সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
লেখক চলচ্চিত্রবেত্তা, শিক্ষক, গদ্যকার, সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার
ষাট দশকের মাঝামাঝি জঁ লুক গদারের মতো প্রতি-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যখন ঈষৎ শ্লেষের সঙ্গে বলেছিলেন— একটা ফিল্ম বানাতে যা আপনার দরকার, তা হল একটি বন্দুক ও একটি তরুণী। বাণিজ্য সিনেমা ও পৌরুষের প্রতি তাঁর এই যে তাচ্ছিল্য তা কি জেমস বন্ড ও তার অভিনেতা শন কনারির দিকে একটি বক্রোক্তি?
ইতিহাসের দ্বারা নির্বাচিত যেকোনও উচ্চারণই কিংবদন্তী হয়ে উঠতে পারে— এরকম মনে করতেন ফরাসি মনস্বী রঁলা বার্ত। আর জেমস বন্ডের ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব বিশেষভাবে খেটে যায়৷ আমরা যে শন কনারিকে দেখি, তাতে দেখা যায় যে শন কনারি শুধু যে জেমস বন্ড চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে স্মরণীয় তা নন, বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে হলিউডে এবং হলিউদের বাইরেও তিনি কাজ করেছেন, ‘আনটাচেবলস’ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে জিতে নিয়েছেন অস্কার, এমনকি ১৯৬৪ সালে স্বয়ং আলফ্রেড হিচককের সঙ্গে তাঁর ছবি ”মার্নি” (Marnie)-তেও কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, এই ছবি করতে গিয়ে শন যথেষ্ট ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কারের পরিচয়ও দিয়েছেন— হিচককের চিত্রনাট্যও পড়তে চেয়েছেন, যে কাজ ক্যারি গ্রান্টও করেননি। হিচককের প্রতিনিধি তাঁকে এই তথ্য জানালে শন এটাও বলতে সাহস পেয়েছেন, “আই অ্যাম নট ক্যারি গ্রান্ট। আমি আমিই। এইরকমই।”
এই সাহসের পরিচয় নিঃসন্দেহে যেকোনও সক্ষম চরিত্রাভিনেতার অহঙ্কার, কিন্তু তাও শন কনারি জেমস বন্ড চরিত্রটির সঙ্গে অভিন্নহৃদয় হয়ে গেলেন কেন? দেখা যাবে যে ইতিহাসের এক প্রণয়কটাক্ষে তিনি সায় দিতে পেরেছিলেন। এটা শুধুমাত্র তাঁর ছ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতা বা এমন রোবট-প্রতিম সৌন্দর্যের জন্য নয়। সেটা এমন এক মুহূর্ত যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পুঁজিবাদ তাদের নিজেদের মনের মতো একটি আইকন চাইছিল। এই ইমেজ নির্মাণের প্রক্রিয়া যদি আমরা আরেকটু মন দিয়ে দেখি তাহলে দেখতে পাব যে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির সঙ্গে শন কনারির কী আশ্চর্য মিল! এবং এও এক ঐতিহাসিক সমাপতন যে ‘বে অফ পিগস’ বা মিসাইল সঙ্কটে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আলোড়িত হচ্ছে, ঠিক তখনই ‘ড. নো’ ছবিতে জেমস বন্ড হিসাবে শন কনারির আবির্ভাব। দুনিয়া তখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিনারায়। কেনেডি-ক্রুশ্চেভ একেবারে মুখোমুখি। তখন এই কল্পিত জেমস বন্ড কে? কোনও সন্দেহ নেই, ডন কিহোতে বা পরবর্তীকালের রবিনসন ক্রুশোর মতো জেমস বন্ডও একটি অনুমিত চরিত্র। আর এই বন্ড কোনও গোয়েন্দা নন, একজন স্পাই, গুপ্তচর। আমাদের বাংলাভাষার চরিত্রগুলির সঙ্গে যদি তুলনা করার চেষ্টা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে জেমস বন্ড ব্যোমকেশ বা ফেলুদা নয়, কারণ গুপ্তচরবৃত্তি ফেলুদা বা ব্যোমকেশের মধ্যবিত্ত পরিধিতে সম্ভব ছিল না, বরং ঘনাদার সঙ্গে বন্ডের সামান্য হলেও মিল আছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুপ্তচরবৃত্তি ঘনাদার পক্ষে দু-একবার সম্ভব হয়েছে বটে, কিন্তু ঘনাদা একান্তই বাঙালি, ভোজনরসিক এবং মোটেই বন্ডের মতো সুদর্শন নন। যৌনতাও তার খাদ্য ছিল না। অন্যদিকে জেমস বন্ড হিসাবে শন কনারি ছিলেন ‘সেক্সিয়েস্ট ম্যান অ্যালাইভ’ যাঁকে পুঁজিবাদী সভ্যতা যৌনতার শিখরবিন্দু মনে করে৷ এই জেমস বন্ড-ই স্বর্ণকেশিণী সুন্দরীকে সমুদ্রতীরে স্তনোচ্ছাসের মধ্যে যেভাবে আবিষ্কার করেন, তাতে পুঁজিবাদ মুহূর্তের জন্য একটু স্বস্তি পায়। সেই স্বস্তিটা কী? স্বস্তিটা হল এই যে জেমস বন্ডের যখন উদয় হচ্ছে, ব্রিটিশ সূর্য তখন অস্তাচলগামী। সুয়েজ সঙ্কটের পরে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে ব্রিটেন ঠান্ডা লড়াইয়ে মস্কো বনাম ওয়াশিংটনের মধ্যে দ্বৈরথে কোনও অংশ নিতে পারে না। তাহলে তারা কী পারে? এই ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের মতো অর্থাৎ বাঙালিদের মতো। বাঙালি যেমন সর্বহারা হয়েও, সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়েও ভেবে চলে যে তার মস্তিষ্ক আছে, সংস্কৃতি আছে, ব্রিটেনও তেমনি এই নির্মিত সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টের মধ্যে আবিষ্কার করে বিশ্বনিয়ন্ত্রণের শক্তি। ব্রিটেনের রাজগরিমা যখন আর নেই, রানির সাম্রাজ্যে সূর্য অস্তমিত হয় না— একথা যখন আর প্রামাণ্য নয়, গ্রেট ব্রিটেন যখন লিটল ইংল্যান্ড হয়ে গেছে, এমন একটা সময়ে জেমস বন্ড ব্রিটিশ অহঙ্কারের প্রতীক হিসেবে বিশ্বরাজনীতিতে বিরাজ করেন। ইয়ান ফ্লেমিং ব্রিটেনকে জেমস বন্ডের মাধ্যমে এক লুপ্ত রূপকথা উপহার দিলেন। উত্তর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যায়ে যে ভোগবাদী সংস্কৃতি প্রবর্তিত হল, সঙ্গে নিয়ে এল ‘সোসাইটি অফ স্পেকটাকল’ বা ‘দৃশ্যের কুচকাওয়াজ’, জেমস বন্ড কী আশ্চর্যজনকভাবে নিজেকে এর সঙ্গে জুড়ে দিতে পারলেন! আমরা যদি ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’ ছবিটি দেখি, সেখানে জেমস বন্ডকে বলা হচ্ছে ‘It is with an image she has fallen in love. He is like the image.’ অর্থাৎ জেমস বন্ড শুধু এক ব্যক্তি নায়ক নন, তিনি এক ইমেজ, সুন্দরীরা যার প্রেমে পড়ে এবং যিনি স্বয়ং সঙ্কটমোচন। এই ইমেজটা তাহলে কার ইমেজ? শন কনারি কেন এই ইমেজ নির্মাণে এত সফল হলেন? তার কারণ ইয়ান ফ্লেমিং বন্ড হিসেবে যে ছবি ভেবেছিলেন তা একটু ব্রিটিশ আভিজাত্যময়। অন্যদিকে শন কনারি জনসাধারণের মধ্যে থেকে উঠে আসা মানুষ। বরং সেই আভিজাত্য পরবর্তী জেমস বন্ড অভিমেতা রজার মুরের মধ্যে ছিল। কারণ রজার মুর টেলিভিশন সিরিয়ালে যে রোলটি করতেন, তাতে তাঁর চরিত্রটা ছিল ‘জেন্টলম্যান আউট-ল’ বা ভদ্রসমাজে উচ্ছন্নে যাওয়া একটি চরিত্র। বেলজিয়ান উদ্বাস্তু এরকুল পোয়ারোর মতোই শন কনারিও ব্রিটিশ নন, তিনি ছিলেন স্কট। স্কচ হুইস্কির পর এই স্কটিশ ভদ্রলোকের নামই সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছে ইংল্যান্ডে। পাশাপাশি এটাও মনে রাখার যে ব্রিটেনের যে পুলিশ মুখ্যালয় তার নামও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। এই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর অবসিত গরিমাকে নতুন উত্থান দিতে পেরেছিলেন শন কনারি তাঁর জেমস বন্ড চরিত্রটির মাধ্যমে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক টেনশন যা ষাটের দশকে হাভানা সঙ্কটের সময় চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করেছিল, সেই দোলাচলে কিছুটা হলেও স্থিতাবস্থা আনতে সক্ষম ব্রিটেন— ব্রিটেনের জনগণের মনে এই কল্পিত অহঙ্কারবোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল শন কনারির জেমস বন্ড। শন কনারির নিষ্পাপ সৌন্দর্য, যেন ‘একহাতে মম বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’-এর মতোই এক হাতে ছিল পিস্তল, অন্য হাতে সুন্দরী রমণী— এই দৃশ্য অস্তাচলে চলে যাওয়া ব্রিটিশ মানসে কিছুদিন সোনা ছড়ায়৷ এসব কারণেই জেমস বন্ড ফ্র্যাঞ্চাইজিতে পরবর্তীতে আরও অনেক সুপুরুষ নায়ক অভিনয় করা সত্ত্বেও এই চরিত্রটি শন কনারির সঙ্গেই একাত্ম হয়ে রইল। শন ওই চরিত্রে ১৯৬২-তে ‘ড. নো’ থেকে শুরু করে ১৯৮৩-তে ‘নেভার সে নেভার এগেইন’ পর্যন্ত মোট সাতবার অভিনয় করেছেন, এবং প্রত্যেকেবারই তিনি একজন কমনার বা সাধারণ মানুষকে বিশ্বত্রাতার পর্যায়ে তুলে নিয়ে গেছেন। সেই মুহূর্তে ব্রিটেনের সেটা দরকার ছিল এবং তারই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মহারানি এলিজাবেথ শন কনারিকে ২০০৩ সালে নাইটহুডে ভূষিত করেন।
ইয়ান ফ্লেমিং প্রথমে শন কনারিকে পর্দায় চাননি তাঁর জেমস বন্ড হিসাবে, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি কনারির কাজে এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েন যে এরপরের জেমস বন্ড উপন্যাসগুলিকে তিনি শন কনারির ছায়াতেই লেখেন। কনারির প্রথম জেমস বন্ড সিনেমার সাফল্যের পর ইয়ান ফ্লেমিং তাঁর পরবর্তী উপন্যাস ‘ইউ অনলি লিভ টোয়াইস’-এ জেমস বন্ডের বাবাকে যে স্কট করে তুলেছিলেন, তাও এক অর্থে শন কনারির প্রতি ফ্লেমিং-এর শুভেচ্ছা ও স্বীকৃতি।
পাশাপাশি আমাদের ভুললে চলবে না যে জেমস বন্ড শুধু ব্রিটেনের সম্পত্তি নন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও। কারণ বন্ড ছবিগুলি তৈরি হচ্ছে খোদ হলিউডে। ষাট দশকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ঘোর বিপন্ন, লাতিন আমেরিকার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, ভিয়েতনাম সঙ্কট অদূরে, মার্কিন সীমানার থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে কিউবা মুক্ত হয়েছে, ঠিক তখনই মার্কিন সমাজ চাইছিল এমন এক ব্যক্তিকে যিনি মার্কিন মানসকে সমস্ত সঙ্কট থেকে উদ্ধার করতে পারেন। এর রাজনৈতিক রূপ জন এফ কেনেডি— সুদর্শন, দীর্ঘকায় এবং মনরো-প্রণয়ী। পর্দায় তারই সিনেম্যাটিক প্রতিরূপ হচ্ছেন জেমস বন্ড ও শন কনারি। কেনেডি হত্যার পর সেই ভূমিকায় আসেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন। এই কেনেডি-লিন্ডন যুগ ও পর্দায় কনারির জেমস বন্ড প্রায় সমার্থক, যার উল্লেখ জাঁ লুক গদারের মধ্য ষাটের ছবি ‘ম্যাসকুলাঁ ফেমিনাঁ’-তেই আসবে। সেখানে এক যুবক ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী আমাদের জানান যে যুগটা ভিয়েতনাম ও জেমস বন্ডের। অবশ্য ভিয়েতনামে আমেরিকার বিপর্যয়ের পর বন্ডের এই ভূমিকাও ধীরে ধীরে অস্তমিত হয়, হলিউড তার জায়গায় নিয়ে আসে র্যাম্বোকে যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরাজয়ের ক্ষত নিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সুকৌশলে রাজনৈতিক হৃতগৌরব ফিরিয়ে দিতে চায়।
একইসঙ্গে আমরা জেমস বন্ডকে মনে রাখব ষাটের দশকে মার্কিন ভোগবাদের সংস্কৃতি তার পোস্টার বয় হিসাবে। নারী ও তার শরীরের পণ্যায়ণকেও চূড়ান্ত রূপ দিতে পেরেছে এই ছবিগুলি। যে নারী পুরুষের সম্মুখবর্তী বা পাশাপাশি থাকতে পারত, শন কনারির বন্ড তার নীল কটিতটের দিকে তাকিয়ে নিতান্ত ক্রীড়াপুত্তলিকা বানিয়ে তাকে পশ্চাৎবর্তী করে তুলল। এই বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন উমবের্তো একো ও টনি বেনেট। ইয়ান ফ্লেমিং-এর সৃষ্ট এই জেমস বন্ড চরিত্রটিকে তাত্ত্বিকদ্বয় প্লে সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে ধরতে চেয়েছেন এবং তাঁরা দেখিয়েছেন রাশিয়ানদের জন্য যেমন দাবা, ইংরেজদের জন্য যেমন ফুটবল যেখানে ফুটবল খেলাটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একজন ফুটবলারের চরিত্রে অভিনয় করতে পারা, অর্থাৎ বাস্তবতার চাইতেও গুরুত্বের হল বাস্তবতার পারফরম্যান্স, ঠিক তেমনি পুঁজিতন্ত্রের নির্দিষ্ট করে দেওয়া জেমস বন্ড চরিত্রে শন কনারির প্রত্যাশামাফিক অভিনয় ও প্লে সিচুয়েশনে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া— নিঃসন্দেহে শন কনারির এক অবিশ্বাস্য শীর্ষারোহন। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে রজার মুর বা অন্যান্য যারা পরবর্তীকালে এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তারা যোগ্যতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন, কিন্তু কেউই শন কনারির মতো জেমস বন্ডের প্রাসঙ্গিকতা স্পর্শ করতে পারেননি। জেমস বন্ড হিসেবে শন কনারির সাফল্য এটুকুই যে বিবদমান ন্যাটো আর ওয়ার-শ ব্লকের ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্যে তিনি ব্রিটেনকে এক কাল্পনিক বিশ্বনিয়ন্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। ০০৭ যে ষাটের দশকের এক আইকনিক মুহূর্ত হয়ে রইল তার কারণ পুঁজিবাদের রুগ্ন নিঃশ্বাস জেমস বন্ডের মধ্যে দিয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে চেয়েছিল। আর সেই প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর্বে শন কনারিই ছিলেন প্রতিমাশিল্পী।
অসাধারণ বিশ্লেষণ।