অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী
বস্তার সম্ভাগ, রাজ্য ছত্তিসগড়, দেশ ভারত। ১৯৯৮ সাল অবধি মূলতঃ আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা বস্তার ছিল ভারতের সর্ববৃহৎ জেলা। আয়তনে কেরালার চেয়েও বড়ো। বর্তমান বস্তার সম্ভাগ সাতটি জেলার বিভক্ত-– কাঙ্কের, নারায়ণপুর, বীজাপুর, সুকমা, দান্তেওয়াড়া, বস্তার এবং কোণ্ডাগাঁও। মোট জনসংখ্যা কম বেশী ৪০ লক্ষ, যার মধ্যে ৩০ লক্ষ আদিবাসী-– কোয়া বা কৈতর, অর্থাৎ ৭৫০টি টোটেমে বিভক্ত ‘গোণ্ড’ আদিবাসী। বস্তার ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা-– মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলী, ওড়িশার মালকানগিরি ও অন্ধ্রের কিছু অরণ্য-পাহাড়-আবৃত অঞ্চল-– সব মিলিয়ে ‘দণ্ডকারণ্য’। নামের উৎস সুপ্রাচীন শবর ভাষার শব্দ ‘জল’। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস ঘাঁটলে সমগ্র গোণ্ডওয়ানা অঞ্চলের কালচারাল কন্টিনিউইটির মধ্যেই পাওয়া যায় এই দণ্ডকবনের হিসেব।
আধুনিকতার হিসেব ভিন্নতর। বস্তার সম্ভাগের মাটির নীচে গোটা দেশের আকরিক লোহার এক পঞ্চমাংশ থরে থরে সাজানো। রয়েছে বক্সাইট, লাইমস্টোন, ইউরেনিয়াম। তাই আজ বস্তারের উপর নকশাল-দমনের অভিপ্রায়ে যে বিপুল সামরিক আয়োজন, এর পিছনে রাষ্ট্রের নিহিত উদ্দেশ্য আঁচ করে নিতে সময় লাগে না। আশির দশকের শেষপাদ থেকে বস্তারে জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর প্রসার ঘটতে থাকে। টনক নড়তে এক দেড় বছর লেগে যায় রাষ্ট্রের। নেমে আসে প্রতিবিপ্লবী অগ্রাসন। ২০০৫ সালে শুরু হয় ‘সলওয়া জুড়ুম’-– গ্রাম কে গ্রাম উজার হয়ে যায় এই ‘প্রাইভেট’ সামরিক প্রতিবিপ্লবী বাহিনীর তাণ্ডবে। তারপর ২০০৮ সালে শুরু হয় অপারেশন গ্রীন হান্ট। মোতায়েন হতে থাকে শ’য়ে শ’য়ে রাষ্ট্রপুলিশের ফৌজ, ব্যাটেলিয়ন। আগ্রাসনের ধরণ ও রকম পালটায়। পালটায় না অবাধ খুন, জখম, ধর্ষণ, গৃহদাহ, ছাড়খাড় হতে থাকা আদিবাসী জীবন, যাপন, বাস্তুতন্ত্র ও কৌমচেতনা। আজ আমরা দেখি বস্তারে ১ লক্ষের কাছাকাছি ফৌজ টহল দিচ্ছে-– সি-আর-পি-এফ, বি-এস-এফ, আই-টি-বি-পি, সশস্ত্র সীমা বল, রাজ্যপুলিশের স্পেশালি ট্রেনড ফোর্স, জেলাস্তরে ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গ্রুপের আদিবাসী পুলিশ। আবার রাওঘাট-এর মতো কিছু জায়গায় শুনি ফৌজের বড়কর্তা ও মাইনবাবু একযোগে বলে উঠছে-– মাইন বসানোর পথ মসৃণ করতেই তাদের মোতায়েন।
এই দুঃস্বপ্নে ছেয়ে থাকা অঞ্চলের যে নিজস্বতা রয়েছে, এখানকার গোণ্ড আদিবাসীদের যে ইতিহাস, সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, ধর্ম-পরম্পরা, নিজস্ব শিক্ষা ও স্বশাসন-ব্যবস্থা-– এই সব কিছুতেই কোপ পড়েছে, ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। আসুন, এই অবক্ষয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা চিনে নিই বস্তারকে, বস্তারের মানুষদের। আসলে ‘রেড করিডোর’ নামক গালভরা পরিচিতির আড়ালে যদি আমরা খুঁজি, চাপা পড়ে যায় প্রাচীন প্রাজ্ঞ সমাজ-জীবন, যুথযাপন তথা কমিউনিটি লাইফের নানান হিসেব, আরণ্যক প্রাত্যহিকীর পরতে পরতে জুড়ে থাকা প্রাকৃত প্রজ্ঞা। সেই সব কিছুর অনুসন্ধান-ই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। চলুন, এগিয়ে যাই।