দেবব্রত শ্যামরায়
লেখক রাজনৈতিক ভাষ্যকার
Everybody Loves a Good Drought, ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় সাংবাদিক পি সাইনাথের লেখা বইটি। ভারতবর্ষের নানা রাজ্যের দরিদ্রতম জেলাগুলিতে কয়েক বছর ধরে প্রায় ১ লক্ষ কিলোমিটার ঘুরে বেড়িয়ে সাইনাথ খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন সেখানকার মানুষজনের সমস্যার রূপ, আদিগন্ত দারিদ্র্য এবং সেই দারিদ্র্যে ভর করে আশ্চর্যজনকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠা একটা সিস্টেমকে। খরা বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র, আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদ, এনজিও, সংবাদমাধ্যম, কাজের ঠিকাদার, ও নানা বেসরকারি সংস্থার সুবিধা ও মুনাফা বাড়িয়ে তোলে, প্রান্তিক মানুষের দুর্দশা কীভাবে এক শ্রেণির মানুষের কাছে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়— বইটিতে তার জ্বলজ্যান্ত তথ্যপ্রমাণ দাখিল করেছিলেন সাইনাথ।
২০২০ সালে অতিমারির মধ্যে দাঁড়িয়ে হঠাৎই মনে পড়ে গেল সাইনাথের লেখা বইটার কথা। তার কারণ দীর্ঘ সিকি শতাব্দী পেরিয়েও বইয়ে লিখিত পুরনো ছবিটার তেমন কোনও বদল হয়নি। বরং সাইনাথ যে সময় ভারতের গ্রামে গ্রামে ঘুরছিলেন, তখন সবেমাত্র ভারতের বাজার বিদেশি লগ্নির জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ভণিতাটুকু তখনও পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি রাষ্ট্রের ব্যবহার থেকে। আজ ২০২০ সালে পৌঁছে আর সে-সবের কোনও বালাই নেই। প্রান্তিক মানুষের দুর্ভোগ, উচ্ছেদ এমনকি মৃত্যুতেও কর্পোরেট রাষ্ট্র এখন অনেক বেশি নির্ভীক ও নিরুদ্বেগ।
তা হঠাৎ এসব পুরোনো কথার অবতারণা কেন?
Housing and Land Rights Network (HLRN) নামে একটি স্বাধীন সংস্থার সমীক্ষা জানাচ্ছে আগস্ট মাসের ১৮ তারিখ অবধি পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে প্রায় ১ কোটি ৪৯ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়েছেন অথবা গৃহহারা হওয়ার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। এই সংখ্যাটির পরিমাণগত বিপুলতা বোঝা যায় যখন তুলনামূলকভাবে আমরা দেখি ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে আমাদের দেশে গৃহহারা মানুষের সংখ্যা ৫ লক্ষ, যদিও এই সংখ্যাটিও নেহাত কম নয়।
প্রহসন এটাই, যে অতিমারির সময় যখন সাধারণ মানুষকে যতটা বেশি সম্ভব নিজের বাড়িতেই সময় কাটাতে বলা হচ্ছে, ঠিক সেইসময় রাষ্ট্র ও তার ‘উন্নয়ন’ মেশিনারি লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছ থেকে তাদের ঘরবাড়ি ছিনিয়ে নিচ্ছে। পরিকাঠামো তৈরি, রাস্তাঘাট নির্মাণ, শহরের সৌন্দর্যায়ণ, বস্তি উচ্ছেদ, এমনকি পরিবেশ রক্ষার ‘অজুহাতে’ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মানুষের মাথার ওপরের ছাদ। আর প্রতিবাদ-প্রতিরোধহীন স্বাচ্ছন্দ্যে এইসব কাজ হাসিল করার সবচেয়ে বড় সুযোগ এনে দিয়েছে অতিমারি ও তার স্বাস্থ্যবিধি।
অতিমরির অজুহাতে জোর করে তুলে দেওয়া হচ্ছে মাত্র পাঁচজন এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের নিয়ে শাহিনবাগের প্রতীকী অবস্থান, অথচ ঘটা করে রামমন্দিরের শিলান্যাসে কোনও বাধা নেই, বাধা নেই মধ্যপ্রদেশে সরকার তৈরির বিজয় সমাবেশেও। অতিমারির ফাঁকে সংসদে প্রশ্নোত্তর-তর্কবিতর্কের সুযোগ না দিয়েই পাশ হয়ে যাচ্ছে ছোট ও প্রান্তিক চাষির পক্ষে দানবিক কৃষি আইন। ঠিক তেমনিভাবেই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষ নির্দেশিকার তোয়াক্কা না করেই শহরে-গ্রামে প্রান্তিক মানুষকে উপড়ে ফেলা হচ্ছে তার ঘর থেকে। এ বছর ১৬ মার্চ থেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আমাদের দেশে এই উৎখাতের সংখ্যাটা কমবেশি ২০,০০০। অথচ মজার কথা এই যে, কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যে দেশের সমস্ত মানুষের মাথায় ছাদের সংস্থান হয়ে যাওয়ার কথা। সেটা কি তাহলে ভোট-ভিখারির মিথ্যে প্রতিশ্রুতি নাকি নিতান্তই ছাপার ভুল?
HLRN-এর তথ্য দেখাচ্ছে, ২০১৭ থেকে ২০১৯, এই দু-বছরের মধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি মোট ১,১৭,৭৭০টি বাড়ি ভেঙে ফেলেছে ও প্রায় ৫,৬৮,০০০ মানুষকে আক্ষরিক অর্থে পথে বসিয়েছে। এই দু-বছরে আমাদের দেশে প্রতিদিন ১০৮টি করে বাড়ি ভাঙা হয়েছে ও দিনপ্রতি ৫১৯ জন মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন, অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ২২ জন করে। মনে রাখা দরকার, উপরের পরিসংখ্যান স্বাভাবিকভাবেই নথিবদ্ধ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি, অথচ অন্য সব অঘটনের মতোই বেশিরভাগ ঘটনাই নথিভুক্ত হয়নি, কিন্তু উচ্ছেদের প্রকৃত সংখ্যাটা যে আরও বহুগুণ তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। দেশজুড়ে এতবড় একটি মানবসঙ্কট নিয়ে নিয়ে মিডিয়া থেকে সংসদ, কোথাও তেমন কোনও হেলদোল নেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, উচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে মূলত পাঁচটি কারণে। ১) বস্তি উচ্ছেদ, বেআইনি দখল হটানো ও শহরের সৌন্দর্যায়ন— উচ্ছেদ হওয়া মানুষজনের ৪৬ শতাংশ, ২) পরিকাঠামো নির্মাণ— ২৭ শতাংশ, ৩) প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধক কর্মসূচি— ৭ শতাংশ, ৪) রাজনৈতিক সভা ও মিছিল— ৩ শতাংশ। হ্যাঁ, ঠিক তাই, আমাদের দেশে মহান রাজনৈতিক নেতারা হইচই করে সভা-সমাবেশ করবেন বলে প্রান্তিক মানুষকে নিজের ঘর ছেড়ে দিতে হয়। সৌন্দর্যায়নের নামে উৎখাত হতে হয় দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের, কারণ নরেন্দ্র মোদির হারিয়ে যাওয়া সহোদর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কয়েক ঘণ্টার জন্য আসছেন আহমেদাবাদ শহরে, অথবা কলকাতা শহরে বসছে যুব বিশ্বকাপের আসর। পরিবেশ-বন্যপ্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই অজুহাতে উৎখাত হন বনবাসী মানুষ, অথচ জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ গভীর অরণ্য মুহূর্তে ডি-ক্যাটেগরাইজড হয়ে উন্মুক্ত হয়ে যায় কর্পোরেট ধাতু-হাঙরদের জন্য।
HLRN-এর অধিকর্তা শিবানী চৌধুরী জানাচ্ছেন, এই গণ-উচ্ছেদের বেশিরভাগই সম্পন্ন হয়েছে যখন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি অতিমারির কারণে খর্বকায়, সে প্রতিবাদে জমায়েত করতে পারছে না, উকিল বা আদালতের থেকে কোনওরকম আইনি সাহায্য নিতে পারছে না৷ অর্থাৎ এই গত কয়েকমাসে ঘটে যাওয়া সমস্ত উচ্ছেদকাণ্ডের এক অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে অতিমারি ও লকডাউনকে।
সুশীল সমাজের অনেকে প্রশ্ন তুলবেন— সরকারি কাজের জন্য উৎখাত হওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য আইনি সংস্থান রয়েছে তো আমাদের দেশে.. এইভাবে সমস্ত উন্নয়নের কাজে বাধা দিলে তো দেশ এগোবে কী করে? দেশ ‘এগোনো’-র ধারণাটি ঠিক কী, কারা সেই এগিয়ে যাওয়া দেশের বাসিন্দা, কারা নয়— এইসব কূট প্রশ্নে না ঢুকেও একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর দেওয়া যাক। বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই, ২০১৯-এ উচ্ছেদ হওয়া প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে পুনর্বাসন পেয়েছেন মাত্র ২৬ শতাংশ৷ যেমন ধরুন, গুরুগ্রামে একটি বায়োডাইভারসিটি পার্ক তৈরি করা হবে, তাই গৃহকর্মসহায়িকার কাজ করেন এমন ৬০০টি পরিবারের একটি বসতি ভেঙে দেওয়া হল। বসতির বাচ্চারা, ধরা যাক, তাদের কারও নাম সোমনাথ বা শাজাহান, মাঠ থেকে খেলাধূলা করে ফিরে এসে দেখল একটু আগে যে বাড়ি থেকে তারা বেরিয়েছিল তা আর কোথাও নেই। চোখের সামনে একটা ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে। উচ্ছেদ যে হবে— এমন কোনও আগাম নোটিশ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি তাদের, ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন তো অলীক কল্পনামাত্র। অর্থাৎ বৈচিত্র্যে পূর্ণ নানা প্রজাতির জীবে সমৃদ্ধ একটি পার্ক তৈরিতে সবচেয়ে আগে বাদ পড়ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বৈচিত্র্যহীন, মূল্যহীন জীবটি, যার নাম অধিকারহীন দরিদ্র মানুষ।
সমাজকর্মীরা পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। আওয়াজ তুলছেন৷ তারা রাজ্য সরকারগুলির কাছে কোভিড অতিমারি চলাকালীন সমস্তরকম উচ্ছেদ বন্ধ করার দাবি করছেন অথবা উৎখাত হওয়া মানুষদের পুরোনো বাসস্থানের দুই থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে সবরকম সাধারণ সুযোগসুবিধাসহ বাসযোগ্য পুনর্বাসনের জন্য আবেদন করছেন৷ সে দাবিতে এখনও কেউ কর্ণপাত করেনি। পি সাইনাথের রিপোর্টাজ পড়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মধ্যপ্রদেশের বস্তারে সরেজমিন তদন্তে গিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, কাজে অবহেলা বা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আমলাদের বদলিও করেছিলেন। বর্তমান শাসকের বিবেক সেই মাপের সংবেদন দেখাবেন কিনা তা অতিমারির দেবতা-ই জানেন।