খাদ্য ও শান্তির পাচ্যতা: বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের নোবেলজয়

বিশ্বরূপ কোনার

 

লেখক সমাজকর্মী; অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক

সর্ষের মধ্যে ভূত যেমন, নোবেল শান্তি পুরস্কারের মধ্যে অশান্তিও তেমনই। বস্তুত নোবেলের পুরস্কাররাজির মধ্যে এই বিভাগটিকে নিয়ে অদ্যাবধি যত আপত্তি ও হাসাহাসি হয়েছে ততটা বোধ করি আর কোনও বিভাগ বা পুরস্কারকে নিয়েই হয়নি। এই পরিহাসপ্রবণতায় ঘৃতাহুতির সাম্প্রতিকতম কর্মটি করেছেন মায়ানমার-কর্ত্রী অং সান সু কি। ১৯৯১ সালের এই নোবেল শান্তি বিজয়িনীর নামে লেগেছে অগুনতি রোহিঙ্গা মুসলমান বিতাড়ন ও খুনের কলঙ্ক।

তবু, এই বিতর্কের ইতিহাসের দিকে তাকানোর দায় এই লেখার নেই। এই লেখায় বরং চেষ্টা থাকবে, এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপকের কাজকর্মের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নেবার, একটু বাজিয়ে দেখে নেবার।

রাষ্ট্রসংঘের অধীনস্থ ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম বা বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের উদ্দেশ্য নিরন্ন, বুভুক্ষু মানুষের জন্য অন্নের সংস্থান করা। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের শেষে এই প্রকল্প চালু রয়েছে ৮৮টি দেশে, এবং এর থেকে উপকৃত হয়েছেন প্রায় দশ কোটি মানুষ। এই প্রকল্পের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে লক্ষণীয় হল, এঁরা পড়ুয়া শিশুদের বিদ্যালয়-চলাকালীন প্রদেয় খাদ্যের সর্ববৃহৎ সরবরাহকারী।

অর্থাৎ, মোটের ওপর এঁরা বেশ একটা পুণ্যের কাজ করছেন এমন একটা ধারনা হওয়াই স্বাভাবিক। এই নোবেল-টোবেলের খোঁজ রাখেন এমন মানুষের মধ্যে অধিকাংশ এই ধারণাই লালন করে থাকেন। অনেকেই বলছেন, ট্রাম্পের নেতৃত্বে বহুপাক্ষিকতার এবং বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলির যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পকে নোবেলপ্রদানের মাধ্যমে সেই বহুপাক্ষিকতার হাতই শক্ত করা হল। সুতরাং কাজটা মোটের ওপর ভালই হল।

কিন্তু এই খাদ্য প্রকল্পের নোবেললাভ নিয়ে যথানিয়মে কিছু গোল বেধেছে।

প্রথম কথা হল, বিশ্ব খাদ্য প্রকল্প আদৌ শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন কি না। এ-ক্ষেত্রে বিষয়টা এঁদের যোগ্যতার নয়, এঁদের নোবেলদানের যাথার্থ্যের। মানে, এই ধরনের একটি সংস্থা কি আদৌ নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন? প্রশ্নটা এখানেই।

এই প্রশ্ন তুলেছেন, এবং নোবেল শান্তিকমিটির কাজকর্ম দেখে বহুদিন ধরেই তুলে আসছেন, এমন একজন হলেন ফ্রেডরিক হেফারমেল। সাহেব নরওয়ের আইনব্যবসায়ী, লেখক এবং সে-দেশের প্রাক্তন রাজকর্মচারী। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ‘লে ডাউন ইয়োর আর্মস’ নামে একটি সংস্থা পরিচালনা করে থাকেন। হেফারমেলের মতে— “বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের গুণাগুণ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু এটুকু বলতেই হচ্ছে যে, ‘মানবজাতির পক্ষে সর্বাপেক্ষা কল্যাণকর’— শান্তি পুরস্কার সম্বন্ধে নোবেলের এই ধারণার বিশালত্বের প্রতি নোবেল কমিটি যথাযথ সুবিচার করে উঠতে পারেননি।” এর মধ্যে মানবজাতির কল্যাণের কথাটি সাহেব নোবেলের ইচ্ছাপত্র থেকে উদ্ধৃত করেছেন। অ্যামেরিকার যুদ্ধবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট ডেভিড সোয়ানসনের বক্তব্যও অনেকটা এরকম। নোবেল শান্তি পুরস্কার পুনরায় শান্তির কথা ভুলে গেল— এমন একটি তির্যক মন্তব্য তিনি করে বসেছেন। এই দুজনের কেউই হয়ত আমাদের কাছে তেমন পরিচিত নন, তবু যে প্রশ্ন তাঁরা তুলেছেন তা মৌলিক। হেফারমেলের সংস্থা প্রতি বছর কিছু নামের তালিকা ও পছন্দের কারণ-সম্বলিত একটি নোট নোবেল কমিটিকে পাঠিয়ে থাকে। ২০২০-র তালিকা দীর্ঘ। চেনা নামের মধ্যে তাতে রয়েছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, চেলসি ম্যানিং ও এডওয়ার্ড স্নোডেনের নাম। নোবেল শান্তি পুরস্কারের অযথাযথতা নিয়ে একটি বইও লিখেছেন ফ্রেডরিক— ‘বিহাইন্ড দ্য মেডালস’— মেডেলের অন্তরালে। বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য হল— শান্তি নোবেলের কমিটি নোবেলের উইল নিয়ে কোনওকালেই বিশেষ চিন্তিত ছিলেন না। তাঁদের উদ্দেশ্য বরং ভূরাজনীতির বিবিধ মারপ্যাঁচকে বৈধতাদান করা।

এবার আসা যাক দ্বিতীয় কথায়। এই প্রশ্নটিও মৌলিক— খাদ্যসহায়তা কি শান্তির পথ আদৌ প্রশস্ত করে?

নোবেল কমিটির ঘোষণাপত্রে ক্ষুধা ও সংঘর্ষের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। কমিটি বলছেন, সংঘর্ষ জন্ম দেয় খাদ্যসঙ্কটের, আবার খাদ্যসঙ্কটের কারণে তৈরি হয় নতুন নতুন সংঘর্ষের ক্ষেত্র। অর্থাৎ খাদ্যের সঙ্কট ও লড়াইয়ের মধ্যে চক্রবৎ আবর্তিত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়।

প্রথম ছবিটা, অর্থাৎ সংঘর্ষজনিত খাদ্যসঙ্কটের ছবিটা আমাদের চেনা। বস্তুত পৃথিবীর যে-সমস্ত দেশ খাদ্যসঙ্কটের পীড়ায় অবসন্নপ্রায়, তাদের অধিকাংশই হিংসা ও দ্বন্দ্বে দীর্ণ। কিন্তু খাদ্যসঙ্কট থেকে যুদ্ধ বা দ্বন্দ্ব, এই তত্ত্ব যে নির্ভুল এমন কথা নির্দিষ্টভাবে বলা চলে না।

ক্ষুধা যদি বা হিংসার কারণ হয়ে থাকে, খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রদত্ত ত্রাণ কি শান্তিস্থাপনা সুনিশ্চিত করতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মত, সব সময়ে যে এমন হবেই তার কোনও কথা নেই। শুধু তাই নয়, এর ফলে কখনও কখনও হিতে বিপরীতও ঘটতে পারে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ত্রাণ স্থানীয় বাজারের এবং উৎপাদনকারীর ক্ষতি করতে পারে। বাজারের স্বাভাবিক মূল্যনির্ধারণ ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিতে পারে। দুর্ভিক্ষকে ব্যবসায়িক লাভের জন্য ব্যবহার করা হতে পারে, যেমন হয়েছিল জিম্বাবুয়ের ক্ষেত্রে, যখন ইউএসএড তাকে বাধ্য করে ৫০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্যের পরিবর্তে জিনগতভাবে পরিবর্তিত ভুট্টা কিনতে। হিংসাপীড়িত অঞ্চলগুলিতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যেতে পারে যে গোষ্ঠী হিংসার কারণ তারই হাতে, যেমন কিছুদিন আগে দেখা গেছে ইয়েমেনে। সুতরাং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে খুব ভরসাযোগ্য কিছু পাওয়া যাচ্ছে না।

হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে থাকা এই প্রশ্নরাজি ও তাদের উত্তরগুলির থেকে নজর সরিয়ে রাখা যাক এই বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেবকটির দিকে। পাঠক, আপনার অনুমান নির্ভুল! আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলছি। এই মহান দেশটির কথা এক ঝলক এসেছে আগের অনুচ্ছেদে— জিম্বাবুয়ে ও ইয়েমেনের প্রসঙ্গে। এবার সামান্য বিশদে বিষয়টি দেখা যাক।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন? এই বছরের দোসরা নভেম্বর তারিখের প্রকল্পদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রকল্পের মোট অনুদানের প্রায় ৪৩ শতাংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে। এই তারিখ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান ৩ বিলিয়ন ডলারের মত, দ্বিতীয় স্থানে থাকা জার্মানির তুলনায় যা তিন গুণেরও বেশি! খাদ্যত্রাণ নিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের ভাবনা ও কাজকর্মের দিকে একবার তাকানো যাক।

অ্যামেরিকার বর্তমান খাদ্যত্রাণের পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৫৪ সালে। উদ্দেশ্য ছিল উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের গতি করা, এবং সেই সঙ্গে জাহাজ কোম্পানিগুলির অবস্থা মজবুত করা। জাহাজ যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে মালপত্র পায় তা নিশ্চিত করার জন্য ত্রাণের অর্ধেক অ্যামেরিকান জাহাজ কোম্পানির মাধ্যমে আনা বাধ্যতামূলক করা হয়। এত বছর পরেও এই কৌশলের পরিবর্তন হয়নি। এই খাদ্যত্রাণের মূলে জোগান যতটা আছে, চাহিদা ততটা নেই। ২০০৩ সালে অ্যামেরিকা বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের আওতায় ইরাকে পাঠায় কিশমিশ, কারণ সে বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় আঙুরের ফলন হয়েছিল খুব। তেমনি ২০০৮ সালে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ার ফলে ত্রাণের অংশ হিসাবে ভুট্টার সরবরাহ অ্যামেরিকা কমিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত ত্রাণই বিশ্ব খাদ্য প্রকল্পের অধীনে। ২০১৩ সালের একটি গবেষণা-মোতাবেক অ্যামেরিকা থেকে খাদ্যশস্য না পাঠিয়ে পীড়িত দেশগুলি থেকেই যদি সেই খাদ্য কেনা যায়, তবে সঞ্চয় হতে পারে প্রায় ৫০ শতাংশ! এই যুক্তি-অনুযায়ী ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন এবং ক্যানাডা খাদ্যত্রাণের বদলে দুর্ভিক্ষ দূরীকরণে সহায়ক হতে পারে এমন প্রকল্পে অর্থসাহায্য করছে। কিন্তু খুল্লতাত স্যাম ও তাঁর মোসাহেবটি অর্থের বদলে খাদ্যই পাঠিয়ে যাবেন, ততদিন, যতদিন তা লাভজনক থাকে।

শেষ করার আগে এই লাভের একটি মনোরম চিত্র। ২০১৮ সালে অ্যামেরিকার কৃষিজাত পণ্যের এক্সপোর্টের পরিমাণ ছিল ১৪০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৯০ বিলিয়ন ডলারের গন্তব্য ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলি। কৃষিজাত পণ্য এক্সপোর্ট করে অ্যামেরিকার অতিরিক্ত লাভ হয় ২৬১ বিলিয়ন ডলারের মত। এই বিপুল লাভজনক ব্যবসা চালিয়ে যেতে গেলে তার খাদ্যত্রাণের প্রকল্পটি চাইই চাই। তাতে দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশগুলির ক্ষুধাতাড়িত মানুষ আখেরে যতই ক্ষতিগ্রস্ত হন না কেন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...