অস্তিত্বের অবশ্যম্ভাবিতা: কৃষ্ণগহ্বর— তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা থেকে বাস্তবে নিরীক্ষণ

তাপস কুমার দাস

 

লেখক ভারত সরকারের পরমাণু গবেষণা দপ্তরে কর্মরত মহাকাশবিজ্ঞানের অধ্যাপক

ষাটের দশকের শেষের দিকে কোয়েজার আবিষ্কার দিয়ে যার শুরু, এ বছরে আন্দ্রিয়া ঘেজ আর রাইনহার্ড গেঞ্জেলের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল (অর্ধেক) পাওয়া দিয়ে সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। প্রমাণ হল মহাকাশের অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর কপোলকল্পনা নয়, বরং তার অস্তিত্বের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণের সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোয়েজারের অত্যুজ্জ্বল বিকিরণের ব্যাখ্যার জন্য কৃষ্ণগহ্বরের উপপ্রমেয় প্রস্তাবিত হওয়ার আগে, এমনকি তত্ত্বগতভাবেও, কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেকে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। সেই তাত্ত্বিক অস্তিত্বের অবশ্যম্ভাবিতাকে জটিল গণিতের সাহায্যে সিঙ্গুলারিটি থিওরেমের মাধ্যমে প্রমাণ করার জন্য রজার পেনরোজ পেলেন নোবেল পুরস্কারের বাকি অর্ধেক অংশ। এবারের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলের কেন্দ্রীয় চরিত্র তাই মহাবিশ্বের অতি রহস্যময় এক সত্তা— কৃষ্ণগহ্বর!

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার স্বপ্নাদ্য মাদুলি পাওয়া নয় কোনও। একজন বৈজ্ঞানিক বা একটি গবেষণাগারের পরীক্ষার ফলাফল নোবেল এনে দেয় না। প্রকৃতপ্রস্তাবে, মহৎ কোনও আবিষ্কারের পেছনে থাকে বহু মানুষের অবদান, বহু গবেষণার উত্তেজনাময় ইতিহাস। ২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলের গুরুত্ব বুঝতে গেলে তাই কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের তাত্ত্বিক প্রস্তাব থেকে শুরু করে মহাবিশ্বে সেই অস্তিত্বের নিরীক্ষণীয় প্রমাণের হালহকিকতের ইতিহাস জানার প্রয়োজন। এবারের নোবেল পুরস্কার যে আবিষ্কারের ভিত্তিতে দেওয়া হল সেই আবিষ্কারের প্রযুক্তিগত খুঁটিনাটি বা আবিষ্কারকদের জীবনী বর্ণনার বদলে, বর্তমান প্রতিবেদনে সেই ইতিহাসের রূপরেখা তুলে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে কেন কৃষ্ণগহ্বরের আবিষ্কার বিজ্ঞানের ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ।

সলতে পাকানোর কালে

আরম্ভটা ঠিক যেন টানটান এক রহস্যরোমাঞ্চ উপন্যাস। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির মহাকাশবিজ্ঞানের গবেষক অধ্যাপক মার্টিন শ্মিট্ পর্যবেক্ষণ করছিলেন একটি নির্দিষ্ট মহাজাগতিক বস্তুর বর্ণালী— সালটা ১৯৬২। আপাতদৃষ্টিতে নক্ষত্র-র মতো দেখতে সেই বস্তুটির পোশাকি নাম 3C 273, এবং সেটি শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গ বিকিরণ করে। মহাজাগতিক বস্তুর এই ধরনের বর্ণসাংখ্যিক (আলফানিউমেরিক) নামকরণের একটি বিশেষ অর্থ এবং ইতিহাস আছে। সেটি জানতে গেলে আমাদের বস্তু দর্শনের (অবজারভেশন) বিজ্ঞানটা একটু বুঝে  নিতে হবে।

দর্শনের বিজ্ঞান ও দূরবীক্ষণ

তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে হতে পারে, তা আমরা জানি। সাধারণত দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ নিয়েই আমরা মাথা ঘামাই, কারণ পৃথিবীর প্রায় যাবতীয় বস্তু এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতেই আমাদের চোখে ধরা পড়ে। এ প্রসঙ্গে একবার বুঝে নেওয়া যাক আমরা যখন বলি আমরা কিছু ‘দেখি’ তখন তার মানেটা আসলে কী দাঁড়ায়। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু নিরন্তর তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে চলেছে কোনও না কোনও তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। বিকীর্ণ সেই তরঙ্গ আমাদের চোখের পর্দায়, অর্থাৎ রেটিনায় এসে পড়ে। রেটিনায় আছে অপটিক নার্ভ, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যার নাম সেকেন্ড ক্রেনিয়াল নার্ভ, যা দশ লক্ষেরও বেশি স্নায়ুতন্তু দিয়ে তৈরি। রেটিনা তরঙ্গকে বৈদ্যুতিক স্পন্দনে রূপান্তরিত করে। অপটিক নার্ভ রেটিনা থেকে সেই স্পন্দন বয়ে নিয়ে যায় মস্তিষ্কের এক বিশেষ অংশে। এই বিশেষ অংশ, ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স যার নাম, তার অবস্থান মানব মস্তিষ্কের পেছনের অংশে, লঘুমস্তিষ্ক অর্থাৎ সেরিবেলাম-এর সামান্য উপরে। এখানে এসে সেই বৈদ্যুতিক স্পন্দনের বিশ্লেষণ করে মানবমস্তিষ্ক, এবং আমরা তখন বুঝতে পারি আমরা কী ‘দেখছি’। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের এই জটিল প্রক্রিয়াই প্রাণীজগৎকে ‘দেখার’ বোধ তৈরি করে দেয়। মানুষ সহ প্রায় সমস্ত প্রাণীর ক্ষেত্রেই, বস্তু দর্শনের এই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র কেবলমাত্র তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের একটি বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমার মধ্যেই ক্রিয়াশীল। মানুষের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান আলোকের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সীমা সাধারণত ৩৮০ থেকে ৭৪০ ন্যানোমিটার। এক ন্যানোমিটার হল এক মিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ। এই ৩৬০ ন্যানোমিটারের গবাক্ষ দিয়ে মানুষ মহাবিশ্বকে অবলোকন করে। পর্যবেক্ষণের সময়ে যেহেতু দৃশ্যমান আলোকেই প্রথম দিকে মানুষ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব  দিয়ে এসেছে, সেহেতু দূরবীনও তৈরি করা হয়েছে সেভাবেই। অর্থাৎ সেই দূরবীন কাজ করবে শুধু দৃশ্যমান আলোকেই।

শুধুমাত্র দৃশ্যমান আলোকে বিশ্বদর্শনের অসুবিধা আছে। বহুদূরের মহাজাগতিক বস্তু থেকে যখন দৃশ্যমান আলো যাত্রা শুরু করে পৃথিবীর দিকে, তখন তাকে পেরিয়ে আসতে হয় অনেকটা রাস্তা। মহাকাশে ছড়ানো গ্যাসের অণু ও মহাজাগতিক ধূলিকণার সঙ্গে মোলাকাত হয় সেই আলোর, সংঘর্ষ হয়, এবং আলোর সিংহভাগই শোষিত হয়ে যায় গ্যাসের অণু আর ধূলিকণার দ্বারা। ফলে মহাকাশের সেই বস্তু থেকে আসা তথ্য, যে কিনা বয়ে নিয়ে আসছে দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ, অনেকটাই আর এসে পৌঁছতে পারে না আমাদের কাছে। তা মাঝরাস্তায় ‘নষ্ট’ হয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই ঘটনাকে বলে বিক্ষেপণ বা স্ক্যাটারিং। বিক্ষেপণ সর্বোচ্চ হয় যখন বিক্ষেপক কণিকার মাপ বিক্ষিপ্ত আলোকের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমতুল্য হয়। এর নাম অনুরণন প্রক্রিয়া বা রেজোন্যান্স। দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য মহাজাগতিক ধূলিকণার ব্যাসের সমতুল্য। সুতরাং আমরা যদি তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের বর্ণালীর এমন কোনও তরঙ্গদৈর্ঘ্য ‘দেখতে’ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতাম যার বিক্ষেপণের মাত্রা খুব কম, তাহলে মহাজাগতিক বস্তু থেকে আসা তথ্য হারিয়ে যাবে না। অনেক বেশি স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে সেই বস্তুকে অবলোকন করে।

তরঙ্গদৈর্ঘ্যর মাপের বিচারে, তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের বর্ণালী অতি বিস্তৃত। সেখানে একপ্রান্তে যেমন আছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের গামা রশ্মি, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর প্রায় একশো কোটি ভাগের এক ভাগ, তেমনি ওপর দিকে আছে বেতার অর্থাৎ রেডিও তরঙ্গ (যার মাধ্যমে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাই এই নাম), যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর থেকে দশ লক্ষ কোটি গুণ অবধি বেশি হতে পারে। যেহেতু অনুরণন, এবং সাধারণভাবে বিক্ষেপণের সম্ভাবনা অনেক কমে যায় বিক্ষেপকের তুলনায় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাপ অনেকটা বেশি হলে, সেহেতু বেতার তরঙ্গের প্রায় কোনও বিক্ষেপণই ঘটাতে পারবে না মহাজাগতিক ধূলিকণা, মহাকাশবিজ্ঞানীরা এইটা বুঝেছিলেন। এই উপলব্ধি থেকেই তৈরি হয় এমন দূরবীন যা দৃশ্যমান আলোর বদলে বেতার তরঙ্গ গ্রহণ করে তার বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, এবং সেই সূত্রে এমন-এমন মহাজাগতিক বস্তু সম্পর্কে তথ্য গ্রহণে সক্ষম যারা বেতার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিকিরণ করে। বেতার তরঙ্গ বিকিরণ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যখন আহিত কণিকা, ধরা যাক ইলেকট্রন, চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে ত্বরিত হয় তখন বেতার বিকিরণ বেরিয়ে আসে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই বিকিরণের নাম সিনক্রোট্রন বিকিরণ।  বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু থেকে সিনক্রোট্রন বিকিরণ পাওয়া যায়।

বেতার তরঙ্গে ক্রিয়াশীল এই দূরবীন, রেডিও-দূরবীন প্রকৃতপ্রস্তাবে, মহাজাগতিক বস্তুর পর্যবেক্ষণে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল। আমরা অন্য ‘চোখ’ দিয়ে ‘দেখতে’ শিখলাম। শুধুমাত্র দৃশ্যমান আলোক বিকিরণকারী বস্তুকেই এতদিন দেখতে পেতাম আমরা। কোনও এক বিশেষ প্রকার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে দেখতে পাওয়ার সীমিত ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেল পর্যবেক্ষণীয় মহাকাশবিজ্ঞান। ফলিত মহাকাশবিজ্ঞানের এক নতুন শাখার উদ্ভব হল তিরিশ আর চল্লিশের দশকে— বেতার তরঙ্গ নির্ভর মহাকাশবিজ্ঞান বা রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি।

আমেরিকার নিউ জার্সি শহরের বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে, যা বেল ল্যাব নামেই বেশি পরিচিত, বৈজ্ঞানিক কার্ল গাথ ইয়ানস্কি সর্বপ্রথম মহাকাশ থেকে আসা বেতার তরঙ্গ সনাক্ত করেন— সেটা ১৯৩২ সাল। বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম বেতার দূরবীন তৈরি করেন আমেরিকার ইলিনয় শহরের গ্রোট রেবার। রেবার ছিলেন শখের বেতারবিদ, যদিও বিজ্ঞানে তাঁর জ্ঞান ছিল অসীম, এবং ডিগ্রি ছিল ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। নিজের বাড়ির পিছনের উঠোনে ৯ মিটার ব্যাসের অধিবৃত্তাকার প্রতিফলক বসিয়ে বেতার দূরবীন বানালেন রেবার— সালটা ১৯৩৭। রেডিও দূরবীনের প্রতিফলক ডিশের আয়তন দৃশ্যমান আলোকের দূরবীনের থেকে বড় হয়। তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের ব্যাবর্তন (ডিফ্র্যাকশন)-এর তত্ত্ব থেকে জানা যায় যে একই মাপের বস্তু খুঁটিয়ে দেখতে গেলে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে বলে অবজারভেশন্যাল রেজোলিউশন, যদি দুটি বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ক্রিয়াশীল দুটি আলাদা দূরবীন আমরা ব্যবহার করি, সেক্ষেত্রে সেই দূরবীনেরই আকার তুলনায় বড় হতে হবে যার ব্যবহৃত তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড়। উদাহরণস্বরূপ, এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে বড় এবং উচ্চক্ষমতাশালী (যদি শুধু মাপের কথা আসে তাহলে সোভিয়েত রাশিয়ার RATAN-৬০০ বেতার দূরবীন) একক বেতার দূরবীনের প্রতিফলকের ব্যাস ৫০০ মিটার বা ১৬০০ ফুট। ফাইভ হান্ড্রেড মিটার এপারচার স্ফেরিক্যাল টেলিস্কোপ— সংক্ষেপে FAST— নামের এই বেতার দূরবীনটি ২০১৬ সালে চিনদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে গুঝাউ প্রদেশে বসানো হয়েছে।

বেতার দূরবীনের পরে আস্তে আস্তে অন্যান্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের দূরবীন তৈরির কাজও শুরু হল। অবলোহিত রশ্মি নির্ভর দূরবীন, অতিবেগুনি রশ্মি নির্ভর দূরবীন, এক্স রশ্মি নির্ভর দূরবীন, এমনকি গামা রশ্মি নির্ভর দূরবীন নিয়েও এখন মহাকাশবিজ্ঞানীরা কাজ করেন। পর্যবেক্ষণের নতুন দিগন্ত খুলে গেছে, দৃশ্যমান পৃথিবীর বাইরে যা এতদিন লুকিয়ে ছিলো, সেই অবাংমানসগোচর মহাবিশ্বের গভীরে অনুসন্ধান চালাতে সক্ষম হয়েছে বিজ্ঞান।

মহাজাগতিক বস্তুর বর্ণসাংখ্যিক নামকরণের পদ্ধতি

অধ্যাপক শ্মিটের গবেষণার বস্তুটির নামকরণের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি তালিকা তৈরি হয় পঞ্চাশটি বেতার-উজ্জ্বল মহাজাগতিক বস্তুর। প্রকৃতপক্ষে তালিকাটি ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মান্থলি নোটিশেস অফ রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটি নামের মহাকাশ গবেষণা পত্রিকায়, গবেষণাপত্রটির নাম ছিল ‘আ প্রিলিমিনারি সার্ভে অফ রেডিও স্টারস ইন দ্য নর্দার্ন হেমিস্ফিয়ার’। এই ধরনের কাজ তখন একেবারেই নতুন। ফলে সেই পঞ্চাশটি বস্তু, যা কিনা বেতার তরঙ্গ বিকিরক, তার তালিকা বানিয়ে নাম দেওয়া হল ফার্স্ট কেমব্রিজ ক্যাটালগ। ফার্স্ট কেমব্রিজ শব্দবন্ধকে লেখা হত 1C বলে। ওই পঞ্চাশটি বস্তুর কোনও একটিকে বোঝাতে গেলে প্রথমে লেখা হত 1C, তারপরে সেই তালিকায় বস্তুটির অবস্থান কত নম্বরে, সেই সংখ্যাটি লেখা হত। নামকরণের এই পদ্ধতি থেকে এইটা পরিষ্কার যে 3C 273 হল তৃতীয় কেমব্রিজ ক্যাটালগের তালিকার দুই শত তিয়াত্তরতম সংযোজন (এন্ট্রি)। তৃতীয় কেমব্রিজ ক্যাটালগ তৈরি হয় ১৯৫৯ সালে, ১৮৯ সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বেতার বিকিরণ নিঃসরণকারী মহাজাগতিক বস্তুকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল কেমব্রিজেরই মালার্ড রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরি ব্যবহার করে। কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি বিভাগের গবেষকরা এই  তালিকা তৈরি করেন। এই তালিকায় এমন কিছু মাজহাগতিক বস্তুও ছিল যেগুলি 3C দিয়ে শুরু না হয়ে সাধারণভাবে অন্য নামে পরিচিত, যেমন M87, M82, সিগন্যাস এ, ক্যাসিওপিয়া এ ইত্যাদি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, সর্বশেষ কেমব্রিজ ক্যাটালগটি দশম কেমব্রিজ ক্যাটালগ বা 10C।

3C 48-এর পর্যবেক্ষণ এবং অস্বাভাবিক বর্ণালীরেখার উপস্থিতি

ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (সংক্ষেপে ক্যালটেক) মহাকাশবিজ্ঞান বিভাগ অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি সংক্রান্ত কর্মসূচিতে জড়িত। ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নেভাদার পূর্ব দিকে অবস্থিত ওয়েন ভ্যালিতে এরকমই একটি মানমন্দির আছে, যার নাম ওয়েন ভ্যালি রেডিও অবজারভেটরি। সেখানকার রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করে কয়েকটি বেতার তরঙ্গ নিঃসরণকারী বস্তুর মহাকাশে নিখুঁত অবস্থান বার করা হয়েছিল। সেই পর্যবেক্ষণের ফলাফল থেকে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির রেডিও-অ্যাস্ট্রোনোমির গবেষক অধ্যাপক টমাস আর্নল্ড ম্যাথ্যুজ মহাকাশের রেডিও ম্যাপ তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন, যাতে করে বোঝা যায় মহাকাশের কোন কোন ছায়াপথ থেকে তীব্র বেতার তরঙ্গের বিকিরণ হচ্ছে। যেহেতু ছায়াপথগুলি আলোক তরঙ্গও বিকিরণ করে, সেহেতু তাদেরকে দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গ ব্যবহারকারী দূরবীন দিয়েও দেখতে পাওয়া যাবে। এভাবেই দৃশ্যমান আলোকে দেখা মহাজাগতিক বস্তু এবং বেতার তরঙ্গে দেখা মহাজাগতিক বস্তুর অভিন্নতা প্রমাণ করা যাবে। অর্থাৎ  দেখানো যাবে যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে একই মহাজাগতিক বস্তু থেকে দৃশ্যমান আলো এবং বেতার তরঙ্গ দুটিরই নিঃসরণ ঘটে। বেতার দূরবীন এবং দৃশ্যমান আলোক নির্ভর, দুরকম দূরবীন দিয়েই সেক্ষেত্রে যাতে সেই বস্তুগুলি পর্যবেক্ষণ করা যায় তার একটা ব্যবস্থা হবে— ম্যাথুজের কাজের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেটাই।

এই গবেষণায় অধ্যাপক মার্টিন শ্মিট ম্যাথুজের সহযোগী গবেষক হিসেবে কাজ করছিলেন। অধ্যাপক শ্মিট-এর প্রধান কাজ ছিল গ্যালাক্সিগুলির আলোক বর্ণালী পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে তাদের লোহিত সরণ পরিমাপ করা (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরে করা হবে)। ১৮৪২ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ডপলার দেখিয়েছিলেন কোনও তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য পাল্টে যাবে যদি তরঙ্গের উৎস এবং শ্রোতার (শব্দ তরঙ্গের ক্ষেত্রে) বা পর্যবেক্ষকের (আলোক তরঙ্গের ক্ষেত্রে) মধ্যে আপেক্ষিক গতিবেগ থাকে। ধরা যাক বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছুটে আসছে। ট্রেনটি স্থির থাকলে বাঁশির আওয়াজ যেমন হত, শ্রোতা তার থেকে একটু আলাদা শুনবেন। শ্রোতা ও উৎস যদি পরস্পর দূরে সরে যায় তাহলে শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যাবে বেড়ে, অপরপক্ষে পরস্পরের দিকে এগিয়ে এলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যাবে।

একইভাবে ধরা যাক কোনও গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়ে আসা দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীর কথা। গ্যালাক্সি যদি পর্যবেক্ষকের থেকে দূরে সরে যায় তাহলে বর্ণালীর প্রতিটি রেখা লাল রঙের দিকে সরে যাবে, কারণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া মানে তরঙ্গের কম্পন কমে যাওয়া, সুতরাং আলোক তরঙ্গের শক্তি কমে যাওয়া। একেই বলে লোহিত সরণ।

এখন প্রশ্ন হলো গ্যালাক্সি কেন দূরে সরে যাবে? ১৯২৯ সালে এর উত্তর দিয়েছিলেন আমেরিকান মহাকাশবিজ্ঞানী এডুইন পাওয়েল হাবল। তিনি দেখান মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একটি অপরটির থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, কারণ মহাবিশ্বের এক সার্বিক সম্প্রসারণ হচ্ছে। এই দূরে সরে যাওয়ার গতিবেগও তিনি অঙ্ক কষে বার করেন, এবং কোন গতিবেগ নিয়ে একটি ছায়াপথ সরে গেলে তার আলোর কতটা পরিমাণ লোহিত সরণ হতে পারে সেটিও অঙ্ক কষে বার করা যায়। এই ধরনের লাল সরণকে বলা হয় কসমোলজিক্যাল রেড শিফট। ছায়াপথের বর্ণালীর লোহিত সরণ থেকে তার বয়স বার করার একটি নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক পদ্ধতিও রয়েছে। কসমোলজিক্যাল রেড শিফট-এর সঙ্গে ডপলার রেড শিফটের সূক্ষ্ম তফাৎ হল এই যে, কসমোলজিক্যাল রেড শিফটের কারণ স্থানের (স্পেস) প্রসারণ, কেবলমাত্র তরঙ্গের উৎস আর পর্যবেক্ষকের মধ্যে আপাত গতিবেগ নয় (প্রকৃতপক্ষে এই আপাত গতিবেগের উৎস মহাবিশ্বের প্রসারণই)।

তৃতীয় কেমব্রিজ ক্যাটালগের কয়েকটি বেতার তরঙ্গ নিঃসারী বস্তুর দৃশ্যমান আলোক-প্রতিরূপের (অপটিক্যাল কাউন্টারপার্ট) কথা ভাবেন অধ্যাপক ম্যাথুজ। ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে কাজ শুরু করলেন 3C 48-কে নিয়ে। এই কাজে প্রথমে তাঁরা যে প্রযুক্তি প্রয়োগ করলেন 3C 48-এর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য, তার নাম বেতার তরঙ্গের ব্যতিচার বিশ্লেষণ পদ্ধতি (রেডিও ইন্টারফেরোমেট্রি)। পর্যবেক্ষণীয় মহাকাশবিজ্ঞানে (অবজারভেশনাল অ্যাস্ট্রোনমি) বেতার ইন্টারফেরোমেট্রি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। এতে সাধারণত একাধিক বেতার দূরবীনের (বা এন্টেনার) একটি শ্রেণিসজ্জা তৈরি করা হয় এমনভাবে যাতে প্রতিটি দূরবীন আলাদা আলাদাভাবে একই লক্ষ্যবস্তুর থেকে আসা বেতার সঙ্কেত গ্রহণ করে। প্রতিটি দূরবীনে পাওয়া বেতার সঙ্কেতের উপরিপাত (সুপারপোজিশান) ঘটিয়ে যে সংহত তরঙ্গ নকশা (ইন্টারফিয়ারেন্স প্যাটার্ন) পাওয়া যায়, তাকে বিশ্লেষণ করে লক্ষ্যবস্তুর প্রতিরূপ নির্মাণ করা হয়। এভাবে পাওয়া প্রতিরূপের ইমেজ কোয়ালিটি অত্যন্ত উন্নত হয় কারণ প্রকৃতপক্ষে একাধিক দূরবীন (বা ডিশ/এন্টেনা) একসঙ্গে মিলে একটিমাত্র বিশাল আকৃতির দূরবীনের কাজ করে, যার কার্যকরী আকার সবকটি আলাদা আলাদা দূরবীন যতটা এলাকা জুড়ে ছড়ানো রয়েছে তার ক্ষেত্রফলের সমান। অধ্যাপক ম্যাথুজ এইভাবেই 3C 48 নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন।

প্রাথমিকভাবে মনে হল বস্তুটি একটি খুব কম ঔজ্জ্বল্যের নীলাভ তারার মতো কিছু। সেই নক্ষত্রসদৃশ বস্তুটির থেকে বেরিয়ে আসা দৃশ্যমান আলোকের বর্ণালীবীক্ষণের কথা ভাবা হল। মেক্সিকান মহাকাশবিজ্ঞানী গুইডো মানখ একসময় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈজ্ঞানিক সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখরের সহযোগী গবেষক ছিলেন। মানখ তখন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক। তিনি লস এঞ্জেলসের মাউন্ট উইলসন মানমন্দির এবং সান দিয়েগোর পালোমার মানমন্দির ব্যবহার করে নক্ষত্রের বর্ণালী বিশ্লেষণ সংক্রান্ত গবেষণা করছিলেন। আমেরিকান সৌরপদার্থবিদ জর্জ এলেরি হেলের নামে যার নামকরণ, বিখ্যাত সেই হেল টেলিস্কোপ পালোমার মানমন্দিরে আছে। দৃশ্যমান আলোক নির্ভর এই প্রতিফলক দূরবীনের ব্যাস ২০০ ইঞ্চি। একসময় পৃথিবীর বৃহত্তম অপটিক্যাল টেলিস্কোপ হিসেবে ব্যবহৃত হত। মহাকাশবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এই দূরবীন ব্যবহার করে হয়েছে। মানখ 3C 48-এর বর্ণালী পরীক্ষা করার চেষ্টা করলেন হেল দূরবীন দিয়ে। আমেরিকান বিজ্ঞানী অ্যালান রেক্স স্যান্ডেজও (যিনি প্রথম হাবল ধ্রুবক-এর মান নির্ণয় করেছিলেন) তখন মাউন্ট পালোমারে গবেষণা করছেন। ছিলেন অধ্যাপক জেসি লিওনার্ড গ্রিনস্টাইন, বসতেন অধ্যাপক শ্মিট-এর কয়েকটা ঘর পরেই। গ্রিনস্টাইনের গবেষণার অন্যতম বিষয় ছিল দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীবীক্ষণ। এঁরা প্রত্যেকেই 3C 48-এর বর্ণালী বিশ্লেষণ সংক্রান্ত কাজ শুরু করেন অধ্যাপক ম্যাথুজের সঙ্গে, বা আলাদাভাবে। এ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ান রেডিও জ্যোতির্বিদ জন গ্যাটেনবি বোল্টন, যিনি আমাদের ছায়াপথের বাইরের রেডিও নিঃসারক মহাজাগতিক বস্তু নিয়ে কাজ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন, তিনিও এ বিষয়ে গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন।

১৯৬০-এর সেপ্টেম্বরে অ্যালান স্যান্ডেজ হেল টেলিস্কোপ দিয়ে 3C 48-এর ছবি তুললেন। তারপর গ্রিনস্টাইন আর গুইডো মানখের সঙ্গে বর্ণালী বিশ্লেষণ করলেন তারকাসদৃশ বস্তুটির। বোল্টনও পিছিয়ে রইলেন না। তিনিও অংশ নিলেন বর্ণালীবীক্ষণে। দৃশ্যমান আলোর রেখা বর্ণালীর সঙ্গে সঙ্গে অতিবেগুনি রশ্মির অবিচ্ছিন্ন বর্ণালীও (কন্টিনিউয়াস স্পেক্ট্রাম) লক্ষ করা গেল। ছবিতে একটা অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার দেখা গেল, 3C 48-এর বর্ণালী কোনও চেনা নক্ষত্রের বর্ণালীর সঙ্গে মিলল তো নাই, বরং সেই বর্ণালীতে এমন কিছু নিঃসরণ এবং শোষণ বর্ণালীর রেখা দেখা গেল যা সম্পূর্ণভাবে সবরকম চেনা ছকের বাইরে পড়ে। মাস তিনেক বাদে, ২৯শে ডিসেম্বর, স্যান্ডেজ তাঁদের এই পর্যবেক্ষণের ফলাফল নিয়ে একটি গবেষণাপত্র পাঠ করলেন আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটির ১০৭তম সাধারণ সভায়। সেবারের সভা বসেছিল নিউ ইয়র্কে। সাধারণত এই ধরনের সভায় যে গবেষণাপত্র পড়া হয়, তা পরে আরও বিস্তৃতভাবে লিখে কোনও গবেষণা পত্রিকায় (পিয়ার রিভিউইড সায়েন্টিফিক জার্নাল) প্রকাশ করা হয়। আশ্চর্যের বিষয়, 3C 48 সংক্রান্ত যে গবেষণাপত্রটি নিউ ইয়র্কে পড়া হল, সেটি নিয়ে সেরকম কোনও বড় লেখা তৈরি হল না। শুধুমাত্র ১৯৬১ সালের স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ নামক সাময়িকপত্রে দু-এক লাইন খবর বেরোল এই নিয়ে, এবং ওয়াশিংটনের কার্নেগি ইনস্টিটিউটের নিজস্ব বার্ষিক প্রতিবেদনে এই ঘটনার উল্লেখ করা হল। এরপরে বোল্টন ফিরে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায় নিজের গবেষণার জায়গায়। তাহলে কি তাঁরা কেউই বুঝতে পারেননি কত বড় গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তাঁরা আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন নিজেদের অজান্তেই? পেরেছিলেন একজন, তিনি বোল্টন। কিন্তু তা প্রকাশ করেননি সংশয়ে।

3C 48-এর মতোই আরও দুটি বেতার তরঙ্গ নিঃসরণকারী তারকাসদৃশ বস্তু, 3C 196 এবং 3C 286 নিয়েও একই কাজ করলেন ম্যাথুজ এবং স্যান্ডেজ। পর্যবেক্ষণের ফলাফল প্রকাশ করলেন বিখ্যাত গবেষণা পত্রিকা অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে। অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালের প্রধান সম্পাদক তখন শিকাগো বিশবিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর। সেই গবেষণাপত্রে এই তিনটি বস্তুর বর্ণালীবীক্ষণের ফলাফলগুলি লিপিবদ্ধ করা হল। কিন্তু কেন যে বর্ণালীর রেখাগুলি ওরকম অস্বাভাবিক ক্রমে সাজানো, এবং কেনই বা রেখাগুলো সাধারণ নাক্ষত্রিক বর্ণালীর রেখার তুলনায় অনেক চওড়া (ব্রড এমিশন লাইন), সে ব্যাপারে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া গেল না।

3C 273-র গ্রহণ

১৯৬২।  অঙ্ক কষে দেখা গেল, তৃতীয় কেমব্রিজ ক্যাটালগের সপ্তম উজ্জ্বলতম বেতার নিঃসারী বস্তু 3C 273-র আংশিক ‘চন্দ্রগ্রহণ’ ঘটবে ১৫ই মে। অর্থাৎ সেইরাত্রে বস্তুটির সামনে দিয়ে চলে যাবে চাঁদ, এবং খানিক্ষণের জন্য পৃথিবী থেকে আংশিকভাবে তাকে দেখা যাবে না। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এই ঘটনাকে বলে অকাল্টেশন। বাংলায় বলা যেতে পারে সমাবরণ, বা সাধারণভাবে, গ্রহণ। অঙ্কের হিসেবে এটাও দেখা গেল যে সেই বছরেরই ৫ই আগস্ট পূর্ণ ‘চন্দ্রগ্রহণ’ হবে 3C 273-র। সাধারণত এই ধরনের অকাল্টেশানের সময় মহাজাগতিক বস্তু পর্যবেক্ষণ করে তাদের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিকরা তাই উৎসাহী হয়ে উঠলেন। এর আগে জার্মান-আমেরিকান জ্যোতির্বিদ রুডল্ফ মিনকোভস্কি সমাবরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে মহাকাশে 3C 273-র সঠিক অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করেছিলেন। রুডল্ফ ছিলেন জার্মান গণিতজ্ঞ হারম্যান মিনকোভস্কির ভাইপো। হারম্যান মিনকোভস্কি আইনস্টাইনের শিক্ষক ছিলেন, এবং আপেক্ষিকতা তত্ত্বে তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান বিশ্ববিদিত। চতুর্মাত্রিক স্থান ও সময়-এর একত্রীকরণ তাঁর নামেই পরিচিত মিনকোভস্কি স্পেসটাইম হিসেবে। রুডল্ফ নিজেও ছিলেন খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী। জার্মান জ্যোতির্বিদ ভিলহেল্ম হাইনরিশ ওয়াল্টার রাডে-র সঙ্গে যৌথভাবে তাঁর সুপারনোভা নিয়ে করা গবেষণা, বিশেষ করে টাইপ ওয়ান এবং টাইপ টু হিসেবে সুপারনোভাদের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কিত তাঁর কাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

দুর্ভাগ্যবশত রুডল্ফের তোলা অকাল্টেশানের ছবিতে 3C 273-র অবস্থান খুব বেশি সঠিকভাবে বোঝা যায়নি, যদিও সেটা বৈজ্ঞানিক হিসেবে রুডল্ফের সীমাবদ্ধতা নয়। পর্যবেক্ষণের আদর্শ পরিস্থিতি সেই অকাল্টেশানের রাত্রে তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানে, বিশেষত অবজারভেশনাল অ্যাস্ট্রোনমিতে এরকম হওয়া খুব স্বাভাবিক। সেজন্য ১৫ই মে এবং ৫ই আগস্টের অকাল্টেশন নিয়ে, পৃথিবী জুড়ে 3C 273 নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীদের উৎসাহের অন্ত ছিল না।

আবার অসাফল্য। ১৫ই মে-তে আংশিক অকাল্টেশানের জন্য ভালো করে ছবি তোলা গেল না। ৫ই আগস্টের জন্য এবার তাই একেবারে বাঘের মতো খাপ পেতে বসলেন বোল্টন— ছবি চাই-ই! কিন্তু শুরুতেই সমস্যা। অঙ্কের হিসেব বলছে সেদিন সমাবরণের সময় পার্কস টেলিস্কোপের পরিপ্রেক্ষিতে (অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের যে ৬৪ মিটার ব্যাসের বেতার দূরবীন দিয়ে বোল্টন পর্যবেক্ষণ চালাবেন বলে ঠিক করেছিলেন) 3C 273-র অবস্থান হতে পারে দিগন্তরেখার নিচে, ফলে অস্বাভাবিকভাবে নিচু করে হেলিয়ে আনতে হবে রেডিও দূরবীনের ডিশকে। পার্কস টেলিস্কোপের একটা লোহার সিঁড়ি খুলে, গিয়ার বক্সকে অন্যভাবে সরিয়ে, নিজে মেঝের ওপর একেবারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে, কোনওরকমে বোল্টন ব্যবস্থা করলেন টেলিস্কোপের ডিশকে এমনভাবে নিচে হেলানোর, যাতে দিগন্তরেখার অনেক নিচের দিকেও তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

ছবি তোলা গেল। ছবি অর্থে বেতার প্রতিরূপ। আশ্চর্য সে ছবি! পর্যবেক্ষণ থেকে মহাকাশে 3C 273-র মোটামুটি সঠিক অবস্থান জানা গেল। আরও দেখা গেল 3C 273 প্রকৃত প্রস্তাবে একটি নক্ষত্রসদৃশ উজ্জ্বল বস্তু যার থেকে লম্বাটে ‘কিছু একটা’ বেরিয়ে আসছে। এই ‘কিছু একটা’-কে জ্যোতির্বিজ্ঞানে বলা হয় জেট। কোনও নাক্ষত্রিক বা মহাজাগতিক বস্তু থেকে বিপুল পরিমাণে বস্তু ও শক্তি যখন লম্বা নল বা ফানেলের আকারে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে তখন তাকে জেট বলা হয়।

3C 273 সম্পর্কে কী কী জানা গেল অথবা গেল না?

তাহলে সংক্ষপে যেটা দাঁড়াল যে 3C 273-র অবস্থান জানা গেল, এবং জানা গেল সেটি একটি তারকাসদৃশ বস্তু যার থেকে উজ্জ্বল জেট বেরিয়ে আসছে। বোল্টনের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে এই আবিষ্কার করলেন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ সিরিল হ্যাজার্ড। হ্যাজার্ড আগেই ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে জডরেল ব্যাঙ্কের আড়াইশো ফুট ব্যাসের ডিশওয়ালা বেতার দূরবীন ব্যবহার করে তৃতীয় ক্যাটালগের আরেকটি রেডিও উৎস 3C 212-র মহাকাশে অবস্থান মেপেছিলেন অকাল্টেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে। হ্যাজার্ডকে প্রকৃত প্রস্তাবে বলা যেতে পারে অকাল্টেশন পদ্ধতিতে মহাকাশে রেডিও উৎসের অবস্থান নির্ধারণ পদ্ধতির আবিষ্কারক। আরও দুজন জ্যোতির্বিদের সঙ্গে হ্যাজার্ড 3C 273-র অবস্থান সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের ফলাফল নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক গবেষণা পত্রিকা নেচারে। গবেষণাপত্রের নাম ‘ইনভেস্টিগেশন অফ দ্য রেডিও সোর্স 3C 273 বাই দ্য মেথড অফ লুনার অকাল্টেশন’। সম্ভবত তৃতীয় কেমব্রিজ ক্যাটালগের অন্তর্গত আর কোনও রেডিও উৎস নিয়েই এত নিখুঁত পর্যবেক্ষণ এর আগে হয়নি। এবং খুব সম্ভবত মহাকাশের কোনও রেডিও উৎস নিয়েই এত নিখুঁত, বিস্তারিত, এবং গভীরে গিয়ে গবেষণা এর আগে হয়নি। সে হিসেবে সিরিল হ্যাজার্ডের কাজ রেডিও জ্যোতির্বিদ্যায় পথিকৃৎ।

কিন্তু তখনও জানা গেল না 3C 273 কী ধরনের রেডিও উৎস। তারকাসদৃশ চেহারা বটে, কিন্তু সত্যিই কি সেটি নক্ষত্র? যদি তাই হয় তাহলে তার ভেতরে কোন কোন মৌলর দহনের ফলে শক্তি উৎপাদন হচ্ছে? 3C 273 কি আমাদের ছায়াপথের মধ্যেই, নাকি সে বহির্বিশ্বের অধিবাসী? এগুলো জানার জন্য 3C 273 থেকে নিঃসরিত দৃশ্যমান আলোকের বর্ণালীর বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন।

3C 273-র বর্ণালী-বিশ্লেষণ

এইখানে মাঠে নামলেন মার্টিন শ্মিট, এবং মহাকাশবিজ্ঞানের সামগ্রিক ধ্যানধারণার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এল 3C 273 বর্ণালী বিশ্লেষণের সূত্রে। শুধু মহাকাশবিজ্ঞানেই নয়, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ, কেন্দ্রীণ-পদার্থবিজ্ঞান (নিউক্লিয়ার ফিজিক্স), এবং সামগ্রিকভাবে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানেই। তারই হাত ধরে মহাবিশ্বের অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের (সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল) কল্পন, উপপ্রমেয় (হাইপোথিসিস), শেষে ‘আবিষ্কার’— এবং সেই সংক্রান্ত বিষয়ে এই বছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি দুই পর্যবেক্ষণমূলক মহাকাশবিজ্ঞানীর। দু হাজার কুড়ি সালের পদার্থবিদ্যার নোবেলের গুরুত্বটা কোথায়, সেটা বুঝতে গেলে তাই বিজ্ঞানের ইতিহাসে শ্মিট-এর আবিষ্কারের ভূমিকাটা সম্যক জানতে হবে।

আগেই বলা হয়েছে, বেতার তরঙ্গ নিঃসারী মহাজাগতিক বস্তুর বর্ণালী বিশ্লেষণের কাজ শ্মিট শুরু করেছিলেন ১৯৬০-এর শেষের দিকে অধ্যাপক ম্যাথুজের সঙ্গে। টমাস ম্যাথুজ তখন অধ্যাপক এলান রেক্স স্যান্ডেজের সঙ্গে জুড়ি বেঁধে ওয়েন ভ্যালি রেডিও ইন্টারফেরোমিটার ব্যবহার করে আকাশে বেতার তরঙ্গ নিঃসারক ছায়াপথের (রেডিও গ্যালাক্সি) অবস্থান নির্ণয় করার কাজে ব্যাস্ত। শ্মিট সেইসব ছায়াপথের বর্ণালীর বিশ্লেষণ শুরু করলেন। মহাজাগতিক বস্তু যে সব মৌল দিয়ে তৈরি, গ্যাসীয় অবস্থায় সেগুলি নির্দিষ্ট বিকিরণ রেখা উৎপন্ন করে, সেই বর্ণালীতে রেখাগুলির অবস্থান দেখে সেই মৌলকে চিহ্নিত করা যায়। টম ম্যাথুজ গোটাপাঁচেক রেডিও গ্যালাক্সির উপাত্ত শ্মিটকে দিলেন বর্ণালী বিশ্লেষণ করার জন্য। সেটা ১৯৬২-র শেষদিক।

সদ্য সদ্য বড়দিন পেরিয়েছে, শ্মিট কদিন আগে এসেছেন পালোমার মানমন্দিরে। ম্যাথুজের দেওয়া পাঁচটা রেডিও গ্যালাক্সির (3C48, 3C286, 3C196, 3C147, এবং 3C273) বর্ণালী খুঁটিয়ে দেখার কাজ শুরু করলেন। 3C 273-র কিছু উপাত্ত ম্যাথুজ অস্ট্রেলিয়াতে সিরিল হ্যাজার্ড আর জন বোল্টনের থেকে পেয়েছিলেন। 3C 273-র নক্ষত্রসদৃশ আকার, কিন্তু তারই সঙ্গে অব্যাখ্যাতভাবে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসা জেটের মতো গঠন 3C 273-কে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছিল। ফলে শ্মিট সেটির দিকে নজর দিলেন বিশেষভাবে। গোটা ছয়েক সুনির্দিষ্ট রেখা পেলেন বর্ণালীতে, তার মধ্যে ৭৬০০ আংস্ট্রম (এক আংস্ট্রম এক মিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ) তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটা অবলোহিত রেখাও ছিল। ক্যালটেকের অধ্যাপক জন বেভারলি ওক-এর সঙ্গে শ্মিটের আলোচনা চলছিল তখন এই নিয়ে। বেশ কিছুদিন কেটে গেল— শ্মিট খুবই দোলাচলে নিজের কাজ নিয়ে, কারণ 3C 273-র বর্ণালীর রেখাগুলির সঙ্গে, সামগ্রিকভাবে কোনও জানা মৌলের রেখা বর্ণালীর মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ওদিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে বোল্টন তাড়া দিচ্ছেন— এত খাটাখাটনি করে অকাল্টেশনের মাধ্যমে যা ফলাফল তাঁরা পেয়েছেন 3C 273 নিয়ে, সিরিল হ্যাজার্ডের সঙ্গে মিলে বোল্টন তা দ্রুত প্রকাশ করতে চান নেচার পত্রিকায়। ওঁরা চান যে শ্মিটও সেখানে 3C 273-র বর্ণালী নিয়ে কিছু লিখুন, আলাদা করে কিন্তু তাঁদেরই সহযোগী প্রবন্ধ হিসেবে। শ্মিট বসলেন লিখতে। লেখার কাজ এগোচ্ছে না ভালো, কারণ কী লিখবেন নিজেই সেভাবে জানেন না— কেন 3C 273 বর্ণালী রেখাকে কোনও চেনা মৌলের রেখা বর্ণালী দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, সে বিষয়ে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। 3C 273-র মধ্যে কি তাহলে বিজ্ঞানের অজানা কোনও নতুন মৌলের সন্ধান পাওয়া গেল? তাও বোঝা যাচ্ছে না সুনিশ্চিতভাবে…

তারপর সেই ঐতিহাসিক ৫ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৩)! মঙ্গলবারের দুপুর, নিজের অফিসে বসে শ্মিট নেচারের লেখাটা তৈরি করছেন আর অন্যমনস্কভাবে বার বার তাকাচ্ছেন হাতের কাছে রাখা 3C 273-র বর্ণালী রেখার ছবিগুলোর দিকে। ‘আচ্ছা, একটা ব্যাপার একটু অদ্ভুত না?’— ভাবলেন শ্মিট— ‘যে ছটা বর্ণালী রেখা দেখা যাচ্ছে সামনে, তার মধ্যে একদিকের লালটা, আর একেবারে অন্যধারের অতিদূর-নীল (ফার ব্লু) লাইনটা যদি তুলে নেওয়া যায়, তাহলে কিন্তু রেখাবর্ণালীর বাকি অংশটায় একটা নির্দিষ্ট চেনা নকশা থাকে। এটা কীরকম হল?’

প্রথমে একটা এনার্জি লেভেল ডায়াগ্রাম এঁকে দেখলেন (এনার্জি লেভেল ডায়াগ্রাম, বা গ্রোট্রিয়ান ডায়াগ্রাম, জার্মান মহাকাশবিজ্ঞানী ওয়াল্টার রবার্ট ভিলহেল্ম গ্রোট্রিয়াম এর নামে। আঁকলে বোঝা যায় পারমাণবিক পর্যায়ে এক শক্তি স্তর থেকে অন্য শক্তি স্তর সংক্রমণে কী ধরনের বর্ণালী রেখার সৃষ্টি হতে পারে কত তরঙ্গদৈর্ঘ্যে)। বিশেষ কোনও কিছু বুঝে ওঠা সম্ভব হল না। তখন বসলেন কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ করতে। রেগুলার প্যাটার্নের যে চারটে রেখা বর্ণালী, তার প্রথম রেখাটা, তার সবচেয়ে কাছাকাছি কম্পাঙ্কের হাইড্রোজেন বর্ণালীর রেখার (হাইড্রোজেন বামার লাইন, সুইশ গণিতজ্ঞ ইয়োহান ইয়াকোভ বামারের ১৮৮৫ সালের আবিষ্কারের ভিত্তিতে নামকরণ যার) তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে ১.১৬ গুণ বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের।

‘তাই?’— ভাবলেন শ্মিট— ‘বাকি রেখাগুলোও তাদের কাছাকাছি বামার লাইনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব নাকি একবার?’

মেলানো হল, এবং দেখা গেল 3C 273-র বর্ণালী রেখার প্রত্যেকটি তার নিকটতম বামার লাইনের থেকে ১.১৬ গুণ বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। তাহলে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে বামার সিরিজের রেখাগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ষোলো শতাংশ বাড়িয়ে দিলে 3C 273-র বর্ণালী রেখার মধ্যে চারটের ব্যাখ্যা হয়ে যায়।

‘বাকি রেখাদুটোর কী হবে তাহলে?’— ভাবলেন শ্মিট।

সেটাও পাওয়া গেল। একটা ম্যাগনেসিয়াম II-এর রেখা ষোলো শতাংশ বেড়ে গিয়ে, আরেকটা O III-এর রেখা ষোলো শতাংশ বেড়ে গিয়ে।

‘তার মানে কি 3C 273-র পুরো বর্ণালীটাই চেনা বর্ণালীর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ষোলো শতাংশ বেড়ে গিয়ে তৈরি?’

বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান আবিষ্কার

আর তখন, একমাত্র তখনই, বিদ্যুচ্চমকের মতো শ্মিট-এর মাথায় এল উনি আসলে ষোলো শতাংশ লোহিত সরণের একটা বর্ণালী দেখছেন চোখের সামনে। 3C 273 আসলে ষোলো শতাংশ রেড শিফটেড!

কিন্তু তা কী করে হয়? ষোলো শতাংশ লোহিত সরণ ছায়াপথের জন্য সেরকম কিছু না, কিন্তু 3C 273 তো একটা তারকাসদৃশ বস্তু (তখন পর্যন্ত যা ধারণা ছিল)। একটা তারার এত বেশি লোহিত সরণ কীভাবে সম্ভব?

উত্তেজনায় ছিটকে বেরিয়ে পড়লেন অফিসঘর থেকে। কয়েকটা ঘর বাদেই জেসি লিওনার্ড গ্রিনস্টাইনের ঘর। তাকে প্রায় হাত ধরে টেনে আনলেন নিজের অফিসে। গ্রিনস্টাইন নিজেও 3C 273 নিয়ে কাজকর্ম করেছেন। গ্রিনস্টাইনকে খুলে বললেন সব। গ্রিনস্টাইন, আত্যন্তিক উত্তেজনায় অবশ হয়ে গেলেন পুরো (শ্মিটের নিজের ভাষায় ‘…he sat down and he got pale when he heard it.‘)।

‘মার্টিন! 3C 48-এর বর্ণালীটা একবার দেখলে হয় না?’ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন গ্রিনস্টাইন।

দেখা হল। এবং সেখানেও সাঁইত্রিশ শতাংশ লোহিত সরিত ম্যাগনেশিয়াম II-র রেখা এল। শ্মিটের অফিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন বেভারলি ওক, তিনিও এসে জুটলেন। খানিক আলোচনার পর তিনজনে উদভ্রান্ত হয়ে অফিস ছাড়লেন। সোজা গ্রিনস্টাইনের বাড়ি, কোনও কথা না বলে, সে বাড়ির আর কাউকে কোনও ভদ্রতাসূচক সম্ভাষণ না জানিয়ে সোজা পানীয় নিয়ে বসে গেলেন আলোচনায়। গ্রিনস্টাইনের স্ত্রী নাওমি হতভম্ব! এইরকম ব্যবহার নিজের স্বামী বা তার বন্ধুদের তো কোনওদিন দেখেননি নাওমি। হলটা কি এদের?— ভাবলেন তিনি।

বহু আলোচনার পর এটাই সাব্যস্ত হল যে এই লোহিত সরণ কসমোলজিক্যাল রেড শিফট ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু তার মানেটা দাঁড়াচ্ছে সাংঘাতিক। নক্ষত্রসদৃশ এই বস্তু তার মানে আমাদের ছায়াপথের বাইরের বহু বহু দূরের বস্তু। এবং মাত্র ওইটুকু আকার থেকে বেরিয়ে আসছে অব্যাখ্যাত অপরিসীম শক্তি। এরকম কোনও মহাজাগতিক বস্তুর উল্লেখ, বা থাকার ব্যাখ্যা তো মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে নেই (তখনও পর্যন্ত)!

সেই রাত্রে শ্মিট ঘুমাতে পারেননি একবিন্দু। সারাটা সন্ধে, রাত, টানা পায়চারি করে গেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়— ‘খাঁচায় বন্দি বাঘের মতো।’ ১৯৭৫ সালের ১০ই মার্চ, ক্যালটেকে শ্মিটের অফিসে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন পল রাইট। সেখানে শ্মিট বলছেন—

‘And I remember that night, in the evening, in the living room I paced up and down like a caged tiger for probably hours.’

আনন্দ। উত্তেজনা। এবং তার সঙ্গে ভয়। এত বড় আবিষ্কার সত্যিই হল কি? পরে খুঁজলে বেরোবে না তো কোনও ভুল রয়ে গেছে গণনায়, কাজটাই অর্থহীন পুরো? নেচারে পেপার জমা দেওয়া নিয়ে (‘3C 273: আ স্টারলাইক অবজেক্ট উইথ লার্জ রেডশিফট’, শ্মিট, মার্টিন, নেচার, ১৬ই মার্চ, ১৯৬৩, পেজ নাম্বার ১০৪০। মাত্র আধপাতার একটা পেপার বিজ্ঞানের ইতিহাসে এত বেশি আলোড়ন তোলেনি কখনও। বাকি আধপাতায় প্রকাশিত হয় বেভারলি ওকের একক, অর্থাৎ সোলো-অথর্ড গবেষণাপত্রের ‘অ্যাবসল্যুট এনার্জি ডিস্ট্রিবিউশন ইন দ্য অপটিক্যাল স্পেকট্রাম অফ 3C 273’ প্রথমাংশ। পরে এই বিষয়ে শ্মিট পরপর অনেকগুলি গবেষণাপত্র লেখেন, কখনও একা, কখনও সহকর্মীদের সঙ্গে, নেচার এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল নামের গবেষণা পত্রিকায়) শ্মিট বলছেন—

 

‘..There was in the beginning, certainly with me, a deep worry that we were missing something completely, that we were being fooled somehow. And that, and I remember that was the main worry with me certainly for two or three weeks.

One felt that there might be a big trap. That you might feel after you had published it and somebody came up with a simple way out that showed that things were not so extraordinary at all.

And yet, we thought as hard as we could and we told our colleagues and we simply couldn’t think of anything that was really a way out.

At that time it was real agonizing about science. Later on there came agonizing about publicity, you know, just publicity to such a degree that it became enormous pressure.

That was really what was, of course, going through my head when I was pacing up and down that night. Boy, I’ll have to say something, what do I say, do I believe it, is there a way out, what does it mean for astronomy?

..

I mean before 1963 things were so unlike after 1963, there was no way to compare it. So in a sense the agony and the pressure of making a good on-the-spot scientific judgment just in one day essentially, the fifth of February, was a very interesting one.’

 

কোয়েজার এবং সক্রিয় ছায়াপথ

মাত্র ছয়টি বর্ণালী রেখার গুরুত্ব অপরিসীম, অনন্ত। 3C 273 দেখাল, নক্ষত্রসদৃশ আকার হয়েও সে একটা পুরো (সাধারণ) ছায়াপথের থেকেও বহুগুণ বেশি শক্তিনিক্ষেপ করে। সে আমাদের ছায়াপথের সদস্য নয়, বহু বহু দূরে তার ঘর, পৃথিবী থেকে প্রায় ২৫ কোটি আলোকবর্ষ (এক বছরে আলো শূন্যস্থানে যতটা ভ্রমণ করে তার হিসাব আলোকবর্ষ দিয়ে, ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার) দূরে। এবং তার বর্ণালীর লোহিত সরণ দেখাল মহাবিশ্ব আসলে ক্রমপ্রসরমান। মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং তার অন্তিম দশা সম্পর্কে তাত্ত্বিক যে ধারণা ছিল ‘অচল অবস্থার তত্ত্ব’ নামে (স্টেডি স্টেট থিওরি, যা বলে এসেছে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, মোটামুটি কিছু লোকাল ইররেগুলারিটি বাদ দিলে মহাবিশ্বের সামগ্রিক চরিত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টায় না তেমন), তার বদলে মহাবিস্ফোরণ (বিগ ব্যাং) এবং প্রসরণশীল মহাবিশ্বের (এক্সপ্যান্ডিং ইউনিভার্স) তত্ত্বের ওপরে জোরালো ছাপ মেরে দিল 3C 273 বর্ণালী রেখার লোহিত সরণ। বহুদূরের বস্তু মানে বহু পুরনো বস্তুও বটে, কারণ আলো এসে আমাদের চোখে (বা টেলিস্কোপে) পৌঁছতে লেগে যাচ্ছে বহু বছর। ফলে 3C 273-র মতো নক্ষত্রসদৃশ বস্তুরা যদি শুধু বহু দূরেই ঘর বাঁধে, তার মানে সমস্ত ছায়াপথ (বা মহাজাগতিক বস্তু) সমসত্ত্বভাবে ছড়ানো নেই বিশ্বে (ইউনিফর্ম ডিস্ট্রিবিউশন ইন স্পেস অ্যান্ড টাইম)। ফলত অচল অবস্থার তত্ত্বের সেভাবে মানে দাঁড়ায় না কোনও।

3C 273 প্রভূত পরিমাণে বেতার তরঙ্গও বিকিরণ করে, সেটা জানা ছিল। এবারে আস্তে আস্তে আরও সেরকম তীব্র বেতার তরঙ্গ নিঃসারী বস্তুর সন্ধান পাওয়া যেতে লাগল এক এক করে। তারা আকারে ছোট (সম্পূর্ণ একটা ছায়াপথের তুলনায়), অনেক দূরে আছে (বর্ণালী যথেষ্ট পরিমাণে কসমোলজিক্যালি রেড শিফটেড), এবং অত্যুজ্জ্বল (বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে)। সমষ্টিগতভাবে তাদের নামকরণ করা হল কোয়াসি স্টেলার রেডিও সোর্সেস, সংক্ষেপে কোয়েজার (QUASAR)। সাংহাইজাত চাইনিজ আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমার হং-ই-চিউ, পরে যিনি নাসাতে কাজ করতেন, কোয়েজার নামটি প্রথম ব্যবহার করেন ১৯৬৪ সালে, ফিজিক্স টুডে নামের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘গ্র্যাভিটেশনাল কোলাপ্স’ শীষর্ক প্রবন্ধে। কোয়েজারের আবিষ্কার অসম্ভব গুরুত্ব পেয়েছিল সেই সময়ে। ১৯৬৬ সালের টাইম ম্যাগাজিনের ১১ই মার্চ সংখ্যার প্রচ্ছদ হয় মার্টিন শ্মিটকে দিয়ে, এবং ‘দ্য ম্যান অন দ্য  মাউন্টেন’ নামে প্রচ্ছদ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জর্জ গ্যামো প্রচলিত নার্সারি রাইম পাল্টে দিয়ে কোয়েজার নিয়ে ছড়া কাটেন (নিউজউইক পত্রিকার ২৫শে মে, ১৯৬৪ সালের সংখ্যার এক প্রতিবেদনে প্রথম প্রকাশিত)—

‘Twinkle, twinkle, quasi-star
Biggest puzzle from afar
How unlike the other ones
Brighter than a billion suns
Twinkle, twinkle, quasi-star
How I wonder what you are.’

পরবর্তী কয়েক বছরে যেটা জানা গেলো, 3C 273 বা আরও অন্য কোয়েজারগুলি আসলে বিশেষ ধরনের এক একটি ছায়াপথের কেন্দ্রের প্রতিরূপ। সেই ছায়াপথকে নাম দেওয়া হল সক্রিয় ছায়াপথ (অ্যাক্টিভ গ্যালাক্সি)। সক্রিয় ছায়াপথগুলির কেন্দ্রের খুব ছোট অঞ্চল— মোটামুটি ৩.২৬ আলোকবর্ষ ব্যাসের (এখানে অবশ্য উল্লেখযোগ্য যে কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মাপ বোঝাতে গেলে কী পদ্ধতিতে মাপা হচ্ছে সেটার ওপরে মাপ অনেকটাই নির্ভর করে, যেমন এক্স রে ভেরিয়েবিলিটি দিয়ে মাপলে ফলাফল প্রায় দশ হাজার গুণ কম আসতে পারে। তবে সে সব টেকনিক্যাল জটিলতা নিয়ে আলোচনা করা এই প্রতিবেদনের ক্ষুদ্র অবকাশে সম্ভব না) বা ক্ষেত্রবিশেষে আরও খানিকটা বেশি (তুলনামূলকভাবে বেশি দূরেরগুলির জন্য)। কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলি অত্যন্ত উজ্জ্বলও বটে। এখানে খুব ছোট শব্দবন্ধটি আপেক্ষিক, সমগ্র ছায়াপথের (যার কেন্দ্রে কোয়েজার রয়েছে, হোস্ট গ্যালাক্সির) তুলনায় খুব ছোট বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাদের আকাশগঙ্গা (মিল্কি ওয়ে) ছায়াপথের (যদিও সেটি সক্রিয় ছায়াপথের নয়) ব্যাস মোটামুটি ৯৭৮০০ আলোকবর্ষ মাপের। সক্রিয় ছায়াপথগুলির অত্যুজ্জ্বল কেন্দ্রীয় অঞ্চলকে বলা হল অ্যাক্টিভ গ্যালাকটিক নিউক্লিয়াই, বা সংক্ষপে AGN (এখন থেকে আমরা AGN শব্দটিই ব্যবহার করব)। সাধারণ ছায়াপথের (যেমন আকাশগঙ্গা) থেকে সক্রিয় ছায়াপথের প্রধান পার্থক্য AGN-এর অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতায়— যে উজ্জ্বলতার ব্যাখ্যা, সেই সময়ের পদার্থবিজ্ঞানের কোনও নিয়ম মেনে দেওয়া গেল না।

ছায়াপথের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের উজ্বলতা বলতে আমরা বুঝি নক্ষত্রসমষ্টির উজ্জ্বলতা— কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মধ্যে যতগুলি নক্ষত্র সন্নিবিষ্ট আছে তাদের মোট উজ্জ্বলতা। নক্ষত্র শক্তি উৎপাদন করে তাপ পারমাণবিক বিক্রিয়ার (থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন) মাধ্যমে, যেখানে একাধিক হালকা পরমাণু জুড়ে গিয়ে ভারী পরমাণু তৈরি হয়, এবং উৎপন্ন পরমাণু ও উৎপাদক পরমাণুর ভরের পার্থক্য বিপুল পরিমাণে শক্তি হয়ে বেরিয়ে আসে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের সূত্র মেনে। ঘটনা হল, তাপ পারমাণবিক প্রক্রিয়ায় কোনও নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে থাকা নক্ষত্রগুলির (তা সেই নক্ষত্রগুলি যতই ঘনসন্নিবিষ্ট থাক না কেন) থেকে সর্বোচ্চ যতটা শক্তি বেরিয়ে আসতে পারে, একই আয়তনের AGN থেকে বেরিয়ে আসা শক্তি তার লক্ষ কোটি গুণেরও বেশি। অর্থাৎ তাপ পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন বিক্রিয়ার মাধ্যমে AGN-এর উজ্জ্বলতার ব্যাখ্যা দেওয়া গেল না।

এবং কেন্দ্রীন-পদার্থবিদ্যার এই অপারগতার নিহিতার্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোয়েজার আবিষ্কার হওয়ার আগে বিশ্বাস করা হত তাপ-পারমাণবিক বিক্রিয়াই মহাবিশ্বে সর্বোচ্চ মাপের শক্তি উৎপাদক বিক্রিয়া। থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশনে যা শক্তি উৎপন্ন হয়, তার থেকে বেশি শক্তি উৎপাদন করা পদার্থবিজ্ঞানের কোনও নিয়মেই সম্ভব না। কোয়েজারের আবিষ্কার সেই ধারণার একেবারে মূলে কুঠারাঘাত করল। AGN-এর উজ্জ্বলতার ব্যাখ্যা দেওয়া তাই সমগ্র তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার সামনেই একটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল।

অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের প্রস্তাবনা

সোভিয়েত-আর্মেনিয়ান মহাকাশবিজ্ঞানী ভিক্তর আমাজাসপভিত্স আমবার্টসুমিয়ান ১৯৫৮ সালের ব্রাসেলস সলভে কনফারেন্সে বলেন ছায়াপথগুলির কেন্দ্রে নক্ষত্ররা ছাড়াও ‘অন্য কিছু’ আছে। যদিও এই হাইপোথিসিসের কোনও তাত্ত্বিক প্রমাণ তিনি সেরকম যুক্তিনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেননি, বা সেই ‘অন্য কিছু’ কী, তা নিয়ে খুব ভালোভাবে কোনও বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। তবুও, ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে, আমবার্টসুমিয়ানই সম্ভবত ছায়াপথের কেন্দ্রে অনাক্ষত্রিক ঘটনাবলির (নন স্টেলার অ্যাক্টিভিটিজ) কথা প্রথম উল্লেখ করেন। তবে একথা মনে রাখার দরকার যে তারও বহু আগে, সেই ১৯২৯ সালে স্যার জেমস জিনস ছায়াপথের কেন্দ্রে পদার্থ উৎপাদনের ব্যাপারে কিছু তাত্ত্বিক সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন, যদিও তা খুবই ভাসাভাসাভাবে।

AGN-এর শক্তি উৎপাদন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাত্ত্বিক মহাকাশবিজ্ঞানীরা ষাটের দশকের শেষের দিকে কৃষ্ণগহ্বর উপপ্রমেয় (ব্ল্যাক হোল হাইপোথিসিস)-এর কথা বলেন। এই ধারণা অনুযায়ী, প্রতিটি AGN-এর কেন্দ্রে একটি অতিভারী (লক্ষাধিক সূর্যের মিলিত ভরের থেকে বেশি) কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে। তার চারিপাশের আন্তর্নাক্ষত্রিক মহাজাগতিক পদার্থ ভীমবেগে আছড়ে পড়ছে সেই কৃষ্ণগহ্বরের ওপরে, এবং এই পদ্ধতি— যা অ্যাক্রেশন (accretion) নামে পরিচিত— কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশের বিপুল পরিমাণ মহাকর্ষীয় স্থিতিশক্তিকে তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণে পরিবর্তিত করে যোগান দিচ্ছে কোয়েজারের (বা সাধারণভাবে যে কোনও AGN-এর) অনৈসর্গিক উজ্জ্বলতার। ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে এই বিষয়ে বহু কাজ আছে, তবে সাধারণভাবে কেমব্রিজের ইন্সটিট্যুট অফ অ্যাস্ট্রোনমির অধ্যাপক স্যার ডোনাল্ড লিন্ডেন বেল, সোভিয়েত মহাকাশবিজ্ঞানী ইয়াকোভ বরিসোভিৎস জেলদোভিচ এবং তাঁর এককালের পিএইচডি ছাত্র ইগোর দিমিত্রিয়েভিত্স নোভিকভ (বর্তমানে ডেনমার্কের কোবেনহ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ইনি এ বছর স্যার রজার পেনরোজ এবং কিপ থর্নের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে স্যার আর্চিবল্ড হুইলার পুরস্কার পেয়েছেন কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য), এবং ভিয়েনিজ জোতিঃপদার্থবিদ এডুইন আর্নেস্ট সলপেটার (কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন)— এই চারজনকেই মোটামুটিভাবে অ্যাক্রেটিং ব্ল্যাক হোল হাইপোথিসিস-এর জনক বলে ধরা হয়ে থাকে। যদিও একথা কখনওই ভুললে চলবে না যে পড়াশোনার অন্য অনেক শাখার মতোই, বিজ্ঞানেও, বিশেষ করে তত্ত্বীয় বিজ্ঞানে, যে কোনও আবিষ্কারের পেছনে বহু মানুষের অবদান থাকে, কিন্তু বিখ্যাত হয়ে ওঠেন বিশেষ কয়েকজন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও, এটাই ঘটনা।

নাক্ষত্রিক ভরের কৃষ্ণগহ্বর

এই যে অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরের প্রস্তাবনা, এর মানে কিন্তু এই নয় যে কোয়েজার আবিষ্কারের আগে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা হয়নি। হয়েছে। কিন্তু সেই সমস্ত কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম ইতিহাস অন্যরকম। সেগুলি ছিল তুলনায় ছোট, সূর্যের ভরের সমান বা কয়েকগুণ, তাই তাদের নাম তারকাসদৃশ ভরের কৃষ্ণগহ্বর (স্টেলার মাস ব্ল্যাক হোল)। এরা নক্ষত্রের জীবনচক্রের শেষ দশা। মহাজাগতিক আণবিক মেঘমালা (ইন্টারস্টেলার মলিকুলার ক্লাউড) ঘনীভূত হয়ে নক্ষত্র তৈরি হওয়ার পর তার কন্দরে শুরু হয় তাপ পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হওয়া নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ বরাবর ক্রিয়াশীল বহির্মুখী তাপীয় চাপ (থার্মাল প্রেশার) জনিত বল অন্তর্মুখী মহাকর্ষকে আটকে রাখে, ফলে দুই প্রকার বলের সাম্য নক্ষত্রকে রক্ষা করে মহাকর্ষভঙ্গ (ফার্দার গ্র্যাভিটেশনাল কোল্যাপস) থেকে। নক্ষত্রের পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে এলে এই সাম্য বিঘ্নিত হয়। অঙ্ক কষে দেখানো যায় যে নক্ষত্রের প্রাথমিক ভর (প্রজেনিটোর মাস) একটি নির্দিষ্ট সীমার বেশি হলে, জীবনচক্রের শেষ ভাগে এসে সেটি জ্বালানি ফুরিয়ে অনিয়ন্ত্রিত মহাকর্ষভঙ্গের (ইনডেফিনিট গ্র্যাভিটেশন্যাল কোল্যাপস) জন্য গুটিয়ে, কুঁচকে ছোট হয়ে বিন্দুবৎ স্ট্রাকচারে পরিণত হয়। সেই অন্তিম দশার চারপাশের মহাকর্ষের টান এত প্রবল যে কোনওকিছুই তাকে কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না, এমনকি দৃশ্যমান আলোও (বা যে কোনও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে কোনও ধর্মের তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ) না। ফলে বিন্দুবৎ স্ট্রাকচারটি হয়ে থাকে চির আঁধারের রাজত্ব— তাকে কোনওদিনই দেখা সম্ভব হয় না। তাই সে ব্ল্যাক। এই স্টেলার মাস ব্ল্যাক হোল, যা আসলে একটি বিন্দুবৎ স্ট্রাকচার (সিঙ্গুলারিটি), তা আবৃত থাকে একটি একমুখী পৃষ্ঠতল দিয়ে, যাকে বলা যেতে পারে ঘটনা দিগন্ত (ইভেন্ট হরাইজন)— একমুখী, কারণ বস্তু বা বিকিরণ (অর্থাৎ মহাবিশ্বের কোনও তথ্যই, কারণ বস্তু বা বিকিরণই তথ্যের বাহক) একবার তা (বাইরের দিক থেকে) পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলে আর কখনওই বেরিয়ে আসতে পারে না। আপতিত তথ্যের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মহাবিশ্বের থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়া (অবশ্যই এখানে ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার কথা বলা হচ্ছে, কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী হারিয়ে যাওয়া তথ্য ফিরে আসা সম্ভব হকিং বিকিরণের মাধ্যমে— কিন্তু সেই প্রসঙ্গ আলোচনা করার সুযোগ আপাতত এখানে নেই)। এই প্রসঙ্গে কবি বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ‘মধ্যরাতের হল্ট’ মনে পড়ে। হারিয়ে যাওয়ার তীব্র আর্তি থেকে কবি লিখেছিলেন:

এখানে গভীর রাত, এখানে সবাই গভীর ঘুমিয়ে আছে…
এখানে চাকার শব্দ চিরতরে থেমে গেছে,
শেষ ট্রেন চলে গেছে, অমিতাভ তাহলে আমার
কী উপায় হবে বল! তুই বল— তাহলে কখনও আর কোনওদিন তোদের ওখানে
ফেরার উপায় নেই? পথ নেই?
আর কোনও পথ নেই।
এখানে গভীর রাত, এখানে এখন খুব রাত।

এই যে স্টেলার মাস ব্ল্যাক হোল, যার জন্মই নক্ষত্রের জীবনচক্রের শেষভাগে এসে, তার সঙ্গে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের প্রধান পার্থক্য এটাই যে দ্বিতীয় প্রজাতির ব্ল্যাক হোলের জন্ম কোনও মনোলিথিক কোল্যাপ্স থেকে নয়। তার কারণ, কয়েক লক্ষ কোটি সূর্যের সম্মিলিত ভরের সমান কোনও প্রোজেনিটার নক্ষত্র থাকা সম্ভব না। অত বিপুল গ্যাসীয় গঠন স্থায়ী নয়, বিভিন্ন ধরনের ইনস্টেবিলিটি, যেমন জিনস ইনস্টেবিলিটি বা আন্তোনভ ইনস্টেবিলিটি, সেই গঠনকে সীমিত সময়ের মধ্যে ভেঙে দেবে। সেই গঠনের সরাসরি মহাকর্ষভঙ্গ হয়ে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল তৈরি হতে পারে বটে, কিন্তু তা কখনও তারকার জন্মমৃত্যুর মতো ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাবে না। স্টেলার মাস ব্ল্যাকহোলের উৎপত্তির তত্ত্ব অনেক আগে থেকেই জানা, তা প্রায় তিরিশের দশক থেকেই। এবং তার নিরীক্ষণ সংক্রান্ত গবেষণার ইতিহাসও পুরনো— সিগন্যাস এক্স ওয়ান, প্রথম গ্যালাকটিক স্টেলার মাস ব্ল্যাক হোল (গ্যালাকটিক অর্থে আমাদের নিজস্ব ছায়াপথ আকাশগঙ্গার মধ্যেই তার বাস) পর্যবেক্ষণে ধরা পরে ১৯৬৪-তে।

সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এবং কৃষ্ণগহ্বর

ঘটনা হল, কৃষ্ণগহ্বর শুধুমাত্র মহাকাশবিজ্ঞানীদেরই পৈতৃক সম্পত্তি নয় কোনও। কৃষ্ণগহ্বরের ধারণা তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যায় একটি সামগ্রিক ধারণা। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে আমরা দেখেছি যে আইনস্টাইনের একগুচ্ছ ক্ষেত্র সমীকরণ দিয়ে মহাবিশ্বে স্থানকালের জ্যামিতি এবং তার মধ্যে ভর ও শক্তির (প্রকৃতপক্ষে পদার্থ ও শক্তি দুই-ই এক, একে অপরের পরিপূরক মাত্র) বণ্টন ও বিন্যাস ব্যাখ্যা করা যায়। ভরের উপস্থিতি স্থানকালের জ্যামিতির প্রকার নির্ধারণ করে, অন্যদিকে স্থানকালের জ্যামিতি পদার্থের গতীয় এবং তাপগতীয় অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। নির্দিষ্ট ভর ও শক্তি বন্টনের জন্য, আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরগুলির সমাধান, সুতরাং, সেই ভরের চারপাশের স্থানকালের জ্যামিতি কীরকম হবে তার নিখুঁত বর্ণনা দেবে। কোনও বস্তুর চারপাশের স্থানকালের জ্যামিতির এই ধর্মকে স্পেসটাইম মেট্রিক বলে একপ্রকার গাণিতিক অস্তিত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সে অর্থে স্পেসটাইম মেট্রিক আমাদের জানায় সেই মেট্রিক দ্বারা বর্ণিত দেশ ও কালে বস্তুর বিভিন্ন গতীয় এবং তাপগতীয় ধর্ম কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণগুলি অরৈখিক (নন-লিনিয়ার), এবং সেগুলির সমাধান অত্যন্ত কঠিন, কোনও বিশেষ ধরনের সরলীকরণ (এপ্রক্সিমেশন) ছাড়া তার যথাযথ সমাধান (এক্স্যাক্ট সল্যুশন। বিশ্লেষণাত্মক সমাধান সেই অর্থে। যন্ত্রগণক ব্যবহার করে নিউমেরিক্যাল সল্যুশন, এপ্রক্সিমেশন ছাড়াও সম্ভব।) অসম্ভব।  ক্ষেত্র সমীকরণের যথাযথ সমাধান যে মেট্রিক দেয় তাকে বলে ব্ল্যাক হোল মেট্রিক।

অর্থাৎ যে বস্তুর চারিপাশের স্থানকালের প্রকৃতি, আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণের যথাযথ সমাধান করে পাওয়া মেট্রিক দ্বারা বর্ণনা করা যাবে, সেই বস্তুকেই আমরা কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল বলব। অতিভারী তারার জীবনচক্রের শেষ অবস্থায় মহাকর্ষভঙ্গের ফলে যে অতিঘন বিন্দুবৎ গঠন পাওয়া যায়, অথবা কোয়েজারের অন্দরে যে মহাকায় কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি, তাদের  চারপাশের স্থানকাল আইনস্টাইন সমীকরণের যথাযথ সমাধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাই সে ব্ল্যাক হোল। তার মানে এই নয় যে শুধু সেই ধরনের বস্তুই একমাত্র ব্ল্যাক হোল ক্যান্ডিডেট। পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় কৃষ্ণগহ্বরের তাত্ত্বিক উপস্থিতি আছে— স্ট্রিং থিওরি, কণাপদার্থবিদ্যা (বিশেষত সাম্প্রতিক লার্জ হ্যাড্রোনিক কোলাইডার সংক্রান্ত উচ্চশক্তির কণাপদার্থবিজ্ঞান) প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে চর্চার সময় আমরা এমন বস্তুসমষ্টির দেখা পাই যার চারিপাশের স্থানকালের প্রকৃতি নির্ধারিত হয় ব্ল্যাক হোল মেট্রিকের প্রকৃতি দিয়ে।

সুতরাং মোদ্দা কথাটা হল কোনও নির্দিষ্ট দেশকালে কোনও বিশেষ ধরনের বস্তুর উপস্থিতিতে জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটির আইনস্টাইন ফিল্ড ইক্যুয়েশনের এক্স্যাক্ট সল্যুশন আমাদের ব্ল্যাক হোল স্পেসটাইম দেবে। যে বস্তুর চারপাশের দেশকাল ব্ল্যাক হোল সল্যুশন দ্বারা নির্ধারিত হবে সেই বস্তুটি একটি ব্ল্যাক হোল (তা সে অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল ব্ল্যাক হোল হোক, বা  স্ট্রিং থিওরিটিক্যাল ব্ল্যাক হোল)। সেই ব্ল্যাক হোল আসলে একটি সিঙ্গুলারিটি বা সিঙ্গুলার পয়েন্ট, নন-কোয়ান্টাম তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার কোনও সূত্র দিয়েই কোনও সমীকরণই সিঙ্গুলারিটিতে সমাধান করা যায় না। সিঙ্গুলারিটি বেষ্টিত থাকে ইভেন্ট হরাইজন দিয়ে। ইভেন্ট হরাইজন একমুখী। তার বাইরের দিক থেকে বস্তু বা শক্তি এসে ইভেন্ট হরাইজন ভেদ করে একবার ঢুকে গেলে তাদের পক্ষে আর বহির্বিশ্বে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। যেহেতু এমনকি তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গও ইভেন্ট হরাইজনের ভেতর একবার ঢুকে গেলে আর বেরিয়ে আসতে পারবে না, তাই ব্ল্যাক হোলকে কোনওদিন দেখা যাবে না। ব্ল্যাক হোল তাই ব্ল্যাক, নিশ্ছিদ্র কালো, কৃষ্ণগহ্বর।

১৯১৫ সালে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব (যেখানে ক্ষেত্র সমীকরণের বর্ণনা ছিল) প্রকাশ করেন। আইনস্টানের ১৮ই নভেম্বরে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, জার্মান বৈজ্ঞানিক কার্ল শ্ভার্তশিল্ড বাইশে ডিসেম্বর (১৯১৫) আইনস্টাইনকে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি আইনস্টাইনের ক্ষেত্র তত্ত্বের সমীকরণের সমাধান করেন শূন্যস্থানে এবং গোলীয় প্রতিসাম্যে (স্ফেরিক্যালি সিমেট্রিক ভ্যাকুয়াম সল্যুশন)। প্রাশিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের সভায় শ্ভার্তশিল্ডের সেই চিঠি আইনস্টাইন পড়ে শোনান এবং ১৯১৬ সালের ১৩ই জানুয়ারি সেই সমাধান সংক্রান্ত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেই বছরেরই ১১ই মে, জার্মানির পত্সদাম শহরে মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়েসে শ্ভার্তশিল্ডের মৃত্যু হয়।

শ্ভার্তশিল্ড গত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই, ডাচ পদার্থবিদ হেনড্রিক আনতুন লোরেন্ৎসের পিএইচডি ছাত্র ইয়োহানে দ্রস্ত সম্পূর্ণ নতুনভাবে আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণের সমাধান করেন, এবং সেই গবেষণাপত্র ১৯১৭-তে প্রকাশিত হয়। ঘটনাচক্রে, দ্রস্ত শ্ভার্তশিল্ডের সমাধান সম্পর্কে অবগত ছিলেন না তাঁর নিজের সমাধান বার করার সময়। ওই ১৯১৭-তেই, জার্মান গণিতজ্ঞ হারমান ক্লস হিউগো ভাইল এবং ডেভিড হিলবার্ট স্বতন্ত্রভাবে শূন্যস্থানে গোলীয় প্রতিসাম্যে আইনস্টাইন ক্ষেত্র সমীকরণের যথাযথ সমাধান বার করেন। পরে ১৯২১ সালে ফরাসি গণিতজ্ঞ পল পেঁলেভ (ঘটনাচক্রে, পেঁলেভ একজন ঝানু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন, দু দুবার ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেছেন), এবং ১৯২২ সালে সুইডিশ চক্ষু-বিশেষজ্ঞ আলভার গুলস্ট্র্যান্ড (দৃষ্টিশক্তি সংক্রান্ত গবেষণায় আলোক-পদার্থবিদ্যা অর্থাৎ অপটিক্স-এর ভূমিকা  নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য ১৯১১ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পান গুলস্ট্র্যান্ড। অপটিক্স, ডাক্তারি এবং সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ— একজন মানুষের জ্ঞানের সীমা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে ভাবলে অবাক হতে হয়!) আরও দুটি স্ফেরিক্যালি সিমেট্রিক ভ্যাকুয়াম সল্যুশনের প্রস্তাবনা দেন স্বতন্ত্রভাবে। পরে দেখা যায় বিশেষ ধরনের স্থানাঙ্ক পরিবর্তন করলে পেঁলেভ এবং গুলস্ট্রান্ডের সমাধান শেষমেশ শ্ভার্তশিল্ডের সমাধানেই পরিণত হয়। বেশ অনেকদিন পরে, ১৯৩৩ সালে বেলজিয়ান গণিতজ্ঞ জর্জ অঁরি জোসেফ এদুয়ার্দো লোম্যাঁতুর (প্রসরণশীল মহাবিশ্বের প্রথম তাত্ত্বিক প্রবক্তা। এডুইন হাবলের গবেষণাপত্রের দু বছর আগেই ১৯২৭ সালে তিনি স্বতন্ত্রভাবে হাবল ধ্রুবকের মান বার করেন, এবং ব্রাসেলসে বিখ্যাত পঞ্চম সলভে সম্মেলনে আইনস্টাইনের সঙ্গে সে বিষয়ে সরাসরি আলোচনা করেন। ওই একই বছরে, বিগ ব্যাং কসমোলজির প্রারম্ভিক ধারণাও লোম্যাঁতুরের দেওয়া।) একটু অন্যরকমভাবে শূন্যস্থানে গোলীয় প্রতিসাম্যে আইনস্টাইন সমীকরণের যথাযথ সমাধান বার করেন। যদিও, সবার আগে কষে বার করেছেন বলে, শূন্যস্থানে গোলীয় সমতলে আইনস্টাইন ক্ষেত্র সমীকরণের যথাযথ সমাধানকে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে শ্ভার্তশিল্ড সমাধান, এবং সেই সমাধান অনুযায়ী শ্ভার্তশিল্ড মেট্রিক দিয়ে যে ধরনের কৃষ্ণগহ্বরের চারিপাশের দেশকালের চরিত্র নির্ধারিত হয় তাকে বলা হয় শ্ভার্তশিল্ড টাইপ ব্ল্যাক হোল, যার জন্য কৃষ্ণগহ্বরের ভরই একমাত্র স্থিতিমাপ (প্যারামিটার)।

আরেকটু জটিল ধরনের ব্ল্যাক হোল স্পেসটাইম, যেখানে ভরের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণন কৌণিক ভরবেগও মেট্রিকের স্থিতিমাপ, আবিষ্কার করেন নিউজিল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক রয় প্যাট্রিক কার। ১৯৬৩ সালের পয়লা সেপ্টেম্বরের ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স গবেষণাপত্রিকায় প্রকাশিত মাত্র দেড় পাতার সেই গবেষণাপত্র শুধু মহাকাশবিজ্ঞান বা আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্বেরই না, সাধারণভাবেই তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান এবং ফলিত গণিতের উচ্চতর গবেষণায় এক মাইলফলক বিশেষ। মজার ব্যাপার হল, কার যখন আবিষ্কার করছেন ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণগহ্বরের চারিপাশের দেশকালের চরিত্র কীরকম হবে, প্রায় একই সময় শ্মিট কোয়েজার আবিষ্কার করলেন, যার কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণন কৌণিক ভরবেগ কোয়েজার থেকে বেরিয়ে আসা অত্যুজ্জ্বল জেটের উৎপত্তির রহস্যের সমাধান করল আনুমানিক দেড় দশক বাদে। এরকম সমাপতন বিজ্ঞানের ইতিহাসে বড় একটা দেখা যায় না।

ঘটনা হল, আইনস্টাইনের সমীকরণের সমাধান হিসেবে আসা এই সিঙ্গুলারিটির ধারণাটা আপাতদৃষ্টিতে এতই চমকপ্রদ— এমনকি সরাসরি উদ্ভট বললেও হয়ত অতিরঞ্জন হয় না— দেশকালের এমন এক অবস্থা, যার ঘনত্ব অসীম, যার ওপরে কোনও তত্ত্ব দাঁড় করানো যায় না কারণ সিঙ্গুলারিটিতে দাঁড়িয়ে সমাধান করা যায় না কোনও সমীকরণের— সেরকম এক আপাত দুর্বোধ্য ধারণা বাস্তবে কোন কাজে আসবে, তা আদৌ আত্মস্থ করা যাবে কিনা— এই নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলেন, আর কেউ না, স্বয়ং আইনস্টাইন! সিঙ্গুলারিটি বাস্তবে আদৌ সম্ভব কিনা, সে নিয়ে নিজেই খানিক সন্দিহান ছিলেন (সম্ভবত আমৃত্যুই) তিনি। ১৯৩৯ সালে অ্যানালস অফ ম্যাথেম্যাটিক্স গবেষণাপত্রিকায় প্রকাশিত ‘অন আ স্টেশনারি সিস্টেম উইথ স্ফেরিক্যাল সিমেট্রি কনসিসটিং অফ মেনি গ্র্যাভিটেটিং ম্যাসেস’ শীর্ষক আইনস্টাইনের একটি গবেষণায়পত্র পড়লে ওঁর এই দোলাচলের ব্যাপারটি সম্যক বোঝা যাবে।

এটা ঘটনা যে শ্ভার্তশিল্ড সমাধান সিঙ্গুলারিটি দেয়, কিন্তু শ্ভার্তশিল্ড সমাধান (বা সেই ধরনের স্ফেরিক্যালি সিমেট্রিক আর যা যা সমাধান) কি আসলে বাস্তব অবস্থাকে সম্পূর্ণ তুলে ধরতে পারে? গোলীয় প্রতিসাম্য, এবং শূন্যস্থানে সমাধান, এই দুটিই কি অতিসরলীকৃত অনুমান (assumption) নয়? এমন কি হতে পারে না যে গোলীয় (বা অক্ষীয়) প্রতিসাম্যর অনুমান থেকে সরে গেলেই সিঙ্গুলারিটি আর পাওয়া যাবে না? প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের অসাম্যে ভর্তি, নিখুঁত সাম্য খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর— সিঙ্গুলারিটি কি তাহলে গোলীয় প্রতিসাম্যেরই আর্টিফ্যাক্ট মাত্র? আর সিঙ্গুলারিটিই যদি কষ্টকল্পিত হয়, তাহলে সিঙ্গুলারিটি এবং ইভেন্ট হরাইজন যার অস্তিত্বের নির্যাস, সেই ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বও কি তাহলে প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় না? বাস্তব প্রকৃতিতে কৃষ্ণগহ্বর থাকা কি আদৌ সম্ভব তাহলে? নাকি তা গণিতজ্ঞদের কল্পনাজগতের এক ফ্যান্টাসি মাত্র?

রায়চৌধুরী সমীকরণ

১৯৫৩ সাল। অমলকুমার রায়চৌধুরী যাদবপুরের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সেস (IACS)-এ রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে যোগ দিয়েছেন সবে বছরখানেক হল (১৯৫২ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত IACS-এ কর্মরত ছিলেন, ১৯৬১-তে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার চাকরি নেন)। তিনি তখন গবেষণা করছেন মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তার গাণিতিক মডেল কীভাবে দেওয়া যায়, সেই নিয়ে। রায়চৌধুরী দেখালেন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ দেশকালের জ্যামিতি এবং সেই জ্যামিতিতে বস্তু ও শক্তির গতীয় অবস্থা বর্ণনা করে এরকমটি ধরে নিলে, মহাকর্ষের দ্বারা আবদ্ধ বিভিন্ন পদার্থকণা (বা আলো, অর্থাৎ ফোটন) যদি সময়ের স্রোতে এগিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে, তাহলে সেই কণাগুলির (বা ফোটনের) যাত্রাপথ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ একে অপরের দিকে সরে আসবে, এবং সসীম সময়ের মধ্যে (সময় বলতে এখানে আপেক্ষিকতাবাদে আলোচিত বিশেষ এক ধরনের সময়ের মাপ যাকে প্রপার টাইম বলা হয়। সঞ্চরশীল বস্তুকণার ওপরে বসে, অর্থাৎ গতিশীল বস্তুর নিজস্ব রেফারেন্স ফ্রেমে যে সময় মাপা হয় তাই হল প্রপার টাইম) যাত্রাপথগুলি একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে অভিসৃত হবে। একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে জিওডেসিকের (দেশকালে বস্তুর যাত্রাপথের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা) কনভার্জেন্স অবশ্যম্ভাবী এবং তার জন্য স্থানকালের কোনও নির্দিষ্ট প্রতিসাম্য থাকার প্রয়োজন নেই (শুধু একটিই শর্ত মেনে চলা প্রয়োজন যে বস্তুর অন্তর্নিহিত শক্তি সংক্রান্ত চাপ যেন ধনাত্মক হয়। ঋণাত্মক চাপের ক্ষেত্রে রায়চৌধুরীর গবেষণা কী ফল দেবে, সেই অতি জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা এই প্রতিবেদনের সীমিত পরিসরের মধ্যে সম্ভব না এবং সম্ভবত তার প্রয়োজনও নেই, কারণ চাপ সাধারণত ধনাত্মকই হয় এরকমই আমরা জানি— যদিও অতি বিশেষ ক্ষেত্রে মহাবিশ্বের শুরুর প্রারম্ভিক মুহূর্তে ঋণাত্মক চাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না)। সময়ের সামনের দিকে এগিয়ে গেলে এই অভিসরণ বিন্দু (পয়েন্ট অফ কনভার্জেন্স) ব্ল্যাক হোল সিঙ্গুলারিটি, এবং সময় বরাবর পিছিয়ে এলে তা বিগ ব্যাং সিঙ্গুলারিটি, অর্থাৎ সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের একেবারে শুরুর দশা। যে সাধারণ সমীকরণের মাধ্যমে জিওডেসিক কনভার্জেন্স-এর অবশ্যম্ভাবিতা প্রমাণ করা হল তারই নাম রায়চৌধুরী সমীকরণ। ১৯৫৫ সালে ফিজিক্যাল রিভিউ এবং ১৯৫৭ সালে সাইৎশ্রিফট ফ্যুর অ্যাস্ট্রোফিজিক গবেষণাপত্রিকায় প্রকাশিত দুটি প্রবন্ধে রায়চৌরধুরী সমীকরণ সংক্রান্ত যাবতীয় গণনা প্রকাশিত হল।

পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য এবং পেনরাজের নোবেল

১৯৬৫ সালে রজার পেনরোজ এককভাবে, তার পরপরই স্টিফেন হকিং স্বতন্ত্রভাবে, এবং পরিশেষে ১৯৭০-এ পেনরোজ এবং হকিং যৌথভাবে দেখালেন যে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ থেকে দেখানো যায় যে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বর অতীতে (শুরুতে) বা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হওয়ার সময় (ভবিষ্যতে) সিঙ্গুলারিটি তৈরি হতে গেলে গোলীয় প্রতিসাম্যর উপস্থিতি বা ঐরকম কোনও নির্দিষ্ট শর্ত মানার কোনও প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ সিঙ্গুলারিটির তৈরি হওয়া (যে কোনও) শর্তনিরপেক্ষভাবে অবশ্যম্ভাবী। এই গণনার ফলাফল পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য নামে পরিচিত।

সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্যের প্রমাণে এক বিশেষ ধরনের নকশার উদ্ভব করেন পেনরোজ। অস্ট্রেলিয়ান তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ব্র্যান্ডন কার্টার (প্যারিসের মিদোঁ তে ল্যাবরেতোরি ইউনিভার্স এত থিওরিস-এর অধ্যাপক কার্টার কৃষ্ণগহ্বর গবেষণায় একজন বিশেষজ্ঞ এবং কসমোলজিক্যাল এন্ট্রপিক প্রিন্সিপল-এর আধুনিক রূপের স্রষ্টা) এবং পেনরাজের নামে এই নকশাকে বলে কার্টার-পেনরোজ ডায়াগ্রাম বা কনফরম্যাল ডায়াগ্রাম— যা কিনা আসলে আইনস্টাইনের একদা শিক্ষক (জুরিখের ফেডারেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে) হারম্যান মিনকোভস্কি আবিষ্কৃত (১৯০৮) দেশকাল নকশার (স্পেসটাইম ডায়াগ্রাম) বিশেষভাবে সম্প্রসারিত আকার।

এই সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য প্রতিষ্ঠা করতে অনেকাংশেই রায়চৌধুরী সমীকরণের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত মহাকাশবিজ্ঞানী জর্জ এলিস ২০০৭ সালে ‘অন দ্য রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশন’ শীর্ষক তাঁর একটি গবেষণা প্রবন্ধে সরাসরিই বলেন (প্রবন্ধের অষ্টাদশতম পাতার চার নম্বর অনুচ্ছেদে) ‘দ্য ফান্ডামেন্টাল সিঙ্গুলারিটি থিওরেম ফলোজ ইমিডিয়েটলি ফ্রম দ্য রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশন’— এবং এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেন গাণিতিক যুক্তির মাধ্যমে। তত্ত্বীয় মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে রায়চৌধুরী সমীকরণের অসীম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, অতএব, অনস্বীকার্য।

পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য সুতরাং আমাদের জানাল যে কৃষ্ণগহ্বর কপোলকল্পনা নয় কোনও, গণিতজ্ঞদের কষ্টকল্পনাও নয় তা। তা বিশুদ্ধ বাস্তব। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ যদি সত্যি হয়, তাহলে মহাকর্ষভঙ্গের সূত্রে কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্যের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ উপপাদ্য তাই বিশুদ্ধ তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে (বা ফলিত গণিতে) কমই আছে। সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্যের আবিষ্কর্তা হিসেবে এই বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পেলেন পেনরোজ, পুরস্কারের অর্ধমূল্যও।

কৃষ্ণগহ্বর— নিরীক্ষণবাদীর দৃষ্টিতে

প্রকৃতিতে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের বাস্তবতা, সুতরাং, দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হল পেনরোজ-হকিং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্বের আবিষ্কারে। কিন্তু তা তাত্ত্বিকভাবে। নিরীক্ষণবাদীদের (অবজার্ভেশন্যাল অ্যাস্ট্রনোমার) কাছে এই তাত্ত্বিক বাস্তব কতটা গ্রহণযোগ্য? অস্তিত্ব থাকলেও বা, তাকে কি দেখা যাবে কোনওদিন? কোনওকিছুই, এমনকি আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না কৃষ্ণগহ্বরের ভিতর থেকে, তাই কৃষ্ণগহ্বর নিকষ কালো। দেখাই যদি না গেল তাকে কোনওদিন, তাহলে সে আছে কি নেই তা দিয়ে কীই বা এল গেল সংশয়বাদীর?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে জেনে নিতে হবে কাকে বলে অ্যাক্রেশন প্রক্রিয়া। কোনও বিপুল ভারী বস্তু মহাকর্ষের ফলে তার চারপাশের মহাজাগতিক গ্যাস ও ধূলিকণাকে যে পদ্ধতিতে নিজের দিকে টেনে নেয়, তাকে বলে অ্যাক্রেশন প্রক্রিয়া। ভারী বস্তু তার চারিপাশে তৈরি করে শক্তিশালী মহাকর্ষক্ষেত্র। তার প্রভাবে চারিপাশের বস্তুকণা ত্বরিত হয়, এবং এসে আছড়ে পড়ে আকর্ষক ভারী বস্তুটির (অ্যাক্রেটর) ওপর। আছড়ে পড়ার আগে বস্তুকণা মহাকর্ষীয় স্থিতিশক্তি লাভ করে। আছড়ে পড়ার পর সেই স্থিতিশক্তির একটা অংশ রূপান্তরিত হয় অন্য কোনও শক্তির আকারে, হয় শব্দশক্তি অথবা তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি। যদি ভারী বস্তুর চারিপাশের মহাকর্ষক্ষেত্রের তীব্রতা অতি প্রবল হয়, তাহলে পতনশীল বস্তুও প্রভূত পরিমাণে মহাকর্ষীয় স্থিতিশক্তি লাভ করে এবং তার অনেকটা অংশই যেহেতু রূপান্তরিত হয়, সেহেতু রূপান্তরিত শক্তি বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তি হিসেবে নিঃসৃত হয়। সেই নিঃসৃত শক্তির বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করে ভারী বস্তুর চারিপাশের মহাকর্ষক্ষেত্রের মান, দেশকালের বক্রতা (মেট্রিক), এবং ভারী বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

দূর থেকে ধেয়ে এসে আছড়ে পড়া বস্তুকণাসমষ্টির যদি নিজস্ব কৌণিক ভরবেগ থাকে, তাহলে আছড়ে পড়ার আগে সে ভারীবস্তুর চারপাশে ঘুরতে থাকবে চাকার মতো আকার সৃষ্টি করে, যাকে বলা হয় অ্যাক্রেশন বলয় বা অ্যাক্রেশন ডিস্ক। আকর্ষকটি কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তু হলে তার কঠিন সীমারেখা বা খোলক থাকবে, ফলে গতিশীল বস্তুকণা আছড়ে পড়বে সেই খোলকের গায়ে এবং গতিহীন হয়ে স্তব্ধ হবে সংঘর্ষের পর। গতিশক্তি শূন্যে পরিণত হবে তাই সংঘর্ষের পরে উৎপন্ন হবে প্রভূত পরিমাণ তাপ যা অবলোহিত তরঙ্গের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে মহাবিশ্বে। কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া, অন্য যে কোনও অ্যাক্রেটরের ক্ষেত্রে, সুতরাং, অবলোহিত রশ্মির ঝলক দেখা যেতে পারে অ্যাক্রেশন প্রক্রিয়ার অন্তিম পরিণতি হিসেবে।

আকর্ষক বস্তুটি যদি কৃষ্ণগহ্বর হয়, তা সে আমাদের ছায়াপথের ভিতরের নক্ষত্রভরের বা কোয়েজারের কেন্দ্রের অতিভারী যে ধরনেরই হোক না কেন, তাহলে অ্যাক্রেশন প্রক্রিয়ায় আকর্ষিত বস্তু কোথাও আছড়ে পড়বে না কারণ কৃষ্ণগহ্বরের কোনও কঠিন আবরণী খোলক নেই। আছড়ে পড়ার বদলে, ধাবমান বস্তুকণা তীব্র গতি নিয়ে (আলোর সমান) ব্ল্যাক হোল ইভেন্ট হরাইজন ভেদ করে আমাদের মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যাবে বরাবরের মতো, কারণ ইভেন্ট হরাইজনের ভেতর থেকে কোনও কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে না। হরাইজনের ভিতরে ঝাঁপ মারার আগে ধাবমান বস্তুকণা তার প্রভূত মহাকর্ষীয় স্থিতিশক্তি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ নিঃসরণ করবে, প্রধানত এক্স রশ্মি এবং অতিবেগুনি রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। নিঃসৃত সেই তরঙ্গ যে বর্ণালী গঠন করে, তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে— যে বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝে নেওয়া সম্ভব হতে পারে যে আকর্ষকটি আসলে কৃষ্ণগহ্বর। অর্থাৎ আকর্ষিত বস্তুকণা নিঃসৃত তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের বিশেষ এক ধরণের বর্ণালীর মধ্যে নিহিত থাকে সেই সঙ্কেত যা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় আকর্ষকটি ইভেন্ট হরাইজনওয়ালা বস্তু— নাকি নয়।

সুতরাং এর থেকে এটাই বোঝা যায় যে, মহাবিশ্বে সিঙ্গুলারিটি আছে কি নেই, আকর্ষিত বস্তুসংক্রান্ত বর্ণালী বিশ্লেষণ করে তার নিরীক্ষণসঞ্জাত প্রমাণ পাওয়া সম্ভব। অ্যাক্রেশন প্রক্রিয়া তাই অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, কারণ একমাত্র এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মহাবিশ্বে কৃষ্ণগহ্বরের ‘দর্শন’ (তা সে হলই বা না হয় বর্ণালী বিশ্লেষণ করে পরোক্ষ পদ্ধতিতে) মেলা সম্ভব।

এবং এই অ্যাক্রেশন পদ্ধতিই আসলে কোয়েজারের (সাধারণভাবে, AGN-এর) অত্যুজ্জ্বল বিকিরণের জন্য দায়ী। AGN-এর কেন্দ্রে যে অতিভারী কৃষ্ণগহ্বর থাকে, তার ওপরে আছড়ে পরে চারপাশের বস্তুকণা, কখনও বা কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরটির প্রবল শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্র চারপাশে ঘুরে বেড়ানো কোনও নক্ষত্রের একাংশ ‘ছিঁড়ে’ নেয় (বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে বলে টাইডাল ডিসরাপশন) এবং সেই ‘ছেঁড়া’ টুকরো অ্যাক্রেশন বলয়ের মধ্যে ঢুকে ঘুরতে ঘুরতে সবেগে আছড়ে পড়ে কৃষ্ণগহ্বরের ওপর। একসঙ্গে অতটা ভর হরাইজনের মধ্যে মিলিয়ে যায় বলে সহসা তীব্র ঝলকানি ওঠে নিঃসৃত বিকিরণের (প্রধানত এক্স রশ্মির, বা কখনও অতিবেগুনি রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যে)— যার পদচিহ্ন বর্ণালীতে পড়ে। বর্ণালীবীক্ষণ করে টাইডাল ডিসরাপশনের বিবরণ জানা যায় তখন।

আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে অতিভারী কৃষ্ণগহ্বর: আন্দ্রিয়া ঘেজ এবং রাইনহার্ট গেঞ্জেলের নোবেল

এই আলোচনা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার— কোয়েজারের কেন্দ্রে শুধু কৃষ্ণগহ্বর থাকলেই হবে না, সেই কৃষ্ণগহ্বরের ওপরে এসে পড়ার মতো যথেষ্ট বস্তুকণার নিরন্তর সরবরাহও থাকতে হবে কোয়েজারকে ‘জ্বালিয়ে’ রাখার জন্য। ধীরে ধীরে বস্তুকণার সরবরাহ ফুরিয়ে এলে (যদিও তার জন্য লেগে যাবে অর্বুদ অর্বুদ বছর), উপোসী কৃষ্ণগহ্বর ঝিমিয়ে পড়বে, তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বেরিয়ে এসে কোয়েজারকে উজ্জ্বল রাখতে পারবে না আর। সক্রিয় ছায়াপথ তখন পরিণত হতে পারে সাধারণ ছায়াপথে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে, আমরা দেখব ‘সাধারণ’ ছায়াপথের ভিতরেও বসে আছে অতিভারী কৃষ্ণগহ্বর এক। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠল— তাহলে কি এমন হওয়া সম্ভব, যে, সমস্ত ছায়াপথই এককালে ছিল সক্রিয়, তারপর কিছু কিছু ছায়াপথের কেন্দ্রীয় জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় তার ‘দীপ নিভে গেছে মম’ দশা হয়, ফলত মহাবিশ্বের সমস্ত ছায়াপথের কেন্দ্রেই আসলে রয়েছে অতিভারী কৃষ্ণগহ্বর?

হুবহু এই যুক্তি অনুসরণ করে নয় যদিও, তবুও আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে এই ধারণা দৃঢ়সংবদ্ধ হতে শুরু করল বৈজ্ঞানিকদের মনে, যে, সক্রিয় হোক বা না হোক, মহাবিশ্বের সমস্ত ছায়াপথের কেন্দ্রেই রয়েছে অতিভারী কৃষ্ণগহ্বর। প্রধানত অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরগুলির সৃষ্টিরহস্য, এবং তাদের অতিথি ছায়াপথগুলির বিবর্তনের সঙ্গে কৃষ্ণগহ্বরগুলির জীবনচক্রের বিবর্তন কীভাবে জড়িত— সেই সংক্রান্ত গবেষণার ফলেই এই ধারণার সৃষ্টি। এবং সেটাই যদি হয়, তাহলে আমাদের একান্ত নিজস্ব আকাশগঙ্গার কেন্দ্রেও অতিভারী কৃষ্ণগহ্বর থাকা উচিৎ। এবং যেহেতু সেই কৃষ্ণগহ্বর পৃথিবীর নিকটতম, তাকে পর্যবেক্ষণ করে অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরের বিজ্ঞান জানা সহজ হত তার নৈকট্যের কারণে।

কিন্তু এখানে একটা বড়সড় সমস্যা দেখা দিল। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মধ্যতল (ইকোয়েটোরিয়াল প্লেন) বরাবর বিস্তৃত রয়েছে প্রায় ৩২৬ আলোকবর্ষ বেধের অস্বচ্ছ ধূলিকণার মেঘ। আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে সৌরজগতের দূরত্ব প্রায় ২৬০০০ আলোকবর্ষের মতো। আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে দৃশ্যমান আলো বেরিয়ে এলে সেই আলোক কণিকাকে তার মানে এতটা দূরত্বের অন্ধকার ধূলিকণার মধ্যে দিয়ে আসতে হবে। আমাদের চোখ (বা দূরবীন) অবধি এসে পৌঁছনোর বহু আগেই সেই আলো ধূলিকণার মেঘে বিক্ষিপ্ত এবং শোষিত হয়ে হারিয়ে যাবে। আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে কি ঘটছে সেটা তাই দৃশ্যমান আলোকনির্ভর দূরবীন দিয়ে দেখা সম্ভব নয়। যেহেতু মহাকাশবিজ্ঞান চর্চার প্রথমদিকে শুধুমাত্র দৃশ্যমান আলোক নির্ভর দূরবীন ব্যবহারেরই চল ছিল, বহুদূরের মহাজাগতিক বস্তু আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি কিন্তু নিজেদের ছায়াপথ সম্পর্কেই জেনে উঠতে পারিনি। এ যেন কবির ভাষায় সেই—

বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে,
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু,
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।

আকাশগঙ্গার হাঁড়ির খবর কীভাবে পাওয়া সম্ভব তাহলে? সম্ভব, যদি এমন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে তার খাসমহলে উঁকি মারা যায় যে তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে নিতে পারবে না ধূলিকণার অন্ধকার পট্টি। বেতার তরঙ্গের জন্য সেটা সম্ভব তা এই প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে। আরেকটি রাস্তা হল অবলোহিত তরঙ্গ ব্যবহার করা। ধরা যাক আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে কোনও একটি তারার গতিপথ আমরা পর্যবেক্ষণ করতে চাই। সেই তারা থেকে বেরোনো দৃশ্যমান আলো আমাদের চোখে পৌঁছনোর অনেক আগেই মিলিয়ে যাবে অন্তর্নাক্ষত্রিক ধুলোর মেঘে শোষিত হয়ে। তবে দৃশ্যমান আলোর সঙ্গেই, তারা থেকে বেরোবে তাপের তরঙ্গও। তাপের বিকিরণ মানেই অবলোহিত রশ্মির বিস্তার। সেই তাপ যখন ধূলিকণা দ্বারা শোষিত হবে, ধূলিকণা উত্তপ্ত হয়ে উঠে তাপ বিকিরণ করবে অবলোহিত তরঙ্গের মাধ্যমে। অবলোহিত তরঙ্গে কার্যকর দূরবীন তৈরি করলে, অতএব, আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে নক্ষত্রের কক্ষপথ, এবং গরম গ্যাস ও বাষ্পের গতিপথ ‘দেখতে’ পাওয়া যাবে। অবলোহিত তরঙ্গ নির্ভর দূরবীন কি তাহলে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে বসে থাকা সুবিপুল কৃষ্ণগহ্বরের হালহকিকৎ জানাতে পারবে আমাদের? এই নিয়েই এবারের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলের বাকি আর্ধেক— যা দেওয়া হল আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলসের মহাকাশবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা আন্দ্রিয়া ঘেজ এবং জার্মানির মুনশ্যেন-এর কাছে গারশিং-এর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল ফিজিক্সের সহ-অধিকর্তা রাইনহার্ড গেঞ্জেলকে (যদিও বলা ভালো, বা উচিৎ, ঘেজ এবং গেঞ্জেলের ওয়ার্কিং গ্রুপকে)।

ঠিক কি অবদান ওঁদের? সেটা বুঝতে গেলে আগে জেনে নেওয়া যাক আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর এবং তার পারিপার্শ্বিকের গতিপ্রকৃতি।

বেতার পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের কাছাকাছি জায়গায় আছে ধনুরাশি, স্যাজিটেরিয়াস নক্ষত্রমণ্ডলী। ধনুরাশির পশ্চিমতম অংশ স্যাজিটেরিয়াস-A, বেতারউজ্জ্বল। অর্থাৎ সেখান থেকে শক্তিশালী বেতার তরঙ্গ বেরিয়ে আসছে। স্যাজিটেরিয়াস-A-র উজ্জ্বলতম অংশের নাম স্যাজিটেরিয়াস-A[স্টার] (ছোট করে উল্লেখ করা হয় SgrA* নামে)। অনুমান করা হয় আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরটি ওই অঞ্চলেই আছে। কিন্তু তাকে ‘দেখা’ যাবে কীভাবে?

কৃষ্ণগহ্বরকে সরাসরি ‘দেখার’ চেষ্টা করা মানে তার অন্ধকার ইভেন্ট হরাইজনটি দেখা। চারিপাশের বস্তুকণা অ্যাক্রেটেড হয়ে তার ওপরে এসে পড়ার সময় মহাকর্ষ শক্তির বিনিময়ে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ দেবে। সেই তরঙ্গ সব জায়গা থেকে বেরিয়ে আসবে, আসবে না শুধু ইভেন্ট হরাইজনের ভিতর থেকে। আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরের ওপর আছড়ে পড়া বস্তুকণা থেকে নিঃসৃত তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গমালা নিরীক্ষণ করলে, অতএব, দেখা যাবে রেডিও বিকিরণের (যেহেতু বর্ণালীর শুধুমাত্র বেতার অংশটিই বেরিয়ে আসতে পারবে, বাকিরা শোষিত হয়ে যাবে মহাজাগতিক ধূলিকণার মেঘে) উজ্জ্বল প্রেক্ষাপটে রয়েছে অন্ধকার একটি চাকতি— চাকতিটি ইভেন্ট হরাইজোনের দ্বিমাত্রিক প্রতিচ্ছায়া। অন্ধকার চাকতিটিকে দেখতে পাওয়া মানেই কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি সম্পর্কে স্থিরনিশ্চিত হওয়া।

তত্ত্বগতভাবে সরল হলেও, নিরীক্ষকদের কাছে কাজটি যথেষ্টই জটিল, প্রায় অসম্ভবই মনে করা হত এতকাল। ইভেন্ট হরাইজোনের কালো চাকতির যা কৌণিক ব্যাস, অত ছোট মাপের কোনও বস্তুকে দেখতে গেলে তার জন্য প্রয়োজনীয় বেতার দূরবীনের অ্যান্টেনার সাইজ হতে হবে আনুমানিক ৫০০০ কিলোমিটারের মতো! সেই মাপের একক দূরবীন বানানো, স্বাভাবিকভাবেই, অবাস্তব প্রকল্প একটি। অতি সম্প্রতি রেডিও দূরবীনের সারি (array) তৈরি করে ইভেন্ট হরাইজনের অতিক্ষুদ্র কালো চাকতিকে সরাসরি নিরীক্ষণ করতে পারা সম্ভব হয়েছে M৮৭ নামের একটি কোয়েজারের কেন্দ্রের অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরের জন্য। অতি গুরুত্বপূর্ণ সেই ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত ২০১৯ সালের ১০ই এপ্রিল। দূরকে কাছে আনার এই বিশেষ ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ। আকাশগঙ্গার কৃষ্ণগহ্বরের জন্যও অচিরেই সেভাবে নিখুঁত পর্যবেক্ষণের ফলাফল প্রকাশিত হবে বলে আশা করা যায়। ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের জন্যও তুলে রাখা আছে একটি নোবেল প্রাইজ, এরকম আশা রাখা তাই অসঙ্গত হবে না হয়তো।

ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের টেকনোলজি খুবই সাম্প্রতিক। এবারের নোবেলের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই সেভাবে। ঘেজ এবং গেঞ্জেল কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি জানতে অন্য পদ্ধতি নিয়েছিলেন। সাধারণত কোনও ভারী বস্তুর বা বস্তুসমষ্টির মহাকর্ষের আকর্ষণে চারদিকে (তুলনায়) ছোট বস্তুকণার গতিপথের নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকার থাকে। অঙ্ক কষে দেখানো যায় আকর্ষকের প্রকৃতির ওপরে গতিপথের জ্যামিতি নির্ভর করে। আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে কৃষ্ণগহ্বর আছে নাকি অন্য কোনও বস্তুসমষ্টি (অতিভারী, ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা বিশেষ ধরনের নক্ষত্ররাজি— নিউট্রন নক্ষত্র বা শ্বেতবামন— সেরকম বস্তুসমষ্টির উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে), সেটা নির্ণয় করার জন্য স্যাজিটেরিয়াস-A[স্টার]-এর কেন্দ্রের তারাগুলির কক্ষপথের প্রকৃতি নির্ণয় করলে বোঝা যাবে সেগুলি কোনও একক এবং অতিভারী অতিঘন বস্তুর আকর্ষণের ফলে ঘুরছে নাকি ঘনসন্নিৱিষ্ট একাধিক ভারী বস্তুর আকর্ষণে ঘুরছে। ঠিক কী ধরনের উপবৃত্তাকার কক্ষপথে স্যাজিটেরিয়াস-A[স্টার]-এর কেন্দ্রে অবস্থিত তারারা কেন্দ্রীয় অতিভারী বস্তুর চারপাশে ঘুরলে প্রমাণিত হবে যে বস্তুটি কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। অর্থাৎ স্যাজিটেরিয়াস-A[স্টার] একদম কেন্দ্রের অতটুকু জায়গার মধ্যে অতগুলো নক্ষত্রকে ওভাবে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরানোর মতো মহাকর্ষবল সৃষ্টি করতে পারে এককভাবে অতখানি ভর কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া আর অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তুর হতে পারে না— তা বার করা হল। এবারে নিরীক্ষণের পালা।

এবং এখানেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হল। প্রায় ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে ভেসে আসা অবলোহিত আলোককণিকা (কক্ষপথে বিচরণশীল নক্ষত্রের আলো, যা দেখে কক্ষপথের যথাযথ আকার জানা যাবে) পৃথিবীতে বসে ধরা অসম্ভব শক্ত কাজ। বিশেষ করে তা আরও জটিল হয়ে দাঁড়াবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপস্থিতির জন্য। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা এবং আরও অনেক স্থিতিমাপের নিরন্তর পরিবর্তনের জন্য বায়ুমণ্ডলের বায়ুস্তরগুলির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। বায়ুমণ্ডলের টারব্যুলেন্সের জন্য, বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে আসা অবলোহিত রশ্মির ফোটনের গতিপথ তাতে বিক্ষিপ্ত হবে এবং প্রতিবিম্বের বিকৃতি ঘটবে। বহু বহু দূরের স্যাজিটেরিয়াস-A[স্টার]-এর কেন্দ্রে খুব কাছাকাছি ঘুরতে থাকা একাধিক নক্ষত্রকে আলাদাভাবে রিজলভ করতে গেলে যে নিখুঁত প্রতিবিম্ব পাওয়া দরকার, তা পাওয়া যাবে না বায়ুমণ্ডলজনিত বিকৃতির জন্য। তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও, সুতরাং, হাতেকলমে মাঠে নামলে ভেস্তে যেতে পারে পুরো প্রকল্পটি।

প্রতিবিম্বের উৎকর্ষ বাড়াতে তাই প্রয়োজন হল দুটি উন্নতমানের পদ্ধতি— স্পেকল ইমেজিং (সত্তরের দশক থেকে ব্যবহারিক মহাকাশবিজ্ঞানে স্পেকল ইন্টারফেরোমেট্রির প্রয়োগ শুরু হয়) এবং অ্যাডাপ্টিভ অপটিক্সের (মহাকাশবিজ্ঞানী হোরেস ওয়েলকাম ব্যাবকক ১৯৫৩ সালে পাবলিকেশন অফ দ্য অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটি অফ দ্য প্যাসিফিক গবেষণা পত্রিকায় ‘দ্য পসিবিলিটি অফ কম্পেনসেটিং অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল সিইং’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে মহাকাশবিজ্ঞানে অ্যাডাপ্টিভ অপটিক্সের ব্যবহার সম্পর্কে প্রথম বিস্তারিত গবেষণার ফলাফল জানান)। ঘেজ ও তাঁর সহকারীরা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মনা কিয়া পর্বতচূড়ার সুবিশাল উইলিয়াম মায়রন কেক মানমন্দিরের একজোড়া দূরবীনে (কেক-I এবং কেক-II) এবং গেঞ্জেল ও তাঁর সহকর্মীরা ইউরোপিয়ান সাদার্ন অবজারভেটরির ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ (VLT)-এ অ্যাডাপটিভ অপটিক্সের সূক্ষ্ম সৌকর্য ব্যাবহার করলেন। একাধিক (সামান্য) বিকৃত প্রতিবিম্বর ছবি তুলে তাদের যথাযথ উপরিপাত ঘটিয়ে কক্ষপথে নক্ষত্রদের অতি নিখুঁত প্রতিবিম্ব পাওয়া গেল।

প্রায় পঁচিশ বছর একটানা পর্যবেক্ষণ চালিয়ে স্যাজিটেরিয়াস-A[স্টার]-এর কেন্দ্রের ঘূর্ণায়মান নক্ষত্রগুলির গতিপথের অনেকটাই নিখুঁত বিবরণ পাওয়া সম্ভব হয়েছে। বিশেষ একটি তারার, S2 (গেঞ্জেলদের দেওয়া নাম) বা SO2 (একই নক্ষত্র, ঘেজদের দেওয়া নাম), সম্পূর্ণ কক্ষপথ অবলোকন করা গেছে। আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রের চারিদিকে একবার ঘুরে আসতে নক্ষত্রটির সময় লাগে ষোলো বছর মতো। তুলনায়, সূর্য কুড়ি কোটি বছরে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের চারপাশে একবার ঘুরে আসে। এর থেকেই বোঝা যায় S2 নক্ষত্রের উপবৃত্তাকার কক্ষপথ কতটা ছোট, এবং যে অতিভারী বস্তুর অসম্ভব শক্তিশালী মহাকর্ষ বলের প্রভাবে S2 ঘুরছে, সেই বস্তু কক্ষপথের কোনও একটি ফোকাসে আছে ধরে নিলে, এটাও বোঝা যায় সেই বস্তু কতটা কম জায়গা জুড়ে আছে। হিসেব কষে দেখা গেছে বস্তুটি যে জায়গা জুড়ে আছে তার ব্যাস মাত্রই কয়েক আলোক-ঘন্টা বা তার থেকেও কম। মহাকর্ষীয় বল সৃষ্টি করে বস্তুর ভর।  S2-র কক্ষপথের উৎকেন্দ্রতা হিসাব করলে আন্দাজ করা যায়, যে বস্তুর প্রভাবে S2 উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে, মহাকায় সেই একক বস্তুটির ভর মোটামুটিভাবে সূর্যের ভরের ৪০ লক্ষ গুণ। এই পরিমাণ ভর মাত্র কয়েক আলোকঘন্টা ব্যাসের আয়তনে আবদ্ধ আছে মানেই সেটি অন্য কোনও সাধারণ মহাজাগতিক বস্তু হতে পারে না। অন্য কোনও জানা মহাজাগতিক বস্তুর এত বেশি ঘনত্ব থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং বস্তুটি কৃষ্ণগহ্বরই বটে।

এ ছাড়াও, যদি কেন্দ্রীয় অতিভারী বস্তুটির কোনও কঠিন খোলক থাকত বস্তুতল হিসেবে, তাহলে তার ওপরে আছড়ে পড়া চারিদিকের বস্তুকণা খোলকে ধাক্কা খেয়ে গতিহীন হয়ে প্রবল তাপ উৎপন্ন করত গতিশক্তির তাপশক্তিতে রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এবং আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে উৎসারিত হত শক্তিশালী অবলোহিত তরঙ্গের ধারা। বাস্তবে সেরকম কোনও অবলোহিত বিকিরণের চিহ্ন আজ অবধি পাওয়া যায়নি। ফলত কেন্দ্রীয় বস্তুটি যে কৃষ্ণগহর এবং তার যে ইভেন্ট হরাইজন আছে, কঠিন উপাদানে তৈরি শক্ত খোলক নয়, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহের্ অবকাশ নেই।

আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরের ভর এবং আয়তনের হিসাব ঘেজ এবং তাঁর সহকর্মীরা এবং গেঞ্জেল এবং তাঁর সহকর্মীরা আলাদা আলাদাভাবে যা পেয়েছেন, তার মধ্যে নিঁখুত সাযুজ্য রয়েছে। এর থেকে আবারও প্রমাণ হয় যে দুটি আলাদা আলাদা যন্ত্রসমষ্টি ব্যবহার করে একই ফল পাওয়া যাচ্ছে মানেই নিরীক্ষণের ফলাফল সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য।

দিনশেষের নায়ক— কৃষ্ণগহ্বর

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, যা নাকি বহুকাল ধরে পরিগণিত হয়ে এসেছে অ্যাবস্ট্র্যাকশন হিসেবে, বিশুদ্ধ গণিতের প্রয়োগ হিসেবেই মাত্র, যার অন্যতম প্রধান ভবিষ্যদ্বাণী কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি, যার নাকি এতদিন কদর ছিল কল্পবিজ্ঞান গল্পের চিত্তাকর্ষক বিষয় হিসেবেই, পেনরোজ, ঘেজ এবং গেঞ্জেলের (এবং সমসাময়িক আরও অনেকের) গবেষণা প্রমাণ করল তা অনস্বীকার্যভাবে বাস্তব। এবছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলের প্রধান চরিত্র, সুতরাং, যত না তিন বিজ্ঞানী, তার থেকেও বেশি একটি আপাত অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ধারণা— কৃষ্ণগহ্বর! এ বছরের নোবেল তাই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ— কল্পবিজ্ঞানের চরিত্রকে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানের বাস্তবতায় নামিয়ে আনার জন্য।

আশা করা যেতেই পারে, যে, কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি সরাসরি প্রমাণ করার কৃতিত্বের পুরস্কার হিসেবে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ টিমও অচিরেই নোবেল প্রাইজ পাবে।


ঋণস্বীকার

এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক শব্দের বাংলা পরিভাষা ব্যবহার করার সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাজারচলতি পরিভাষার বদলে নিজস্ব পরিভাষা বানিয়ে নেওয়া হয়েছে, এবং তার পাশে ইংরেজি শব্দগুলি বাংলা হরফে দেওয়া হয়েছে। বিদেশি নাম অথবা পদবী সর্বত্র বাংলা হরফে লেখা হয়েছে, অনেকক্ষেত্রে সেই নামের বা পদবীর প্রকৃত উচ্চারণের অডিও ফাইল ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁজে বার করে সেই উচ্চারণ অনুযায়ী বাংলা হরফ ব্যবহার করা হয়েছে। একই বানানের অনেক সময় একাধিক উচ্চারণ হয়, নেটিভ ইংলিশ স্পিকিং মানুষদের জন্য একরকম, নন ইংলিশ স্পিকিং মানুষদের জিভে আরেকরকম। যে শব্দের বাংলা লেখা হয়েছে, আগে দেখে নেওয়া হয়েছে সেই শব্দ আলোচ্য ক্ষেত্রে ও দেশের ভাষায় ব্যবহার হয়েছে, এবারে সেই ভাষার উচ্চারণপদ্ধতি ব্যবহার করে বাংলা হরফ চয়ন করা হয়েছে। যেমন অধ্যাপক Marteen Schmidt-এর পদবী লেখা হয়েছে শ্মিট কারণ উনি ডাচ, এবং ডাচ বা জার্মান Schmidt ওরকমই শোনায়। ইংরেজদের উচ্চারণে তা শোনাত স্মিড (যা অনেকটা স্মিথ-এর কাছাকাছি। উৎপত্তিগতভাবেও অবশ্য স্মিথ আর স্মিড বা শ্মিট্ একই অর্থবাহী, কারণ Schmidt এসেছে Schmied থেকে যার অর্থ কামার, স্মিথের অর্থও তাই)।

শ্রী প্রতীক তরফদার লেখাটির অনেকগুলি টাইপো সংশোধন করে দিয়েছেন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...