সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার পর কেমন আছে কাশ্মির

বরুণ দাসগুপ্ত

 


লেখক বরিষ্ঠ সাংবাদিক

 

 

 

৫ আগস্ট, ২০১৯, লোকসভায় দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন ঘোষণা করলেন যে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করা হল এবং কাশ্মিরকে দুভাগে ভাগ করে দুটি ইউনিয়ন টেরিটরি বানানো হল (একটি জম্মু সহ কাশ্মির ও অন্যটি লাদাখ) তখন লোকে খুব একটা আশ্চর্য হয়নি। কারণ ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার কথা বিজেপি বরাবরই বলে এসেছে। কাজেই সেটা যে তারা করবে তা মোটামুটি সকলেই ধরে নিয়েছিলেন। সন্দেহটা আরও দৃঢ় হয়েছিল যখন জানা গেল (৫ আগস্টের আগে) যে কাশ্মির উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়েছে এবং বিরোধী নেতাদের আটক করা হয়েছে ও হচ্ছে। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেল। কাশ্মিরের ভেতরে কী ঘটে চলেছে, সেখানকার পরিস্থিতি কী, তা জানাবার কোনও উপায়ই রইল না। শুধু সরকারি মাধ্যমের প্রচার— ‘কাশ্মির মেঁ সব ঠিক হ্যায়’।

এবারে একটু ভালো করে দেখা যাক, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের যুক্তি হিসেবে যা বলা হয়েছিল, আর কার্যত যা হয়েছে তাতে সে যুক্তি আদৌ ধোপে টেকে কিনা। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের অন্যতম যুক্তি ছিল যে এর ফলে কাশ্মিরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ কমবে, সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ কমবে। দুটোর কোনওটাই হয়নি। সন্ত্রাসী হামলা কমে তো নিই, বরং বেড়েছে। এবং, যেটা সবথেকে উদ্বেগের বিষয়, ক্রমশই বেশি সংখ্যায় স্থানীয় তরুণরা সন্ত্রাসবাদী খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। সাউথ-ইস্ট এশিয়া টেরোরিস্ট পোর্টাল বলছে, ২০২০-র মার্চ পর্যন্ত যে সন্ত্রাসবাদীদের হত্যা করা হয়েছে তাদের ৮৭.৫ শতাংশই স্থানীয় ছেলে। এদের অংশগ্রহণও বেড়েছে। কী হারে বেড়েছে?

বছর সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে ধৃত স্থানীয়দের শতাংশ
২০১৮ ৫৫%
২০১৯ ৭৯%
২০২০ ৮৭.৫%

 

এটা তো অঙ্কের হিসেব। কিন্তু এর আড়ালে একটা মানবিক হিসেবও তো আছে। যে পরিবারগুলির ঘর খালি করে এই ছেলেগুলি চলে গেল, তাদের কি ভারত রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বাড়বে? নিজেদের সন্তান হারানোর পর তারা কি নিজেদের ভারতীয় বলে ভাববে, ভাবতে পারবে? কাশ্মিরের মানুষদের সঙ্গে বাকি ভারতীয়দের আবেগের ঐক্য কি দৃঢ় হবে?

জীবনের পরেই যেটা আসে সেটা জীবিকা। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পরে কাশ্মিরে জীবিকার অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে? সেন্টার ফর দ্য মনিটরিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)র একটি সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কাশ্মিরে বেকারত্বের হার আগস্ট ২০২০-তে ২০ শতাংশ অতিক্রম করে। তার আগের ত্রিশ মাস এই বিলোপের ফলে কাশ্মিরের ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হয়েছে ১৭,৮৭৮.১৮ কোটি টাকার। ২০১৮-১৯-এ মোট ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৬,৬২৮ কোটি টাকা। এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা কাশ্মিরি সমাজের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পড়েছে। বহু পরিবারের জীবন তছনছ হয়ে গেছে।

পর্যটন বা টুরিজম কাশ্মিরের অন্যতম শিল্প। কাশ্মিরে বেড়াতে গেছেন কিন্তু ডাল হ্রদের শিকারায় চড়েননি এমন লোক পাওয়া বিরল। সেই পর্যটনশিল্পের কী অবস্থা আজ? কাশ্মির সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে পর্যটকদের সংখ্যা ছিল ১,৬৪,৩৯৫। ২০১৯ সালের আগস্টে (যখন ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত হল) সংখ্যাটা ছিল মাত্র ১০,১৩০। তার পরের মাসে, অর্থাৎ ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে পর্যটকদের সংখ্যা এসে দাঁড়াল একদম তলানিতে— মাত্র ৪,৫৬২। তবুও সংসদে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অম্লান বদনে বললেন, কাশ্মিরে এখন অবস্থা স্বাভাবিক, কোনও অশান্তি নেই। আর এদিকে ডাল হ্রদের শিকারা চালক পাড়ে তাঁর শিকারা লাগিয়ে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে— যদি কোনও টুরিস্ট আসেন।

কেমন আছে কাশ্মির? কোনও ঘোষিত কারফিউ না থাকলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যায়। বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে গৃহবাসীরা শোনেন রাস্তায় ভারী মিলিটারি বুটের আওয়াজ। আর তটস্থ থাকেন কখন নিরাপত্তাবাহিনীর লোকেরা তল্লাশির নামে ঘরে ঢুকে পড়ে সব ওলটপালট, সব তছনছ করে দেবে, আর যাওয়ার সময় হয়ত পরিবারের কোনও জোয়ান ছেলেকে ধরে নিয়ে যাবে। যার কোনও খোঁজ হয়ত আর কোনওদিনই পাওয়া যাবে না। পুলিশ বলবে, এই নামের কোনও লোককে আমরা গ্রেপ্তার করিনি, সে আমাদের হেফাজতে নেই। তাহলে সে ছেলেটা গেল কোথায়? কেউ জানে না। কেউ কোনও হদিশ দিতে পারে না।

কাশ্মির বছরে ২০ লক্ষ টন আপেল রপ্তানি করে। ‘করে’ মানে করত, যখন অবস্থা স্বাভাবিক ছিল। প্রায় সাত লক্ষ পরিবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপেল ব্যবসার উপর নির্ভরশীল। আর এখন? আমরা খবরের কাগজে ছবি দেখেছি, আপেলওয়ালারা ঠেলাভর্তি আপেল রাস্তার উপর উপুড় করে ফেলে দিয়ে চলে গেছেন। বাড়িতে রাখার জায়গা নেই। ক্রেতাও নেই। রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছেন। সেগুলি রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে। একটা আনুমানিক হিসেব হচ্ছে, প্রায় লাখ খানেক টন আপেল এখনও কোল্ড স্টোরেজে মজুত হয়ে আছে। যদি এগুলি শেষ পর্যন্ত বিক্রি না হয়, তাহলে এই মজুত করা আপেল সবই পচে নষ্ট হয়ে যাবে। তার ফলে আপেল যারা চাষ ও বিক্রি করেন, তাঁদের কী হবে? তাঁরা বাঁচবেন কী করে? নীরস সংখ্যাতত্ত্বের আড়ালে এই হিউম্যান ট্রাজেডির দিকটা প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়।

কাশ্মির বিখ্যাত তার আখরোটের জন্যও। কাশ্মিরে বছরে প্রায় ২৫ লক্ষ টন আখরোট উৎপন্ন হয়। এখন কী অবস্থা? আখরোট উৎপাদক ও বিক্রেতারা থলি ভর্তি শুকনো আখরোট নিয়ে বসে আছেন। খদ্দের নেই। বাজারে আখরোটের খুচরো দাম ৪৫০ টাকা (প্যাকেট)।

আঘাতটা এসেছে সর্বস্তরে, সব ধরনের মানুষের মধ্যে। বাকি ভারত এখনও অনুভব করতে পারেনি কাশ্মিরিদের বেদনা। কাশ্মিরকে বাকি ভারতের সঙ্গে একীভূত করার বা ইন্টিগ্রেশনের তাড়নায় আমরা যত বেশি করে কাশ্মিরের ভারতভুক্তিকরণকালীন দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলির একটা একটা করে লঙ্ঘন করেছি, মনের দিক থেকে কাশ্মিরিরা ততই আমাদের থেকে দূরে সরে গেছে। এখন কাশ্মির ভারত রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হয়ে আছে কারণ আমাদের সামরিক বাহিনী কাশ্মিরকে ধরে রেখে দিয়েছে। কাশ্মিরিদের চোখে এই সৈন্যবাহিনী হচ্ছে ভারতের দখলদার বাহিনী বা অকুপেশন ফোর্স।

কাশ্মিরে এখনও ৪-জি ইন্টারনেট সার্ভিস চালু নেই— মাত্র দু’টি জেলা বাদে। এই দুই ভাগ্যবান জেলা হল গন্ডেলওয়াল ও উধমপুর। তবুও সরকারি কর্তারা দাবি করেন, কাশ্মিরের অবস্থা স্বাভাবিক। কাশ্মিরের সব থেকে পুরনো ইংরিজি দৈনিক ‘কাশ্মির টাইমস’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ২০ অক্টোবর। রাজ্যের এস্টেট ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা গিয়ে দৈনিকটির অফিস সিল করে দেয়। পত্রিকার পরিচালকরা বলেছেন, সত্যি কথা বলার জন্যই আমাদের সঙ্গে এই রকম প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করা হল। পত্রিকাটির পথ চলা শুরু ১৯৫৪ সালে। আর দৈনিক হয় ১৯৬৪ সালে।

অবশ্য ‘কাশ্মির টাইমস’ বন্ধ হল মানে এটা নয় যে বাকি কাগজগুলি নির্ভয়ে এবং নির্ভীকভাবে কাজ করতে পারছেন। হুমকি-টুমকি, ভয় দেখানো চলছেই। প্রতিটি খবর ছাপবার আগে পত্রিকা পরিচালকদের দুরুদুরু বুকে ভাবতে হয়— এটা ছাপব কি ছাপব না। ছাপলে সরকারি কোপে পড়তে হবে না তো? জেলে যেতে হবে না তো? বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেবে না তো? কাজেই বোঝাই যাচ্ছে কাশ্মিরের অবস্থা ‘সম্পূর্ণ স্বাভাবিক’।

৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার আগেই জম্মু ও কাশ্মিরের তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ‘গ্রেপ্তার’ কথাটা বলা ঠিক হল কিনা জানি না। কারণ সরকারি কর্তারা ‘আটক’, ‘গ্রেপ্তার’ ইত্যাদি কথার নানা মারপ্যাঁচ কষে সত্যি কথাটা সোজাসুজি বলেন না। এই তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হলেন ফারুক আবদুল্লা, তাঁর পুত্র ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতি যার সঙ্গে বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে একযোগে সরকার চালিয়েছিল। তাঁরা ছাড়া অন্যান্য বিরোধী দল ও সংগঠনগুলির সব নেতাকেই ধরা হয়। তিন মুখ্যমন্ত্রীকে আপাতত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের চলাফেরা, কথাবার্তা সরকারের পছন্দ না হলে তাঁদের আবার জেলে ঢোকানো হবে তাতে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, থাকবে কি থাকবে না, সেটা নির্ভর করবে কেন্দ্রের শাসক দলের ওপর।

ইতিমধ্যে এই তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য বিরোধী নেতারা মিলে একটা একটা মঞ্চ তৈরি করেছেন যার নাম ‘পিপলস অ্যালায়েন্স ফর গুপকার ডেক্লারেশন’। এঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হল ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলোপ বাতিল করা এবং সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা। বিজেপি বলে দিয়েছে তারা এ-কাজ কিছুতেই করবে না। অতএব ৩৭০ ধারার সমর্থনে যদি ফের একটা গণ-আন্দোলন শুরু হয় তাহলে সেই আন্দোলন দমন করতে কেন্দ্রীয় সরকার যে বদ্ধপরিকর হবেন, তা বলাই বাহুল্য। ফলে, ফারুক, ওমর, মেহবুবা সহ অন্যান্য বিরোধী নেতাদের আবার জেলে যেতে হতে পারে। গেলে, কাশ্মিরের জনগণ সেটাকে নিঃশব্দে মেনে নেবেন না তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে তা আগেভাগে বলা মুশকিল। একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কাশ্মিরিদের মন-জয়ের লড়াইয়ে আমরা হেরে গেছি। এখনও যে কাশ্মিরিরা ভারতে আছেন তার কারণ তাঁদের ভারতে থাকাটা কেন্দ্রীয় সরকার ও তাদের নিরাপত্তা বাহিনী নিশ্চিত করেছে।

অথচ এমনটা হোক সেটা জওহরলাল নেহরু চাননি। ভারতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি ১৯৫২ সালের ২৬ জুন দ্বিধাহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন,

‘আমাদের সংবিধানের প্রতি সমস্ত সম্মান নিয়েই আমি বলছি যে সংবিধানে কী বলা হয়েছে আর হয়নি তাতে কিচ্ছু আসে যায় না, যদি কাশ্মিরের জনগণ এটা (মানে ভারতীয় সংবিধান) না চায়। তারা না চাইলে এই সংবিধান কাশ্মির যাবে না। কেননা এর বিকল্প হচ্ছে জবরদস্তি এবং জোর করে চাপানো। কাশ্মিরের জনগণ যদি না চায় তাহলে কি আমরা তাদের ওপর জোর-জবরদস্তি করে এই সংবিধান চাপিয়ে দেব? আপনারা ভাববেন না যে আপনারা উত্তরপ্রদেশ কি বিহার কি গুজরাটের একটা অংশ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এমন একটা জায়গা নিয়ে যার একটা ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও অন্যান্য বিষয়ে একটা নিজস্ব পটভূমি আছে।’

অর্থাৎ কাশ্মির যে ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যের মতো নয় সেটা নেহরু ভালো করেই জানতেন। সেটাই তিনি সংসদে তাঁর সতীর্থদের জানাতে চেয়েছিলেন। আজও কাশ্মির সমস্যার সমাধান করতে হলে তার নিজস্ব বৈশিষ্টগুলিকে স্বীকার করতে হবে। তাদের মর্যাদা দিতে হবে। জোর-জবরদস্তি করে তাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু ‘গ্লিম্পসেস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’র লেখকের ইতিহাস বোধ ও ইতিহাস চেতনা আমাদের আজকের শাসকদের নেই। কাজেই কাশ্মির সমস্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কীভাবে তার সমাধান হবে তা সবই অনিশ্চিত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...