কুন্তল-ঘোষ ও শঙ্খশুভ্র-নাগ
লেখকদ্বয় পেশায় অধ্যাপক। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সমাজের আন্তর্সম্পর্ক বিষয়ে উৎসাহী আলোচক।
ডায়ালেকটিক্স অফ নেচার (ডা-নে— এই লেখায় পরবর্তীকালে আমরা সুবিধার জন্য বহুক্ষেত্রে এঙ্গেলসের অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটিকে এভাবে সম্বোধিত করব) এই আকারে রিয়াজনভের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। জীববিদ্যায় গণিতশাস্ত্র (Mathematical Biology) ও সংখ্যাতত্ত্বের (biostatistics) প্রয়োগের অন্যতম পুরোধা অধ্যাপক জেবিএস হ্যালডেন এই বইটির একটি ভূমিকা লেখেন ১৯৩৯ সালে। এই ভূমিকায় হ্যালডেন দুঃখ করেছেন:
It was a great misfortune, not only for Marxism, but for all branches of natural science, that Bernstein[1], into whose hands the manuscript came when Engels died in 1895, did not publish it.
প্রকৃতপক্ষে ডা-নে পাণ্ডুলিপিটি এঙ্গেলস রচনা করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর বহু আগে– ১৮৭২-১৮৮২-র মধ্যে। প্রকৃতিবিজ্ঞান, যা এই পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তু, তা এমনিতেই একটি অত্যন্ত গতিশীল ও পরিবর্তনশীল বিষয়। তদুপরি, এই পর্যায়ে, অর্থাৎ বইটি লেখা ও প্রকাশ হওয়ার মাঝে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা এবং জীববিদ্যায় ঘটে গেছে একের পর এক বৈপ্লবাত্মক পরিবর্তন। স্বভাবতই বিজ্ঞানের খুঁটিনাটির দিক থেকে বিচার করতে গেলে বইটি তার প্রকাশের সময় অনেক প্রাসঙ্গিকতাই ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। তাই ১৯২৪ সালে আইনস্টাইনের হাতে যখন পাণ্ডুলিপিটি তুলে দেওয়া হয় প্রকাশনার ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে, তিনি দ্বিধান্বিত ছিলেন; কিন্তু সামগ্রিকতায় এঙ্গেলসের এই লেখার গুরুত্ব বিচার করে তিনি প্রকাশের পক্ষে মত দেন। তারও ১৫ বছর পর হ্যালডেনের মতো বড় মাপের বিজ্ঞানী এই বই সম্পর্কে তাঁর ভূমিকায় ডা-নের সীমাবদ্ধতার বহু দিক আলোচনা করেও বলেছেন:
When all such criticisms have been made, it is astonishing how Engels anticipated the progress of science in the sixty years which have elapsed since he wrote.
কিন্তু হ্যালডেন এঙ্গেলসকে খুব সচেতনভাবেই পীরবাবা বানানোর চেষ্টা করেননি। ভুলগুলিকে তিনি চিহ্নিত করেছেন এবং তা এঙ্গেলসের স্থাপিত দৃষ্টান্তকেই অনুসরণ করে। ১৮৪৪ সালে ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা’ বলে যে গ্রন্থটি এঙ্গেলস লিখেছিলেন, ৪৮ বছর পরে তার নতুন ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন:
I have taken care not to strike out of the text the many prophecies, amongst others that of an imminent social revolution in England, which my youthful ardour induced me venture upon. The wonder is, not that a good many of these prophecies proved wrong, but that so many of them have proved right, and that the critical state of English trade, to be brought on by continental and especially American competition, which I then foresaw— though in too short a period— has now actually come to pass.
শুধু প্রকৃতিতে নয় দ্বান্দ্বিকতার নিয়মে সমাজও নিরন্তর বদলে চলে। তার কোনও কোনও বদল প্রকৃতিবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞান আন্দাজ করতে বা উপলব্ধি করতে ভুলও করতে পারে, কিন্তু বদলটাই নিয়ম— এই উপলব্ধিতে অন্তত এঙ্গেলসের মতো সমাজবিজ্ঞানী ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের ছাত্রের ভুল হয় না। তাই ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে মার্ক্স ও এঙ্গেলস ফয়েরবাখের মত একজন দৃঢ়চেতা বস্তুবাদীরও এই প্রশ্নে সীমাবদ্ধতা দেখাতে বাধ্য হয়েছেন, যে সীমাবদ্ধতা, বৈশিষ্ট্য অনেক বড় বড় প্রকৃতিবিজ্ঞানীরও।
He does not see how the sensuous world around him is, not a thing given from all eternity, remaining ever the same, but the product of industry and of the state of society…in Manchester, for instance, Feuerbach sees only factories and machines, where a hundred years ago only spinning-wheels and weaving-rooms were to be seen, or in the Campagna of Rome he finds only pasture lands and swamps, where in the time of Augustus he would have found nothing but the vineyards and villas of Roman capitalists. Feuerbach speaks in particular of the perception of natural science; he mentions secrets which are disclosed only to the eye of the physicist and chemist; but where would natural science be without industry and commerce?
চিন্তার এই পটভূমিতেই এঙ্গেলস তিল তিল করে সৃষ্টি করছিলেন ডা-নে। প্রকৃতিবিজ্ঞানের উন্মুক্ত আকাশে বিস্তৃত করেছিলেন তাঁর ডানা। দুঃখের বিষয় কাজটা অসমাপ্ত থেকে গেল।
ডায়ালেকটিক্স অফ নেচার-এর পটভূমি
বাস্তবিকই, উৎপাদিকা শক্তির এক সুবিপুল বিকাশ, বলতে গেলে মাত্র দু-এক শতকের মধ্যে সামন্তবাদের বদ্ধ জলাশয় থেকে প্রকৃতিবিজ্ঞানকে এক অসীম মুক্তাঙ্গনের চেহারা দিচ্ছিল, যে মুক্তাঙ্গনে বিচরণ করে বেড়াচ্ছিলেন ফ্যারাডে-ফ্যুয়েরার-হেলম্হোল্টজ-ম্যাক্সওয়েল-ল্যাভয়সিয়ের-জেনার-ডারউইন-লিয়েলদের মত পদার্থবিদ-গণিতবিদ-রসায়নবিদ-জীববিদ-ভূতত্ত্ববিদেরা। উৎপাদনের বিকাশের সমস্ত বাধা আর শৃঙ্খলগুলি ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই খুলে যাচ্ছিল গ্যালিলিও-কোপার্নিকাস-আন্দ্রে ভেসালিয়াস[2]-দের পায়ে পরানো যাবতীয় বেড়ি, উৎপাদনের সামন্তবাদী বদ্ধতাকে রক্ষা করার জন্য যে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধবিশ্বাসের পাণ্ডারা। আর বিজ্ঞানের অর্গল যত খুলে যাচ্ছিল ততই পুরনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে তোলপাড় করে জন্ম নিচ্ছিল নতুন পুঁজিবাদী সমাজ। বাণিজ্যপুঁজি আর গিল্ডব্যবস্থাকে নতুন নতুন ভৌগোলিক অঞ্চলের আবিষ্কার আর বাজারের চাপ টেনে নিয়ে গেল হস্তশিল্পের কারখানায়। তারপর তাতেও কুলাল না। জেমস ওয়াটের বাষ্পযন্ত্র তাকেও তছনছ করে দিয়ে নিয়ে এল আধুনিক যন্ত্রশিল্পের উৎপাদনের দোরগোড়ায়। বিজ্ঞানের আর দর্শনের মেলবন্ধন সামন্তবাদ ও তার সঙ্গে সঙ্গে— মার্ক্স-এঙ্গেলসেরই ভাষায়— “অনড় জমাট সব সম্পর্ক ও তার আনুষঙ্গিক সমস্ত সনাতন শ্রদ্ধাভারাক্রান্ত কুসংস্কার ও মতামতকে ঝেঁটিয়ে বিদায়” করে (কমিউনিস্ট ইশতেহার)। একদিকে রুশো তাঁর ‘দ্য সোশাল কনট্রাক্ট’ গ্রন্থে হাঁক দিয়েছেন “Man is born free but everywhere he is in chains”; ধর্মের পথ পরিত্যাগ করে ফাদার র্যানাল[3] ধর্মকেন্দ্রিক বৈষম্যমূলক মূল্যবোধের শিকড়ে আঘাত করে লিখছেন— “Fear a greatly unequal division of wealth, which gives rise to the appearance of a small number of opulent citizens and a multitude of citizens in misery, from which is born the insolence of the former and the degradation of the latter. (Philosophical and Political History of the Two Indies)”; অন্যদিকে চলছে আবার জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে জনপ্রিয়করণের এক মহাযজ্ঞ। যাজক আন্তনে প্লুশঁ লিখছেন ‘দ্য স্পেক্ট্যাকল অফ নেচার’। আরেক ফাদার জিন আন্তনে নোলেট লিখছেন ‘লেসনস অফ এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স’। এদিকে দেড় হাজার বছরেরও বেশি পুরনো গ্যালেনের অ্যানাটমি আর চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর শুরু হল আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অস্ত্রোপচার। ওদিকে অর্ধসহস্র বছর পুরনো চার্চ অনুমোদিত জ্ঞানের আকর টমাস অ্যাকুইনসের সাম্যা থিওলজিকা-কে বাই বাই করে এবং ক্যাথলিক চার্চকে নস্যাৎ করে শুরু হয়েছে এনসাইক্লোপিডিয়া রচনার সুবিপুল কর্মযজ্ঞ।
এইখানে এসে আমরা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এঙ্গেলসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা, যা প্রকৃতপক্ষে তিনি ডা-নের কাজ অসমাপ্ত রেখেই সাময়িকভাবে লিখেছিলেন, সেই অ্যান্টি-ড্যুরিং গ্রন্থের যে তিনটি পরিচ্ছেদ একটি স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় সেই ‘ইউটোপীয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’-এর প্রতি। ১৮৯২ সালে এই পুস্তিকাটির ইংরেজি সংস্করণের একটি ভূমিকা এঙ্গেলস লেখেন। সেখানে তিনি উপরোল্লিখিত এই পরিস্থিতির অল্প কথায় একটি চমৎকার সারসংক্ষেপ করেছেন:
শিল্পোৎপাদনের বিকাশের স্বার্থে বুর্জোয়াশ্রেণির প্রয়োজন ছিল বিজ্ঞানের। যাতে প্রাকৃতিক বস্তুর ধর্ম এবং প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ক্রিয়াপদ্ধতি নিরূপণ করা যায়। এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞান হয়ে ছিল গির্জার বিনীত সেবাদাসী, খ্রিস্টবিশ্বাসের আরোপিত সীমা তাকে লঙ্ঘন করতে দেওয়া হত না। সেই কারণে তা আদৌ বিজ্ঞানই ছিল না। বিজ্ঞান বিদ্রোহ করল গির্জার বিরুদ্ধে; বিজ্ঞান ছাড়া বুর্জোয়াশ্রেণির চলছিল না, তাই সে বিদ্রোহে যোগ দিতে হল তাকে।
কিন্তু এ-সবই ঘটছিল অষ্টাদশ শতকে। ঘটে গেল ফরাসি বিপ্লব। তারও প্রায় ৮০ বছর পরে, ১৮৭০ দশক জুড়ে ডা-নে বা অ্যান্টি ড্যুরিং লেখার মূল পটভূমি আলাদা। তা বুঝতে গেলে আমাদের এই ১৮৯২-এ লেখা ভূমিকাটি পথ ধরে আরও কয়েক পাতা এগোতে হবে, যেখানে পদার্থবিজ্ঞানেরই তরঙ্গধর্মের আদলে তিনি সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াশ্রেণির বৈপ্লবাত্মক ভূমিকার নতুন পরিণতির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন:
বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপের এই আধিক্যের পর অবশ্যই আসে অনিবার্য প্রতিক্রিয়া এবং যে সীমা পর্যন্ত সে প্রতিক্রিয়ার থাকা সম্ভব ছিল, তাও এবার তার ছাড়িয়ে যাওয়ার পালা। একাদিক্রমে এদিক-ওদিক দোলার পর অবশেষে পাওয়া যায় নতুন ভারকেন্দ্র এবং তা থেকে হয় একটা নতুন যুগের সূচনা। … শিল্পবিপ্লবে বৃহৎ কারখানামালিক পুঁজিপতিদের একটা শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল তাদের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় কলজীবী শ্রমিকদের একটা শ্রেণি। যে অনুপাতে শিল্পবিপ্লব উৎপাদনের একটার পর একটা শাখা অধিকার করতে থাকে, সেই অনুপাতে এই শ্রেণি সংখ্যায় বেড়ে ওঠে, হয়ে ওঠে শক্তিশালী। … ১৮৩২ সালের আইনে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করায় তারা জনগণের চার্টার বা দাবিসনদের মাধ্যমে … বৃহৎ বুর্জোয়া পার্টির বিরুদ্ধে নিজেদের সংগঠিত করে এক স্বাধীন চার্টিস্ট পার্টিতে। আধুনিককালে এই প্রথম মজুর পার্টি। … শস্য আইন বাতিল ছিল ভূমিজীবী অভিজাতদের উপর বুর্জোয়াশ্রেণির বৃহত্তম জয়, কিন্তু একান্ত নিজস্ব হিসাবে এই তার শেষ বিজয়। এরপর যা কিছু সে জিতেছে তা ভাগ করে নিতে হয়েছে নতুন এই এক সামাজিক শক্তির সঙ্গে। যে শক্তি একসময় ছিল তার সহায়, কিন্তু অচিরেই হয়ে দাঁড়াল তার প্রতিপক্ষ।
ব্রিটিশ বুর্জোয়াশ্রেণি প্রমাদ গুনল প্রথম। এঙ্গেলসের ভাষায়:
কন্টিনেন্টি ভায়াদের[4] বিদ্রুপের পরোয়া না করে নিম্নশ্রেণির মধ্যে বাইবেল প্রচারের জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করে চলেছে; নিজেদের স্বদেশি ধর্মযন্ত্রে তুষ্ট না হয়ে তারা আবেদন জানিয়েছে ধর্মব্যবসার বৃহত্তম সংগঠক জোনাথন ভাই[5]-এর কাছে এবং সেখান থেকে আমদানি করেছে রিভাইভ্যালিজম, মুডি স্যাস্কি প্রভৃতিদের; এবং পরিশেষে ‘স্যালভেশন আর্মি’র বিপজ্জনক সাহায্যও গ্রহণ করেছে— এরা আদি খ্রিস্টধর্মের প্রচার ফিরিয়ে আনছে।
অবশ্য ‘কন্টিনেন্টি ভায়া’দের বিদ্রুপ অচিরেই বন্ধ হল।
ফ্রান্স ও জার্মানির শ্রমিকরা বিদ্রোহভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল। … বড়াই করে জ্বলন্ত চুরুটটা নিয়ে ডেকের উপর আসার পর সমুদ্রপীড়ার প্রকোপে ছোকরা যাত্রী যেমন সেটিকে গোপনে ত্যাগ করে, তেমনিভাবে শেষ পন্থা হিসেবে ফরাসি ও জার্মান বুর্জোয়াশ্রেণির পক্ষে তাদের স্বাধীন চিন্তা নিঃশব্দে পরিত্যাগ করা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর রইল না; বাইরের ব্যবহারে একের পর এক ধার্মিক হয়ে উঠতে লাগল ঈশ্বরবিদ্বেষীরা। চার্চ ও তার শাস্ত্রবচন ও অনুষ্ঠানাদি বিষয়ে কথা কইতে লাগল সসম্মানে। … ফরাসি বুর্জোয়ারা শুক্রবার হবিষ্যি করতে শুরু করল আর প্রতি রবিবার জার্মান বুর্জোয়ারা গির্জার নির্দিষ্ট আসনটিতে বসে শুনতে লাগল দীর্ঘ প্রোটেস্ট্যান্ট সারমন। বস্তুবাদ নিয়ে তারা বিপদে পড়েছে।
বিপদে তারা পড়েছে বিজ্ঞানকে নিয়েও। পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম, সমাজের নিয়ম— অটল অনড় সামন্তবাদকে উৎখাত করতে গিয়ে সেই মন্ত্র আউড়ে তারা ডেকে এনেছে নিজেদের বিপদ। কারণ সেই একই নিয়মে এবার তাদের অস্তিত্বও যে প্রশ্নের মুখে। আলাদিনের প্রদীপের দৈত্যের মতো যে গণতন্ত্রকে তারা জাগিয়ে তুলেছে, তা যখন তাদের বিরুদ্ধেই উদ্যত, তখন বস্তুবাদ, বিজ্ঞান, প্রগতিকে শিকেয় তুলে জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ-উগ্র জাতীয়তাবাদ সহ সমস্ত ধরনের আত্মপরিচিতির ভিত্তিতে তাদের একদা মিত্র, অধুনা প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রমিকশ্রেণিকে মোকাবিলা করা ছাড়া আর রাস্তা কী? এভাবেই বস্তুবাদ তার স্বাভাবিক গতিপথে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে রূপান্তরিত না হয়ে নিত্যনতুন ভাববাদের কানাগলিতে যখন পথ হারাতে বসেছে— সেই পটভূমিতেই লেখা হচ্ছে প্রকৃতিতে দ্বান্দ্বিকতা। এই পটভূমিকে না চিনলে আমরা বুঝতে পারব না এঙ্গেলস ডা-নের প্রথম অধ্যায়ে কেন লিখছেন যে—
Natural science, so revolutionary at the outset, suddenly found itself confronted by an out-and-out conservative nature in which even to-day everything was as it had been at the beginning and in which— to the end of the world or for all eternity— everything would remain as it had been since the beginning…For the Greek philosophers the world was essentially something that had emerged from chaos, something that had developed, that had come into being. For the natural scientists of the period that we are dealing with it was something ossified, something immutable, and for most of them something that had been created at one stroke. Science was still deeply enmeshed in theology.
অথচ মাত্র এক-দুই শতক পিছনে যদি তাকানো যায়, এঙ্গেলস বলছেন যে ইমানুয়েল কান্ট-এর মহাজাগতিক তত্ত্ব না জেনেও, ল্যাপলাসের তত্ত্ব তখনও আবির্ভূত না হওয়া সত্ত্বেও, “from Spinoza right to the great French materialists— it insisted on explaining the world from the world itself and left the justification in detail to the natural science of the future.”
এঙ্গেলসও ঠিক এই চেষ্টাটাই ডা-নে-তে করেছেন। ক্রিজ আঁকড়ে থেকেছেন যখন একের পর এক বড় বড় উইকেট তাঁর চারদিকে পড়ে যাচ্ছে। ডাবলু জি গ্রেসের সঙ্গে এঙ্গেলসের চেহারা আর অনেকটাই সমসাময়িকতার কথা মাথায় রেখে এমন একটা তুলনা— মন্দ কি? একটাই বোধহয় তুলনার সমস্যা—ক্রিকেটের পিতা সম্পর্কে বলা হয় তিনি ছিলেন “notoriously unscholarly”।
বৈপ্লবিক সময়— প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন
সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের প্রকৃতি বিজ্ঞানে যে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে চলেছিল, যা আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করেছি, ঊনবিংশ শতকে এসে ভীত বুর্জোয়াশ্রেণি পরিবর্তনের ভয়ে তাতে যতই বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, মন্ত্রবলে জেগে ওঠা দৈত্যের কিন্তু আর বাঁধ মানার কোনও ইচ্ছা ছিল না। ফলে শাসকদের ইচ্ছানিরপেক্ষভাবেই বিজ্ঞানের জগতে ঘটে চলেছিল এমন একের পর এক যুগান্তকারী ঘটনা যা প্রকৃতির নিরন্তর পরিবর্তনশীলতাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করছিল। ভূতত্ত্বে হাটন[6]-এর উত্তরসূরি চার্লস লিয়েলই হোন, বা মহাজাগতিক তত্ত্বে কান্টের উত্তরসূরি ল্যাপলাস— ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন থেকে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারার অনিত্যতা প্রতিষ্ঠা করে চলেছিলেন এঁরা সকলেই। আর ডারউইন। তিনি তো এমন এক পরিবর্তনের তত্ত্ব হাজির করলেন যা মানুষের চেতনা, তার অনুভূতিকে আশ্রয় করে ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্বের যে ভাববাদী দর্শন, তার একেবারে মূলে কুঠারাঘাত করল। মানুষই তো এল এই সেদিন। কোথায় তার অনুভূতির বয়স, আর কোথায় ব্রহ্মাণ্ডের বয়স— লিয়েল-ডারউইন-ল্যাপলাস এঁরা মিলে ধর্মীয় গালগল্পগুলিকে ঠাট্টার বিষয় করে তুললেন। ডা-নের প্রথম অধ্যায়ে এঙ্গেলস শুধু যে এই সমকালীন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তার তাৎপর্য তুলে ধরলেন তাই নয়— অজৈব ও জৈব রসায়নের মধ্যে, রসায়ন ও জীবনবিজ্ঞানের মধ্যে টিঁকিয়ে রাখা চিনা প্রাচীরগুলি কীভাবে অবলুপ্ত হচ্ছে, তা-ও দেখালেন। দেখালেন যে, ধর্মপ্রচারে হাজার হাজার মুদ্রা খরচ করেও, শুক্রবারের হবিষ্যি আর রবিবারের সারমন সত্ত্বেও—
…we have once again returned to the point of view of the great founders of Greek philosophy, the view that the whole of nature, from the smallest element to the greatest, from grains of sand to suns, from protista[7] to men, has its existence in eternal coming into being and passing away, in ceaseless flux, in un-resting motion and change, only with the essential difference that what for the Greeks was a brilliant intuition,[8] is in our case the result of strictly scientific research in accordance with experience, and hence also it emerges in a much more definite and clear form (মোটা হরফ বর্তমান লেখকদের)।
কিন্তু জগতের এই নিরন্তর পরিবর্তনশীলতা আরও নিশ্চিত ও পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে বুর্জোয়াশ্রেণির চলবে কেন? যেমন চলেনি সে যাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল সেই সামন্তশ্রেণিরও। জগৎ অনড়, অটল, অপরিবর্তনশীল— এই ধারণার আড়ালে লুকাতে চেয়েছিল সেও। প্রতিক্রিয়াশীল চার্চ তাকে সায় দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় সায় দেওয়ার জন্য বুর্জোয়াদের হাতে তো সেই রাম বা অযোধ্যা আর নেই। যতই তারা রিভাইভ্যালিজমের নতুন চর্চা শুরু করুক— ধর্মের গুরুত্ব যে তারা নিজেরাই হ্রাস করেছে। বিপদ বুঝে ধর্মকে শেষ অব্দি ঝেঁটিয়ে বিদায় করেনি বটে, কিন্তু ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র বুলি তো তাদের বিস্তর কপচাতে হয়েছে। অতএব সোজা আঙুলে ঘি তোলা মুশকিল। ভাববাদী দর্শনকে আমদানি করতে হবে নতুন পথে। ডা-নে থেকে এঙ্গেলসের উপরোল্লিখিত উদ্ধৃতিটিতে মোটা হরফের জায়গাটি এখানেই প্রাসঙ্গিক। কীভাবে, তা আমরা দেখব পরে। সেই আলোচনাতে আমরা ঢুকব, কিন্তু অন্য একটি পরিচ্ছেদে, তার আগে, পদার্থবিদ্যার কিছু চর্চা যা ডা-নেতে হয়েছে, তারই সূত্র ধরে।
গতি, শক্তি, তাপ প্রমুখ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এক একটি অধ্যায়ে আলোচনা করে ষষ্ঠ অধ্যায়ে এসে এঙ্গেলস প্রবেশ করছেন তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনায়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভাববাদের অনুপ্রবেশ কীভাবে ঘটল সে প্রসঙ্গটি বুঝতে হলে আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে, এই প্রতিটি অধ্যায়ে গতি-শক্তি-তাপ-তড়িৎ যা যা নিয়ে এঙ্গেলস চর্চা করেছেন, তা সেই সময়ের অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের যে বিজ্ঞানধারণা তার ভিত্তিতেই লেখা। মনে রাখতে হবে যে সেই সময় তড়িৎ ও চুম্বক— পদার্থের এই দুই ধর্মের সাধারণীকরণ করে ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকত্বের ধারণার আবির্ভাব ঘটলেও, ইথার মাধ্যম সম্পর্কিত মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষার ফলাফল তখনও সামনে আসেনি। অতএব বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বও ভবিষ্যতের গর্ভে। সে কারণে তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের ধারণার অনুপস্থিতিতে ইথারের অলীক ধারণাই বৈজ্ঞানিক মহলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ইলেকট্রনের আবিষ্কার হয়েছে, কিন্তু পরমাণুর গঠন সংক্রান্ত প্রাথমিক বোঝাপড়াটাও তৈরি হতে তিন দশক দেরি আছে। অতএব এই তড়িৎ শীর্ষক[9] ষষ্ঠ অধ্যায়টিতে এঙ্গেলস যে বিতর্কের অবতারণা করেছেন তাকে সেই সময়ের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতেই বিচার করে আলোচনাটির তাৎপর্য অনুধাবন করা সম্ভব।
দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়ও এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন। এঙ্গেলস বিজ্ঞানসংক্রান্ত এই রচনায় বৈজ্ঞানিক সত্যটি প্রকৃতপক্ষে কী, তা নির্দেশ করার কোনও চেষ্টা করেননি। সে উদ্দেশ্যও তাঁর নয়, সে কথা আমরা আগেও বলেছি। এমনকি এঙ্গেলসকেই উদ্ধৃত করে দেখিয়েছি যে বৈজ্ঞানিক সত্যটি কেবলমাত্র নির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তৎসংক্রান্ত তথ্যাদির যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া যায়।[10] এঙ্গেলস যেটা করেছেন সেটা হল, সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যে তত্ত্বগত কাঠামোটি নির্মাণ করেছেন, তার বিভিন্ন যৌক্তিক স্ববিরোধিতার দিকগুলির উন্মোচন। দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা, অর্থাৎ অবিরত চলমান যে প্রক্রিয়াগুলির মধ্য দিয়ে বস্তুজগতের পরিবর্তনশীলতা[11] প্রবহমান— প্রচলিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলি যে পরিমাণে একে তাত্ত্বিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করতে সীমাবদ্ধতা দেখিয়েছে, সেই পরিমাণেই বিশেষ বিশেষ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে নতুন নতুন পদার্থের অস্তিত্ব কল্পনা করতে হচ্ছে, এবং নিত্যনতুন স্ববিরোধিতার আগমন ঘটছে। পক্ষান্তরে, যখনই বিজ্ঞান বস্তুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনশীলতার পারস্পরিক রূপান্তরগুলিকে সূত্রায়িত করতে সমর্থ হয়েছে, সেখানেই পূর্ব স্ববিরোধিতার সমাধান হয়েছে এবং নতুন তাত্ত্বিক কাঠামো আবির্ভূত হয়েছে।
এই অধ্যায়ে তড়িৎক্ষরণ সংক্রান্ত টমসনের ধারণা নিয়ে আলোচনায় এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে হেগেল বা ফ্যারাডের মতই টমসন তড়িৎ-বিচ্ছুরণ (spark)-কে “পদার্থের কোনও বিশেষ অবস্থা নয়, বরং একটি বিশেষ স্বতন্ত্র ধরনের পদার্থ”— এই চিন্তার বিরোধিতা করলেও পদার্থের কোন অবস্থা সেটি, তা নির্দিষ্ট করতে গিয়ে ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন এবং সেটি একটি “তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট পদার্থ থেকে মুক্ত বল”— এই আধিবিদ্যক (metaphysics) ধারণার আশ্রয় নিয়েছেন। এঙ্গেলস উল্লেখ করেছেন, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে এটা প্রমাণ হয়েছে যে উল্লম্ফনরত ধাতব কণাগুলিই বিচ্ছুরণের বিশেষ পদার্থরূপ (special materiality) সৃষ্টি করে।
একই ভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি দেখা যায় পরিবাহীর মধ্য দিয়ে তড়িৎপ্রবাহের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও, যাকে সেই সময় গ্যালভানীয় প্রবাহ বলে অভিহিত করা হত। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে তড়িৎকে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক— দুটি বিপরীত প্রবাহী বিশেষ ধরনের পদার্থ হিসেবে দেখা হত, যা স্বাভাবিক অবস্থায় একটি অপরটি দ্বারা প্রশমিত থাকে। কিন্তু যদি কোনও “তড়িৎ বল” তাদের আলাদা করে দেয়, তখনই দুটি আহিত বস্তুর সৃষ্টি হয়, যেগুলিকে পুনরায় পরিবাহী দ্বারা যুক্ত করলে আধানের সাম্যবস্থা পুনঃস্থাপিত হয়। কিন্তু গোল বাঁধল প্রবাহের প্রকৃতি ব্যাখ্যার প্রশ্নে। ওয়েবার প্রমুখ বিজ্ঞানীরা বললেন সাম্যবস্থায় পৌঁছতে দুটি প্রবাহী পদার্থই একইভাবে বিপরীত অভিমুখে প্রবাহিত হয়। কিন্তু হেলম্হোল্টজ দেখালেন যে সেক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র লঙ্ঘিত হয়। সেই হিসেব মেলাতে নিউম্যান[12] যে প্রকল্প হাজির করলেন তদনুযায়ী পদার্থ দুটির একটিমাত্রই প্রবাহী, অন্যটি নয়। অপরদিকে ভিদেম্যান[13] প্রস্তাব করলেন ধনাত্মক ও ঋণাত্মক পদার্থ দুটির সঙ্গে আরও একটি প্রশমিত প্রবাহী পদার্থের অস্তিত্বের। এর অর্থ দাঁড়াল, প্রাথমিকভাবে দুইটি বিশেষ প্রবাহী পদার্থের ভিন্নকরণের উপর তড়িৎ-আহিত বস্তুর যে ধর্ম ব্যাখ্যাত হল, তড়িৎপ্রবাহকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিসর্জন দিতে হল সেই প্রকল্পকেই।
এই ধরনের একদেশদর্শী তত্ত্বায়ণের ফলেই বিজ্ঞান তার গতিশীল চেহারাটাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কিছুটা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে এবং বিশেষ করে পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে এমন একটা ধারণার সঞ্চার ঘটে যে নতুন করে পদার্থবিদ্যার গভীরে ঢোকার আর বিশেষ জায়গা নেই। এঙ্গেলস সরাসরি এই End of Physics-এর উল্লেখ না করলেও এ-প্রসঙ্গে আমরা একটু পরেই যাব— ডা-নের পটভূমিকে আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে। মোদ্দা কথা, প্রকৃতির গতিময়তা (dynamism) ও দ্বান্দ্বিকতার প্রতি নজর রাখলে, তত্ত্বায়ণের সময় বস্তুর অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য ও তজ্জনিত বিভিন্ন ধরনের বিপরীতমুখী পরিবর্তনশীলতার প্রশ্নটি অনুসন্ধানের অংশ হয়ে পড়ে। এই অনুসন্ধানের কথা মাথায় রেখেই হয়তো সম্প্রতি দার্শনিক ও গণিতবিদদের ক্ষুদ্র একটি ধারা এর জন্য উপযুক্ত একটি যুক্তিকাঠামো প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।[14]
এর বিপরীতে একদেশদর্শী যান্ত্রিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন নয়া বস্তুর কল্পনার দিকে অনুসন্ধানকে চালিত করে, বিজ্ঞানকে ভাববাদের খপ্পরে নিয়ে ফেলে। তড়িৎ-প্রশ্নে যে স্ববিরোধের উল্লেখ করা হল, এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, যে তারও সমাধান ঘটে যখন ম্যাক্সওয়েল প্রমুখরা গোটা প্রক্রিয়াটিকে একটি স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের নড়াচড়া ও তার সঙ্গে অংশগ্রহণকারী কণাসমূহের পরিবর্তনশীলতার প্রতিভাত রূপ হিসাবে বর্ণনা করেন। এখানে উল্লেখ্য যে ম্যাক্সওয়েল স্থিতিস্থাপক মাধ্যম হিসেবে ‘ইথার’ নামে একটি কাল্পনিক পদার্থের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানে পরবর্তীকালে এটি প্রমাণিত ও স্বীকৃত যে, তথাকথিত স্থিতিস্থাপক ইথার মাধ্যমের নয়, নড়াচড়ার প্রক্রিয়াটি আসলে চলে আমাদের চারপাশের বস্তুজগতে, সর্বব্যাপী, এবং সেই বস্তুজগতেরই অঙ্গাঙ্গী অংশ তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মাধ্যমে— ম্যাক্সওয়েলের সূত্রাদি মেনে।
এক্ষেত্রে এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বস্তুজগতের অস্তিত্বকে তার অন্তর্নিহিত অসংখ্য বৈপরীত্য এবং তৎসঞ্জাত অসংখ্য বিপরীতমুখী পরিবর্তনশীলতার সমাহার হিসাবে দেখেছেন। দ্বিতীয়টির, অর্থাৎ বিপরীতমুখী পরিবর্তনশীলতাসমূহের রূপান্তরই— যা নির্দিষ্ট বস্তুটির অবস্থার উপর নির্ভরশীল— বস্তুর মধ্যে চলমান প্রক্রিয়াগুলিকে এবং গুণাবলিকে নির্দিষ্ট করে। এভাবে, এঙ্গেলসের বক্তব্য অনুযায়ী, বস্তুর মধ্যে বিপরীতমুখী পরিবর্তনশীলতা (motion) সমূহের রূপের পরিবর্তনের মাধ্যমেই বস্তুজগতের বিভিন্ন নতুন নতুন ঘটনা (phenomenon) ও প্রক্রিয়ার সুসঙ্গত ব্যাখ্যা সম্ভব। অন্যথায়, কোনও নতুন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংযোগহীনভাবে আরও কিছু নতুন গুণ ও প্রক্রিয়ার অবতারণা করতে হয়, এবং শেষ পর্যন্ত স্ববিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। Motion শব্দটি এখানে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে স্থান পরিবর্তনার্থে গতির পরিভাষা হিসাবে নয়, পরিবর্তনশীলতার বৃহত্তর অর্থে।
দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এঙ্গেলস এখানে তড়িত-বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ার অবতারণা মারফত দেখিয়েছেন যে কেবলমাত্র তড়িৎ-বলের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটির সুসঙ্গত ব্যাখ্যা প্রদান সম্ভব নয়। সম্ভব কেবলমাত্র যদি রাসায়নিক পরিবর্তনশীলতা ও তাপীয় পরিবর্তনশীলতা এবং তাদের পারস্পরিক রূপান্তরের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়। ঠিক যেমন একটি পতনশীল বস্তুর ক্ষেত্রে— প্রথমে অভিকর্ষের বিপরীতে সেটিকে উত্তোলনের যান্ত্রিক গতি, পতনের কালে ভূমি-অভিমুখী গতি এবং পতনের পরে পারিপার্শ্বিকের মধ্যে অপসারী শব্দ ও তাপীয় গতিতে তার রূপান্তর— এই সবগুলি পরিবর্তনশীলতার পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ না করে, শুধুমাত্র অভিকর্ষজ বলের একদেশদর্শী অবতারণা করে কেবলমাত্র পতনের সূচনা ও সমাপ্তির ঘটনা সুসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে সাধারণভাবে তাপ, আলোক, তড়িৎ ও তড়িৎপ্রবাহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নতুন নতুন পদার্থের কল্পনা এসেছে এবং ক্রমান্বয়ে নানান স্ববিরোধিতার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিটিই বস্তুজগতের ভিন্ন ভিন্ন পরিবর্তনশীলতা (motion) ও তাদের রূপান্তরের প্রকাশ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে।
এভাবেই, একদিকে বিজ্ঞানের বৈপ্লবিক জয়যাত্রা, অন্যদিকে ভাববাদের পুনরুজ্জীবনের আয়োজনের মাঝে একদেশদর্শী দর্শনে আক্রান্ত বিজ্ঞানী— এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই দুনিয়া উপনীত হল ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ডা-নে লেখার পটভূমিতে। যখন বিজ্ঞানী তাঁর সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিতে বিজ্ঞানের অগ্রগমনের চেয়ে বৈজ্ঞানিক সত্যের সীমাবদ্ধতাটাকেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখতে শুরু করলেন। আমাদের পরবর্তী পরিচ্ছেদ তা নিয়েই।
ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ: পদার্থবিদ্যা অতীত, না কি ভূতের ভবিষ্যৎ?
এরকম একটা কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে আধুনিক পদার্থবিদ্যার আবির্ভাবের[15] আগের কয়েক দশক একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল শিক্ষিত মহলে যে, পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে আর নতুন করে বিশেষ কিছু জানার নেই। উন্নততর যন্ত্রপাতি এলে শুধু এই ধর্মগুলি আরও সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা যাবে, এই মাত্র। বড় বড় পদার্থবিদরা ঠিক এভাবে সেই সময়ে ভাবছিলেন কিনা তাতে বিলক্ষণ কিছুটা সন্দেহ আছে, তবে কথায় বলে, যা রটে তার কিছু তো বটে। ‘ইতিহাসের অবসান’ তত্ত্বের খলনায়ক যেমন ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা, ‘পদার্থবিদ্যার অবসান’-এর ব্যাপারে হয়তো কিছুটা ভুলভাবেই খলনায়ক করা হয় লর্ড কেলভিনের মত বিরাট মাপের পদার্থবিদকে। তিনি যদিও ঠিক এ কথা বলেননি, কিন্তু এও সত্য যে লর্ড কেলভিন বলেছিলেন যে এরোপ্লেন ওড়ানোর মত আরও কিছু বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এক অসম্ভব কল্পনা। সেটা বলেছিলেন রাইট ভাইয়েরা তা ওড়ানোর মাত্র ৮ বছর আগে। সত্য একথাও যে কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্লাঙ্ককে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ফিলিপ জলি[16] উপরোক্ত যুক্তিতেই পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা চালাতে বারণ করেছিলেন। প্লাঙ্ক যে সে কথা শোনেননি তা তো আজ ইতিহাস। আধুনিক পদার্থবিদ্যার অন্যতম জনক তাঁকে বললেও এতটুকু অতিরঞ্জন হয় না। তবে শুধু প্লাঙ্কই নন, তার আগেও তৎকালীন বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক বড় মানুষই পদার্থবিদ্যার অবসান না স্বীকার করে তার অনিঃশ্বেষ ভাণ্ডারের খোঁজে নিরত ছিলেন। যেমন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। অন্য অনেক বিষয় নিয়ে কাজের পাশাপাশি ১৮৬০-৭০ সাল নাগাদ তিনি কাজ করছিলেন গ্যাসের গতিতত্ত্ব নিয়ে। তিনি একটি বক্তৃতা দেন যা গবেষণাপত্র হিসাবে ছাপাও হয়।[17] অণুর বিন্যাস বোঝার পরেও পদার্থের রহস্যের খাসমহল যে আরও পাকিয়ে উঠছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাবে সেই লেখাটি থেকে কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত করলেই।
In studying the constitution of bodies we are forced from the very beginning to deal with particles which we cannot observe. For whatever may be our ultimate conclusions as to molecules and atoms, we have experimental proof that bodies may be divided into parts so small that we cannot perceive them.
Hence, if we are careful to remember that the word particle means a small part of a body, and that it does not involve any hypothesis as to the ultimate divisibility of matter, we may consider a body as made up of particles, and we may also assert that in bodies of parts of bodies of measurable dimensions, the number of particles is very great indeed. (মোটা হরফ বর্তমান লেখকদের)
ম্যাক্সওয়েলের মত বিজ্ঞানীর পক্ষে এটা বলার কোনও প্রশ্নই ছিল না যে পদার্থের নতুন কিছু ধর্ম আর খোঁজার নেই, কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন যে অজস্র কণাকে দেখতে, শুনতে বা ছুঁতে না পারলেও পরীক্ষা ও তত্ত্বায়নের মাধ্যমে ধরা পড়ছে যে পদার্থের যে প্রতিটি ধর্মকে আমরা পরিমাপ করতে পারছি তার পিছনে রয়েছে অদৃশ্য কণাগুলির কোনও না কোনও ধর্ম; আর আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে সেই অদৃশ্য, অশ্রুত, অননুভূত কণার প্রতিটি নিজেরাও আবার বিভাজ্য ক্ষুদ্রতর আরও অজস্র কণিকায়। পদার্থের ধর্মকে বোঝার লক্ষ্যে বিজ্ঞানের এ এক অন্তহীন যাত্রা। এই বক্তৃতা তথা প্রবন্ধে ম্যাক্সওয়েল তাঁর এই প্রসঙ্গটি অবতারণার কারণও ব্যাখ্যা করেন। গ্যাসের গতিতত্ত্বের সাহায্যে তিনি দেখালেন যে অণুভিত্তিক এই তত্ত্ব আপেক্ষিক তাপের অনুপাতের বাস্তব পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলছে না—
I have now put before you what I consider to be the greatest difficulty yet encountered by the molecular theory.
আগেই দেখেছি যে তৎকালীন ধারণা অনুযায়ী গ্যাসের অণুগুলি ইথার মাধ্যমে গতিশীল। সেই মাধ্যমের সাহায্যে ম্যাক্সওয়েলের বৈজ্ঞানিক সহযোগী আরেক প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী লুদভিগ বোলৎজম্যান এই ফারাককে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওই বক্তৃতায় ম্যাক্সওয়েল দেখালেন যে তাতে সমস্যা আরও বাড়বে বৈ কমবে না। হয়তো কাকতালীয় নয় যে ইথারের উপস্থিতি প্রমাণের লক্ষ্যে একের পর এক পরীক্ষা যিনি করেছিলেন ১৮৮০-র দশক জুড়ে, শেষ পর্যন্ত যা ১৮৮৭-তে এসে উল্টে ইথারকেই নস্যাৎ করে দিল, সেই অ্যালবার্ট মাইকেলসনও কিন্তু ১৮৯৯-এ তাঁর এক বক্তৃতায় বলেন, “পদার্থবিদ্যার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম তথা বিষয়গুলি ইতিমধ্যেই আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, এবং সেগুলির ভিত্তি এতই দৃঢ় যে নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে সেগুলির কোনও ব্যত্যয় ঘটানো প্রায় অসম্ভব।” যদিও তিনি যোগ করেছিলেন যে পরীক্ষায় ধরা পড়ে এমন কিছু কিছু ব্যতিক্রমকে কেন্দ্র করে এর বাইরেও কিছু বিষয় ও নিয়ম আবিষ্কার হতে পারে।[18] কিন্তু তা যেন নেহাতই কথার কথা। অথচ ফাইনম্যান তাঁর বিখ্যাত বই ‘ফাইনম্যান লেকচারস অন ফিজিকস’-এ দেখাচ্ছেন যে প্রায় সেই সময়েই সে-সময়ের আরেক দিকপাল জেমস জিনস[19] গ্যাসের আপেক্ষিক তাপ সংক্রান্ত ম্যাক্সওয়েলের ধাঁধারই নতুন করে পুনরাবৃত্তি করেছেন। ১৮৭০-এর দশকে এঙ্গেলস যখন ডায়ালেকটিকস অফ নেচার কিংবা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি ড্যুরিং-এ বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করছেন তখনও এই সবই যে ঘটে যায়নি[20] তা তো উল্লিখিত সালগুলি দেখলেই বোঝা যায়, কিন্তু ডা-নের শেষ অধ্যায়টির ভিত্তি প্রস্তুতি কিন্তু এই আলোচনার মধ্যেই চলছিল। এঙ্গেলস লক্ষ্য করেছিলেন যে, বিজ্ঞানের এই ধাঁধাগুলির সমাধান যাঁদের করার কথা, পদার্থবিদ্যার সমস্যাগুলি কেমন যেন তাঁদেরই চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। বৈপরীত্যের ঐক্য— যা দ্বন্দ্বতত্ত্বের অন্যতম (এবং প্রাচীনতমও বটে) একটি সূত্র, তা দিয়ে বিজ্ঞানে, এমনকি দর্শনেও যে বিজ্ঞানবিরোধী চেতনার আমদানি হতে পারে— এঙ্গেলস চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন তা এই অধ্যায়টিতে। অধ্যায়টির শিরোনাম Natural Science and the Spirit World, যার তর্জমা করা যেতে পারে “প্রকৃতি বিজ্ঞান ও প্রেতলোক”!
এই অধ্যায়টির শুরুতেই এঙ্গেলস যাঁর নাম টেনে এনেছেন তিনি হলেন আধুনিক বিজ্ঞানের পিতৃস্বরূপ ফ্রান্সিস বেকন। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন মেধাবী ও কৃতবিদ্য দার্শনিক গ্রন্থকারদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ঊনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় মনীষী শ্রী অক্ষয় দত্ত বলছেন যে— “এই ধরনের দার্শনিক গ্রন্থকারেরা অনেকেই সতেজ বুদ্ধির সুপুষ্ট বীজ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। … তাঁদের একটি পথপ্রদর্শকের অভাব ছিল। একটি বেকন— একটি বেকন— একটি বেকন তাঁদের দরকার ছিল। একটি সেইরকম গুরুর অভাবে, তাঁরা মেঘাচ্ছন্ন ও অন্ধকারময় রাতের সময়ে দুর্গম বনাঞ্চলে পথহারা পথিকের মতো চিরজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন।” এঙ্গেলস কিন্তু দেখিয়েছেন বেকনেরও সীমাবদ্ধতা, যে সীমাবদ্ধতা তাঁকে দিয়ে বলিয়েছে “a little philosophy inclineth man’s mind to atheism, but depth in philosophy bringeth men’s minds about to religion.”[21] এঙ্গেলস দেখালেন যে বেকনের কেবল অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতাবাদই উল্টে চিন্তার ক্ষমতাকে ছোট করে ও বড় প্রতিভাধরকেও “প্রত্যক্ষ-আরোহী” (empirical-inductive) তত্ত্বের শূন্যগর্ভ হিজিবিজির মধ্যে আটকে ফেলে, যা তাকে দিয়ে বলায় এই সর্বশক্তিমান তত্ত্বের মাধ্যমে সব পেয়েছির দেশে পৌঁছানো যাবে— পাওয়া যাবে দীর্ঘজীবন, প্রায় পুনর্যৌবন, বাতাসের উপর প্রভুত্ব, ঝড় সৃষ্টির ক্ষমতা, স্বর্ণ সৃষ্টির প্রকরণ।
একটু আগে আমরা যে জেমস জিনস-এর পরীক্ষার কথা আলোচনা করলাম তিনি তো একাধারে ছিলেন পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ গণিতজ্ঞও বটে। সেই জিনস যিনি ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস-এর সভাপতি, তিনি কিন্তু, বেকনের প্রায় তিনশো বছরের পরেও দর্শনের ক্ষেত্রে “প্রেতলোক”-এই বিচরণকারী। কখনও তিনি বলছেন: “The universe begins to look more like a great thought than a great machine. Mind no longer appears to be an accidental intruder into the realm of matter…we ought rather to hail it as the creator and governor of the realm of matter.” আবার কখনও আরও সরাসরি বলছেন: “I incline to the idealistic theory that consciousness is fundamental, and that the material universe is derivative from consciousness, not consciousness from the material universe.” আর পদার্থবিদ্যা আর দর্শনের আন্তঃসম্পর্ক তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বস্তুবাদী তথা বৈজ্ঞানিক অদ্বৈতবাদ[22] ছেড়ে পূর্বোল্লিখিত ভাববাদী অদ্বৈতবাদের[23] পক্ষে সরাসরি ওকালতি করেছেন: “Modern physics has moved in the direction of philosophic idealism. Mind and matter, if not proved to be of similar nature, are at least found to be ingredients of one single system. There is no longer room for the kind of dualism which has haunted philosophy since the days of Descartes.” বাস্তবিকই তাই। শুধু হেগেলেরই মতো জেমস জিনস সবটা দেখলেন হেঁটমুণ্ড হয়ে। ফলে ‘বস্তু থেকে চেতনা’— এই গতিপথকে প্রতিস্থাপিত করল ‘চেতনা থেকে বস্তু’ অর্থাৎ ‘আত্মা থেকে দেহ’। তাই জিনসের কথা না জেনেও এঙ্গেলস এঁদের গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করেছেন বইয়ের দশম অধ্যায়ে।
বস্তুতপক্ষে এই অধ্যায়টি প্রায় ৩০ বছর বাদে লেনিনের লেখা ‘বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ-বিচারবাদ’ গ্রন্থটির পথনির্দেশক। ওই বইটির লক্ষ্য জিনসেরই মতো বড় মাপের যে বিজ্ঞানী ও তাঁর দর্শন — সেই আর্নেস্ট মাখ তুলনায় এঙ্গেলসের অনেক সমসাময়িক। যদিও এঙ্গেলস বেঁচে থাকাকালীন তার বৈজ্ঞানিক প্রতিভার তুলনায় দার্শনিক ‘প্রতিভা’র ততটা উদ্ভাস ঘটেনি। ১৮৬৭ থেকে শুরু করে ২৮ বছর মাখ প্রাগের চার্লস ফার্ডিনান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যার চেয়ার প্রফেসর হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৯৫-এ তিনি যে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন ৪০ বছর আগে, সেখানেই ফিরলেন আরোহী বিজ্ঞানের ইতিহাস ও দর্শনের (History and Philosophy of Inductive Studies) চেয়ার প্রফেসর হিসেবে। ১৮৯৫— এঙ্গেলসের মৃত্যুবর্ষ। হেঁটমুণ্ড হয়ে তাঁর ভূত, নাকি আড়াইশো বছরেরও বেশি পুরনো বেকনেরই প্রত্যক্ষ-আরোহবাদী ভূত— কোনটা যে তাঁর চেয়ারে ভর করল, তা তিনিই জানেন, কিন্তু বাস্তবিকই এরপরে তাঁর মাথায় যেন ভূত চাপল। ১৩ বছর বাদে (১৯০৮) লেনিনের ওঝাগিরি সত্ত্বেও সে ভূত তাড়ানো গেল কিনা সন্দেহ। একটু আগে আমরা আধুনিক পদার্থবিদ্যার জন্মের পিছনে ম্যাক্সওয়েল-বোলৎজম্যানদের গ্যাসের অনুতত্ত্ব থেকে উৎসারিত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের কথা আলোচনা করেছি। আলোচনা করেছি যে অণুর অভ্যন্তরস্থ পরমাণুর যে ইঙ্গিত তাঁদের কাজ থেকে উঠে আসছিল, সে-কথা। অথচ ১৮৯৭ সালে ভিয়েনায় বোলৎজম্যানের এক লেকচারের পরে মাখ ঘোষণা করলেন “আমি এই পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না!” স্বাভাবিক। কারণ অভিজ্ঞতা ও আরোহবাদের সাহায্যে তো পরমাণুতে পৌঁছানো যাচ্ছে না! বহু বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ সেসময় মাখের এই প্রেতলৌকিক চিন্তায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন।[24]
কিন্তু সুখের বিষয়, লেনিনের ওঝাগিরির বছর (১৯০৮) থেকেই ম্যাক্স প্লাঙ্কের মতো বিজ্ঞানীরা এই দর্শনকে খারিজ করতে, বিজ্ঞানবিরোধী বলে চিহ্নিত করতে শুরু করলেন। বস্তুত, যে-সময়ে জিনস বা মাখেরা বস্তুর উপর চেতনা বা সংবেদনের আধিপত্যের এমন প্রচার চালাচ্ছিলেন, ঠিক সেই একই সময়েই, অর্থাৎ এঙ্গেলস মারা যাওয়ার অব্যবহিত পরেই পৃথিবীতে চেতনার বস্তুগত স্বরূপ উন্মোচিত হতে শুরু করেছিল অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে। মস্তিষ্ক তথা স্নায়ুতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ গঠনের রহস্য উন্মোচিত করার জন্য ১৯০৬ সালে শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসাবিদ্যার নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ইতালির ক্যামিলো গলগি ও স্পেনের সান্তিয়াগো রামনি ক্যয়াল। স্নায়ুর মধ্যে যে বিদ্যুৎপ্রবাহের কথা ১০০ বছর আগেই গ্যালভানি ও ভোল্টের গবেষণার মাধ্যমে মানুষ জেনেছিল, সেই বিদ্যুৎপ্রবাহের বিশেষ বৈশিষ্ট্য (action potential) নিয়ে এর পর এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসছিল বিংশ শতকের প্রথম দশকে, বিশেষত জার্মান বিজ্ঞানী জুলিয়াস বার্নস্টাইন ও ফরাসি বিজ্ঞানী লুই লাপিক্যুর গবেষণায়। মনে রাখতে হবে স্নায়ুতন্ত্রের মূল একক নিউরোনও কিন্তু তখনও অদৃশ্য[25]। অথচ রামনি ক্যয়াল-এর অনুপ্রেরণায় বিজ্ঞানীরা তার ধর্ম খুঁজে বেড়াচ্ছেন মাখের প্রত্যক্ষ-বিচারবাদকে শিকেয় তুলে। অথচ তারও প্রায় তিন দশক আগে ডা-নের নবম অধ্যায়ে[26] এঙ্গেলস প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছেন যে মানুষের মস্তিষ্ক বা তথাকথিত সচেতনতা (consciousness) নিয়ে কোনও রোমান্টিকতার বাড়তি জায়গা নেই— প্রাইমেট জাতীয় প্রাণীদেরই মস্তিষ্কের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত রূপ হচ্ছে মানবমস্তিষ্ক[27]। তখন ৫-৬ বছর হয়েছে মাত্র ডারউইনের অরিজিন অফ স্পিসিস-এর প্রকাশ। কিন্তু ইতিমধ্যেই এঙ্গেলস তার সাহায্য নিয়ে মস্তিষ্কের ও চেতনার বস্তুবাদী রূপকে সুসংবদ্ধভাবে প্রকাশ করতে আগুয়ান হয়েছেন— এতটাই ছিল তাঁর বৈজ্ঞানিক দূরদৃষ্টি।
এর পাশাপাশি রাখুন প্রখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়ালেসকে। ইনি ডারউইনেরই সমসময়ে একই তত্ত্ব উপস্থিত করেছিলেন, তার কথা ধরুন, যা ডা-নের দশম অধ্যায়ে এঙ্গেলস নিজেই তুলে ধরেছেন। দেখিয়েছেন যে কীভাবে এমন একনিষ্ঠ এক প্রকৃতিবিজ্ঞানী বস্তুর বিপরীতে চেতনার দাসত্ব করতে গিয়ে লন্ডনের এক ভণ্ড বিরিঞ্চিবাবার ভক্ত হয়েছেন। প্রেত-ভূত-মিডিয়াম-প্লানচেট ইত্যাদি নিয়ে এই উৎসাহ শুধু ওয়ালেসই বা কেন, পাশাপাশি দেখিয়েছেন প্রখ্যাত আরও দুই পদার্থবিদ। একজন উইলিয়াম ক্রুকস, যার আবিষ্কৃত ক্রুকস টিউব, যে সমস্ত আবিষ্কার একটু একটু করে ফিজিক্সের ভোল পাল্টে আধুনিক পদার্থবিদ্যার জন্ম দিচ্ছিল, তার অন্যতম। অন্যজন তো ওই সময়ের বহু পদার্থবিদের পিতৃসম লর্ড র্যালে, জিনসের প্রসঙ্গে যাঁর কথা ইতিমধ্যেই আমরা বলেছি। বড় আশ্চর্য যে, যে ব্রিটিশরা নাকি ভারতবর্ষের অন্ধত্ব আর কুসংস্কার দূর করছিল, তাদেরই অন্যতম শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কগুলি— ক্রুকস, র্যালে, ওয়ালেস, জিনস— বন্ধক থাকছিল ভূত-প্রেতের কারবারে, কুসংস্কারের যূপকাষ্ঠে। বৈপরীত্যের ঐক্য এখানেও। ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় ক্রুকস, যাঁর প্রেতলোকপ্রীতির কথা এঙ্গেলসও লিখছেন, তিনি একজন বিজ্ঞানী হয়ে দাবি করছেন প্রেতদর্শনের, এটা জেনেও যে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ এবং তার জন্য তিনি চশমাও ব্যবহার করতেন না। এমন দৃষ্টিতে প্রেত থেকে শুরু করে যা কিছুই যে মস্তিষ্কে অক্সিপিটাল লোব-এ দর্শন হতে পারে, তা আজ আমরা না হয় ভালোভাবেই বুঝি, কিন্তু ক্রুকসের মতো বড় বিজ্ঞানী কি কিছুই বুঝতেন না? নাকি মস্তিষ্কের রহস্য যতই উন্মোচিত হতে থাকছিল, ততই একদল বিজ্ঞানী চেতনার গুরুত্ব হ্রাসের সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে এই অপবিজ্ঞানের অন্ধকারে স্বেচ্ছায় প্রবেশ করছিলেন, যার পিছনে মদত ছিল ধর্মীয় ভাববাদের বড় বড় পাণ্ডাদের? লর্ড র্যালের মত অত বড় একজন পদার্থবিদের কথাই ধরুন না। ১৯০৪-এ নোবেল প্রাইজ জয়ী এই পদার্থবিদ বলেছিলেন: “I have never thought the materialist view possible, and I look to a power beyond what we see, and to a life in which we may at least hope to take part.”
আর এখানেই ছিল এঙ্গেলসের অবদান— বিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে দেখা এবং বোঝা। এই দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া হাজারো ভণ্ডামি ধরা পড়া সত্ত্বেও ভণ্ড বাবাজিরা যে পার পাবেনই তা এঙ্গেলস দেখিয়েছেন। সঠিকভাবেই তিনি বলেছেন যে এর কারণ হল হাজার একতম কোনও একটি ম্যাজিক বা তথাকথিত অলৌকিকতা এরপরও সবসময়ই থাকবে, যার ফাঁকটুকুই ওই ভণ্ড বাবাজিদের জন্য যথেষ্ট— the existence of falsifications proves the genuineness of the genuine ones. এঙ্গেলসের মৃত্যুর বছর সাতেক পরে কার্ল পপারের জন্ম। বিজ্ঞানের ধুরো ধরে প্রত্যক্ষ আরোহী (empirical inductive) তত্ত্ব যে কীভাবে প্রেততত্ত্বের খপ্পরে গিয়ে পড়তে পারে তা তো এঙ্গেলস দেখেইছিলেন, কিন্তু বৈজ্ঞানিক দর্শনের মাপকাঠি যে falsification-এর নামে আরোহী যুক্তিকেই (inductive logic) নাকচ করতে চলেছে, অবরোহী যুক্তিকে (deductive logic) প্রতিষ্ঠার ছলে, খণ্ডবাদকে (reductionism) নাকচের নাম করে, সমগ্রতাই (Gestalt or Holism) বিজ্ঞানের প্রকৃত দর্শন ইত্যাদি আউড়ে বিজ্ঞানের মূল পদ্ধতিটিকেই হেয় করার খেলায় নামতে পারে তাও কি তিনি তখনই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন?
পূর্ববর্তী একটি পরিচ্ছেদে (তৃতীয়) আমরা এঙ্গেলসের একটি বাক্যকে মোটা হরফে দিয়েছিলাম, যেখানে তিনি প্রাচীন গ্রিসের প্রকৃতিদর্শনের প্রতিতুলনায় আধুনিক প্রকৃতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বলছেন— “in our case the result of strictly scientific research in accordance with experience.” প্রকৃতির অনড়-অটলত্বকে প্রমাণ করতে ভাববাদ যখন অভিজ্ঞতাবাদ/প্রত্যক্ষ বিচারবাদের রাস্তা ধরল, মানুষের অনুভূতির অনড়-অটলত্ব দিয়ে প্রকৃতির পরিবর্তনশীলতাকে নস্যাৎ করার ঘুরপথ ধরল, তখন খোড বেকনকেই উল্লেখ করে যে এঙ্গেলস এই বিপজ্জনক প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন করে দিতে চেয়েছিলেন তা আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি। পরবর্তীকালে মাখের দর্শনের বিরুদ্ধে লেনিনের সংগ্রাম এবং সেইসঙ্গে আইনস্টাইন-প্ল্যাঙ্ক প্রমুখ প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর একই অবস্থান গ্রহণ ভাববাদের প্রচারে ভাঁটা আনে। বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামও পাশাপাশি শক্তিশালী হয়। বুর্জোয়ারা প্রমাদ গোনে। নতুন করে তাই ভাববাদের পুনরুজ্জীবনের আয়োজন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে পরেই। এবার উল্টো রাস্তা। পর্যবেক্ষণ-সর্বস্বতার বদলে পর্যবেক্ষণ-নস্যাতীকরণ। কোনও তত্ত্বেরই মূল্য নেই, কারণ নতুন এক পর্যবেক্ষণ এসে তাকে করে দিতে পারে মূল্যহীন। তত্ত্ব যেন থাকে সদাই ভয় কাঁটা হয়ে। এটাই নাকি বিজ্ঞান। ১৯৩৪ সালে কার্ল পপারের এক লেখাকে ধুলোটুলো ঝেড়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা শুরু হল যার আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হল আরোহী যুক্তি (inductive logic)-র ওপর। Falsification শুধু তার চটকদারি মোড়ক যা বুর্জোয়া সমাজের হৃদয়ে দোলা দিল। Falsify theory, falsify science, falsify ideology, ফলে স্বভাবতই End of History। প্রচার করা হল এতদিনে এসে গেছেন বিজ্ঞানের প্রকৃত দার্শনিক। আর পপারের ভাঁড়ারে তো রয়েইছে ক্ষয়িষ্ণু বুর্জোয়াদের খুশি হওয়ার মতো আরও লেখাপত্র— The Poverty of Historicism, অর্থাৎ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হটাও; কিংবা The Open Society and its Enemies, অর্থাৎ সমাজতন্ত্র হটাও। সমস্যাটা গভীর। কারণ মাখ যেভাবে সমাজতন্ত্রের শিবিরকে বিভ্রান্ত করেছিলেন, পপার যা করেছেন তা তার বেশি বৈ কম নয়। আরোহী যুক্তির সমস্যা নিয়ে সহস্রাধিক বছর ধরেই দার্শনিকরা আলোচনা করছেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক পীরো[28] কিংবা প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক চার্বাক এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য। এই সমস্যাগুলির একটি সুসংবদ্ধ রূপ অষ্টাদশ শতকে হাজির করেন ব্রিটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম। এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন রাসেলও। কিন্তু Empiricism বা Positivism-এর যুগে induction-কে যুক্তিকাঠামো হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই অষ্টাদশ শতকে ছিল না। এ সুযোগটা পপারের জন্য তৈরি করে দিলেন মাখ। অতএব, “চার্বাকবাদী”, “এঙ্গেলসবাদী” ও “লেনিনবাদী”, এককথায় “বস্তুবাদী” পপার উঠে পড়ে লাগলেন এই আরোহী যুক্তিকাঠামোটিকেই বিজ্ঞানের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসন দিতে, এবং এভাবে চার্বাক, এঙ্গেলস, লেনিন এবং বস্তুবাদ— সবগুলিকেই কবরে পাঠাতে। বস্তুবাদীদের পপারে গদগদ হওয়া দেখে মনে হচ্ছে সে কাজে তিনি আপাতত সফলই হয়েছেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আরোহী ও অবরোহী উভয় যুক্তিকাঠামোকেই ব্যবহার করে। মাখের মতই পপার চেয়েছিলেন একটিকে খোঁড়া করে দেবেন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান আবার তা হতে দিচ্ছে কই? Statistical Mechanics আর thermodynamics— এর মধ্যে একটিকে বাদ দিতে পারছেন কি পদার্থবিদরা, নাকি কণাবিজ্ঞান থেকে মহাজাগতিক কৃষ্ণগহ্বর— সর্বত্রই এই দুটি পদ্ধতিরই গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে? গণকবিজ্ঞানী (computer scientist)-রা কি পারছেন top-down আর bottom-up— এই দুই পদ্ধতির কোনও একটিকেই বেছে নিয়ে এগোতে? স্নায়ুবিজ্ঞানী (Neuroscientist)-রা কি পারছেন Neurophysiology-কে বাদ দিয়ে Neuropsychology বা এমনকি Functional MRI-কেই সর্বেসর্বা করে তুলতে? নাকি হতভাগ্য অর্থনীতিবিদরাও পারছেন কেবলমাত্র Macroeconomics দিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের হাবুডুবু খাওয়া থেকে বাঁচানোর দাওয়াই দিতে? আর দার্শনিক ও গণিতবিদদের ক্ষুদ্র হলেও একটা অংশ যে ইতিমধ্যেই দ্বান্দ্বিকতাকে যুক্তিকাঠামোর একটি অঙ্গ করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন, সেকথা আমরা আগেই বলেছি।
শেষের কথা
প্রায় দেড়শো বছর আগের এঙ্গেলসের এই অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটি আবার খোলার বা পড়ার প্রয়োজন কী? বিশেষত এটা যখন জানাই যে আধুনিক বিজ্ঞান এঙ্গেলসের যুগ থেকে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। এবং এঙ্গেলস এই রচনায় যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক ধারণা ও সত্যের উল্লেখ করেছেন সেগুলি অধিকাংশই হয় বাতিল না-হয় আধুনিক কালে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এই বইটির নবম ও দশম অধ্যায় এঙ্গেলসের মৃত্যুর পরে পরেই স্বতন্ত্রভাবে আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। সব মিলিয়ে সত্যিই কি এই দশটি অধ্যায়ের সেই গুরুত্ব আজ আর রয়েছে?
এ-প্রশ্নেরই উত্তর আসলে আমরা খুঁজেছি, সাধ্যমতো দিয়েছি বর্তমান লেখাটি জুড়ে। বিজ্ঞানকে সাথী করে বুর্জোয়াশ্রেণি সামন্তসমাজ অবসান ঘটানোর লড়াইয়ে নেমেছিল। বিজ্ঞানের ব্যাপকতম প্রয়োগ ও বিকাশের মধ্য দিয়েই শেষ পর্যন্ত সমাধা হয়েছিল বুর্জোয়া বিপ্লব। এর ফলেই আবার সে খুঁড়ল নিজের কবরও। প্রকৃতি মানেই নিরন্তর পরিবর্তনশীল বস্তুজগৎ (matter in motion)— সামন্তসমাজকে ভাঙতে গিয়ে এই যে প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত হল, তা আজ এক সর্বব্যাপী চেহারা নিয়েছে বিজ্ঞানের জগতে। এ বোঝাতে আর জল থেকে বাষ্পে ভৌত/অজৈব পরিবর্তন বা জন্ম-মৃত্যুর জৈবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিমাণ থেকে গুণগত রূপান্তর, বৈপরীত্যের ঐক্য বা নেতির নেতিকরণকে ব্যাখ্যা করে দ্বন্দ্বতত্ত্ব বোঝানোর খুব প্রয়োজন হয় না। এঙ্গেলস যে ভাষায় কান্ট ও ল্যাপলাস দ্বারা আলোকিত হয়ে সূর্যের অভ্যন্তরীণ গতিময়তা (motion) ব্যাখ্যা করেছেন— “the conflict of heat with gravity— ঠিক সেই ভাষায় না হলেও, বহির্মুখী বিকিরণের চাপ এবং অন্তর্মুখী মহাকর্ষজ চাপই যে সূর্য সহ সমস্ত তারকার স্থিতিস্থাপক গতিশীলতাকে ব্যাখ্যা করে, এরই একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে শেষ অবধি কৃষ্ণগহবর তৈরি হতে পারে, যে গহ্বরও অনড়-অটল নয়, সেখানেও চলে পরিবর্তন, ঘটে বিকিরণ[29]— এসব সম্বন্ধেই বর্তমান বিজ্ঞানীরা অবহিত। Ape to Man[30]— এই ভাষায় না হলেও অপাপের প্রাইমেট থেকেই যে সাধের মনুষ্যজন্ম তা নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের কোনও মন্ত্রী মহাশয়ের সন্দেহ থাকলেও[31], বিজ্ঞানীরা এখন এমনকি সাড়ে সাঁইত্রিশ কোটি বছর আগে যে মৎস্য অবতার ভূপৃষ্ঠে পদধূলি দিয়ে আমাদের আরও অনেক পুরাতন এক পূর্বসূরি বনেছেন, তারও ঠিকুজি-কুলুজি বার করে ফেলেছেন[32]। আর সর্বোপরি, গোটা মহাবিশ্বটা নিজেই নাকি ক্রমেই প্রসারিত হয়ে চলেছে, এবং আরও আরও বেশি গতিবেগ নিয়ে। স্থিতাবস্থার কফিনে পেরেক পড়তে এরপর আর কোনও পেরেক বাকি থাকল কি?
ফলে যতই চেষ্টা চলুক, বিজ্ঞান সেদিন যেমন উদীয়মান শাসক বুর্জোয়াশ্রেণির হাতিয়ার হয়েছিল সামন্তবাদকে ধ্বংস করার কর্মযজ্ঞে, আজকের বিজ্ঞান আরও অনেক শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে উদীয়মান শাসক শ্রমিকশ্রেণির জন্য পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে মানবসভ্যতা ও বিশ্বপ্রকৃতিকে রক্ষা করার কর্মযজ্ঞে। ভাববাদের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে, ধর্ম-বর্ণ-প্রাদেশিকতা-উগ্র জাতীয়তার মাধ্যমে সর্বহারাশ্রেণিকে সাময়িক বিভ্রান্ত করা যেতে পারে, শাসনক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে রাখা যাবে না। এই দশটি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে এঙ্গেলস প্রকৃতিজগতের নিরন্তর পরিবর্তনের ব্যাখ্যার দৃষ্টিভঙ্গি; মানবসমাজের বিবর্তনে হস্ত ও মস্তিষ্কের যুগপৎ বিকাশ[33]; ও শেষপর্যন্ত ভাববাদে পুনরুজ্জীবন দ্বারা মানবসমাজের অবধারিত গতিকে আটকানোর প্রয়াস— এই যে প্রসঙ্গগুলি তুলে ধরেছেন, ভাবাদর্শগত বা রাজনৈতিক দিক থেকে আধুনিক তত্ত্ব গঠনের আলোচনায়, কি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, কি সামাজিক ক্ষেত্রে, তার প্রাসঙ্গিকতা রয়ে গেছে অমলিন। জন্মদ্বিশতবর্ষে ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকে আমাদের প্রণাম।
- এডুয়ার্ড বার্নস্টাইন
- সম্ভবত প্রথম নিউরোসার্জেন
- প্রখ্যাত দার্শনিক দিদেরোর বন্ধু ও সহযোগী
- অর্থাৎ ফরাসি-জার্মান বুর্জোয়াদের
- অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
- জেমস হাটন, ১৭২৬-১৭৯৭
- এককোষী প্রাণীজগত
- এখানে উল্লেখ্য যে শ্রী অক্ষয় কুমার দত্ত এবং পরবর্তীকালে শ্রী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে গ্রিসে যেমন থ্যালিস-এপিকিউরাস-হেরোক্লিটাস প্রমুখ মহর্ষিরা, তেমনি প্রাচীন ভারতে মহর্ষি কপিল, পতঞ্জলি, কণাদ, গৌতম, জৈমিনি প্রমুখরা বস্তুবাদের সপক্ষে বহু brilliant intuition-এর পরিচয় ভারতীয় ষড়দর্শনে রেখে গেছেন।
- আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে অবশ্য এই শিরোনামটি তড়িচ্চুম্বকত্ব হওয়াই বাঞ্ছনীয়
- প্রাচীন গ্রিক বা ভারতীয় দার্শনিকদের brilliant intuition-এর সঙ্গে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানচর্চার যেখানে তফাত
- motion— এঙ্গেলসের ব্যবহৃত ভাষা
- কার্ল নিউম্যান— জার্মান গণিতবিদ
- গুস্তভ ভিদেম্যান— জার্মান পদার্থ ও রসায়নবিদ
- Paraconsistent logic— Standard Encyclopedia of Philosophy
- অর্থাৎ পরমাণুর অভ্যন্তরের রহস্য যে সময় থেকে উদঘাটিত হতে শুরু করে
- তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৫৪ সালে তড়িৎবিদ্যায় ওহম সূত্র খ্যাত গিয়র্গ ওহমের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন
- On the Dynamical Evidence of the Molecular Constitution of Bodies, Vol 28: 493-508, 1975
- এ এ মাইকেলসন (১৯০২), “লাইট ওয়েভস অ্যান্ড দেয়ার ইউজেস”, দ্য ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস
- যিনি পরে লর্ড র্যালের সঙ্গে একত্রে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের সূত্রায়ন করেন
- বিশেষত আধুনিক পদার্থবিদ্যার আবির্ভাব হয়নি
- বেকনের প্রবন্ধাবলি, ১৬২৫
- অর্থাৎ বস্তুজগৎ থেকেই চেতনার জন্ম
- অর্থাৎ চেতনাই অক্ষয়, তা জন্ম দেয় বস্তুর
- অর্থাৎ ধরাছোঁয়ার বস্তুজগৎ মুখ্য নয়, ধরাছোঁয়াটাই মুখ্য—বস্তু নয়, সংবেদনই প্রধান। বস্তু হল শেষ বিচারে কতগুলি সংবেদন-সমষ্টি মাত্র
- ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের আবিষ্কার হয় অনেক পরে
- এটিও মূল বইটির মতোই অসম্পূর্ণ
- Chapter 9 : The part played by labour in the transition from ape to man
- Pyrrho— 4th century B.C.
- Hawking Radiation
- ডা-নের নবম অধ্যায়
- ইনি ঘোষিতভাবে স্বদেশপ্রেমী হলেও কণাদমুনিকে ছেড়ে আর্নেস্ট মাখের ভক্ত, কারণ মাখের মতোই ইনি মনে করেন যে আমার অভিজ্ঞতায় পরমাণু নেই, অতএব পরমাণুই নেই
- Neil Shubin, “Your Inner Fish”, Penguin Books
- যা ব্যাখ্যাত হতে পারে experiment ও theory কিংবা আরোহী ও অবরোহী যুক্তিকাঠামোর ভাষাতেও
অত্যন্ত সুচিন্তিত ও যুক্তিসঙ্গত লেখা। সমৃদ্ধ হলাম।