ভাইরাসের যুদ্ধ: বাইডেন-হ্যারিসের আমেরিকা কি পাবে তার ভ্যাক্সিন?

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 


লেখক মার্কিন-নিবাসী তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক

 

 

 

 

কত কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছি জীবনে? 

এক বরফঝড়ের দিনে শিকাগো থেকে ডেট্রয়েট ফিরছি গাড়িতে। বরফের উপর দিয়ে পিছলে যেতে যেতে, শামুকের গতিতে। চারশো মাইলের এই বরফমোড়া দূরত্বের পাশে পাশে বিভিন্ন গাড়িকে উল্টিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আমার চোখ রাস্তায়, স্ট্রিয়ারিং-এ দুই হাত কোনওদিন এইভাবে জেগে থাকেনি। কালামাজুর কাছে এসে সেইটা হল, যার ভয়ে ছিলাম সারাক্ষণ। বরফের রাস্তায় ব্রেক মাখনের মত গলে গেল আর আমার গাড়ি সামনের ট্রাকের দিকে ছুটে গেল পাগলের মত। শেষ মুহূর্তে স্টিয়ারিং কোনওমতে সামলে, কীভাবে কয়েক ইঞ্চির দূরত্বে রেখে আমি যেন সামনের নিরাপত্তায় ছিটকে গেলাম। 

আজ সেইরকম এক দিন। আমেরিকার জন্য। ভোটের খবরে চোখ বেঁধে থাকা আমাদের সবার জন্য। কানের একেবারে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল যেন বুলেট। 

কিন্তু এইভাবেই কি জয় ছিনিয়ে আনার কথা ভেবেছিল ডেমোক্র্যাটরা? ২০১৬-র সেই স্বপ্নভাঙ্গা সকালটার ছড়িয়ে থাকা টুকরোগুলো থেকে নিজেদের সন্তর্পণে তুলে ধরতে ধরতে তারা ২০২০-র দিনটাতে অন্যভাবে পৌঁছাতে চেয়েছিল। তাদের ধারণা হয়েছিল চার বছরের অপশাসন, জাতিগত বৈষম্যকে ঘৃতাহুতি দেওয়া, অভিবাসীদের জন্য কাঁটাতারের বেড়া লাগানো, বিশ্বের দরবারে নিজেদের উঁচু আসন টলিয়ে দেওয়া, আইনকানুনের তোয়াক্কা না করা (যার জন্য ইম্পিচমেন্টও হয়ে গেছে) এবং সর্বশেষে অতিমারির সামনে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পন্ন দেশকে হাঁটু গেঁড়ে বসিয়ে দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক ঐতিহাসিক পরাজয়ের মুখোমুখি হতে চলেছেন। নির্বাচনের আগের সবরকম সমীক্ষায় দেখা গেছে ট্রাম্পের নেতৃত্বে জনতার ভরসা নেই মোটেই। কিন্তু একেবারে ভোটের দিনে, সব সমীক্ষা মিলিয়ে বাইডেনের জেতার সম্ভাবনা ৮৯ শতাংশ ঘোষণার পরেও, তার হারার সম্ভাবনাও কেউ উড়িয়ে দিতে পারেনি। গত সাতদিনের ঘটনা থেকে এটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে করোনা ভাইরাস আমেরিকাকে নতজানু না করলে, অতিমারিতে অর্থনীতির মাজা না ভেঙে গেলে, সবরকমের অপশাসনের পরেও, আমেরিকার গণতন্ত্রের সমস্ত স্তম্ভকে ক্রমাগত আঘাত করা রাষ্ট্রপতি হাসতে হাসতে জিতে যেতেন আবার। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে ট্রাম্প নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডাক্তারদের কেরামতিতে রণক্ষেত্রে ফিরেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু নির্বাচনে পরাজিত হলেন ওই করোনার কাছেই। অতিমারিকে সামলানোর অক্ষমতায় আড়াই লাখ আমেরিকানের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে আর অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে না দিলে অন্য সমস্ত সমালোচনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জিততেন সেই ট্রাম্পই, হয়তো ল্যান্ডস্লাইড হয়ে যেত (ইলেক্টোরাল কলেজের ভিত্তিতে)। 

তার কী কারণ? একটা লোক উঠতে বসতে মিথ্য বলেন; এমন একটা শালীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আপত্তিকর ভাষায় আক্রমণ করেন; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে থেকে গড়ে তোলা বিভিন্ন সংগঠনের যত বন্ধুদেশকে অম্লানবদনে কাঁচকলা দেখিয়ে খুঁজে খুঁজে একনায়কদের সঙ্গে ইয়ার দোস্তি করেন; বিজ্ঞানের বিষয়ে নিজের অজ্ঞানতাকে গর্বের সঙ্গে জাহির করেন (উইন্ডমিল থেকে ক্যান্সার ছড়ায়, ভাবুন একবার!); এবং সর্বোপরি বর্ণবৈষম্যের বিষবৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালেন যত্নসহকারে।  

অথচ সারা দেশের সমীক্ষা কী বলেছিল? যেখানে চার বছর আগে মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষ বলেছিল হয়তো এই লোকটার রাষ্ট্রশাসনের ক্ষমতা আছে, সেখানে এইবারের ভোটের এক সপ্তাহ আগে ৪৪ শতাংশ মানুষ সেইদিকে মাথা হেলাল। কোথায় দেখল তারা এই যোগ্যতা? কোন জাদুতে বেড়ে গেল এই লোকটির নির্ভরযোগ্যতা? যারা বলল, তারা কোন দেশের মানুষ? 

আসলে তখনই বোঝা যায় এই দেশের মধ্যে দুটো দেশ আছে। ট্রাম্প ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন, কজন মহিলার সঙ্গে অশালীন আচরণ করেছেন, দেশের পয়সায় নিজের ব্যাবসা উজিয়ে তুলেছেন, নিজের দেশের যুদ্ধে নিহত সৈনিকের আদ্যশ্রাদ্ধ করেছেন এবং অবশ্যই গত ছয়মাস ধরে অতিমারিকে ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকানোর বদলে ইন্ধন জুগিয়ে গেছেন— তারপরেও এই অন্য দেশের মানুষ কোন অসুখে আক্রান্ত যে ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারেন? হ্যাঁ, আক্রান্ত তো বটেই। বর্ণবৈষম্যের যে ভাইরাস চাপা ছিল বুকের ভিতরে তাকে কীভাবে উস্কে দিতে হয় সেটা ট্রাম্প ভালোই জানেন। আজ সেই অ্যাসিম্পটোমাটিক ভাইরাস মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, পিছনে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ট্রাম্পের কড়ে আঙুল জড়িয়ে। ঠিক যেমনভাবে পেটে লাথি খেলেও দৌড়ে গিয়ে ধর্মের জাঁতাকলে মাথা ঢুকিয়ে দেয় ভারতের মানুষ, এই দেশেও তেমনি পিঠে ছোরা গুঁজলেও তাদের ট্রাম্পপ্রীতিতে খামতি হয়নি। ঘৃণা একটা পরম সুখের দ্রব্য, এই নেশা ধরিয়ে দিলে বুঁদ হয়ে থাকে মানুষ। ট্রাম্পের চেয়ে বেশি কেউ জানে না সে কথাটা। তাই ইন্ধন জুগিয়ে গেছেন গত চার বছর ধরে। কয়েকটা উদাহরণ দেখি এখানে:

এবারের নির্বাচন প্রচারের প্রথম দিনেই Black Lives Matters-এর প্রতিবাদে অংশ নেওয়া আফ্রিকান আমেরিকানদের দিকে আঙুল তুললেন— They’re rapists … some, I assume, are good people।

টিভির বিতর্কে যখন প্রেসিডেন্টকে বিশেষ করে Proud Boys নামের শ্বেত-আধিপত্যবাদী দলটির নিন্দা করতে বলা হল, তিনি কী বললেন? Proud Boys— stand back and stand by. শ্বেত সন্ত্রাসকে মদত দেওয়ার সুযোগ পেলে কখনও পিছপা হননি ট্রাম্প। 

শুধু কালোদের উদ্দেশ্য করেই নয়। কখনও মেক্সিকান, কোনও সময় জাপানিজ, ইরানি তুরানি কাউকে বাদ দেননি ট্রাম্প। করোনা ভাইরাসের নামই দিলেন চায়না ভাইরাস। যার ফলে পথেঘাটে চিনা অভিবাসীদের অবস্থা কী হল, সেটা নিয়ে দেশের রাষ্ট্রপতির কোনও মাথাব্যাথা ছিল না কোনওদিন। কিংবা ভিতরকার উদ্দেশ্যটাই ছিল বিদ্বেষের গোড়ায় সুড়সুড়ি দেওয়া। ট্রাম্পের ল্যাবরেটারিতে সযত্নে লালন করা হয়েছে বর্ণ ও জাতিগত বিদ্বেষের ভাইরাস। এটা এমন ভাইরাস যাতে আক্রান্ত হলে অপশাসনের কোনও দুর্গন্ধই আর নাকে লাগে না তো! 

ট্রাম্পের ল্যাবরেটারির আর এক ভাইরাস স্বপ্রণোদিত মিথ্যা আর গুজবের বিস্তার। যে কোন গুজবকে ভাইরাল করার ক্ষমতা রাখেন ট্রাম্প। কী নিয়ে গুজবের ডালপালা ছড়াননি এই ভদ্রলোক? ওবামার জন্মের দেশ নিয়ে ছড়ানো গুজবে বার্থারিজমকে সম্মানের জায়গা দিয়েছেন। এই তো কমলা হ্যারিস বাইডেনের নির্বাচনসঙ্গী হওয়ার পরে পরেই তার জন্যেও সেই চেষ্টা করেছেন। ধোপে টেকেনি। ইলেকশানে ইউক্রেনের হস্তক্ষেপের মত অবাস্তব ফিসফিসানি, বাইডেনের ছেলেকে কুৎসায় জড়ানো, স্পাইগেট ষড়যন্ত্র তত্ত্ব— এইসব তাঁর রোজকার টুইটার ফিড দ্বারা প্রচারিত বিকল্প সত্য। শুধু এতেই কি ক্ষান্ত থাকার লোক ট্রাম্প? হারিকেন ডোরিয়ান আলাবামাতে আসতে চলেছে জানিয়ে আবহাওয়া দপ্তরের ঝড়ের ম্যাপেরও রদবদল করেছেন। করোনা ভাইরাসের ওষুধ হিসাবে ভিডিও কনফারেন্স করে ব্লিচ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। উইকিপিডিয়াতে ট্রাম্পের মিথ্যা নিয়ে একটা আলাদা পাতা তো আর এমনি এমনি তৈরী হয়নি। লিস্ট নেহাতই লম্বা। 

শুধু নিজের মিথ্যা নয়, অন্যের মিথ্যা আর গুজবকে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি। কুঅ্যানন নামে দক্ষিপন্থী ষড়যন্ত্রবাদী দলের গুজব সম্বন্ধে কী লিখেছে উইকিপিডিয়াতে দেখুন— 

QAnon[a] (/ˌkjuːəˈnɒn/) is a fa-right conspiracy theory that alleges that the world is run by a powerful cabalof Satan worshiping pedophiles , who work to undermine US PresidentDonald Trump and his actions against them, with the cabal operating a global child sex trafficking ring

ট্রাম্প এদের সমর্থন করে টুইট করেছেন। ভাবা যায়? 

কেন করেছেন এরকম মিথ্যের চাষ? আসলে বানিয়েছেন এক বিকল্প সত্যের ভাইরাস, সবচেয়ে বড় মেগাফোন থেকে যা ছড়িয়ে পড়েছে রোজ। এর পরে সংবাদমাধ্যমে বা সোশাল মিডিয়াতে সত্যি আর মিথ্যারা মিলেমিশে একাকার হতে আর কি সময় লাগে? তার পঞ্চাশটা মিথ্যা কেউ না মানলে, অন্য পঞ্চাশটা মিথ্যে সত্যিকে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে মানুষের বিশ্বাসে। তাছাড়া সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য একবার আঙুল তুললেই যথেষ্ট, মিথ্যাকে মিথ্যা বলে দাগানোর জন্য এত আলোচনা করতে হয় যে সেটা আরও বেশি সত্যের সঙ্গে একসারিতে ঠাসাঠাসি করে বসে পড়ে। এই যেমন দেখুন, নির্বাচনী প্রচারের মধ্যে যেদিন সবচেয়ে বেশি কোভিড সংক্রমণের খবর জানা গেল সেদিনই ট্রাম্প বললেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করে তার অনুশাসনে কোভিডকে কব্জা করে ফেলা গেছে, কদিন বাদেই সব আবার আগের মত উন্মুক্ত করতে চলেছেন তিনি। ভাবুন! কতটা বুকের পাটা থাকলে ২৩০০০০ মৃতদেহকে উপেক্ষা করে এমন মিথ্যা বলে যায়। এই করেই একই দেশের মধ্যে তিনি তৈরি করতে পেরেছেন আর একটা দেশ যেখানে তার বলা মিথ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দৈববাণী। 

বর্ণবিদ্বেষ আর মিথ্যের এই দুই ভাইরাস এইভাবে আমেরিকাকে দুই শিবিরে বিভক্ত করে দিয়েছে গত চার বছরে।  করোনা ভাইরাস যদি না অর্থনীতিকে মাটিতে পেড়ে ফেলত, তাহলে জয় হত এই ট্রাম্পিজমের। জো বাইডেন আর কমলা হ্যারিসের জয় হয়তো ঐতিহাসিক, কিন্তু এই দুই ভাইরাস যে এই দেশের মাটিতে শিকড় গেড়েছে তাকে কতদিন চাপা দেওয়া যাবে? 

এই ভোটের ফলাফল আর সেটা নিয়ে ট্রাম্পের মিথ্যা দোষারোপ প্রমাণ করে যে দুটো উপসর্গই খুব ভালোমত জীবন্ত আছে। যায়নি কোথাও। এক্সিট পোল দেখলে একটা আন্দাজ পাওয়া যায় আমেরিকার মধ্যে এই লাল আর নীল দেশের বাসিন্দা কিভাবে বর্ণ আর জাতিগত ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গেছে।

নির্বাচন প্রচারে বাইডেন বারবার বলেছেন আমি নীল (ডেমোক্র্যাট) কিংবা লাল (রিপাবলিকান) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চাই না, আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। বহুদিন সেনেটে থাকা ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বাস করেন সবার সঙ্গে মিলেজুলে কাজ করার পদ্ধতিতে। বাইডেনের সঙ্গে আছেন কমলা হ্যারিস যিনি একই সঙ্গে ভারতীয়, কৃষ্ণাঙ্গ এবং নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। যখন ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখেই নিজেকে জয়ী ঘোষণা করেছেন, ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনেছেন একরাশ মিথ্যার পশরা সাজিয়ে এবং ন্যূনতম প্রমাণ ছাড়াই আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন, অনেক ভোটে এগিয়ে থাকা বাইডেন-হ্যারিস ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন নির্বাচনের ফলাফলের ঘোষণার জন্য।

আমেরিকায় ভোট পরিচালনা বিকেন্দ্রীভূত। প্রতিটা রাজ্যে ভোট দেওয়া, ভোট গোনা সব কিছু সেই রাজ্যের দ্বারা পরিচালিত হয়। সমস্ত প্রক্রিয়াটা টিভির চোখের উপর। তাছাড়া অর্ধেকের বেশি রাজ্যের শাসনভার ট্রাম্পের নিজের দলের হাতে। সবচেয়ে বড় কথা যেহেতু পুরো ব্যাপারটা বিভিন্ন প্রশাসকের দ্বারা আলাদা আলাদাভাবে পরিচালিত, তাই কোনওরকম সঙ্ঘবদ্ধ কারচুপির কোনও সম্ভাবনাই নেই। অথচ ট্রাম্প ভোটের আগে থেকেই এই ধুনো তুলেছিলেন। বারবার মিথ্যে বললে সত্যের সঙ্গে এক আসনে বসা যায় সেটা তার থেকে ভালো আর কেউ তো জানে না।   

বাইডেনের কাছে কোন যাদুদণ্ড আছে যার সাহায্যে উনি এক করবেন আমেরিকাকে? কোনও সঞ্জীবনী বটিকাও তো নেই।  

তাঁর আছে মানবিকতা। নিজের জীবনে অনেক ঝড়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন। ১৯৭২-এ গাড়ির দুর্ঘটনায় প্রথমা স্ত্রী আর মেয়েকে হারিয়েছেন। ২০১৪-তে বড় ছেলে গেল ক্যান্সারে। জানি না ওনার গলায় ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’র ধারায় কোনও ইংরাজি গান গুনগুনিয়ে মনের শান্তি ফিরিয়েছিল কিনা সেদিন। কিন্তু এক একটা ঝড় সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বারবার। 

তাঁর আছে ধৈর্য। প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে নেমেছিলেন ১৯৮৮ সালে। তারপর ২০০৮। আজ ২০২০-তে এসে সেই আসনের দোরগোড়ায় দাঁড়ালেন। লড়াইয়ের ময়দানে যারা দাঁতে দাঁত চেপে থেকে যায়, তারা সহজে পিছিয়ে যায় না কোনও অবস্থাতেই। অভিজ্ঞতাও তাই গভীর। যারা হারতে জানে, তারাই তো জেতে। 

তাঁর আছে অধ্যাবসায়। ছোটবেলা থেকে তোতলা। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা হিসাবে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন একবারও না থমকে। নিজের উপর কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকলে সেটা সম্ভব? কোনও বাধাকেই বাধা বলে মানেন না হয়তো। 

তাঁর পন্থা সহযোগিতার। সেনেটে জিতে এসেছেন মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে। কাজ করেছেন সব দলের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। লাল আর নীল, সাদা আর কালো, বাদামী আর হলুদ সব রংকে যদি মেলাতে হয় দরকার এইরকম এক সেতুর। 

ইতিহাস ঠিক সময়ে ঠিক লোকটিকে খুঁজে নেয়। এটা ভাবার তাই যথেষ্ট কারণ আছে। 

বাইডেন বুড়ো, বাইডেন ফুরিয়ে গেছেন, বাইডেন রাজনৈতিক দায় এমন কথা তার নিজের দলের অনেকেই তো বলেছেন। অনেকের কাছে তাই বাইডেন সমঝোতামূলক প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু ওনাকে দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় পি ভি নরসিমহা রাওয়ের কথা। উনিও আকর্ষণীক্ষমতাহীন এক সমঝোতার প্রধানমন্ত্রী হয়ে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। তাঁর দেখিয়ে দেওয়া উন্নতির পথ থেকে সরতে দেশের লেগেছিল ২৫ বছর। 

আসলে শিক্ষা আর অর্থনীতি একটা দেশের মানুষের মানসিকতাকে চালিত করে। একবার দেখুন, ট্রাম্পের সমর্থক কারা? কলেজের গণ্ডির বাইরে থাকা সাদারা। এদের মধ্যেই তার মিথ্যা, বর্ণ বৈষম্য ও নারীবিদ্বেষের পোশন এক ভক্তকূল তৈরি করেছে।

  

কিন্তু কেন? শিক্ষা কি মানুষকে উদার করে? জোর দিয়ে সেটা বলতে পারি না। বরং একটু অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে দেখা দরকার। যেমন যেমন বিশ্বায়ন হয়ে শিল্পক্ষেত্রের চাকরিগুলো বিশ্বের অন্য দেশে বেটে গেছে, অন্তর্জালের কল্যাণে রিটেল ব্যাবসার হাতে হ্যারিকেন ধরানো হয়েছে, চাকরি গেছে কাদের? কলেজের ডিগ্রিহীন মানুষের। আমেরিকার গ্রাম আর ছোট শহরের মানুষের জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছে যেখানে সাদাদের জীবন একটা সুরে বাঁধা ছিল। সেই জায়গায় পটাপট আলো জ্বলেছে বড় বড় শহরে আর তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা মফস্বলে যেখানে নতুন আসা অভিবাসীদের জীবন গড়ে উঠেছে। যখন পেটে টান পড়ে, তখন মানুষকে ক্ষেপিয়ে দেওয়া, জাতিগত বিদ্বেষ গড়ে তোলা আর সব কিছু আবার আগের মত করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখানো সোজা। ট্রাম্প সেটাই করেছিলেন। তাই মিশিগান, উইনসকন্সিন আর পেনসিলভেনিয়ার রুগ্ন হয়ে আসা শিল্পশহরগুলো থেকে ভোট তুলে এনে জিতেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু গত চার বছরে কথা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই দেননি তাদের। সেই চলে যাওয়া ভোটেরা কিছুটা ফিরে এসেছে বাইডেনের হাত ধরে আর টলিয়ে দিয়েছে শাসকের আসন। সুতরাং কলেজ শিক্ষা নেই এমন মানুষদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা, এটাই হতে পারে এই বিদ্বেষপূর্ণ আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিষেধক।      

তবে হেরে গেলেও ট্রাম্প কিন্তু কোথাও যাচ্ছেন না। থাকবেন মেগাফোন হয়ে। তিনি থাকবেন টিভির পর্দায়, টুইটারের ফিডে, ট্যাবলয়েডের পাতায়। আর অবশ্যই রিপাবলিকান পার্টির সর্বশক্তিমান হয়ে। আর মিথ্যার এই ট্রাম্প টাওয়ারের মাথায় দাঁড়িয়ে লেলিয়ে দেবেন বিদ্বেষ আর বিকল্প সত্যের ভাইরাস। প্রশ্ন হচ্ছে জো বাইডেন আর কমলা হ্যারিসের প্রশাসন কি এই ভাইরাসের প্রতিষেধকের কাজ করতে পারবে? সারা পৃথিবীর মত আমেরিকাও তাকিয়ে আছে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক টিকার দিকে চেয়ে। কিন্তু পৃথিবীর অসুখ আজ গভীর। জাতি ও বর্ণবৈষম্য এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বিকল্প সত্য— এই দুই ভাইরাসের টিকারও দরকার আছে। যেটা আমেরিকাকেই খুঁজে পেতে হবে। এই দুই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে, করোনার মত। আমেরিকার কাছ থেকে কি ভবিষ্যতে কোনও নৈতিক কন্ঠের আওয়াজ শুনতে পাবে বাকি পৃথিবী?  

বাইডেন-হ্যারিসের দিকে চেয়ে থাকবে গোটা বিশ্ব। 

 

ছবি (হেডার) –  ইভান ভুসি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...