বন্দুক আর গোলাপফুলের লড়াই

ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জি

 


লেখক গদ্যকার, পেশায় শিক্ষক

 

 

 

 

অনেক অনেক দিন আগে শারদীয়া আনন্দমেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম। লেখকের নাম ভুলে গেছি। গল্পে দনুজ আর ধরে নেওয়া যাক দিতির আট-নয় বছর বয়সী বেজায় খিটখিটে ছেলে হঠাৎ একদিন সকালে আর ঘুম থেকে ওঠে না। দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক ছেলে, সমান শ্বাস বইছে, মুখ হাসি হাসি, কপালে একটিও কষ্টের রেখা নেই, কিন্তু হাজার ডাকলেও তার ঘুম ভাঙছে না। দিনের পর দিন কেটে যায়, ঘুম আর ভাঙে না। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও এর কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। শিশুটি ঘুমোচ্ছে, সম্ভবত স্বপ্নও দেখছে এবং তা সুস্বপ্ন, কারণ তার মুখ প্রসন্ন। একদম স্বাভাবিক ঘুম, কিন্তু চেতনা কিছুতেই আসছে না। এ রহস্যের কোনও সমাধান হওয়ার আগেই খবর আসে আর একটি বাচ্চার ঘুমিয়ে পড়ার— এবার একটি প্রায় সমবয়সী মেয়ের, অন্য এক মহাদেশের। দিন কয়েকের মধ্যেই এরকম আরও খবর আসতে থাকে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। যেন ঘুমের প্যান্ডেমিক শুরু হয়েছে, আর তাতে আক্রান্ত হচ্ছে শুধু শিশুরা। তবে তথ্যের ভেতর একটা স্পষ্ট প্যাটার্ন চোখে পড়ে এবার। বোঝা যায় এইসব বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ছে পৃথিবীজোড়া হিংসা, ধ্বংস আর দূষণের থেকে পালাতে চেয়ে। এতদিনে রাষ্ট্রনেতাদের টনক নড়ে। ইউনাইটেড নেশনসের বিশেষ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এইসব শিশুদের দিতে হবে তাদের কাঙ্ক্ষিত পৃথিবী, একমাত্র তাহলেই হয়তো তারা জেগে উঠবে। দুনিয়াজুড়ে নিষ্ক্রিয় হয় সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্র, থেমে যায় সাদা-কালো সব যুদ্ধ, দূষণ রুখে দেওয়া যায় কয়েক বছরের মধ্যেই, পৃথিবী দ্রুত সেরে উঠতে থাকে। এদিকে বিরাট এক বাগানের মধ্যে এক বিশ্রাম-কেন্দ্রে সারি সারি বিছানায় ঘুমিয়ে থাকে স্বপ্ন দেখতে থাকা শিশুরা। খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসে পাখির ডাক, ফুলের গন্ধ; আর মিউজিক সিস্টেমে মৃদুস্বরে বাজতে থাকে রাষ্ট্রনেতাদের যৌথ বার্তা— আমরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছি। তোমাদের জন্য সুস্থ পৃথিবী গড়ে তুলব আমরা, কথা দিচ্ছি। হে শিশুরা, হে মানবতার ভবিষ্যৎ, এবার জেগে ওঠো। দ্যাখো, স্বপ্নের পৃথিবী আর জাগরণের পৃথিবী কেমন এক হয়ে গেছে।

২০১৮ সালে মণিপুরের মেয়ে লিসিপ্রিয়া কাঙ্গুজম যখন ভুবনেশ্বরে তার স্কুল ছেড়ে দিল্লির সংসদ ভবনের সামনে দিল্লির বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ আর কার্যকরী পরিবেশ আন্দোলনের দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে শুরু করে তখন তার বয়স মোটে বছর সাতেক। সরকারি তরফে তার এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হলেও সে দমে যায়নি। দু বছর ধরে নাছোড় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে গত ডিসেম্বরে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্সে আমন্ত্রিত হয়ে স্প্যানিশ মিডিয়ায় বেশ সাড়া ফেলে দেয় লিসিপ্রিয়া। মিডিয়া তাকে আখ্যা দেয় ‘গ্রেটা থুনবার্গ অফ দ্য গ্লোবাল সাউথ’। এভাবে তুলনা টানায় লিসিপ্রিয়ার আপত্তি থাকলেও গ্রেটা-র সঙ্গে তার সাদৃশ্যের কথা অনস্বীকার্য। যাই হোক, দিল্লির বায়ুদূষণ নিয়ে তার প্ল্যাকার্ড-আন্দোলন চলতেই থাকে। কিন্তু গত ১৮ই অক্টোবর লিসিপ্রিয়া আর তার সমবয়সী অ্যাক্টিভিস্ট আরভ শেঠকে হঠাৎই পার্লামেন্টের সামনে থেকে সরে যেতে বলে পুলিশ। তারা অস্বীকার করলে তাদের একটা গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। মিনিট চল্লিশেক পর তাদের নামিয়ে দেওয়া হয় যন্তরমন্তরের সামনে। শাসানো হয়, ফের পার্লামেন্টের সামনে তাদের দেখা গেলে অ্যারেস্ট করা হবে।

গ্রেটা থুনবার্গ বা লিসিপ্রিয়া কাঙ্গুজম, আরভ শেঠের মত ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্টরা ঐ নাম-ভোলা গল্পটার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। না, এরা ঘুমিয়ে পড়েনি, পালিয়ে যায়নি। উল্টে এরা লড়ছে, বুঝে নিতে চাইছে নিজেদের দাবি, রাষ্ট্রনেতাদের স্পষ্ট গলায় বলছে ২০৪০ বা ২০৩০ বা এমনকি ২০২১ নয়, ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে দৃঢ পদক্ষেপ নিতে হবে এক্ষুনি। কোনও প্রোটোকলের ধার ধারছে না এরা, আর তা করবেই বা কেন? এখন যারা প্রাপ্তবয়স্ক বা প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ তারা নয়, ক্লাইমেট চেঞ্জের অবশ্যম্ভাবী শিকার তো গ্রেটা-লিসিপ্রিয়া-আরভের প্রজন্ম। শ্রেণিসংগ্রাম পুরনো হয়ে গেছে, এদের লড়াই এখন আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে যাদের হাতে সমস্ত ক্ষমতা। এই অ্যাডাল্ট-ওয়ার্ল্ডের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে রাষ্ট্রের হাতে, তাই এরা রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে সরাসরি। ভেবে দেখুন, রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করছে না কি আট-ন বছর বয়সী শিশুরা! যেন গোলিয়াথ আর ডেভিডের লড়াই অথবা জ্যাক দ্য জায়ান্ট স্লেয়ার! বেশিরভাগ সময় উল্টোদিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে রাষ্ট্র, শক্ত হাতে দমন করতে পারছে না। তার দ্বিধা এবং অস্বস্তি প্রকট হচ্ছে। এক পা এগিয়ে এসে খ্যাঁক করেই দু পা পিছু হটছে লেজ গুটিয়ে। চোরা চোখে ইতিউতি চাইছে। এই লিসিপ্রিয়ার ব্যাপারটাই ধরা যাক। ১৮ই অক্টোবর লিসিপ্রিয়া আর আরভকে অ্যারেস্ট করার হুমকি দেয় পুলিশ, কিন্তু সে হুমকি অগ্রাহ্য করে তেইশ তারিখ আবার সংসদ ভবনের সামনে ফিরে এসেছে দুজনেই। কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের হাতে তুলে দিয়েছে লাল গোলাপ। বোকা বোকা মুখ করে সে গোলাপ নিয়েওছে তারা। এদিকে আরভ আর লিসিপ্রিয়া দাঁড়িয়ে পড়েছে প্ল্যাকার্ড হাতে, দিল্লির বায়ুদূষণের স্থায়ী সমাধানের দাবী নিয়ে যাতে বড় বড় করে লেখা ACT NOW।

পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন যত জোরদার হবে ততই নখ-দাঁত বার করবে রাষ্ট্র, কারণ রাষ্ট্র আসলে বাজারের প্রতিভূ আর বাজার এক অন্ধ শক্তি যা কোন কিছুরই তোয়াক্কা করে না। পরিবেশ সঙ্কটকে অস্বীকার করতে না পারলে বাজার নিজেই সঙ্কটাপন্ন হবে, অতএব দমন-পীড়ন চলবে। কোভিড পরিস্থিতির সুযোগে আমাদের রাষ্ট্র এখন বেপরোয়া পরিবেশ ধ্বংসের নেশায় মেতেছে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং এর ছুতোয় পরিবেশ আন্দোলনগুলোকে চেপে দেওয়া এখন আরও সহজ। অবস্থা এমনই যে পরিবেশ মন্ত্রীকে ই-মেইল করার অপরাধে অ্যারেস্ট হবার হুমকি শুনতে হচ্ছে, শুধুমাত্র প্ল্যাকার্ড হাতে সুস্থ পরিবেশের দাবি করার জন্য পুলিশ হুমকি দিচ্ছে, ডিটেইন করছে আট-ন বছরের শিশুদের।

লিসিপ্রিয়া কিন্তু স্পষ্ট জানিয়েছে যে তার আন্দোলন থামবে না। একই প্রত্যয় আরভের টুইটেও। এবার দেখার রাষ্ট্র এদের সঙ্গে কী করে। এরাই একমাত্র আশা আমাদের। যদি এদের প্রজন্ম জেগে ওঠে, যদি আমরা সঠিকভাবে অণুঘটকের ভূমিমা পালন করতে পারি এদের অভিভাবকদের মত, তাহলে একদিন রাষ্ট্র এদের সামনে মাথা নিচু করতে বাধ্য। ভবিষ্যতের সঙ্গে কি আর লড়াই করা যায়?

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...