অরিন্দম
লেখক পেশায় শিক্ষক, সমাজ রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী
Scientists are often accused of living in the “Ivory Tower” and not troubling their mind with realities and apart from my association with political movements in my juvenile years, I had lived in ivory tower up to 1930. But science and technology are as important for administration now-a-days as law and order. I have gradually glided into politics because I wanted to be of some use to the country in my own humble way.
—Meghnad Saha
মেঘনাদ সাহা। কি নামটা চেনা চেনা ঠেকছে? ঠিক ধরেছেন। হ্যাঁ উনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। কিসের বিজ্ঞানী ছিলেন বলুন তো? আটকে গেলেন তো! বলুন তো কী করতে মনে রাখবেন? লোকটা কী এমন করেছে? রাজা মহারাজাদের থেকে পয়সা নিয়ে বিদেশে গিয়ে ধর্মসভায় বক্তৃতা দিয়ে দেশের নাম বাড়িয়েছে? না। কাজের খোঁজে ভগবানের কাছে দয়াভিক্ষা করেননি, কোনও ঠাকুরের শিষ্যও ছিলেন না। কোনও ধর্মীয় মিশন প্রতিষ্ঠা করেছে? না। এমনকি সবজায়গায় খাপে খাপ মিলে যায় এমন কোনও বক্তৃতা দেননি, উদ্ধৃতিও পাওয়া যায় না। এমনকি কলকাতাতেও জন্মাননি। নামদার বাপ-মাও ছিল না। বিশ্বাস করুন আমিও নামটুকুই জানতাম। বড় একজন বিজ্ঞানী ছিলেন আর সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র ফিজিক্স— ওইটুকুই। কিন্তু বিজ্ঞান-ঐতিহাসিক আশিস লাহিড়ীর মেঘনাদ সাহা সম্পর্কে বক্তব্য শুনে আর একটু পড়াশুনো করে আমি অভিভূত ও শ্রদ্ধাবনত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র, বিজ্ঞানী সত্যেন বসুর সতীর্থ ও বন্ধু, কী অসাধারণ মানুষ ছিলেন এই সাহা। একবগগা কাঠখোট্টা বিজ্ঞানসাধক, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, ছাত্রদরদী শিক্ষক, এক নিখুঁত বিজ্ঞানপ্রসারক ও পরিকল্পক। জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের যোগ্য উত্তরসুরি হিসেবে বিজ্ঞানে ইউরোপীয় আমেরিকানদের একচেটিয়া দখলদারিত্বে ভাগ বসিয়েছেন শুধু নয়, ভেঙে দিয়েছেন। আধুনিক ভারতের এই যতটুকু বৈজ্ঞানিক উন্নতি হয়েছে তার অন্যতম মূল পরিকল্পক শুধু নন তার খুঁতটুকু নিয়েও উচ্চকিত। শুধু তাই নয় গান্ধির খাদি, চরকা ও শিল্পনীতির ঘোর বিরোধী, জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্ক, বয়সে ছোট সুভাষ বসু সম্পর্কে প্রগাঢ় ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পোষণ করতেন মেঘনাদ সাহা। বারবার তীক্ষ্ণ যুক্তিতে ও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পাণ্ডিত্যে সনাতন ভারতের ফাঁপা ধর্মীয় গর্ববোধকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছেন। কিন্তু ছোট করেননি। যুক্তি দিয়ে বিজ্ঞানের ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে বাঙালির মনে জায়গা করে নিতে গেলে যে দক্ষতা ও চতুরতা লাগে সেটা ছিল না তাঁর। আসলে লোকটার মধ্যে নায়ক হয়ে ওঠার কোনও গুণই ছিল না। আর আমরা ভুলে যেতে খুব দক্ষ অবশ্যই নির্বাচিতভাবে। তবুও জাতির এই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সঙ্কটে মেঘনাদ সাহা বিশ্ব, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে বার বার উঠে আসবে। অত্রি মুখোপাধ্যায় মেঘনাদ সাহার জীবনী লিখতে গিয়ে সঠিকভাবেই ‘অবিনাশ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। মেঘনাদের বন্ধুরা তাকে বলতেন ‘আইগেনসাফটেন’। একটা জার্মান শব্দ। ইংরাজিতে বলা যায় ‘ইনভিন্সিবল’।
আসুন সেই ‘অবিনাশ’ মানুষটাকে নিয়ে একটু আলোচনা করি। আমার এই ধৃষ্টতা আপনারা ক্ষমা করে দেবেন বলেই আমি মনে করি।
জীবনের প্রথমভাগ
ঢাকা শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে শেওড়াতলি গ্রাম। এ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ খুবই গরীব। তার উপর আবার অন্ত্যজ শ্রেণির পরিবার। অর্থাৎ নিচু জাত। যদিও মেঘনাদের বক্তব্য অনুযায়ী গ্রামে পড়াশুনোর চল ছিল কিন্তু তা কাজচালানো গোছের। এটা কিন্তু ওই সময়ের একটি দিকনির্দেশ দেয়। গ্রামের মুদি দোকানি জগন্নাথ সাহা ও ভুবনেশ্বরী দেবীর ঘরে ১৮৯৩ সালের ৬ই অক্টোবর মেঘনাদের জন্ম। ভীষণ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে জন্মেছিলেন বলে ঠাকুরমা নাম রেখেছিলেন মেঘনাথ। পরে স্কুলে যাবার সময় নাম বদলে মেঘনাদ করা হয়। আট ভাই-বোনের মধ্যে মেঘনাদ পঞ্চম। ছয় বছর বয়সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করানোর পাশাপাশি মেঘনাদকে দোকানে নিজের পাশে বসিয়ে কাজও শেখাতে শুরু করলেন বাবা জগন্নাথ সাহা। বাবার মনে হয়েছিল পড়াশুনো শিখে কী হবে। তার চেয়ে দোকানে বসলে রোজগারে সহায়তা হবে। বড় ছেলে জয়নাথকে হাইস্কুল পর্যন্ত পড়িয়েছেন। মাধ্যমিকই পাশ করতে পারল না ছেলেটা। সে এখন জুট মিলে কাজ করে মাসে বিশ টাকা পায়। পড়ে সংসারের কী লাভ? জগন্নাথ সাহা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন— মেঘনাদকে আর পড়াবেন না। কিন্তু শিক্ষকেরা রত্ন চিনতে ভুল করেননি। বলেকয়ে মেঘনাদের বাবাকে রাজি করালেন। মেঘনাদ ভর্তি হলেন ১০ কিমি দূরের সিমুলিয়া জুনিয়র হাইস্কুলে। এইখানেই ওনার মনে গণিতের বীজ বপন করেছিলেন শিক্ষক প্রসন্নকুমার চক্রবর্তী। এই বিজ্ঞানচেতনাই বোধহয় তাকে পরবর্তীকালে বিজ্ঞান পড়তে উৎসাহিত করেছিল।
এখানে বলে রাখি, আমি এই লেখাটি লিখছি তাঁর জীবনের ঘটনার দিনক্ষণ জানানোর জন্য নয়। তার জন্য বহু বই আছে। আসলে আমার ইচ্ছে ইতিহাসে সাহাদের যে স্থান নির্দিষ্ট সেখানে অনধিকার চর্চা করা। আবার বলছি ঢাকার থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের অজপাড়াগাঁয়ের নিচু জাতের একটি ছেলে। অন্যের বাড়িতে থেকে গরু চরিয়ে, নিচু জাতের অপমান সহ্য করে, গোটা পূর্ববঙ্গে সাহিত্যে প্রথম স্থান অধিকার করবার পর সিভিল সার্ভিসে না ঢুকে, উকিল না হয়ে কেন কেঠো বিজ্ঞানচর্চায় ঢুকলেন? এর একটি সম্ভাব্য উত্তর আছে— আশীষ লাহিড়ী বলছেন— রামমোহন রায়ের হাত ধরে পরবর্তীতে বিজ্ঞানচর্চা অক্ষয় কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর হয়ে প্রফুল্লচন্দ্র ও জগদীশ বসুর হাত ধরে বাংলার প্রত্যন্ত জীবনেও বিজ্ঞানচর্চার ছাপ ফেলতে যে সমর্থ হয়েছিল প্রমাণ হচ্ছে সাহার প্রথম জীবনের শিক্ষক প্রসন্নকুমার চক্রবর্তী। তারই ফসল মেঘনাদ সাহা। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার এই অংশটি বেশিরভাগ সময়ই উহ্য থেকে যায়। এর সঙ্গে রয়েছে পরাধীন দেশের এবং নিচু জাতের মানুষ হিসেবে মেঘনাদের নিজেকে, দেশকে প্রতিষ্ঠা করবার ইচ্ছে।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় অংশগ্রহণের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া সত্ত্বেও পড়াশুনোর লড়াই ছাড়েননি। চিন্তা করুন ১৯১১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান পড়তে ঢুকলেন। পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, রসায়নের অধ্যাপক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সহপাঠীদের মধ্যে আছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আছেন জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নীলরতন ধর, নিখিলরঞ্জন সেন। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ছিলেন মেঘনাদের এক বছর সিনিয়র। এদের সঙ্গে পড়লেও মেঘনাদের লড়াইটা আলাদা। ছোট জাতের অসম্মান নিয়ে বিজ্ঞানসাধনা চালিয়ে যাওয়ার লড়াই। থাকেন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে। ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণদের জন্য আলাদা আলাদা থাকা ও খাবার ব্যবস্থা। হোস্টেলের সরস্বতী পূজায় অঞ্জলি দিতে গেলে কিছু ব্রাহ্মণসন্তান মেঘনাদকে অপমান করে মণ্ডপ থেকে বের করে দেয়। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় মেঘনাদ সাহা প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন, আর প্রথম হলেন সত্যেন বসু। মেঘনাদ সাহা আর সত্যেন বসু দুই প্রিয় বন্ধু ভারতীয় বিজ্ঞানে ঊজ্জলতম জ্যোতিষ্ক। কিন্তু আজ বোঝা যায় নিচু জাতের হিন্দু হিসেবে সাহার লড়াই স্বচ্ছল, উঁচু জাতের বসুর চেয়ে কত কঠিন ছিল। এর থেকেই বোঝা যায় এই এই হিন্দুধর্ম ও তার জাত প্রথা, তার অত্যাচার এই উপমহাদেশের বিজ্ঞানসাধনার হাজার বছরের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। গত দুই হাজার বছরে কত শত মেঘনাদ সাহা হারিয়ে গেছে হিন্দু গর্বের জাতের করাল অন্ধকারে। এটাই তো ইতিহাসের কাজ। পরতে পরতে লেগে থাকা ঘটনাগুলিকে আলাদা করা। ব্যাখ্যা খোঁজা।
ইডেন হস্টেলে জাতের বজ্জাতির বিরুদ্ধে সহপাঠী ও আবাসিক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও নীলরতন ধর তীব্র আপত্তি করলেন এবং তিনজন হস্টেল ছেড়ে দিলেন। চলে এলেন মেসে। সেই বিখ্যাত মেস— ১১০, কলেজ স্ট্রিট। সেখানেই তার আলাপ হয় বিপ্লবী বাঘাযতীন, ভূপেন দত্ত (বিবেকানন্দর ভাই) সহ আরও অনেকের সঙ্গে। ভূপেন দত্ত এই ব্যপারে ‘বিপ্লবের পদচিহ্ন’ বইতে আলোকপাত করেছেন। এমনকি ১৯২৭ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হওয়ার সময়েও তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা দফতরের রিপোর্ট যায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বলশেভিক কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সাহায্য করবার। বলশেভিক সাহিত্য পড়বার। তার মেয়ে চিত্রা রায় লিখছেন যে তার শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিকেলবেলায় কলকাতার গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যাওয়ার সময়ে সাহা সহ তার প্রিয় ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে স্বদেশি আন্দোলনে দীক্ষিত করতেন। এ এক হারিয়ে যাওয়া সময়। এক দিকে পরাধীনতার গ্লানি। অন্যদিকে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদের, বিদ্রোহের প্রস্তুতি। মেঘনাদ সাহা তার এক উজ্জ্বল অভিজ্ঞান মাত্র।
অদ্ভুত এক লড়াকু মানুষ এই মেঘনাদ সাহা। ছিলেন গণিতের ছাত্র। উনি জানতেন স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যোগসূত্র থাকার কল্যাণে উচ্চপদস্থ সরকারি কাজ তার জুটবে না। ১৯১৬ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে সাহা ও বসু দুই বন্ধুই যোগ দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। কিন্তু পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষক নেই। তাছাড়া নতুন বিভাগ— পরিকাঠামো নেই, তৈরি করতে হবে। এবং এটার জন্য জার্মান ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাগবে। সাহার আগেই জার্মান ভাষা কিছুটা জানা ছিল। কুছ পরোয়া নেই। লড়াকু সাহা ও তার বন্ধু সত্যেন বসু লেগে পড়লেন। গভীরভাবে জার্মান শিখলেন। পরিচিত হলেন আইনস্টাইন সহ অন্যান্য জার্মান পদার্থবিদদের কাজের সঙ্গে। সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাপ ও তাপগতিবিদ্যা পড়াতেন। এবং এই বিষয়টি পড়ানোর জন্য জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে তাকে অর্জন করতে হয়েছিল। এর মধ্যেই বিজ্ঞানের ইতিহাসে সাহা এবং বসু নিজেদের নাম চিরস্থায়ী করে ফেললেন ১৯১৫ সালে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব’-এর ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করলেন। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর বলেন, এটি একটি চমকপ্রদ ঘটনা। আগে সবাই জানত যে আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব’-এর প্রথম অনুবাদ হয় জাপানি ভাষায়। তা ঠিক নয়। প্রথম অনুবাদক হচ্ছেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসু। সাহা ও বসুর ১৯১৯ সালের অনুবাদ এখন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আইনস্টাইন আর্কাইভে রাখা আছে। এই অনুবাদের মাধ্যমেই আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ হয় সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদের।
১৯১৭-১৮ সালের মধ্যে ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় সাহার। তার ভিত্তিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি লাভ করেন। আর পরের বছরই পৃথিবীর জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে সাহার যুগান্তকারী আবিষ্কারের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ‘তাপীয় আয়নন তত্ত্ব’ নামে পরিচিত Ionization of the Solar Atmoshphere নামের এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে ফিলজফিক্যাল পত্রিকায়। মেঘনাদ সাহার বয়স তখন মাত্র ২৭ বছর। যদিও মেঘনাদ শক্তির বিকিরণের চাপ (radiation pressure) সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা শুরু করেছিলেন ১৯১৭ সালেই। ১৯১৭ সালের শেষের দিকে ‘সিলেকটিভ রেডিয়েশান প্রেশার’ শিরোনামে গবেষণাপত্র রচনা করেন তিনি। অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশের জন্য গবেষণাপত্রটি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু জার্নালের সম্পাদক জানালেন গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পক্ষে বড় দীর্ঘ হয়ে গেছে। তবে প্রকাশ করা যেতে পারে একটি শর্তে। প্রকাশনার খরচ যদি মেঘনাদ সাহা দিতে পারেন তবে। সেই ১৯১৭ সালে মেঘনাদের পক্ষে শতাধিক ডলার দেওয়া কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। ফলে প্রকাশ হয়নি। কিন্তু হতাশ হওয়ার মানুষ তিনি নন। তার তিন বছরের মধ্যে তাঁর গবেষণা জ্যোতির্বিদ্যার ভবিষ্যতের গবেষণার ধারাকেই পরিবর্তন করে দিল। না তাঁর গবেষণার ফলে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার জগতে যে ভয়ানক পরিবর্তন এল তার বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার ইচ্ছে বা যোগ্যতা কোনওটাই আমার নেই। খালি জানাই ১৯২৭ সালে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে স্যার আর্থার এডিংটন লিখছেন ১৫৯৬ সাল থেকে ‘তারা’ সম্পর্কিত যত গবেষনা তার মধ্যে সেরা বারোটার মধ্যে সাহার গবেষণা অন্যতম। ১৯৩৬ সালে শ্যেন রোসেল্যান্ড লিখছেন “যদিও বোরকে জ্যোতির্বিদ্যার পথিকৃৎ বলে ধরা হয়, কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যার প্রথম নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব আবিষ্কার করেন ভারতীয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। … ভবিষ্যতের সমস্ত আবিষ্কারই সাহার তত্ত্বকে ধরেই এগিয়েছে।”
সাতবার মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরস্কারের জন্য অনুমোদন পান। কিন্তু শিকে ছেঁড়েনি। একমাত্র রয়্যাল সোসাইটির সভ্যপদ ব্যতিরেকে দেশি বিদেশি আর কোনও সম্মান জোটেনি। অনেকে অবাক হন, আমি হই না। যে দেশ বা জাতির অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীরা শিকাগোর ধর্মসভায় দেওয়া একটি ধর্মীয় বক্তৃতাকে দেশের পরিচয় বলে মনে করেন, তার শতবর্ষ উদযাপন করেন, তাঁরা যুক্তিবোধ বা বিজ্ঞানবোধকে যে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখবেন এ আর আশ্চর্য কি! আর এই বছর যে মেঘনাদ সাহার যুগান্তকারী আবিষ্কারের শতবর্ষ তা কে মনে রেখেছে? অনেকে বলতে পারেন এই তুলনাটা কি ঠিক হল? আমি বলব আলবাত ঠিক। কেন নয়? মানুষের জীবন, চেতনা বা বিজ্ঞানবোধের মানোন্নয়নে ভারতের অবদান হিসেবে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ? মেঘনাদ সাহার আবিষ্কার, না শিকাগোর কারখানা-মালিকদের পয়সায় ফি বছর উদযাপিত হওয়া ধর্মসভার বক্তৃতা?
সাংগঠনিক কাজকর্ম
আগেই লিখেছি একসময় পয়সার অভাবে সাহা উনি গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারেননি। সেই থেকেই বোধহয় বিজ্ঞান গবেষণার সাংগঠনিক দিকটা নিয়ে উনি ভাবতে শুরু করেন। উনি গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরে আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার কথা ভাবতে শুরু করেন। ১৯২৩ সালে মাইনে বৃদ্ধি ও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের অভাবের কারণে উনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যোগ দেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকৃতপক্ষে সাহার কাজের পূর্ণ বিচ্ছুরণ ঘটে এই সময়। তার গভীর বিজ্ঞানবোধ ও এগিয়ে থাকা চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯২৫ সালের বিজ্ঞান কংগ্রেসে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান শাখার সভাপতির ভাষণে। সেখানে ৩২ বছরের যুবক জ্ঞানবৃদ্ধ মেঘনাদ বলেন “ভারতে প্রাচীন শাস্ত্রের পূজা করা পাণ্ডিত্যের পরাকাষ্ঠা হয়ে পড়েছে। এককালে ইউরোপও এরকম ছিল। বাইবেল, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের পুজো করাই পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক ছিল। কিন্তু গ্যালিলেও, কেপলার, ব্রুনোর মতন বিজ্ঞানীরা নিজের জীবন ও রক্ত দিয়ে ইউরোপকে সেই ভুল পথ থেকে সরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু ভারতে বিজ্ঞান জগতে এরকম শহীদ তো নেই।” ওনার এই বক্তব্য যে কতটা সঠিক তা আজকে প্রমাণিত। সাহার এই বিপ্লবী যুক্তিবাদী মতামতই তাঁকে ভারতে বিস্মৃতির অতলে নিক্ষেপ করেছে। একদিকে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, তিলক প্রভৃতির নেতৃত্বে প্রবল হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান, অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধিতায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলবার জন্য নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের তাগিদে অতীতকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখানো— এখানে মেঘনাদ, সত্যেন বসুদের স্থান কোথায়? তবুও সেই সময় এর বিপরীতে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল। যার অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন সাহা। আমাদের ইতিহাসে সচেতনভাবেই এই দিকগুলি অনালোচিত।
এই সময়ই প্রকৃতপক্ষে সাহা নিজের উদ্যোগে ও পরিচিতিকে ব্যবহার করে ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউপি অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’, যা ভবিষ্যতে হবে ‘ন্যাশনাল অ্যাকাদেমি অব সায়েন্সেস’। ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আলাদা একটি সংগঠন।
১৯৩৩ সালে মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে কলকাতায় গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি’। ফিজিক্যাল সোসাইটি থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’।
১৯৩৫ সালে মেঘনাদ সাহা লন্ডনের ‘নেচার’ সাময়িকী এবং আমেরিকার ‘সায়েন্স’ সাময়িকীর আদলে বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তোলার জন্য ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশান’ গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে নিয়মিত ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমৃত্যু তিনি এই জার্নালে নিয়মিতভাবে লিখে গেছেন (মেঘনাদ সাহা – জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অগ্রদূত— প্রদীপ দেব)।
ভারতে পরমাণু পদার্থবিদ্যা গবেষণার জনকও মেঘনাদ সাহা। তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র ফিজিক্স যা পরে হবে সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়র ফিজিক্স। ভারতে প্রথম সাইক্লোট্রন স্থাপন করেন। এবং ১৯৪৪ সালে সাহা আমেরিকা ও ইংল্যান্ড গেলে সেখানকার গোয়েন্দারা সারাক্ষণ সাহাকে নজরে রাখতেন পাছে সাহা তাদের পরমাণুবিজ্ঞানের পরিকল্পনা জেনে যান। আন্তর্জাতিক স্তরে বিশাল মাপের স্বীকৃত বিজ্ঞানী হলে কী হবে এখানে ভারতে পরমাণুবিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে সাহার ভূমিকার কোনও স্বীকৃতিই নেই। যা পেয়েছেন হোমি ভাবা, ভাটনগর, সারাভাইরা। পরমাণু কমিশনে সাহাকে কাজ করতে হয়েছে তার চেয়ে আঠারো বছরের ছোট ভাবা এবং ভাটনগরের অধীনে। কেন? অবশ্যই কারণ আছে। যা পুরোপুরি রাজনৈতিক এবং মেঘনাদ সাহার স্পষ্টবাদিতাও এর জন্য দায়ী।
পরাধীন ভারতে ১৯৩৬ সালে সাহা সুভাষ বসু ও নেহেরুকে বুঝিয়ে মেঘনাদ সাহা জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির প্রস্তাব গ্রহণ করান।
১৯৪৬-এর জুলাইতে বিজ্ঞানকর্মীদের একটি সম্মেলন ব্রিটেনে হয় সাহা যাতে অংশগ্রহণ করেন। সংগঠনের লক্ষ্য হিসেবে তিনি লেখেন “… এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জাতীয় জীবনে শিক্ষা ও গণক্ষেত্রে বিজ্ঞানের পূর্ণ ব্যবহার…।” ভারতে এই সংগঠনের শাখা তৈরি হয় ১৯৪৭ সালের ৭ই জুলাই।
১৯৩৪ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসে বম্বেতে উনি ভারতের বন্যার ভয়ঙ্কর বিপদ সম্পর্কে বলেন। ১৯৩৮ সালে আবার সাহা নদীবিষয়ক পৃথক গবেষণাগার তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ১৯৪৮ সালে সাহার প্রস্তাব ও পরিকল্পনামাফিক দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন তৈরি হয়। ছাত্রজীবন থেকেই বন্যাত্রাণে অংশগ্রহণ করেছেন, বন্যার্তদের দুর্দশা দেখেছেন। ওনার বহুধাবিস্তৃত গবেষণার মধ্যে নদীপরিকল্পনা একটি। ডিভিসি তাঁর পরিকল্পনামাফিক হলেও তাঁর সতর্কবাণী উপেক্ষিত থেকে গেছে।
সাহা পরাধীন ভারতে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির পরিকল্পক ও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হলেও কংগ্রেসের গান্ধিবাদী শিল্পনীতি উনি কোনওদিন মেনে নিতে পারেননি। উনি তাঁর প্রবন্ধে এর সমালোচনা করেছেন। ফলে সাহাকে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কখনওই কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা রূপায়ণের দায়িত্বে রাখা হয়নি। (LIFE WITH FATHER–Chitra Roy née Saha, A Commemorative Volume on Saha’s 125th Birth Anniversary,Indian National Science Academy)।
ভারতের প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে সাহার প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল। ভারত সরকার ওনাকে ১৯৫২ সালে পঞ্জিকা সংস্কারের জন্য ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটির চেয়ারম্যান করেন। প্রায় তিরিশটি পঞ্জিকা পর্যালোচনা করে সাহার কমিটির দেওয়া পরামর্শ মোতাবেক সরকার প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ পঞ্জিকা প্রকাশ করে।
সেইসময় মেঘনাদ সাহার তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল। ১৯৫১ সালে তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের সমর্থনে বিপুল ভোটে উত্তর পশ্চিম কলকাতা লোকসভা আসন থেকে জয়লাভ করেন।
আমার এই স্বল্পজ্ঞানে আর কোনও ভারতীয় বিজ্ঞানসাধকের সামাজিক ও জ্ঞানের জগতে এত বৈচিত্রময় কর্মকাণ্ড ও অবদান আছে বলে মনে করতে পারছি না।
মেঘনাদ সাহা, বিজ্ঞান ও ধর্ম
আমি আগেই বলেছি মেঘনাদ সাহা হিন্দু পুনরুত্থানবাদের বিরুদ্ধে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের রাস্তায় হেঁটেছিলেন। একদিকে প্রাচ্যবিদদের তুমুল প্রচার যে ভারতের যা কিছু গর্ব তা লুকিয়ে আছে প্রাচীন সনাতন হিন্দু ভারতে, অন্যদিকে সাহা-বসুদের আধুনিক ভারতীয় বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াই। সুতরাং সাহা, বসুদের তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ে সামিল হতে গিয়ে অতীতের ফাঁপানো গর্ববোধকে নস্যাৎ করতেই হত। কিন্তু নস্যাৎ করতে গিয়ে তাঁরা অতীতকে কখনও খাটো করেননি।
এবং মেঘনাদ সাহা জানতেন এই লড়াইটা কত কঠিন। এই লড়াইতে উনি রবীন্দ্রনাথকেও পাশে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ৭০তম জন্মদিনে সাহা অভিযোগ করছেন, আমাদের কবি এত সম্মান এনে দিয়েছেন, কিন্তু বিজ্ঞান সম্পর্কে এত নিঃস্পৃহ কেন? জার্মান কবি গ্যেটে বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে পারলে আমাদের কবি কেন পারবেন না? বিজ্ঞানের এই অনন্ত বিশ্বের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্রমপরিবর্তন কি কবির মনে রোমাঞ্চ জাগায় না? কবিরা কেন এক ধরনের ধর্মীয় আগড়ে বাঁধা পড়ে থাকবেন! আশিষ লাহিড়ী এই প্রসঙ্গে সাহার একটি কথাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। সেটি হল— “প্রকৃতির অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি প্রার্থনা (Worship to the inner spirit of Nature)’’। সাহা নাস্তিক কাঠখোট্টা মানুষ ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতিকে উনি যান্ত্রিক বিজ্ঞানবাদের দৃষ্টিতে দেখেননি।
নদী পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও উনি বারবার প্রকৃতিকে বোঝার উপর জোর দিয়েছেন। যাকে ভুলে গিয়ে মানুষ প্রকৃতিকে, নদীকে ধবংস করছে। সুতরাং উনি বিজ্ঞানের হাত ধরে প্রকৃতিকে জয় করতে চাননি। প্রকৃতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাঁটতে চেয়েছিলেন। এখানেই উনি মিলে যান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তার কিছুদিন পরেই লেখেন ‘বিশ্বপরিচয়’ সত্যেন বসুকে উৎসর্গ করে।
ওনার একটি লেখা নিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ওনাকে চরম আক্রমণ করেছিল। সেটি হল “সব আছে ব্যাদে”।
এই প্রসঙ্গের বিতর্ক ঘাঁটলে দেখা যাবে অতীত ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে মেঘনাদ সাহার যথেষ্ট পড়াশুনো ছিল। দুঃখের কথা হলেও সত্যি আজ ভারতে “সব আছে ব্যাদে” জাতীয় লোকের সংখ্যা বেশি ও তারা সমাজে মান্যতাপ্রাপ্ত। প্রধানমন্ত্রী মোদিসাহেব মনে করেন গণেশের মাথা প্লাস্টিক সার্জারির উদাহারণ। বিজ্ঞান কংগ্রেসে বলা হয় স্টিফেন হকিং যা বলেছেন সব বেদে আছে। সুতরাং এখন আরও প্রয়োজন মেঘনাদ সাহার মতন বিজ্ঞানপ্রচারকের। সাহা একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘এক নতুন জীবনদর্শন’ নামে। সেখানে প্রাচ্যের আধ্ম্যাত্মিক চিন্তা কীভাবে বিজ্ঞান প্রসারের অন্তরায় হচ্ছে তা আলোচনা করেছিলেন। তখন অরবিন্দ আশ্রমের তৎকালীন সম্পাদক অনিলবরণ রায় সাহাকে তীব্র আক্রমণ করেন এবং তাঁর বেদ নিয়ে আলোচনার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখন তিনি ‘আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দুধর্ম’ নামে একটি প্রবন্ধে তার সমুচিত জবাব দেন। এই বিতর্কটি “সব ব্যাদে আছে” বলে বিখ্যাত। সেই লেখা থেকে আমি তিনটি দীর্ঘ মন্তব্য তুলে দিতে চাই যারা প্রাচীন ভারতের কোলে মুখ লুকিয়ে বর্তমানকে আলোকিত করতে চান তাঁদের জন্য। এই প্রবন্ধে সাহা শুরু করেছেন—
…অনেক পাঠক আমার প্রথম প্রবন্ধে ‘সব ব্যাদে আছে’ এইরূপ লিখায় একটু অসন্তুষ্ট হইয়াছেন। অনেকে ধরিয়া লইয়াছেন যে আমি ‘বেদের’ প্রতি অযথা অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়াছি। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। এই বাক্যটির প্রয়োগ সম্বন্ধে একটু ব্যক্তিগত ইতিহাস আছে। প্রায় ১৮ বৎসর পূর্বেকার কথা, আমি তখন প্রথম বিলাত হইতে ফিরিয়াছি। বৈজ্ঞানিক জগতে তখন আমার সামান্য কিছু সুনাম হইয়াছে। ঢাকা শহরনিবাসী (অর্থাৎ আমার স্বদেশবাসী) কোন লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল আমি কী বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাঁহাকে আমার তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে (অর্থাৎ সূর্য ও নক্ষত্রাদির প্রাকৃতিক অবস্থা যাহা Theory of Ionisation of Elements দিয়া সুস্পষ্টরূপে বোঝা যায়) সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, “এ আর নূতন কী হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।” আমি দুই-একবার মৃদু আপত্তি করিবার পর বলিলাম, “মহাশয়, এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে, অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি?” তিনি বলিলেন, “আমি তো কখনও ‘ব্যাদ’ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবী কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।” অথচ এই ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য যে, বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। ………… বাস্তবিকপক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যাবসায় প্রসূত।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান সম্পর্কে তিনি বলেছেন:
একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি, এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন, আর নতুন কি করিয়াছে? কিন্তু এই সমস্ত “অল্পবিদ্যা-ভয়ঙ্করী” শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহসূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস (Elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন নাই। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণকক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোনও হিন্দু গ্রীক বা আরবী পণ্ডিত, কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহু পূর্বেই মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিস্কার করেছেন এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। দুঃখের বিষয়, দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞানপ্রচারকের অভাব নাই, তাহারা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করিতেছেন মাত্র।
এই শ্রেণীর লোক যে এখনও বিরল নয় তাহার প্রমাণ সমালোচক অনিলবরণ রায়। তিনিও ‘সবই ব্যাদে আছে’ এই পর্যায়ভুক্ত, তবে তিনি ‘বেদ’ মূলে না হউক, অনুবাদে পড়িয়াছেন। সুতরাং তাহার পক্ষে সবই বেদে আছে এইরূপ অজ্ঞান আরও জোর গলায় প্রচার করা সম্ভবপর হইয়াছে। অনিলবরণ রায় মহাশয়ের মতন মনোবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্বন্ধে আমার মনোভাব প্রকাশ করিয়াছি মাত্র।
সুতরাং এই মানুষটিকে মনে রাখবার কোনও কারণ বিজ্ঞানের কাছে থাকলেও শাসক রাষ্ট্রের কাছে ছিল না। আর আমাদের তথাকথিত লিবারেল বুদ্ধিজীবীরাও আসলে হিন্দু বুদ্ধিজীবী। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরাও সাহাকথিত জ্ঞানের গজদন্তমিনারে অধিষ্ঠান করছেন। সমাজ-সচেতনতা তাদের কাছে বাহুল্য মাত্র। তাই আমাদের বার বার মেঘনাদ সাহার কাছে ফিরতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আইনস্টাইন বাদ দিলে সমাজের, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে তাঁর মতন বিচরণ আর কারও মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায় না। মেঘনাদ সাহার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার করতে হবে। ইউরো আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতাকে জ্ঞানের জগতে কোনও ধর্মসভার বক্তৃতা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়নি। ভারতীয় উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চাকে বিশ্বমেধার জগতে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু, পি সি রায়, শিশির মিত্র, জ্ঞান ঘোষ, নীলরতন ধর প্রমুখ।
তাই এই অকিঞ্চিৎকর লেখাটি মেঘনাদ সাহার ‘তাপীয় আয়নন তত্ত্ব’-এর শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে তার উদ্ভাবকের প্রতি ক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তথ্যসূত্র:
- ইংরাজি পত্রিকা “বিজ্ঞান প্রসার”-এর নভেম্বর, ২০০২ ৫ম মাসিকপত্র।
- MEGHNAD SAHA A GREAT SCIENTIST AND VISIONARY-LECTURES DELIVERED AT 125TH BIRTH ANNIVERSARY CELEBRATION OF PROFESSOR MEGHNAD SAHA– A Publication of The National Academy of Sciences India (NASI)
- মেঘনাদ সাহা— জীবন ও সাধনা, সুখেন্দু বিকাশ কর মহাপাত্র
- Meghnad Saha— His Science and Personathrough Selected Letters and Writings— A Commemorative Volume on Saha’s 125th Birth Anniversary— Edited and Coordinated by Ashok Kumar Singhvi, Indian National Science Academy
- মেঘনাদ সাহা – জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অগ্রদূত, প্রদীপ দেব
- বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠিপত্র