চার নম্বর নিউজডেস্ক
বছর দুয়েক আগেও পুষ্টিকর খাবার কাকে বলে জানত না সুকান্তি। দুবেলা ভরপেট খাওয়া কাকে বলে, সেটাও না। খাওয়া বলতে সে মোটের ওপর বুঝত পেটের গর্তটাকে কোনওভাবে ভরে দেওয়া, যখন যতটুকু সম্ভব। দুই সন্তানকে খাওয়ানোর পর প্রায়ই রাতে স্রেফ জল খেয়ে কাটাতে হত নিজেদের। খুব বেশিদিন নয়, সে সব মাত্র বছরদুয়েক আগের কথা।
ওডিশার প্রায় নামগোত্রহীন গ্রাম কারুয়াবহলে বাড়ি সুকান্তির। সুকান্তি ওরাওঁ। ব্লক বালিশঙ্করা, নুয়াপড়া গ্রাম পঞ্চায়েত। চারজনের পরিবার। স্বামী সুকরা, ও দুই ছেলেমেয়ে— গণেশ আর জয়ন্তী। ছেলের বয়স ১১, মেয়ের ৯। স্বামী-স্ত্রী দিনমজুরি করে সংসার চালাত। যেদিন কাজ পাওয়া যেত, সেদিন খাওয়া জুটত দুবেলার, কাজ না-পেলে, ছেলেমেয়ের জন্য জাউভাত, আর নিজেদের জন্য মাড়টুকু। স্থাবর সম্পত্তি বলতে একটা কাঁচামাটির ঘর, সাম্বৎসরিক ঝড়জল সামলে সেটা যে টিকে ছিল কোনওরকমে, সেটাই আশ্চর্য!
ফলে পুষ্টিকর খাবার কাকে বলে, ছেলেমেয়েদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো কেন জরুরি, সেসব নিয়ে ভাবার অবসর পায়নি সুকান্তি। বেঁচে থাকাটাই ছিল জীবনের লক্ষ্য— যেভবে আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ বেঁচে থাকেন।
তারপরে এল কোভিড, সঙ্গে করে নিয়ে এল লকডাউন। কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে গেল একধাক্কায়। দিনমজুরির কাজের হাল গত ছ মাসে কী দাঁড়িয়েছে, খবরের কাগজে, টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়াতে সকলেই দেখেছেন, জানেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন অনেকেই, কোনও-কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দায়িত্ব নিয়েছে কিছু কিছু পরিবারের। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সে আর কতটুকুই বা!
কথায় বলে, কাউকে একদিন একমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করে দিলে সে সেদিন ভালো থাকবে, কিন্তু চাষের কাজ শিখিয়ে দিলে তাকে অন্তত কখনও আর না-খেয়ে থাকতে হবে না। ট্রিক্ল আপ নামে এক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই পন্থা মেনে কাজ করে অতি গরিব মহিলাদের নিয়ে। ঘটনাক্রমে, ২০১৯ সালে ওডিশা লাইভ্লিহুড মিশনের হাত ধরে ওই সংস্থা গিয়ে পৌঁছয় সুকান্তির গ্রামে। সে গত বছরের জুলাই মাসের কথা। গ্রামের অতি গরিব পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে সংস্থাটি তাদের প্রস্তাব দেয় নিজেদের বাড়ির আশপাশের জমিতে ছোট্ট শাকসবজির বাগান গড়ে তোলার।
প্রস্তাবের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল অতি দরিদ্র পরিবারগুলিকে অপুষ্টির মোকাবিলার একটা স্থায়ী রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া। এবং তারপরে, ধীরে-ধীরে বাগানের বাড়তি শাকসবজি বাজারে বিক্রি করার পথ খুলে দিয়ে পরিবারের মহিলাদের আত্মনির্ভর করে তোলা। সেই লক্ষ্যে গত জুলাইয়ে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সেবকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ শুরু করে ট্রিক্ল আপ।
সেই থেকে শুরু। সেবকের কর্মীরা সুকান্তিকে পৌঁছে দেয় ১৩ রকম সবজি-বীজ। নিজের বাড়ির লাগোয়া একচিলতে জমিতে শুরু হয় বাগানের কাজ। সঙ্গে শুরু হয় মুরগি-পালন এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ।
দ্বিতীয় দফায় (লকডাউন শুরুর ঠিক আগে) ২০২০-র জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে, সেবকের কর্মীদের সাহায্যে সুকান্তি আরও ১৭ ধরনের শাকসবজির বীজ বোনে তার বাগানে। বেশি জায়গা না-থাকায়, ভাঙা হাঁড়ি, প্লাস্টিকের ব্যাগ, ভাঙা বালতি— বাদ যায় না কিছুই। সবরকম পাত্রে বীজবপন করা হয়।
লকডাউনের প্রথম দু’তিন মাসে সেবকের কর্মীরা যেতে পারেননি সুকান্তির গ্রামে। কয়েকমাস পরে যখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, সুকান্তি জানায়, “প্রথমদিকে বিষয়টা আমি ভাল বুঝতে পারিনি। দুবেলা দুমুঠো খেতে পেতাম না ঠিক করে, সেই অবস্থায় বাগান করার কথা আমি ভাবতেই পারিনি। এটা করে আদৌ কিছু লাভ হবে কি না, সে প্রশ্নও ছিল। তবে একটা ব্যাপার আমি খেয়াল করেছিলাম। দেখলাম, আমাদের গ্রামের সবাই এঁদের খুব ভরসা করেন। তাই আমিও কথা শুনলাম। ভাবলাম, দেখাই যাক না। যে অবস্থায় আছি, তার চেয়ে খারাপ আর কীই বা হতে পারে। সত্যি বলছি, এই লকডাউনের বাজারে এই বাগানটা না থাকলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমরা না-খেয়েই মরে যেতাম। কাজ নেই। রোজগার নেই। তবু দুবেলা শুধু যে খেতে পেয়েছি তা-ই নয়, রীতিমত পুষ্টিকর খাবার খেয়েছি। জানেন, স্রেফ এই বাগানের দৌলতে মাসে প্রায় আড়াই হাজার টাকা বেঁচে যায় আমাদের। এক বছর আগেও আমার ছেলেমেয়েরা গাজর কাকে বলে জানত না। সে সব ভাবতেই পারি না এখন। এই বাড়ন্ত বয়সে ওদের প্রয়োজনীয় খাবার ওদের খাওয়াতে পারছি, সেটা ভেবেই আনন্দ…”
এখানেই শেষ নয় সুকান্তির গল্পের। আর, সেখানেই আর পাঁচজনের সঙ্গে সুকান্তির অমিল। নিজের প্রয়োজন মিটিয়েই থেমে থাকেনি সে। অভাব-অনটনের তাড়না কী রকম তা নিজে জানে বলেই, নিজের বাগানের বাড়তি ফসল গ্রামের প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছে সে। “কাজকম্ম শুরু হলে ব্যবসার কথা ভাবা যাবেখন। আগে সবাই তো খেয়ে বাঁচুক!”