পশ্চিমবঙ্গের মন্দির টেরাকোটা: রূপ থেকে অরূপে

পশ্চিমবঙ্গের মন্দির টেরাকোটা: রূপ থেকে অরূপে -- ইন্দ্রনীল মজুমদার

ইন্দ্রনীল মজুমদার

 

ষোড়শ শতকের অন্তভাগ থেকে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের টেরাকোটা মন্দিরের স্থাপত্য, অঙ্গসজ্জার বিবর্তন ও কালানুক্রম খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনুসন্ধানী গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী ও অগ্রণী শিল্পরসিকদের মূল্যবান আলোচনার বিষয় হয়ে আছে আজও। সেই নিরলস ও কষ্টসাধ্য তত্ত্ব ও তথ্যনির্মাণের ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই আমরা আজ প্রায় সব দিক থেকেই বাংলার এই একান্ত আপন শিল্পরূপটিকে দেখতে পারি, নতুন দৃষ্টি নিয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারি। শুধু এই বঙ্গেরই নয়, ওপার বাংলারও অনেক মন্দির-গবেষক আজও চালিয়ে যাচ্ছেন এই পরিশ্রমী তন্বিষ্ঠ উদ্ঘাটনের কাজ। এই দুইধারা মিলিয়ে মন্দির টেরাকোটার সৌন্দর্যযাত্রায় আমরা যে বড় একটি পরিপ্রেক্ষিত পাই তা অন্য কোনও শিল্পমাধ্যমে সহজলভ্য নয়। টেরাকোটা মন্দির শুধু এক শিল্পপ্রাঙ্গন না হয়ে হয়ে উঠেছে বৃহৎবঙ্গের আর্থসামাজিক ও ধর্মচেতনার বিবর্তনের, তার কারিগরদের কারুচেতনার নিবিড় বর্ণমালা।

সব শিল্পমাধ্যমেরই যে নান্দনিক দিক সেটি বিষয় ও কলাকৌশল উত্তীর্ণ হয়েই প্রকাশিত হয়। আর্টকে লুকিয়ে রেখে যে আর্ট তার প্রকাশ নন্দনের অমৃতলোকে। পালযুগের ভাস্কর্যে বাঙালি তার চিহ্ন রেখে গেছে। সেই অলৌকিক সুষমার পিছনে থাকে শিল্পীর অন্তর্জগত, শুধু প্রকরণগত কৌশল নয়। পশ্চিমবঙ্গের টেরাকোটা মন্দিরের এক একটির বৈশিষ্ট্য, কাল ও অবস্থান, স্থাপত্যশৈলী, উপকরণ, কারিগরী, টেরাকোটায় রূপায়িত মূর্তিভাবনা ও তার সূত্রনির্দেশ, সর্বোপরি প্রাকৃত জীবনচিত্রন নিয়ে এক সুবিশাল জ্ঞানভাণ্ডার আমরা প্রণম্য অগ্রণীদের কাছ থেকে পেয়েছি। প্রশ্ন ওঠে শুদ্ধ শিল্পের মাপকাঠিতে সবই কি উত্তীর্ণ হল? তথ্য ও তত্ত্ব ছাড়িয়ে সেখানে প্রয়োজন এক নান্দনিক বিশ্লেষণ। সেখানে উঠে আসতে পারে শিল্পীকারিগরের এমন এক শিল্পবোধের হদিশ যা একটি ভিশন-নির্ভর, কৌশল যার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। অগ্রণী মন্দির-আলোচক ও শিল্পরসিক শ্রী হিতেশরঞ্জন সান্যাল এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন,

রচনা যখন শিল্পীর কাছে বন্ধনমাত্র না হয়ে তার জীবনের অভিজ্ঞতা ও রূপকল্পনাকে প্রকাশের মাধ্যম হয় তখনই সে হয় শিল্পসৃয্টি— criticism of life— এই criticism কারও নিজস্ব ব্যাখ্যা নয়, এ উপলব্ধির ফল (গণপুরের মন্দির)।

শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় বা ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্তের মতো শিল্পীরা এই আলোচনারই পথদিশা দেখিয়ে গেছেন। আচার্য নন্দলাল কলাভবনের ছাত্রদের নিয়ে বনকাটির আশ্চর্য পিতলের রথের মোটিফ তুলে নিয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনের কালোবাড়িতে। বনকাটির পিতলের রথে খোদিত অবয়বের দেহভঙ্গিমা ও রেখার অনায়াস সাবলীল গতি যে লৌকিক শিল্পের অলৌকিক উত্তরণ সেটি তিনি দেখিয়েছিলেন। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় যা লিখলেন তার সত্যতা তাঁর উল্লিখিত মন্দিরগুলি ছাড়াও বিষ্ণুপুরের শ্যামরাই, গুপ্তিপাড়ার কৃষ্ণচন্দ্র বা বাঁশবেড়িয়ার অনন্তবাসুদেব মন্দিরের সামনে একটু দাঁড়িয়ে যে কোনও দর্শকই বুঝতে পারবেন।

বক্রেশ্বর, ইলামবাজার, সুরুল গ্রামের পোড়া ইটের কাজ চিত্র ও মূর্তির বিশিষ্টতা অতিক্রম করে প্রায় একাকার হয়েছে।… সমস্ত মন্দিরের উৎকীর্ণ নকশা আলোছায়ার প্রভাবে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। আলো-ছায়ার মধ্যে কোনও আকার তলিয়ে যাচ্ছে না। উজ্জ্বল আলো এবং গাঢ় ছায়ার প্রভাবে নকশাগুলি যখন সামনের দিকে এগিয়ে আসে তখন রেখা ও ছন্দগুলি ধারালো হয়ে চোখে পড়ে। তখন আমরা মূর্তিধর্মী গুণের সাক্ষাৎ পাই। অপরদিকে আলো যখন তীব্র নয় তখন আকার ও ভঙ্গি রেখাঙ্কিত চিত্ররূপে প্রকাশ পায়।

এই সামগ্রিক ছন্দোবদ্ধ রূপ যাঁরা ছোট ছোট মাটির ফলক খোদাই করতে করতে মনের গভীরে ধরে রাখতে পারলেন তাঁদের ভিশনারি বলাই তো সঠিক। বিনোদবিহারী আবার বললেন,

টেরাকোটা মূর্তিতে ভাব প্রকাশিত হয়েছে ভঙ্গির সাহায্যে। মস্তক ও মেরুদণ্ডের সংযোগস্থল থেকে শ্রোণীচক্র পর্যন্ত শরীরের অবস্থান… হাত ও পায়ের মধ্য দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে হাতের পাতা পায়ের পাতা পর্যন্ত। এইভাবে একটি নৃত্যভঙ্গি গুণ এইসব মূর্তিতে পাওয়া যাবে।… বিশ্লেষণ করলেই আমরা লক্ষ করব যে চিত্রিত আকারগুলি সকল সময়েই কোনও-না-কোনও ভাবে মাটির ফলকে ফ্রেমের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ শূন্য অংশগুলি তরল নয় বরং আল-দেওয়া জমির মতো নির্দিষ্ট ও স্থির (টেরাকোটা কাজের বৈশিষ্ট্য)।

আলো-ছায়ায় রামচন্দ্র মন্দির, গুপ্তিপাড়া
কোনাচের ফলক, গণপুর
বলরাম, গণপুর
বনকাটি গ্রামের পিতলের রথের কাজ

বীরভূমের মন্দির বললেই মনে আসে আর এক শিল্পচিন্তার মানুষ শ্রী মুকুল দে-র কথা। তাঁর বীরভূম টেরাকোটা বইটি শুধু মন্দির নির্দেশনার দিশারী নয়। সেটি বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক চিত্ররূপময় আলেখ্য। শিল্পীর চোখ ছাড়া সাদাকালো ছবির ঐ মহিমা সম্ভবই নয়। সেই সময়কালে জাপানি সহষোগীদের নিয়ে ওই ধরনের ছবি নেওয়া শুধু কারিগরী নয়, এক শিল্পমননেরও প্রকাশ।

সেইসব মূর্তি এখন আর নেই। সুরুল ও কেন্দুলির মন্দিরে এখন গেলে প্রাপ্তি শুধু যা হারিয়েছি তার জন্য আফশোষ। হিতেশরঞ্জন খুব সুন্দর লিখেছেন,

বহিরঙ্গের একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে। এই অস্তিত্বের পরিচয় পরিমাণজ্ঞানে, সামঞ্জস্য বিধানে, রেখা রচনায় এবং পৃষ্ঠপটস্থ মূর্তি (bas-relief) হলে যথোপযুক্ত গভীরতা ও উচ্চতা বিন্যাসে।

এইভাবে দেখাটাকে আমরা কি এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি? বা একালের শিল্প-আলোচকেরাও কি তাই করেছেন? তাঁদের দেখা কেমন করে বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন করাতে পারে তার কিছু উদাহরণ আমি রেখেছি। এইভাবে দেখাটা এখন আমরা আবার শুরু করতে পারলে ভালো। তাতে মনে হয় সংরক্ষণেরও সুবিধা হবে। এত অজস্র টেরাকোটা মন্দির দুই বাংলার আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে এবং তাদের মধ্যে এত মন্দির ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে যে সব কটির সঠিক তথ্যসঙ্কলন বা ফটোডকুমেন্ট করা সম্ভব হয়নি। সবকটিই হয়তো শিল্পবিচারে উত্তীর্ণ হবে না। কিন্তু বিশেষ শিল্পগুণসম্পন্ন মন্দিরগুলিকে চিহ্নিত না করার ফলে কী শিল্পসম্পদ যে আমরা হারিয়ে ফেলছি দিনে দিনে তার হদিশ থাকছে না। হুগলির কোটালপুরের রাজরাজেশ্বর মন্দির, হরিপালের কয়েকটি, আঁটপুরের সংরক্ষিত রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পূর্বদিকে একটি শিবমন্দির, এমনকি বিখ্যাত সুরুলের মন্দির ছাড়াও কত যে হারিয়ে যাচ্ছে!

ষড়ভুজ চৈতন্যদেব, হদলনারায়ণপুর
টেরাকোটার নকল দরজা, রাধাবিনোদ মন্দির, বিষ্ণুপুর
টেরাকোটার নকল দরজা, হাটতলা গৌরাঙ্গ মন্দির, ইলামবাজার
মাদারির খেলা, আঁটপুর

একটি আয়তাকার বা বর্গাকার চতুষ্কোণ, একটি ত্রিকোণ বা একটি আনুভূমিক ফলকের সীমিত পরিসরেও একাধিক দেহাবয়ব নিয়ে একটি সুপরিচিত পৌরাণিক ঘটনা  বা নাটকীয় কোনও মুহূর্ত কীভাবে জীবন্ত করে তোলা যায় তার প্রকাশ স্থানভেদে বিভিন্ন। কোনও জায়গায় সেটি বিস্ময়কর তো অন্য জায়গায় প্রাণহীন। কোথাও সামান্য শারীরিক বাঁকে খুব ছোট অবয়বেও যে অভিব্যক্তি এসেছে তা শ্রেষ্ঠ শিল্পের অভিজ্ঞান। বিষ্ণুপুরে তাই। বা-রিলিফ কখনও হাই, কখনও লো। শতাব্দীর সঙ্গে সঙ্গে রিলিফ আরও হাই হচ্ছে। বেশিরভাগই পুতুলের আকৃতি পাচ্ছে। আবার হাই রিলিফে পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্যের ইশারাও মিলছে গুটিকয় ক্ষেত্রে। পোশাকের বিন্যাসে কোথাও সমকালীন দরবারী আভিজাত্য, কোথাও বা সাধারণী স্নিগ্ধতা। শাড়িতে গহনায় প্রায় তাঁতি বা স্বর্ণকারের সূক্ষ্মতা নিয়েও অবয়ব কখনও কখনও মডেলিং থেকে উত্তীর্ণ হতে পারছে না। কোথাও একটুকরো প্রসারিত আঁচলেই সীমার বাধাকে মুছে ফেলার চিহ্ন। মুখের প্রোফাইল সাধারণভাবে পাশ ফেরা ও ভাবলেশহীন হলেও কোথাও তা আশ্চর্যভাবে সজীব। অর্থাৎ মুড়িমুড়কি সমান নয়। বাছাবাছির দরকার আছে।

টেরাকোটা ফলকের সূত্রধরদের প্রাথমিক সমস্যাই ছিল স্থানের বিভাজন। নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী বিভিন্ন চিত্ররূপে আনুভূমিক, উল্লম্ব, কৌণিক স্পেসটুকু ভরিয়ে দিয়েও দৃষ্টির নন্দনের জন্য প্রয়োজনীয় ফাঁকটুকুও রেখে দিতে হয়েছে তাঁকে, যাতে ডিটেলের আতিশয্যে (তা যতই নিপুণ হোক না কেন) সমগ্র ছবি যেন হারিয়ে না যায়। এই প্রসঙ্গে সোনামুখীর শ্রীধর মন্দিরের কথা ভাবা যায়।

তারপরেই আসে ঐ নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যেই একাধিক দেহাবয়বের সংস্থান চিন্তা। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনার স্বাধীনতা তিনি দাবী করতে পারেন না কারণ একটি সুপরিচিত পৌরাণিক আখ্যানের রূপায়ণই তাঁর লক্ষ্য। সেখানে অনেক সময়েই চরিত্র একাধিক, তাঁদের রূপও বিধিবদ্ধ। ঘটনাটিকেও তাঁকে ধরতে হচ্ছে একটি বিশেষ নাটকীয় মুহূর্তে।

হদলনারায়ণপুরের মেজ তরফের মন্দিরে খিলানের মাথায় ষড়ভুজ চৈতন্যের রূপ ভাবুন। সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রটি ছাড়াও আছেন করজোড়ে দণ্ডায়মান রাজা ও উপস্থিত নৃত্যরত সহচরেরা। আশ্চর্য এই যে শিল্পী কারিগর কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রীচৈতন্যকে মধ্যে রাখলেন না। তাঁকে বাঁদিকের প্রান্তে রাখলেন। তাতে পুরো প্যানেলটি মঞ্চের দৃশ্যের জঙ্গমতা পায়। মনে হয় এক অলৌকিক পর্দা উঠে গেল, আর এক ঐশ্বরিক দৃশ্য চোখের সামনে স্থির হয়ে গেল। পৃথিবীর মানুষ ঐ দৃশ্য দেখবে আর চোখের জলে ভাসবে। পিছনের বেসে শ্রীচৈতন্যের ডানদিকের তিনটি বাহুর বাঁককে ঘিরে কৌণিক নকশা আর গোটা প্যানেল ঘিরে আয়তাকার চতুষ্কোণ বর্ডার এক মঞ্চবিভ্রম তৈরি করে দেয় অব্যর্থভাবে। এত বড়, এত লাবণ্যময় প্যানেলটিতে আড়াআড়ি বেশ কয়েকটি জীর্ণতার ফাটলও সৌন্দর্যের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। দেহগুলির সংস্থান, শারীরিক বিভঙ্গ, মুখের ঐশী ভাব— সব মিলিয়ে অগণিত ষড়ভুজ চৈতন্য রূপায়ণের মধ্যে এটি শুধু শ্রেষ্ঠতমই নয়, টেরাকোটা শিল্পেরও এটি শ্রেষ্ঠ এক অভিজ্ঞান।

এবার দেখুন আরও সমস্যা। খিলানের ওপরে অনেকটা আয়তাকার জায়গা পাওয়া গেল। দরজার দুপাশেও না হয় উল্লম্ব কুলুঙ্গি সার সার বসিয়ে কৃষ্ণলীলা, দশাবতার বা দশমহাবিদ্যা দেখানো গেল। কিন্তু কোণের তিনকোণ ফলকে বা আনুভূমিক বেস প্যানেলে? আশ্চর্য এই সেখানেও আমরা পাচ্ছি অপরূপ সীতাহরণ, চলন্ত শকটে নারী, প্রায় অজন্তার মতো সার দিয়ে চলা হাঁস, বৃন্দাবনবিলাসী গাভী। কত অল্প জায়গায়, এমনকি সরল দৃষ্টিতে যা সামনে আসবে না সেখানেও। এটি গণপুরে। স্তম্ভের গায়ে বা বেস প্যানেলেও আমরা পাচ্ছি সপরিবার দেবী দুর্গা (কালনা, গুপ্তিপাড়া)।

আবার অনেক সময় কৃষ্ণজন্ম, সঙ্কীর্তন দৃশ্য বা শ্রীকৃষ্ণের মথুরাত্যাগ করার সময় গোপিনীদের পথরোধ এরকম ঘটনাক্রম কালানুক্রমিকভাবে পরপর ফলকে সাজানোর প্রয়োজন হয়েছে। সেই ফলকবিন্যাসে কিন্তু সবসময়ে এত বড় সংলগ্ন স্পেস পাওয়া যাচ্ছে না। আবার গণপুর মনে পড়ছে। সেখানে কৃষ্ণের কারাগারে জন্ম, ঘুমন্ত প্রহরীদের টপকে যাওয়া, শিশুকে নিয়ে বসুদেবের নিষ্ক্রমণ, সর্পছত্রের নিরাপত্তায় ষমুনাপাড়ি, শৃগালের অনুসরণ, শিশুবিনিময় পরপর দেখানো হয়েছে সারি ভেঙেই। কিন্তু ঘটনা এতই নাটকীয় যে চোখ আপনাআপনি সরে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অষ্টম/নবম শতকের সুপ্রসিদ্ধ বৌদ্ধবিহারগুলির নীচের তলায় শেলফের মতো সোজাসুজি বড় বড় টেরাকোটা ফলক সাজিয়ে দেওয়ার চেয়ে এটা বেশি মুন্সিয়ানার দাবি রাখে। যাঁরা হালে মোগলমারি দেখতে গেছেন তাঁরা এটা বুঝতে পারবেন।

টেরাকোটার শিল্পীকারিগর কাঠ ও পটের কাজেও দক্ষ ছিলেন এ তথ্য নতুন নয়। অনেকে মনে করেন তাঁরা কাঠের খোদাই জানতেন বলেই মাটিতে খোদাইয়েও দক্ষ ছিলেন। আবার পটে আঁকা থেকে তাঁরা পেয়েছিলেন পৌরাণিক কাহিনির পরিচিত চিত্ররূপ। কিন্তু মনে রাখা দরকার মাধ্যমের তফাত দাবি করে কারিগরির তফাত। কাঠ খোদাই বা পটের রংতুলিতে যে সূক্ষ্মতা আনা যায় সেটা উপযুক্ত রিলিফে মাটিতে আনা অনেক বেশি সতর্কতা দাবী করে। বিষ্ণুপুরের রাধাবিনোদ মন্দিরের ও ইলামবাজার হাটতলার মন্দিরের অসামান্য টেরাকোটা নকল দরজার তুল্য প্রতিরূপ (এরাবেস্ক, জ্যামিতিক, ফ্লোরাল) কাঠে কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। যে পৌরাণিক কাহিনিগুলি মন্দির টেরাকোটায় বারবার মোটিফ হিসাবে এসেছে (রাসমণ্ডল, নবনারীকুঞ্জর, বস্ত্রহরণ, রাম রাবণের যুদ্ধ, গজেন্দ্রমোক্ষ, কয়েকটি কৃষ্ণলীলার উপাখ্যান ইত্যাদি) অথবা লোকজীবনের কিছু পরিচিত দৃশ্যের (মাদারির খেলা, নাম সঙ্কীর্তন, হংসলতা, হরিণ শিকার, যুথবদ্ধ গাভী ও হরিণ, গীত বাদ্য ও নৃত্যে বিভোর নরনারী ইত্যাদি) রূপায়ণ যেখানে হয়েছে সেগুলির প্রতিটিতেই একটি ফলকেই একাধিক দেহ সংস্থানের সমস্যা, ঘটনার ঘনঘটার স্থির রূপ দেওয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক এক জায়গায় সে সমস্যর সমাধান করেছেন তাঁরা এক একরকমভাবে। ওই এক একটি মোটিফের স্থানভেদে মন্দিরভেদে রূপায়ণের বিভিন্নতার শিল্পগত আঙ্গিক নিয়ে আলোচনা করলেই একটি দীর্ঘ পর্যায় হয়ে যেতে পারে। একাধিক টেরাকোটা মন্দিরের ফলক সংস্থানের নিবিড় পর্যবেক্ষণ যাঁরা করেছেন তাঁদের কাছে এই তুলনামূলক শিল্পবিচার নিশ্চয় কঠিন হবে না।


*লেখার ভেতরের সমস্ত ছবি লেখকের তোলা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...