প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
জায়গাটার ভূগোল খুবই গোলমেলে!
কলকাতার কাছেই। তবে কলকাতা শহরে নয়। শহরতলি বলে সেকালে কিছুই ছিল না। শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত একটা পাণ্ডববর্জিত জায়গা বলা যেতে পারে।
একটা বিশালাকার মাঠ। রাতের বেলায় মাঠের এই শূন্যতা খুবই স্বাভাবিক লাগে। বরং সকালেই মাঠের এই ব্যাপকতা ভুতুড়ে। যেন একটা দানো ঘিরে রয়েছে মাঠটাকে। মাঝবেলায় মাঠের ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় সব রোদ মুছে গেল লহমায়। কোনও দানো যেন আড়াল করে দিল মাঠটা। যেন সবদিকের রাস্তা বন্ধ। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। যেন প্রকাণ্ড দেহ দিয়ে মাঠটাকে ঢেকে ফেলে একটা দানো চোখে চোখ রাখছে। সেই চোখও দেখা যায় না। অথচ অদ্ভুত অস্বস্তি।
আর ঠিক তখনই চোখে পড়বে অট্টালিকাটা!
এমনিতে মাঠটার যে কোনও প্রান্তে দাঁড়ালে এই অট্টালিকা চোখে পড়ে না আশ্চর্যভাবে। কিন্তু মাঠের মাঝখানে গেলেই দেখা যায় অট্টালিকাটা। এই বিশাল মাঠের ঠিক কোনখানে অট্টালিকাটা অবস্থিত, তাও বোঝা যায় না।
দুই ভাই কানাই ও জগাই, ও বৃদ্ধা সরযূ এখন এই প্রেতপুরীর দেখভাল করে।
তবে এ প্রেতপুরী প্রেতপুরী ছিল না।
এই পরিত্যক্ত অট্টালিকা ছিল চৌধুরীদের।
সে অনেককাল আগের কথা।
অনাদি চৌধুরী আর পাঁচজন জমিদারের মতো লম্পট, বদ ছিল না। বরং হিসেবি, সংযত। কিঞ্চিৎ প্রজাদরদীও বটে। আসলে অনাদি চৌধুরীর আজীবনের লক্ষ্য ছিল একটিই, রায়বাহাদুর হওয়া।
তো যে সময় কলকাতায় চূড়ান্ত মোচ্ছব হত না দুর্গাপুজোয়, হুতোমের বর্ণনায় যেমনটা দেখা যায় আর কী— মা বিসর্জন গেলেন বলে গণেশকে কাছা পড়িয়ে আবার কোটি টাকার পুজো— এই বারোইয়ারি ছ্যাঁচড়ামো যখনও পর্যন্ত চালু হয়নি— তখন থেকে চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো শুরু। এমন একটি পাণ্ডববর্জিত এলাকার আশপাশে তখন ছিল ভরা লোকবসতি। প্রজাদের প্রবেশ ছিল সে পুজোতে অবাধ। তখনও কলকাতায় এমন রংচঙে নগরজীবনের গোড়াপত্তনই হয়নি তেমন করে। ভারতচন্দ্র লিখছেন অন্নদামঙ্গল। কৃষ্ণচন্দ্র আসর জমাচ্চেন। আর কলকাতার দেবরা হেস্টিংসকে খুশি করার জন্য পুজোর উদযুগ করছে। কিন্তু অনাদি চৌধুরীর পূর্বপুরুষ ছিলেন ধর্মপ্রাণ। কোম্পানির সঙ্গে কখনওই তাঁর দহরম মহরম ছিল না।
তার প্রায় একশো বছর পর অনাদি চৌধুরী এই বংশে প্রথম বিলেত গেল।
মাঝে সিপাহী বিদ্রোহ হল। অস্তে গেলা কোম্পানি। ভিক্টোরিয়ার শাসন শুরু হল।
অনাদি ফিরে এল যখন, তখন ধর্মকর্মে তার আর মতি নেই।
মাঝে দশ নম্বরী আইন হয়ে ব্রিটিশদের দুর্গাপুজোয় টাকা ঢালার নিয়ম খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়াও ভিক্টোরিয়ার আমলে আর হেস্টিংসের আমলের মতো দস্তুর ছিল না। শুধু পুজোপার্বণ করে ব্রিটিশ সরকারকে খুশি করা যাবে— এমন অবস্থা ছিল না। কিন্তু অনাদিকে রায়বাহাদুর খেতাব পেতেই হবে।
তাই অনাদি চৌধুরী অন্য নানা তোষামোদ শুরু করল। প্রথমেই, বিলেতে থাকতেই, সে রানির গুণগান করে ‘লন্ডন টাইমস’-এ একখান বড়সড় চিঠি লিখল। একজন নেটিভ জমিদার বিলেতের পত্রিকায় ভিক্টোরিয়ার শাসনের সুখ্যাতি করছে— আর যায় কোথায়! এদেশের সাহেবরা খুশি হল বেজায়!
এরপর আরেক কাণ্ড করল অনাদি।
বিলেত থেকে ফিরে এসে সে তার জমিদারিতে প্রজাদের খুশি রাখার যাবতীয় বন্দোবস্ত করল! কিন্তু নিজের ঘাঁটিটি গাড়ল কলকাতায়। কলকাতায় তাদের প্রাসাদ ছিল পাইকপাড়ায়। সেখানে সাহেব বাবুদের নিয়ে নিয়মিত মজলিশ বসছিল।
তবে শুধু তাতেই কি আর সাহেবদের মন ভেজানো যায়?
এবার মোক্ষম চালটা চালল অনাদি চৌধুরী।
এক সাহেব আঁকিয়েকে ভাড়া করে একখান ছবি আঁকাল সে। পোর্ট্রেট বটে, তবে দেখে দেখে সে পোর্ট্রেট আঁকা নয়। তাতে অনাদির কল্পনাশক্তিই মূল।
সেই পোর্ট্রেটে সিংহাসনে বসে আছেন রানি ভিক্টোরিয়া। এবং তাঁর পায়ে মাথা নত করে চুমু খাচ্ছেন অনাদি চৌধুরী।
কলকাতার বাড়ির এক মজলিসে সেই ছবির পর্দা উন্মোচন হল।
সাহেবরা যারপরনাই বিস্মিত ও বিব্রত হল এই ছবি দেখে। খানিক রসও পেল অনাদির রায়বাহাদুর হওয়ার এই অদম্য প্রচেষ্টা দেখে।
অনাদি এখানেই থেমে থাকল না। সে ওঝার পাট তুলে দিয়ে এক ব্রিটিশ ডাক্তার নিয়ে এল গ্রামে। প্রথমেই জাত যাওয়ার ভয়ে একদল প্রজা পালাল গ্রাম থেকে। বুদ্ধিমান অনাদি কখনওই জুলুমে বিশ্বাস করত না। অবশ্য তা বলে সে ফিরিঙ্গি ডাক্তারকে অর্ধচন্দ্রও দেখাল না। সেই ইংরেজ চিকিৎসকের জন্য সে একখানা ডাক্তারখানা বানিয়ে দিল কলকাতায়। সেই ডাক্তারের নাম ছিল থম্পসন সাহেব। থম্পসনের এক প্রিয় ছাত্র ছিলেন বিলেতফেরত ডাক্তার প্রসাদরঞ্জন মিত্র। তিনি থম্পসনকে সেই ডাক্তারখানায় সাহায্য করতেন।
প্রসাদরঞ্জনের ভাই প্রমথরঞ্জন ছিল মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তার নাম গিয়েছিল কাটা।
এই প্রমথরঞ্জন একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে চলেছে এই গল্পে।
সে তার দাদার সাহায্য নিয়ে পৌঁছল থম্পসনের কাছে। থম্পসন তার ডাক্তারি পারদর্শিতায় খুশি হয়ে তাকে থম্পসনের ডাক্তারখানায়, তার দাদার সঙ্গে কাজ করার আদেশ দিলেন।
রাজি হয়ে গেল প্রমথরঞ্জন। শুধু এই ফাঁকে সে থম্পসনকে দিয়ে একটি শংসাপত্র লিখিয়ে নিল।
কিছুদিনের মধ্যে থম্পসন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন তিনি। প্রসাদ ছিল তার মূল সহকারী। তাদের দুজনকে একযোগে ধন্বন্তরি বলত রোগীরা। ওই ডাক্তারখানা ছিল মূলত দাতব্য চিকিৎসালয়। বড়লোকদের চিকিৎসা খুব বেশি করতেন না থম্পসন। অনাদির পৃষ্ঠপোষকতায় ডাক্তারখানা চলত। থম্পসনের নিজস্ব সঞ্চয়ও তাছাড়া মন্দ ছিল না। তাই এই দুর্ভাগা দেশের গরিব রোগীরা যাতে চিকিৎসা পায়— এমন একটি মহৎ ভাবনা ছিল তাঁর। তবে হ্যাঁ, অনাদি চৌধুরীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন থম্পসন, থম্পসনের অনুপস্থিতিতে প্রসাদরঞ্জন কখনওসখনও অনাদির চিকিৎসা করেছেন বটে, তবে বাঙালি ডাক্তারকে যে অনাদি বিশেষ ভরসা করত, তা নয়। তাই থম্পসনকেই বেশিরভাগ সময় তার চিকিৎসা করতে হত। কিন্তু থম্পসন অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে পাট চুকল। অনাদি তখন নিজের জন্য অন্য সাহেব চিকিৎসকের সন্ধানে রত হল। কিন্তু এই ডাক্তারখানার পেছনে টাকা ঢালা বন্ধ করল না অনাদি। থম্পসনকে সে সমীহ করত।
থম্পসন অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডাক্তারখানার দায়িত্ব মূলত উঠে এল প্রসাদরঞ্জনের কাঁধে। চিকিৎসা তিনি-ই করতেন। সঙ্গে থাকত তাঁর ভাই।
কিন্তু থম্পসনকে একটু বেশিই সময় দিতেন প্রসাদ। থম্পসন ছিলেন একভাবে তাঁর পেশাদার জীবনের শিক্ষক। এইভাবে তাঁর ভেঙে পড়া কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না প্রসাদ।
ফলত ডাক্তারখানার দায়িত্ব তিনি কিঞ্চিৎ ছাড়তে লাগলেন ভাই প্রমথরঞ্জনের উপর।
ডাক্তারখানা ছিল অনাদির একটি ছোট বাড়িতে। সেই বাড়িতেই ছিলেন থম্পসন। থম্পসনকে দেখতে আসতেন তাঁর বহু সাহেব চিকিৎসক বন্ধুরা। তাঁদের সঙ্গে আলাপ করত প্রমথরঞ্জন। প্রমথরঞ্জনের ডাক্তারি জ্ঞান ছিল নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। সেই জ্ঞানে অনেকেই অভিভূত হয়ে পড়তেন।
দু-একজন অবিশ্যি একটা বিষয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহ পোষণ করত।
যে বিলিতি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হত প্রমথর, তাকে দিয়েই প্রমথ লিখিয়ে নিত একটি করে শংসাপত্র।
সকলেই কমবেশি দরাজ মনে লিখে দিয়েছেন সেই শংসাপত্র। প্রথমত, প্রসাদরঞ্জন যথেষ্ট প্রসিদ্ধ এবং সজ্জন ডাক্তার। সর্বোপরি, সে থম্পসনের স্নেহভাজন। এবং থম্পসন এখন মূলত তাঁর চিকিৎসাতেই রয়েছেন। দ্বিতীয়ত, প্রমথরঞ্জন নিঃসন্দেহে পারদর্শী। এবং থম্পসন তাকেও যথেষ্ট স্নেহ করেন, ভরসা করেন।
যে দু-একজন সন্দেহ করেছিল, তারা পরে ভেবে দেখল, সত্যিই তো, নামকাটা ডাক্তার, তাকে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়, তাহলে তো এই শংসাপত্রই ভরসা।
এর মাঝে দুটো ঘটনা ঘটল।
এক, অনাদি চৌধুরী রায়বাহাদুর হল।
দুই, থম্পসনের শরীরের বেশ ভালরকম অবনতি হল। অনাদির সঙ্গে শলা করে প্রসাদ ঠিক করলেন, থম্পসনকে হাওয়াবদলে নিয়ে যাওয়া উচিত।
থম্পসনকে নিয়ে প্রসাদ রওনা দিলেন সিমলায়। যাওয়ার আগে ডাক্তারখানার দায়িত্ব পুরোপুরি তুলে দিয়ে গেলেন প্রমথরঞ্জনের হাতে।
আর এই দুই ঘটনার পরপরই আরও দুটো ঘটনা ঘটল।
প্রথমত, দুর্গাপুজো করবেন না— এরম একটা হুঙ্কার অনাদি ছেড়েছিলেন। পুজোয় তার প্রবল অনীহা ছিল। প্রজারা এই সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি ছিল না। কিন্তু রায়বাহাদুর খেতাব পেয়েই দিলখুশ অনাদি ঘটা করে পুজো করবেন বলে জানিয়ে দিলেন। প্রজারা বেজায় খুশি হল।
দ্বিতীয়ত, থম্পসনের নিয়মিত রোগী ছিলেন এক ছোটলাট। তিনি হঠাৎ বেজায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় থম্পসনের খোঁজ পড়ল। কিন্তু থম্পসন সিমলায়, প্রসাদও তাই। এই অবস্থায় প্রমথরঞ্জনই সহায় হল। তার এত শংসাপত্র দেখে ছোটলাটের মুৎসুদ্দিরা আপত্তি করল না।
এমন একটা সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল প্রমথরঞ্জন।
ছোটলাট কোনও একটি বাগানে বিহার করছিলেন তাঁর স্থূলকায় চেহারা নিয়ে। এমন সময় একঝাঁক ভীমরুল তাঁকে আক্রমণ করে বসে।
তো, সেই মরণাপন্ন ছোটলাটকে উদ্ধার করল প্রমথরঞ্জন। সে সারিয়ে তুলল তাঁকে।
প্রমথরঞ্জনের সুখ্যাতি চারপাশে ছড়াতে লাগল।
কিন্তু ডিগ্রি ছাড়া এ-বাজারে করে খাওয়া মুশকিল।
নিজের সুখ্যাতি ভাঙিয়ে বিভিন্ন শাঁসালো রোগীকে পাকড়াও করত প্রমথরঞ্জন। তার মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের আমলাও ছিলেন কেউ কেউ।
তাঁদেরই কেউ একজন একটা জাল ডিগ্রির ব্যবস্থা করে দিলেন প্রমথরঞ্জনকে।
ছোটলাটকে সারিয়ে তোলার আগে অনেক দরিদ্র সাধারণ রোগীকেই সারিয়ে তুলেছে প্রমথ। কিন্তু তাকে কেউই কখনও ডাক্তার বলে ডাকেনি। থম্পসনকে রোগীরা ডাকত ‘ডাক্তারসায়েব’ বলে, আর প্রসাদরঞ্জনকে ‘ডাক্তারবাবু’ বলে। যখনই প্রমথ চাউর করলে, সে ডিগ্রি পেয়েছে, তখনই তার নাম হয়ে উঠল ‘ডাক্তার বাবু’।
কিন্তু থম্পসন এবং প্রসাদরঞ্জন যেমন পড়ে থেকে থেকে গরিব রোগীর সেবা করতেন, তেমনটা মোটেও করল না প্রমথরঞ্জন। সে ঘুরে ঘুরে বেড়াত বাবু আর সাহেবদের বাড়িতে। কাঁচা টাকার পাহাড় জমতে লাগল। আর মাঝেমধ্যে একটুআধটু সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা করে দিত।
আশ্চর্যের বিষয়, ভুল চিকিৎসা প্রমথরঞ্জন কখনও করেছে— একথা বলার কোনও অবকাশ নেই।
কিন্তু এর আগেই বলা হয়েছে, এককালে কারও কারও কাছে প্রমথর মতিগতি ভালো ঠেকেনি। তাঁরা এ-ও জানতেন যে, প্রমথরঞ্জন নামকাটা ডাক্তার। হঠাৎ তিনি ডিগ্রি পেলেন কোথায়?
তাঁরা ফিসফিসিয়ে ছড়াতে লাগলেন সেই সন্দেহের কথা।
কিন্তু ততদিনে প্রমথরঞ্জন বহু বাবু ও সাহেবের প্রিয়পাত্র। ফলে সেই রটনা তাকে ঠেকাতে পারল না।
ইতিমধ্যে একখান বেফাঁস কাজ করে বসল প্রমথ।
পিলেরুগী ছিলেন হাটখোলার জমিদার নবীন ঘোষ। তাঁর চিকিৎসা করতে গিয়ে একটু বেশি সাহস দেখাল প্রমথ। খানিক এক্সপেরিমেন্ট করে বসল সে।
সন্ধানী মন তার ছিলই। সে ঠিক করেছিল ধনুষ্টঙ্কারের ওষুধ আবিষ্কার করবে। নিজেকে নিয়ে তার ছিল অসীম প্রত্যাশা। তাই বাবু আর সাহেবদের চিকিৎসা করে ফুলেফেঁপে ওঠার পরেই সে নিজের ল্যাবরেটরি খুলে বসেছিল অনাদির কলকাতার ওই বাড়িতে। সেখানেই ওই ওষুধ আবিষ্কারের প্রকল্প নিয়েছিল সে।
আর তার সেই পরীক্ষানিরীক্ষার প্রথম স্বীকার হলেন নবীন ঘোষ।
পিলেরুগী নবীন ঘোষকে গিনিপিগ করে নিজের নিরীক্ষা চালাতে গেল প্রমথরঞ্জন। আর নবীন পড়লেন প্রাণঘাতী কালাজ্বরে। দুদিন যমে-মানুষে টানাটানির পর চোখ বুজলেন নবীন।
পরের দিন ডাক্তারখানায় হাজির হল নবীনের ছোট ছেলে গিরীন। নেশায় তার চোখ টকটক করছে লাল।
প্রমথর কোটের কলার চেপে গিরীন বললেন, ‘বল হারামজাদা, কী করেছিস আমার বাবাকে?’
গিরীনের পেছনে দাঁড়িয়ে দুই লেঠেল। তাদের রক্তচক্ষু টগবগ করছে।
বাইরে লোক জড়ো হয়ে গেল লহমায়।
পাইকপাড়ার এক জমিদার ছিলেন কাছেপিঠে। তিনি এসে পড়ায় প্রমথকে কোনও মতে বাঁচানো গেল সে যাত্রায়।
কিন্তু গিরীন যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘তোর লাশ যদি আমাদের বাগানে পুঁতে না রাখি, তাহলে আমার নাম গিরীন ঘোষ নয়।’
ঠকঠক করে কাঁপছিল প্রমথরঞ্জন।
কিন্তু তার বিপদের সবে শুরু হল।
যেটুকু রটনা ছড়াচ্ছিল বাতাসে, তা এবার আগুনের মতো ছড়াতে লাগল শহরজুড়ে।
আর তখনই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে শুরু করল।
যাঁরা রটাচ্ছিলেন প্রমথর ডিগ্রি জাল, তাঁরা এক এক করে কালাজ্বরে পড়তে লাগলেন। এবং সেই জ্বর হয়ে উঠল কালান্তক। তাঁদের ইন্তেকাল হতে লাগল দমাদ্দম।
এইসব মৃত্যু যে স্বাভাবিক নয়, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন গোয়েন্দা বিভাগের একজন। পুলিশের বড়কর্তারা বিষয়টি সরেজমিনে দেখতে বললেন দাপুটে গোয়েন্দা-দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়কে।
প্রিয়নাথ খতিয়ে দেখতে গিয়ে খোঁজ পেলেন প্রমথরঞ্জনের।
প্রমথ বুঝল, তার আর উপায় নেই। নবীন ঘোষের মৃত্যুতে সে বুঝেছিল, তার ওষুধ সাক্ষাৎ বিষ, যে বিষপ্রয়োগে মারলে মনে হয় কালাজ্বরে মৃত্যু।
এই উপায়েই সে তার পথের কাঁটাদের সরাতে চেয়েছিল। ঠারেঠোরে তাঁদের সঙ্গে দেখা করে সেই বিষপ্রয়োগ করতে শুরু করেছিল সে। কিন্তু প্রিয়নাথ তার নাগাল পেয়ে যাওয়ায় সে বুঝল, সবটাই তার হাতের বাইরে চলে গেছে।
সমস্ত টাকাপয়সা নিয়ে সে পালাল কলকাতার বাড়িতে তালাচাবি লাগিয়ে।
তার আগে সেই বাড়িতে, যেখানে থম্পসন এককালে নিজের ডাক্তারখানা আর ল্যাবরেটরি খুলেছিলেন, সেই বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে মাটির সঙ্গে তাকে মিশিয়ে দিয়ে গেল প্রমথ।
শিগগিরই সেই বাড়িতে তল্লাশি চালাল পুলিশ। কিন্তু সেখান থেকে কোনও প্রমাণ পাওয়া দুষ্কর। তবে প্রমথরঞ্জনকে ফেরার ঘোষণা করা হল।
এসব খবর অনাদির কাছে পৌঁছলেও অনাদির হুঁশ ছিল না এসবে। সে তখন ঘটা করে দুর্গাপুজো করা নিয়ে ব্যস্ত। আর সেই ঘটার নমুনা দেখে চোখ কপালে উঠল প্রজাদের। ধর্মপ্রাণ চৌধুরীবাড়িতে যা কখনও হয়নি, তাই হল। অনাদির নিমন্ত্রণে সাহেব মেমরা এসে ভিড় করল। শেরি শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ছুটল। সাহেবদের নাচাগানার বন্দোবস্তও করে দিলেন অনাদি। মা দুর্গার সামনে এসব অনাচার দেখে মাথায় হাত পড়ল প্রজাদের।
এর মধ্যেই সিমলায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন থম্পসন।
বিমর্ষ প্রসাদরঞ্জন হতোদ্যম হয়ে ফিরলেন সিমলা থেকে।
ফিরে এসে দেখলেন থম্পসনের সাধের ডাক্তারখানা ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে।
স্থানীয়দের থেকে এবং পুলিশের থেকে সব কথা শুনে রাগে বিস্ময়ে বিমূঢ়, স্তব্ধবাক হয়ে গেলেন প্রসাদরঞ্জন।
তিনি শোকে মুহ্যমান হয়ে ফিরলেন তাঁদের পৈতৃক বাড়িতে।
আর সেখানেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল তাঁর যম।
ফেরার প্রমথরঞ্জনের শেষ সম্বলটুকুও ফুরিয়ে আসছিল। সে জানত থম্পসন তার দাদাকে একটা মোটা টাকার জীবনবিমা করে দিয়েছে। এখন তার বাঁচার উপায় একটাই। ওই জীবনবিমার টাকা।
প্রসাদরঞ্জন সে রাত্রে নিজের পালঙ্কে শুয়ে রয়েছেন, এমন সময় তিনি অনুভব করলেন কেউ একটা তাঁর ওপর ঝুঁকে রয়েছে। লক্ষ করছে তাঁকে।
চোখ খুললেন।
কালো চাদরের আড়ালে যে মুখটা দেখা যাচ্ছে, যে চাহনি দেখছেন তিনি, তা তাঁর আজন্ম চেনা। কিন্তু সেখানে হিংস্রতার এই আগুন তিনি কখনও দেখেননি।
তিনি প্রতিরোধে এবং ক্রোধে গলা টিপে ধরলেন প্রমথর। চিৎকার করে উঠলেন, নরাধম! কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
মুখ হাঁ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রমথ কালান্তক বিষ পুরে দিল তাঁর মুখে।
কালাজ্বরে পড়ার সুযোগটুকুও পেলেন না প্রসাদরঞ্জন।
কিন্তু আবার একটা বড়সড় বেচাল চালল প্রমথ।
তার ফেরার হওয়ার খবর যে বিমা আপিসে পৌঁছয়নি, এমন একটা ধারণা করে সে পৌঁছেছিল সেখানে। প্রসাদের বিমার টাকা দাবি করতে। সঙ্গে ছিল একখান জাল ডেথ সার্টিফিকেট।
ভুল নয় ধারণাটা। তবে ডেথ সার্টিফিকেটটাই সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়াল বিমা এজেন্টের কাছে।
আর সেই বিমা এজেন্টের সন্দেহের ভিত্তিতেই প্রিয়নাথ পাকড়াও করল প্রমথরঞ্জনকে। তবে সেসব গল্পে ঢোকার বিশেষ প্রয়োজন নেই। প্রমথরঞ্জন তার জবানবন্দিতে সমস্ত কীর্তিকলাপের কথা স্বীকার করল।
তবে প্রমথরঞ্জনের গল্প এখানেই ফুরোল না।
অনাদির দুর্গাপুজো মিটল। বিসর্জনের আগেই সাহেব-মেমরা সব ফিরে গেল।
কিন্তু তার কাটল বিসর্জনের সময়।
ঠাকুরকে আর কিছুতেই নড়ানো যায় না নাটমন্দির থেকে।
প্রথমে চারজন, পরে আটজন, তারপরে আশিজন, অবশেষে দুশোজন মজুর মিলে চেষ্টা করেও একটা সাধারণ মাপের দুর্গাঠাকুরকে একচুলও নড়াতে পারল না।
এমন আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী কেউ কোনওদিন হয়নি এই জমিদারির দুগ্গাপুজোর ইতিহাসে।
চৌধুরীদের কুলপুরোহিত অখিল ঠাকুর খেপে উঠলেন যেন। হাতে একখানা জ্বলন্ত ধুনুচি নিয়ে তিনি উন্মাদের মতো আরতি করতে লাগলেন।
কেউ বলল, এক বালক, যাকে কখনওই এ তল্লাটে দেখা যায়নি, সে নাকি সন্ধেবেলা ধুনুচি হাতে আরতি করছিল ঠাকুরের সামনে। তার মুখও কেউ দেখেনি। পেছন থেকেই দেখা গিয়েছিল তাকে।
অখিল ঠাকুর একথা শুনে খানিক স্তব্ধ হল। এবং তারপর আরও পাগলের মতো আরতি করতে শুরু করল। ধোঁয়াতে ভরে গেল ঠাকুরদালান। চামর দুলতে লাগল তীব্র গতিতে। সঙ্গে শান্ত পুরোহিত অখিল ঠাকুরের হিংস্র গলায় মন্ত্রোচ্চারণ।
কিন্তু শত আরতিতেও লাভ হল না কিছু।
অবশেষে ঠাকুর গলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে ঠিক হল।
কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। বালতি বালতি জলেও সে ঠাকুর ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
অবশেষে ঢাকা দিয়ে দেওয়া হল সেই ঠাকুরকে। ঠিক হল আর বছরের আগে সে ঢাকা আর খোলা হবে না।
প্রজারা বলল পুজোর সময় তুমুল মোচ্ছব ও অনাচারের কারণেই এমন অনাসৃষ্টি ঘটছে।
নাস্তিক অনাদি চৌধুরী যেন খানিক টলে গেলেন এই ঘটনায়।
তবে টলে যাওয়ার আরও খানিক বাকি ছিল।
অখিল ঠাকুর সস্ত্রীক পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন তাদের কুঁড়েঘরসুদ্ধ। এর কিছুকাল বাদেই।
কিছুকাল পরে অনাদি চৌধুরীর বাড়ির পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে উঠে এল এক চামুণ্ডা কালীমূর্তি। যেখানে কস্মিনকালেও ওবাড়িতে কালীপুজো হয়নি।
শেষ ধাক্কাটা নির্মম। অনাদি চৌধুরীর চোদ্দ বছরের মেয়ে ঝাঁপ দিল ছাদ থেকে। হঠাৎই।
নাস্তিক রায়বাহাদুর অনাদির সব প্রতিরোধ ভেঙে গেল। এই বাড়ি ফেলে সে যে পরিবার নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে কোথায় গেল কেউ জানে না।
তারপর এবাড়ির আশপাশ থেকে জনবসতিও সরে গেল।
কিছুকাল পরে এক জজসাহেব এই বাড়িখানা কিনলেন। এই বাড়িকে তিনি বানালেন অতিথিশালা।
তাঁর তিন খাস ঝি-চাকর এবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল। সরযূ, কানাই ও জগাই। সঙ্গে তাঁর খাস খানসামা হরগোপাল।
জজসাহেব ছিলেন মহেশ সেনের বন্ধু। ঘটনাচক্রে সনাতন হাজরাও চিনতেন জজসাহেবকে।
সন্ধে তখন অল্প নামছে। লতাকে নিয়ে কলকাতা যাওয়ার পথে এখানেই বিশ্রাম করার জন্য দাঁড়াল মহেশ সেনের ঘোড়ার গাড়ি।
এই ভূতুড়ে বাড়িতে, এই প্রেতপুরীতেই আজ রাতটা বিশ্রাম নেবে তারা।
(আবার আগামী সংখ্যায়)
*প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের দলিল এবং সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত The Wicked City বইতে এই ‘ডাক্তারবাবু’ এবং এই সিরিয়াল কিলিংয়ের ঘটনার উল্লেখ আছে। মূল ঘটনার কিয়দংশ এক রেখে এবং ‘ডাক্তারবাবু’ চরিত্রটিকে রেখে কাহিনির প্রয়োজনে বাকিটা বানানো হয়েছে। ডাক্তারবাবু-র কোনও নামোল্লেখ সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বা প্রিয়নাথ করেননি। তার দাদা ডাক্তার ছিলেন, এমনটাও নয়। থম্পসন সাহেব বা অনাদি চৌধুরী সম্পূর্ণভাবেই গল্পের চরিত্র।
সমস্ত পর্বের জন্য ক্লিক করুন: তারান্তিনো — প্রিয়ক মিত্র