগেই ছিল, কিন্তু মর্গানের গবেষণা এঙ্গেলসকে সেটা অনেক সমৃদ্ধ করতে দিল। মর্গান ও এঙ্গেলস দুজনেই সে যুগের ভাষা ব্যবহার করে প্রথম স্তরকে বলেছিলেন ‘savagery’ বা বন্য অবস্থা। কিন্তু তাদের রচনাতে সেটা কদর্থক ব্যবহার ছিল না। এই স্তরকে আজকের যুগে বলা হয় শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের স্তর (‘hunter-gatherer’ or ‘foraging’ societies)। প্রতিক্রিয়াশীল লেখকরা দাবি করতেন, ওই সমাজ চালাত হিংস্র কিছু পুরুষ, তাদের বাহুবলের সাহায্যে। এঙ্গেলস দাবি করলেন, না, ঐ সমাজ শ্রেণিসমাজ থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিল। তাতে না ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তি না শ্রেণিবিভাগ। সমাজের সংগঠন বিন্যস্ত ছিল পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাধ্যমে। এঙ্গেলস এদের বোঝাতে জেন্ট, ক্ল্যান, ফ্র্যাট্রি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, যা মূলত গ্রিক ও রোমান সমাজ থেকে নেওয়া। আজকাল এদের বলা হয় লিনিয়েজ সমাজ বা কিন-কর্পোরেট সমাজ।
শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের স্তর সম্পর্কে আধুনিক গবেষণা দেখাচ্ছে, এঙ্গেলসের মূল যুক্তি সঠিক ছিল। গড়পড়তা ৩০-৪০ জনের দলে বাস করত এই মানুষরা, যারা সময়ে সময়ে শ দুই অবধি একজোট হত। এইরকম গোষ্ঠীতে শ্রেণিবিভাজন ছিল না, এমনকি নেতৃত্বের খুব সুস্পষ্ট চিহ্নও ছিল না। আর্নেস্টিন ফ্রিডল বলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পুরুষ ও নারী উভয়েরই ছিল। তারা কার বা কাদের সঙ্গে দিনের খাদ্য আহরণের কাজে বেরোবে নিজেরাই স্থির করত। জমির মালিকানা এবং শ্রমের বিশেষীকরণের ভিত্তিতে সম্পদের প্রতি কারও কম-কারও বেশি অধিকার, এমন ধারণা বা অনুশীলন ছিল না— একথা বলেছেন এলিনর লিকক। সামাজিকতার ধাঁচ এমন ছিল, যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফলে স্বার্থপরতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু দেখা দেয়নি। কালাহারির তথাকথিত বুশমেন বা কুং-দের সম্পর্কে রিচার্ড লি-র গবেষণা দেখায়, যারা বেশি সফল, তাদের উপর একটা সামাজিক দায়িত্ব বর্তায়, যারা কম সফল, সমাজের যৌথ খাদ্যভাণ্ডারে অংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করার।
এই তথ্যনিষ্ঠ ছবির বিপরীতে আছে ডেসমন্ড মরিসের দ্য নেকেড এপ, বা রবার্ট আর্ড্রের আফ্রিকান জেনেসিস-এর দাবী— যে হত্যার প্রেরণা থেকে মানুষের বিবর্তন হয়েছিল। এক যান্ত্রিক বস্তুবাদের ব্যবহার করে আর্ড্রে বলতে চেয়েছেন, হিংসা মানুষের জিন-এ আছে, এবং সভ্যতার একটা পাতলা আস্তরণ লুকিয়ে রেখেছে গণহত্যা, দাসত্ব, নরমাংসভোজন, এই সবকিছুকে। উপর থেকে না দেখে যাঁরা খুটিয়ে এদের দেখেছেন, তাঁরা একেবারেই অন্য কথা বলছেন। এই সব ছোট ছোট গোষ্ঠী যে এলাকায় থাকত সেখানেই খাদ্য সংগ্রহ করত। খাদ্য শেষ হয়ে গেলে এরা নতুন জায়গায় যেতে বাধ্য হত। শিকারী ও সংগ্রহকারীরা একে অপরের সাহায্যের উপর নির্ভর করত। সংগ্রহকারীরা অনেক নিয়মিত খাদ্য আনত, আর শিকারীরা আনত অনিয়মিত, কিন্তু অনেক বেশি লোভনীয় খাদ্য। মেয়েরা শিকার বিশেষ করত না। কিন্তু যেহেতু প্রধান খাদ্য ছিল নিরামিষ, তাই মেয়েদের অবস্থান কোনও অবস্থাতেই হীনতর ছিল না। নারী-পুরুষের সমতা ছিল, আর সামাজিক পরিবেশের দরুণ সম্পর্ক ভাঙা সহজ ছিল। মোটামুটি ১০০০০ বছর আগে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এল, যাকে ভেরে গর্ডন চাইল্ড নাম দেন নব্যপ্রস্তর বিপ্লব। এঙ্গেলস একেই বলেছিলেন স্যাভেজ স্তর থেকে বর্বর স্তরে উত্তরণ। মানুষ অনেক দক্ষভাবে পাথরের নতুন নতুন সরঞ্জাম ব্যবহার শুরু করল, খাদ্য রাখার এবং রান্না করার জন্য মাটির পাত্র ব্যবহার শুরু করল, চাষ শুরু করল এবং সেই চাষের দেখভালের জন্য স্থায়ীভাবে বসতি করে গ্রাম গড়তে শুরু করল। লোহার ব্যবহার যখন শুরু হল, এঙ্গেলস সঠিকভাবেই বলেন, তখন অনেক বেশি জমি চাষ করা সম্ভব হল, ফলে খাদ্য সরবরাহ বাড়ল। তার ফলে জনসংখ্যাও বাড়তে পারল, এবং শ্রেণিসমাজের ভিত্তিও কায়েম হল।
কিছু উল্লেখযোগ্য ত্রুটি
এঙ্গেলসের গবেষণার এই পর্বে কিছু উল্লেখযোগ্য ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতার কথা বলা দরকার। তিনি মনে করেছিলেন, দাসব্যবস্থা প্রথম শ্রেণিসমাজ। বাস্তবে, রোমের আগে কোথাও দাসব্যবস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে বলবৎ ছিল না। ভারতে তা চিরকালই প্রান্তিক ছিল। মেসোপোটেমিয়াতে কৃষকদের শোষণ করাটাই শাসকশ্রেণির মূল ধাঁচ ছিল। এমনকি এথেন্স ছাড়া গ্রিসের অন্যত্র দাসত্ব গৌণ ছিল। কিন্তু যে বিষয়ে তিনি একেবারে সঠিক, সেটা হল যে শ্রেণির উদ্ভব হল কৃষির উদ্ভব ও উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের সুযোগ আসার পর। চাষের দেখাশোনার জন্য গোষ্ঠীকে বছরের পর বছর একই জায়গায় থাকতে হত। চাষের ফলেই গোষ্ঠীর মধ্যে সহযোগিতা কমে গেল। নিজের ঘরের সামনের একখণ্ড জমি চাষ করে এক একটি পরিবার নিজের জন্য অনেকটাই খাদ্য উৎপাদন করতে পারত। একই সঙ্গে, পরিবারের চেহারা পাল্টাতে শুরু করল। শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের পর্বে চেষ্টা করা হত এক সন্তান ও পরের সন্তানের মধ্যে সময় যেন অনেকটা হয়, কারণ অনেক বাচ্চাকে নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যাওয়া সহজ ছিল না। অন্যদিকে এই নতুন পরিস্থিতিতে দেখা গেল, বেশি সন্তান মানে চাষের কাজে বেশি পারিবারিক শ্রম। জমি ও শস্যসঞ্চয় সম্ভব ছিল, যেটা শিকার করা মাংস আর গাছের ফল বা শিকড় বা পাতার ক্ষেত্রে বলা যায় না।
কেন শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল, তা নিয়ে এঙ্গেলসের মত সমালোচিত হয়েছে। আমরা দেখেছি, ওরিজিন-এ তিনি যেন কিছু মানুষের ব্যক্তিগত লোভকেই শুধু দায়ী করেছেন। কিন্তু যা আমরা অবশ্যই বলতে পারি, সেটা হল বিভিন্ন ক্ষেত্রে, মেসোপোটেমিয়াতে, নীল নদের উপত্যকায়, ইরানে, ভারতে, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়, শ্রেণিসমাজের আবির্ভাব হয়েছিল। গোড়ার দিকের কৃষির সঙ্গে যুক্ত যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, তা সব এলাকাতেই ঘটেছিল তখনকার প্রযুক্তি দিয়ে কতটুকু জমি চাষ করা যেত, কত ফলন হত, তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। নব্যপ্রস্তর যুগে গ্রাম থেকে এগোনোর রাস্তা ছিল সভ্যতা— সিভিলাইজেশন— যে কথাটার আক্ষরিক অর্থ হল নগরভিত্তিক সমাজ। গোয়েন্ডোলিন লাইক তার মেসোপোটেমিয়া, দ্য ইনভেনশন অফ দ্য সিটি (২০০১) বইয়ে এই প্রক্রিয়ার প্রাচীনতম ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। নগরসভ্যতার জন্য দরকার ছিল বিরাট উদ্বৃত্তের। সেটা এল প্রযুক্তির বিকাশের হাত ধরে। বহু শতকের বসতির ফলে কিছু গ্রাম থেকে জন্ম নিল শহর। নতুন প্রযুক্তির জন্য দরকার হল বিশেষীকরণের। শস্য রাখার বিশাল ভাণ্ডার, সেচের হিসেব, এই সব থেকে জন্ম নিল এক শিক্ষিত আমলাতন্ত্র। আর যেহেতু প্রকৃতির উপর সীমিত নিয়ন্ত্রণের ফলে প্রায় সবকিছুর জন্যই দায়ী করা হত নানা দেবদেবীকে, তাই মন্দির আর তার পুরোহিতরাই পেলেন বড়রকম প্রভাব। কালক্রমে এই মন্দির আর তার পুরোহিতরা এক স্বতন্ত্র স্তর, ও শেষে শ্রেণি হয়ে ওঠে। উর, লাগাশ বা অন্য প্রাচীন মেসোপোটেমীয় শহরে এই প্রক্রিয়া স্পষ্ট বোঝা যায়। কৃষকরা ক্রমে মন্দিরের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে। পোড়ামাটির ট্যাবলেটের লেখা থেকে জানা যায়, এই সময়ে মন্দিরের শ্রমিকদের যে দৈনিক রেশন জুটত, তাতে থাকত দিনে ৩ সিল্লা যব (মোটামুটি ২.৪ লিটার), এবং সেই সঙ্গে বিয়ার ও তেল। আজকের ভারত বা আফ্রিকার বহু শ্রমিকের চেয়ে ক্যালরির হিসেবে এরা বেশি খেতে পেত (সেকালে ৩০০০, আজ অনেকের ক্ষেত্রে ১০০০)।
নারী অবদমন ও শোষণ
অবশ্যই ওরিজিন শুধুমাত্র শ্রেণি ও রাষ্ট্রের উত্থান নিয়ে লেখা হয়নি। এর এক প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল কীভাবে নারী অবদমন ও শোষণ আরম্ভ হল তা দেখা। এঙ্গেলসের এক মূল দাবী ছিল, যে শ্রেণিদের উত্থানের আগে মেয়েরা পুরুষদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন না। দুটি প্রশ্ন তখনই ওঠে। প্রথমত, তিনি কতটা সঠিক ছিলেন? দ্বিতীয়ত, মাতৃতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর ধারণা কি সঠিক ছিল?
লেভি-স্ত্রসের মত স্ট্রাকচারালিস্ট নৃতত্ত্ববিদরা দাবি করেছেন, শ্রেণিসমাজ হওয়ার অনেক আগে থেকেই, মেয়েরা ছিল দুই গোষ্ঠীর পুরুষদের মধ্যে বিনিময়ের বস্তু। কিন্তু এই দাবি এসেছে আধুনিক পিতৃতান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক পাশ্চাত্য সমাজের চশমা চোখে দিয়ে।
এলিনর লিকক সহ বিভিন্ন নৃতত্ত্ববিদ যে তথ্য একজোট করেছেন, তা দেখায়, সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দী অবধি ইউরোপীয়রা যে সব শিকার ও খাদ্যসংগ্রহ-নির্ভর গোষ্ঠীদের দেখেছিল, তাদের মধ্যে পুরুষ-শাসনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর্নেস্টিন ফ্রিডল বলেন, কোনও কোনও অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের ক্ষেত্রে, দেখা গেছে, খাদ্যে মাংস পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষরা বাড়তি সুযোগ পেত। কিন্তু কোথায় বসতি করা হবে, ইত্যাদি আলোচনাতে পুরুষ-নারী উভয়েরই মত নেওয়া হত।
ক্যারেন স্যাকস, ক্রিস্তিন গেইলি ও অন্য মার্ক্সবাদী নৃতত্ত্ববিদরা বলেন, প্রাক-রাষ্ট্র সমাজের ছবি দেখায়, কে কাকে বিয়ে করবে, এ নিয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছিল, কিন্তু সেটা লেভি-স্ত্রস কথিত পুরুষ নিয়ন্ত্রণ না। নিয়ন্ত্রণ করত আত্মীয় গোষ্ঠী (kin-corporate group)। তার মধ্যে বয়স্ক পুরুষ এবং বয়স্ক নারী, উভয়েরই কণ্ঠ পাওয়া যায়। বিশেষত যে সব সমাজদের বলা হয়েছে ‘matrilineal’ ও’matrilocal’, সেখানে ছবিটা স্পষ্ট। প্রথম কথাটার মানে, বংশ পরম্পরা ধরা হয় মায়ের দিক থেকে। বাবা অন্য বংশের লোক। বাবার চেয়ে মায়ের ভাইয়ের সঙ্গে নিবিড়তর সম্পর্ক। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একজন পুরুষ মায়ের বাড়ি থেকে বিয়ের পর স্ত্রী, স্ত্রীর মা ও স্ত্রীর বোনদের পরিচালিত বাড়িতে চলে যেত। নিজের মায়ের বাড়িতে একজন পুরুষের কিছুটা কর্তৃত্ব থাকতে পারে, কিন্তু সে যে বাড়িতে বাস করে, তার স্ত্রীর বাড়ি, সেখানে তার কোনও ক্ষমতা থাকত না। আর, নিজে যেহেতু মায়ের বাড়ি বাস করত না, তাই সেখানেও তার ক্ষমতা হত সীমিত। তাই স্ট্রাকচারালিস্টরা যে দাবী করেছেন, তার পক্ষে অনেক বেশি প্রমাণ দরকার, যা তারা দেননি। অর্থাৎ, আমাদের নিজেদের যুগের পুরুষপ্রাধান্যবাদী ঠুলিগুলো খুলে তাকালে দেখব, ওই সব সমাজে নারী ও পুরুষ, উভয়েরই দায়িত্ব আর অধিকার, দুটোই ছিল।
এঙ্গেলস বৈবাহিক সম্পর্কের এক জটিল বিবর্তন ব্যাখ্যা করেছিলেন, তার সবকটি স্তর সম্ভবত ঠিক ছিল না। আদি পর্বে তিনি একরকম ‘গোষ্ঠীবিবাহের’ কথা বলেন, যা আজকের যুগে আমরা যে ছোট ছোট গোষ্ঠীদের কথা মনে করি এবং যার কথা আগে বলা হয়েছে, তার মধ্যে অত জটিল প্রথা, সামাজিক রীতি, না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরে তিনি যে দুটো স্তরের কথা বলেন, সেগুলি অনেক বাস্তব। প্রথমে আসে দুই ব্যক্তি (এক নারী ও এক পুরুষ) মিলে গড়া পরিবার যাতে পরবর্তীকালের মতো পুরুষপ্রাধান্য ছিল না। কিন্তু কালক্রমে কৃষিভিত্তিক সমাজের এই পরিবার থেকে উঠে আসে পিতৃতান্ত্রিক একগামী পরিবার, যেখানে একগামিতা হল স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর উপর চাপানো নিয়ম, যেটা কিন্তু স্বামীর উপর খাটত না। ফলে একই সঙ্গে তৈরি হল যৌনপেশা। যদি প্রত্যেক স্ত্রীকে স্বামীর প্রতি অনুগত হতে হয়, অথচ পুরুষের থাকে অবাধ যৌন অধিকারের দাবী, তাহলে স্বতন্ত্র একরকম মেয়েকে থাকতে হবে, যারা সব পুরুষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য থাকবে, এক স্বামীর জন্য না। তিনি বলেন, আগের যুগের যৌন স্বাধীনতা রূপান্তরিত হল, এবং একদিকে বিবাহিত মেয়েদের জন্য একগামিতার পাশে এল যৌনপেশা। অর্থাৎ একগামিতা শুধু মেয়েদের জন্য, আর সবার যৌন স্বাধীনতা রূপান্তরিত হল পুরুষের একপেশে যৌন স্বাধীনতায় (মার্ক্স-এঙ্গেলস নির্বাচিত রচনাবলি, ৩ খণ্ডের সোভিয়েত সংস্করণ, খণ্ড ৩, পৃঃ ২৩৭-২৪৩)।
এ পর্যন্ত এঙ্গেলসের এই পর্বের যুক্তি বোঝা যায়। সমস্যা হয়, কেন মেয়েদের উপর এই চাপ নেমে এল তার ব্যাখ্যায়। তিনি বলেন, পুরনো যৌনস্বাধীনতা যত তার আদিম চরিত্র হারাতে থাকল, পুরনো সাম্যবাদ যত ভেঙে পড়তে থাকল, তত ওইরকম যৌনসম্পর্ক নিশ্চয় মেয়েদের কাছে অবমাননাকর ঠেকেছিল, এবং এই কারণে তারা সতীত্বের অধিকার চেয়েছিল, একজন মাত্র পুরুষের সঙ্গে বিয়েকে মুক্তি হিসেবে দেখেছিল (ঐ, পৃঃ ২২৯)।
সমস্যা একাধিক। প্রথমত, এঙ্গেলস ধরে নিয়েছেন, প্রাক-মানু্ষ থেকে মানু্ষপর্যায়ে আসার পর্বে এমন এক যৌনসম্পর্ক চালু ছিল, যাকে তিনি বলছেন আদিম বিমিশ্রতা (primitive promiscuity)। তিনি দাবী করেন, এর কারণ হল, যে সহযোগিতা নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে কঠিন লড়াই করে মানুষকে বাঁচতে হত, সেই পারস্পরিক সহযোগিতা রাখতে হলে ঈর্ষান্বিত পুরুষদের ঠান্ডা রাখার জন্য ওই ব্যবস্থা জরুরি ছিল। আমরা এখনও নিশ্চিত নই, যে ওই ঊষাকালের মানুষের সামাজিক সংগঠন সাধারণ শিম্পাঞ্জিদের মতো পুরুষকেন্দ্রিক ছিল, না পিগমি শিম্পাঞ্জিদের মতো নারীকেন্দ্রিক ছিল। উপরন্তু গোরিলা ও শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে যতটা গবেষণা হয়েছে, তাতে এটা আদৌ নিশ্চিত নয় যে এদের নিকটতম আত্মীয় হোমিনিডদের মধ্যে তীব্র ঈর্ষাবোধ কাজ করত। এবিষয়ে লিকি ও লেউইন, এবং অন্য কিছু বই পড়লে সন্দেহের জায়গা থাকে।
এরপর, আমরা আগেই দেখলাম, এঙ্গেলস একরকম গোষ্ঠীবিবাহ অনুমান করেছিলেন যায় প্রমাণ নেই।
গার্ডা লার্নার লিখেছেন, মেয়েরা বিশেষভাবে সতীত্ব চেয়েছিল, এটা এঙ্গেলসের নিজের মধ্যে ভিক্টোরীয় মূল্যবোধের ফল। মেরি জেন শার্ফি এক সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রস্তাব করেছেন, যেটাও নিশ্চিত নয়, কিন্তু যার পিছনে আছে জীববিদ্যাগত জ্ঞান। শিম্পাঞ্জিদের মাসিক ঋতুচক্র এস্ত্রুসে মেয়ে শিম্পাঞ্জির যৌনসক্রিয়তা মাসের মধ্যে কয়েকদিন মাত্র। তা থেকে মানুষের ক্ষেত্রে ঋতুচক্র পালটে যাওয়ার ফলে নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষের সমস্যা বাড়ে। নারীর যৌনতা নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ উঠে আসে এ থেকে। এই তত্ত্ব নিশ্চিত না, কিন্তু এ থেকে একটা প্রশ্ন আসে, তা হল, সব যুগে মেয়েরা ‘স্বাভাবিক’ বা ‘সহজাতভাবে’ লজ্জাবতী, যৌনসম্পর্ক স্থাপনের সব উদ্যোগ পুরুষ নেয়, এটা মনে করার বাস্তব কোনও প্রমাণ কিন্তু নেই।
তৃতীয়ত, এঙ্গেলস লিনিয়েজ সমাজ বা কিন-কর্পোরেট সমাজকে অতীতের অবশিষ্ট হিসেবে দেখেছিলেন, কিন্তু তার আধুনিক মার্ক্সবাদী সমা্লোচকরা কেউ কেউ মনে করেছেন, তিনি উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ফলে যে নতুন সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল সেটা ভালো করে বোঝেননি। অর্থাৎ সমস্যা মার্ক্সবাদী পদ্ধতিতে না, এই ক্ষেত্রে এঙ্গেলসের মার্ক্সবাদ প্রয়োগে ঘাটতি থেকে যাওয়াতে।
দ্বিতীয় যে মূল প্রশ্ন ওঠে, তা হল এঙ্গেলস কি মাতৃতন্ত্র বলতে নারী একাধিপত্য বুঝিয়েছিলেন? পরবর্তীকালে কেউ কেউ তার উক্তিকে এইভাবে পাঠ করেছেন বটে, কিন্তু তিনি নিজে জার্মান লেখক বাখোফেনের থেকে ‘Mutterrecht’ শব্দটা যখন নিয়েছেন, তখন সাবধান করে দিয়েছেন, এটা সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু এর কোনও আইনি অধিকারের অর্থ ছিল না (পৃঃ ২২০)।
সবশেষে যে বড় প্রশ্নটা আসে, তা হল একটা সমতাভিত্তিক সমাজে পুরুষরাই বা কেন অসাম্য ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দিকে গেল?
এঙ্গেলসের আধুনিক সমর্থকদের বক্তব্য
এখানে দুরকম উত্তর এসেছে। লিকি ও গেইলি বলেন, মূল উপাদান হল রাষ্ট্রের উদ্ভব। রাষ্ট্র গোটা সমাজকে নতুন গড়ে ওঠা শাসকশ্রেণির অধীনে রাখতে চায়। সেটা করতে হলে কিন-কর্পোরেট সমাজের স্বাতন্ত্র্য ধ্বংস করা জরুরি হয়ে পড়ে। এইজন্য তাদের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলে। জীবনের পুনরুৎপাদনে মেয়েদের বড় ভূমিকা বলেই মেয়েরা ক্ষমতা হারাল বেশি। কিন্তু এখানেও পুরো বোঝা গেল না, কেন শাসকশ্রেণির মধ্যে মেয়েরা সমতা পাবে না। আর, শোষিতশ্রেণির মধ্যেও কেন তারা অপেক্ষাকৃত হীন অবস্থানে থাকবে।
গর্ডন চাইল্ড ও আর্নেস্টিন ফ্রিডল বলেন, উৎপাদনের ক্ষেত্রে কার কী ভূমিকা সেটা পালটে যাওয়া ছিল মূল কারণ। চাইল্ড বলেন, নব্যপ্রস্তর যুগের গোড়ায় কৃষির বিকাশে মেয়েদের বড় ভূমিকা ছিল। এস্থার বোসরাপ-ও একই কথা বলেছেন। শুধু চাষ বা তার সরঞ্জাম আবিষ্কার না, মাটির পাত্র নির্মাণ, কাপড় বোনা, এসবেও মেয়েদেরই বড় ভূমিকা ছিল।
কিন্তু নিড়ানির বদলে লাঙ্গল আসার পর পরিস্থিতি পালটে গেল। পশুপালন করত পুরুষরা। লাঙ্গল পশু দিয়ে টানা হত। ফলে পুরুষদের আপেক্ষিক ক্ষমতা বাড়ল। দ্বিতীয়ত, আমরা দেখেছি, স্থায়ী কৃষি এলে পরিবারে সদস্যসংখ্যা বেশি হলে গোটা পরিবারের লাভ হত। কিন্তু তার মানে মেয়েদের বারেবারে সন্তানধারণ। সুতরাং গোটা সমাজের স্বার্থে (মেয়েদের সহ) মেয়েরা যুদ্ধ, ভারী কৃষিকাজ, ইত্যদি থেকে বাদ পড়ল।
যে সব পুরুষ ওইসব কাজ করত, তারা সকলে অবশ্যই শাসকশ্রেণির সদস্য ছিল না। চাষিরা খুব বেশি নৃপতি হত না, সৈনিকরা সকলে নায়ক হত না। প্রথম শাসকশ্রেণি হল যে মন্দিরের পুরোহিততন্ত্র, তারা তো একেবারেই আলাদা ছিল। কিন্তু নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা পুরনো লিনিয়েজ সমাজে ভাঙন আনল। প্রথম প্রজন্মের পুরুষের শ্রম বেশি বয়সের সহায় হিসেবে দেখা দিল। বাবা-ছেলে সম্পর্ক মৌলিক সম্পর্ক হয়ে উঠল, আর তাই রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণিতে পিতৃতন্ত্র ও পুরুষের ক্ষমতাবৃদ্ধি নিশ্চিত করল। শাসকশ্রেণির মেয়েরা অবশ্যই শ্রেণির অংশ হিসেবে লাভবান হয়, কিন্তু নিজের শ্রেণিতে তারা পুরুষের অধীনে থাকে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এঙ্গেলসের বিশ্লেষণ আমাদের অনেকগুলি সঠিক সাধারণ সিদ্ধান্তের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু ত্রুটিও দিয়েছিল। তাঁর কাজের প্রধানতম তাৎপর্য হল, তিনি নারী অবদমন ও শোষণকে একটা ঐতিহাসিক মাত্রা দিলেন। যদি সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়ে আরম্ভ হয়ে থাকে, তার মানে ওটা আমাদের জিন’-এ নেই। ওটা স্বাভাবিক না। তিনি অল্প কথায় হলেও, এটাও বলেছিলেন যে পেট্রিয়ার্কি অপরিবর্তিত থাকে না। দাস সমাজে আর ফিউড্যালিজমে তার চেহারা স্বতন্ত্র।
এঙ্গেলসের রচনার ফলে সে কথাগুলো সামনে এল, তা হল— আত্মীয়তার সম্পর্ক ও শ্রম-বিভাজনের সঙ্গে সমাজে মেয়েদের অবস্থানের সম্পর্ক তুলে ধরা; ব্যক্তিমালিকানা, একগামী বিবাহ এবং যৌনপেশার এক সুতোয় গেঁথে যাওয়া; পুরুষের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রাধান্য ও নারীর যৌনতার উপর নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে তার সম্পর্ক; এবং রাষ্ট্রগঠন, শাসকশ্রেণির উত্থান ও নারী অবদমনের এক নিবিড় আন্তঃসম্পর্ক।
.
শ্রমের লিঙ্গবিভাজন— এঙ্গেলস ও তাঁর পর
শ্রমের লিঙ্গবিভাজন সম্পর্কে এঙ্গেলসের ধারণাতে কিছু সমস্যা দেখা যায়। তিনি লেখেন: বড় শিল্প আসার ফলে মেয়েরা বাড়ি থেকে শ্রমের বাজারে এবং ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার ফলে এবং অনেক সময়ে পরিবারের মূল আয় করার ফলে প্রলেতারীয় পরিবারে পুরুষ প্রাধান্যের শেষ ভিত্তি চলে গেছে। হয়ত আছে কেবল একগামিতা কায়েম হওয়ার সময় থেকে আসা মেয়েদের প্রতি পাশবিক ব্যবহার। প্রলেতারীয় পরিবার প্রকৃত অর্থে একগামী নয়। এখানে এঙ্গেলস অতি আশাবাদী। মেয়েরা বাইরের জগতে কাজ পাওয়াতে তাদের মুক্তির ভিত্তি তৈরি হয়ে গেছে, প্রায় দেড়শো বছর পরে আর এই সহজ আশাবাদ সম্ভব না। উপরন্তু এঙ্গেলস মেয়েদের উৎপাদক হিসবে ভূমিকা ও পরিবারে তাদের ব্যক্তিগত ভূমিকার মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা বলেছিলেন। এখানে একটা সমস্যা হল গৃহকর্ম ও সন্তানপালনকে প্রধানত মেয়েদের কাজ হিসেবেই দেখা হয়েছে। ফলে প্রলেতারীয় পরিবারের মধ্যেও যে পুরুষপ্রাধান্যের একটা ভিত্তি থেকে গেল, সেটা তিনি দেখতে পেলেন না। বেবেল এবং পরে ক্লারা জেটকিন সেটা দেখতে পেরেছিলেন।
উপরন্তু, এঙ্গেলস মনে করেছিলেন, গৃহকর্মের সামাজিকীকরণ পুরুষপ্রাধান্যবাদকে হঠিয়ে দেবে। কিন্তু সেই সামাজিকীকৃত কাজটা করবে কে? সন্তানের জন্ম তো দেবে মেয়েরাই। কিন্তু ভবিষ্যতের সমাজে সেটা যাতে তাদের অগ্রগতির পথে বাধা না হয়, সেটা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? এঙ্গেলস বলেছিলেন, ভবিষতের সমস্যার সমধান ভবিষ্যৎকাল করবে, আমরা তা নিয়ে কল্পনা করব না। রুশ বিপ্লব, চিন বিপ্লব, ইত্যাদির উত্থান-পতনের পর আজ এমন কথা আমরা বলতে পারি না। বিংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতা দেখায়, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নারীমুক্তি নিশ্চিত করে না। সেটা এঙ্গেলসের দোষ না। কিন্তু এই জন্য তাঁর প্রতিটি বাক্যকে শেষ কথা বলে মনে করা ভুল।
আর একটা কথা হল, এঙ্গেলস বিষমকামী একগামিতাকে নৈতিক অগ্রগতি বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু কোনও কারণ দেখাননি। তিনি লিখেছিলেন, প্রলেতারিয়েতের মধ্যে সম্পত্তির চিন্তা নেই, তাই পুরুষপ্রাধান্যের জন্য কোনও তাগিদ নেই। এখান থেকে নানারকম সমালোচনা এসেছে, যার প্রত্যেকটি এক না। আমরা খুব সংক্ষেপে তাদের উল্লেখ করব।
সিমোঁ দ্য বোভোয়ার এবং কেট মিলেট বলেন, এঙ্গেলস অতিরিক্ত অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ দেখিয়েছেন। বোভোয়ার স্বীকার করেন, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অন্যদের চেয়ে নারী অবদমনের অনেক উন্নত ব্যাখ্যা করেছিল। কিন্তু তিনি বলেন, লিঙ্গ একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি, এবং শ্রেণি দিয়ে তার পুরো ব্যাখ্যা হয় না। তিনি বলেন, নারীত্ব একটা সামাজিক নির্মাণ, যা এঙ্গেলস বা ফ্রয়েড কেউই ঠিকভাবে বোঝেননি। মিলেট এঙ্গেলসের অনেক বক্তব্যকে গ্রহণ করেন, কিন্তু বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে যে নারীমুক্তির প্রতিশ্রুতি নষ্ট হয়েছিল, তার কারণ মার্ক্স-এঙ্গেলসের চিন্তার মধ্যেই একটা সীমাবদ্ধতা।
মেয়েরা শ্রমের বাজারে এলে কী পরিবারে সাম্য আসে? বেবেল প্রলেতারীয় পরিবারে অসাম্যের কথা বলেছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রী নারীবাদীরা বলেছেন, গৃহকর্ম (কাপড় কাচা, রান্না করা, বাড়ি পরিষ্কার রাখা, সেলাই করা, বাড়ির হাজার খুচরো কাজ করা) বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়ায়, এবং ওই কাজের বেশিরভাগতা মেয়েদের উপরেই পড়ে। রাষ্ট্রের নীতি এই ধাঁচা মজবুত করে, এবং শ্রমিকশ্রেণির মধ্যেও এর পুনরাবৃত্তি হয়।
কোনও মানুষ পুরোটা নিজের যুগের বাইরে বেরোতে পারে না। এঙ্গেলসও তার ব্যতিক্রম না। তাই তিনি আদর্শ সম্পর্ক বলতে নারী-পুরুষের মধ্যে পরস্পরকে বঞ্চনা না করে একগামিতা ছাড়া আর কিছু দেখতে পারেননি, এবং পুরুষের পক্ষে পুরুষের সঙ্গে প্রেমকে অবক্ষয় বলে চিহ্নিত করেছিলেন (পৃঃ ২৩৯)।
মার্ক্সবাদী-নারীবাদীরা (মার্থা গিমেনেজ, লিজে ভোগেল, প্রমুখ) মনে করেন, প্রতিটি উৎপাদন ব্যবস্থার মূর্ত বিশ্লেষণের মধ্যেই সেই সমাজে লিঙ্গসম্পর্ক দেখা যাবে, এবং এঙ্গেলস সেই কাজ যথেষ্ট করেননি। বিশেষ করে, ভোগেল, ও তাঁর অনুসরণকারীরা মার্ক্সের ক্যাপিটাল থেকে রসদ নিয়ে দেখাতে চেয়েছেন, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজির পুনরুৎপাদনের জন্য মেয়েদের নিখরচার পারিবারিক শ্রম কত দরকার। এবং তাই পুরুষপ্রাধান্য, পরিবারের মতাদর্শ, এ সব কেন পুজির স্বার্থে টেঁকানো ও গভীরতর করা হয়।
সুতরাং, ত্রুটি থাকলেও, আলোচনার সূত্রপাত এঙ্গেলস থেকেই। এই প্রবন্ধ তার একটা প্রথমিক রূপরেখা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে।
সহায়ক গ্রন্থ:
- Gerda Lerner, The Creation of Patriarchy, Oxford 1987
- Ernestine Friedl, Women and Men: An Anthropologist’s View. New York: Holt, Rinehart and Winston, 1975
- Eleanor Burke Leacock, Myths of Male Dominance: collected articles on women cross-culturally. New York: Monthly Review Press, 1981
- Richard Lee, The !Kung San ,Cambridge University Press,, 1979
- Richard Leakey and Roger Lewin, Origins: The Emergence and Evolution of Our Species and Its Possible Future, E.P. Dutton, London, 1979.
- Mary Jane Sherfey, The Nature and Evolution of Female Sexuality, Vintage Books, NY, 1973
- Gordon Childe, What Happened in History, Penguin, Harmondsworth, 1942.
- Christine Ward Gailey, Kinship to Kingship: Gender Hierarchy and State Formation in the Tongan Islands, University of Texas Press, 1987
- Simone de Beauvoir, The Second Sex, http://www.marxists.org/reference/subject/ethics/de-beauvoir/2nd-sex/ch03.htm accessed on 18.2.2007.
- Michele Barrett and Mary McIntosh, The Anti-Social Family, Verso, London, 1985